গল্প ৫ । আশ্বিন ১৪৩২



ভিসিটের অদ্ভূত বন্ধুরা 











তরুণকুমার

সরখেল

পুরুলিয়া, পশ্চিম বঙ্গ



 

শীতের রাত। রাস্তা খুবই নির্জন। হিমের ভয়ে পলাশের ঝোপগুলো মাথা গুঁজে গুটিসুটি মেরে আছে। দোলগোবিন্দবাবু জোরে জোরে পা চালালেন। শীতের মরা পাতা জমে জমে রাস্তা ঢেকে ফেলেছে। মাঝে মাঝে চোরকাঁটা বিঁধছে। 

রাতের অন্ধকারে পথ চলতে তাঁর খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না। রাস্তা প্রায় মুখস্ত। রোজই দু-বেলা এ পথ দিয়ে যাতায়াত করেন তিনি, তাই কোন ঝোঁপটার পাশ দিয়ে বাঁক নিতে হবে তা আন্দাজ করে নিচ্ছেন

দ্রুত পা চালিয়ে যখন ঠিক মাঝপথে এসেছেন তখনই অভ্যাসমত হাতটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে দেশলাই হাতড়াতে শুরু করলেন দোলগোবিন্দবাবু দু-পকেটে খুঁজেও সেটা না পেয়ে বিড়িটা ছুড়ে দিলেন একটা ঝোপ লক্ষ‍্য করে

বিড়িটা যেখানে গিয়ে পড়ল সেখান থেকে একটা চাপা অথচ তীক্ষ্ম আর্তনাদ ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে ঝোপটা ভাস্বর হয়ে উঠল লাল আলোতে। নিমেষেই লাল আলো বদলে উজ্জ্বল সবুজ আলো ঠিকরে পড়ল। তবে আলোটা খুব দূরে ছড়াল না। বড় জোর পাঁচ মিটার ব্যাসার্ধ তৈরি করল। ঝোপটার অন্য প্রান্ত আগেকার মতই অন্ধকার। দোলগোবিন্দবাবু সেই চিৎকার আর অর্ধবৃত্তাকার উজ্জ্বল আলোর ঘেরাটোপে পড়ে চমকে উঠলেন। পা দুটো কখন যেন থেমে গেছে। সঙ্গে টর্চলাইটও নেই

তিনি এই আলোর রহস্য দেখে ভয় পেয়েছেন যথেষ্ট, তবে কৌতুহলও যে হচ্ছে না তা নয়। বিশেষ করে তার মনে হল, বিড়িটা যেন তিনি একটা ঢিলের মতো কারো উপরে ছুড়ে মেরেছেন। আর তার আঘাতেই এই আর্তনাদ

কিন্তু খুব বেশি ভাববার সময় পেলেন না তিনি দেখলেন সবুজ আলোটা দ্রুত সরে যাচ্ছে তার উৎসস্থানের দিকে, ঠিক যেমন ভাবে জল গড়িয়ে যায় সেভাবে। আলোটা একদম নিভে গেল না। ঐ মৃদু আলোয় তিনি দেখলেন এটা কোন ঝোপ নয়। হালকা নীল রঙের ধাতু বা ঐ ধরণের জিনিস দিয়ে তৈরি দুটো বড় ফুটবলের মতো কিছু। তবে নীচের বলটি অপেক্ষাকৃত ছোট। উপরের অংশে ধূপদানিতে রাখা ধূপের মত ছোট ছোট অ্যান্টেনাগুলো অনবরত একটি অপরটির সাথে স্পর্শ ঘটাচ্ছে। আর চিড় চিড় করে স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছে। সেই স্ফুলিঙ্গগুলো একসাথে জমা হয়ে একটা বড় অ্যান্টেনার মাথায় উঠে অনেকটা ফোয়ারার মত আলো ছড়াচ্ছে। সাথে সাথে উপরের ফুটবলটির গায়ের খুব ছোট জানালা থেকে পাতলা কাঁচের মত স্বচ্ছ কপাটগুলো কখনো দ্রুত কখনো আস্তে আন্দোলিত হচ্ছে। ফলে একটানা একটা অস্বস্তিকর এবং ভয়জাগানো সুর সৃষ্টি করছে

দোলগোবিন্দবাবু অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন সেই যন্ত্রটির দিকে। ভাবলেন এটা এখানে কী করে এলকেই বা আনল ?” চারদিকে সন্তর্পণে চোখ রাখলেন তিনি না, সবুজ আলো তার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। তিনি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না

চাদর মুড়ি দেওযার মত অন্ধকার ঢেকে দিয়েছে বাঁশবন। পকেটে দেশলাইটা থাকলেও জ্বালানো যেত। অন্ততঃ সঙ্গে একটা অস্ত্র আছে এই সাহসটা পেতেন। বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে। দশটা অনেকক্ষণ আগেই বেজে গেছে। এবার বাড়ি ফেরা দরকার। তিনি গলার মাফলারটা খুলে আবার জড়ালেন

