গল্প । আষাঢ় ১৪৩২



পাখির বাসা











শুকদেব চট্টোপাধ্যায় 
রহড়া, পশ্চিমবঙ্গ

 

ঈশানের দাদুর ঘরের দক্ষিণ দিকে একটা ছোট্ট বারান্দা আছে। বারান্দার ঠিক সামনেই আছে একটা বড