দোলগোবিন্দবাবু বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছেন এমন সময় আবার সেই আর্তনাদ। তিনি ভয় আর কৌতূহলের মাঝে একটা মজাও পেলেন। পকেট হাতড়ে আরেকটা বিড়ি বের করে সেটা যেই ফুটবলটির উপর ছুড়তে যাবেন অমনি ওটা বিদ্যুৎ গতিতে একপাক খেয়ে ঠিক তার মাথার কাছাকাছি উঠে নিশ্চল হয়ে গেল। এই সময় জানালার পাল্লাগুলো দ্রুত কাঁপতে লাগল

ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল দোলগোবিন্দবাবুর। শীতের মধ্যেও তিনি বিন্দু বিন্দু ঘামতে লাগলেন। একসময় শক্তি হারিয়ে পা দুটো টলে গেল। মাটিতে বসে পড়লেন। আর অমনি ঠিক তার মুখোমুখি যন্ত্রটা নেমে এসে একেবারে নিশ্চল হয়ে গেল। শুধু অ্যান্টেনার মাথায় আলোটা ভাস্বর হয়ে থাকল। আর তাতেই তিনি যন্ত্রটাকে লক্ষ্য রাখতে পারলেন। এখনো ভয়ে তাঁর বুক কাঁপছে

     যন্ত্রটা কি খুব ভারী? তার মাথায় ওটা ধাক্কাও তো মারতে পারত। ওঃ তাহলে মাথাটা বোধহয় ছাতু হয়ে যেত। কেন যে এসব ঘটছে মাথায় কিছুই ঢুকছে না তাঁর

আরো দু-এক মিনিট এমনিভাবে কেটে যাওয়ার পর তিনি খুব ক্ষীণ একটা শব্দ শুনতে পেলেন। আরো ভালো করে শব্দটা শোনার জন্য মাফলার খুলে ফেললেন। দেখলেন ফুটবলের মত যন্ত্রের গায়ে জানলার কাছে একফুটের মত লম্বা একটি অদ্ভূত প্রাণীর মুখ দেখা যাচ্ছে। যন্ত্রটির ভেতরে আলো জ্বলে উঠতেই প্রাণীটির পুরো অংশ দেখা গেল

“ কোলরেভো নইসিভ রাডোরোব.... লেসেসেভ সোডোথিম মেসিলান টেসনেস....

দোলগোবিন্দবাবু কান খাড়া করে এই ধরণের উচ্চারণ শুনে যেতে লাগলেন। তবে তার মাথায় কিছুই ঢুকল না। তিনি এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন অদ্ভূত খুদে জীবটির দিকে

এরাটিন এনিউট সিয়েন্ট......

মনে হচ্ছে শব্দটা আসছে অনেক দূর থেকে। অল্প পরেই সমস্ত শব্দ থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরে দোলগোবিন্দবাবুর মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠল। মনে হল তিনি হালকা ইলেকট্রিকের শক্ খেলেন। কিন্তু আবার কয়েক সেকেন্ড পরেই তিনি সুস্থ বোধ করলেন

দুঃখিত দোলগোবিন্দবাবু, ভয় পাবেন না। আমরা ভিসিটের অতিথি। এসেছি কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে।

বড় বড় চোখ মেলে দেখলেন দোলগোবিন্দবাবু সেই ক্ষুদে প্রাণিটি কখন নেমে এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। তিনি ভাবলেনতাজ্জব ব্যাপার, এরা আমার নাম জানলো কী করে ? ”

ক্ষুদে প্রাণিটি বললআমার নাম সিংভিট।... আমি ও আমার বন্ধুরা এই কয়েক মিনিট আগে আপনাদের গ্রহে এসেছি।... আর হ্যাঁ, আপনার মগজে যত রকম তথ্য আছে সেসব জানতে এই একটু আগে আপনাকে রেডিয়েট করে নিলাম।... তাতেই জানলাম আপনার নাম, আপনাদের ভাষা সহ আপনাদের দেশের নতুন করে মুদ্রিত দুই হাজার টাকার নোটের কথাও।... মায় আজ আপনি টাকা পয়সার হিসেবে একটু ভুল করেছেন সে তথ্যও আমরা পেয়ে গেলাম।...দয়া করে ভয় পাবেন না।... আপনার কোন ক্ষতি হবে না। আপনি আমাদের বন্ধু ভাবতে পারেন।...

পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণে ঠিক দোলগোবিন্দবাবুর কায়দায় বলে গেল ক্ষুদে প্রাণিটি দোলগোবিন্দবাবু অনেকটা ধাতস্থ হয়ে বললেনআপনারা তাহলে আমার মগজ ধোলাই ইয়ে মানে মগজ চুরি করলেন বলুন।

তাঁর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির আভাস দেখা গেল। তিনি সাহস করে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলেন সিংভিট-এর দিকে

সিংভিট বললআপনি তো স্কুলে অঙ্কে কাঁচা ছিলেন, তাই না ?”

দোলগোবিন্দবাবু বললেনসে আর বলতে। তবে বাংলায় ভালো ছিলাম তা নিশ্চয়ই মগজ ঘেঁটে বুঝলেন।

এই জায়গাটার নাম পলাশবনী, তাই তো নামটা কী আপনিই দিয়েছেন, সিংভিট জানতে চাইল

হ্যাঁ, এই পলাশবনীর মাঠ আমার বড় প্রিয় জায়গা , দোলগোবিন্দবাবু বেশ আবেগ নিয়ে উত্তর দিলেন। তিনি কথা চালিয়েই যেতে লাগলেন আসলে সারাদিন ব্যবসা নিয়ে থাকি। অবসর বলে কিছু নেই। এই পলাশ গাছে ঢাকা মাঠটা আমার বড় নিজের বলে মনে হয়। বসন্তকালে যখন পলাশ ফুটে লাল হয়ে যায় তখন এর রূপই আলাদা হয়। আর ঐ যে দেখছেন দূরে, ওগুলো হল বাঁশগাছ।

সিংভিট বললবাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ....।

পদ্যটি বলেতে গিয়ে সে থেমে গেল। দোলগোবিন্দবাবুকে জিজ্ঞেস করলচাঁদ হল গিয়ে আপনাদের একমাত্র উপগ্রহ সেটা বুঝলাম। কিন্তু চরকা কাটা বুড়িটা কে বলুন তো ?”

দোলগোবিন্দবাবু উত্তর দিলেনআরে মশাই ঐ উপগ্রহের ভেতরই তো বুড়ির বাসা... ইয়ে মানে ঘর। বুড়ি নাকি চরকা কাটে। তবে মশাই এই বুড়ির গল্পটা আমি ঠাকুরমার কাছে শুনেছিলাম মগজের এক কোণে গল্পটা কতকাল জমা ছিল। নিলেন তো চুরি করে ?”

সিংভিট বললদুঃখ করবেন না। আমাদের ধারণা ছিল এই বিশ্বমণ্ডলের আর কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নেই। আপনাদের হিসেবে বহু বছর ধরে অনুসন্ধান করে চলেছি আমরা। ছুটে গেছি গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। কোথাও খুঁজে পাইনি প্রাণের চিহ্ন। শেষে একজন প্রবীণ বিজ্ঞানীর নির্দেশে আমরা  মিসিট নামের একটি গ্রহের সন্ধানে বেরিয়েছি। জানি না সেখানে প্রাণ আছে কী না। তবে আজ এই পলাশবনীর মাঠে আপনার সাক্ষাৎ না পেলে পৃথিবী সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারতাম না। জানতাম না ইতিমধ্যেই আপনারা ঈশ্বরকণা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। এই তথ্যটাও কিন্তু আপনার মগজ ঘেঁটেই আমরা পেলাম।

ঐ খবরের কাগজ ঘেঁটে যেটুকু জানা এই আর কি দোলগোবিন্দবাবু বললেন

অবশ্য আমাদের যান আপনাদের পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করতেই বুঝে ফেলে এখানে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। পরে আমরা এখানের সবুজ গাছগাছালি থেকেও অনেক রকম সংকেত পাই.... যা আপনারা ধরতে পারেন না।...

না, তা পাই না। মানে গাছ তো আর কথা বলতে পারে না, আমতা আমতা করলেন দোলগোবিন্দবাবু

কোলরেভো নইসিভ রাডোরোব.... আবার যেন অনেক দূর থেকে কথাগুলো  ভেসে আসছে এরকম মনে হতে লাগল। দোলগোবিন্দুবাবু তবু শুনতে পেলেন প্রাণীটি বলছেঅনেক অনেক ধন্যবাদ দোলগোবিন্দবাবু, আমাদের এত দিনের অনুসন্ধান আজ সার্থক হল। আর এজন্য আপনাকে কখনই ভুলবে না আমাদের গ্রহ ভিসিটের ভাসরা। ভাস হল আমাদের বিজ্ঞানীদের নাম। আজ আপনার কাছ থেকে যে সব তথ্য পেলাম তা নিয়ে আমরা পাড়ি দেব নিজের দেশে। হয়ত আমাদের আবার আসতে হতে পারে এই পৃথিবীতে....

বলতে বলতে সিংভিট ক্ষুদে জানালা দিয়ে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ল। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই অদৃশ্য হয়ে গেল। ভিসিটের অদ্ভূত বন্ধুরা দোলগোবিন্দবাবু ফাঁকা মাঠে আকাশ পানে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন।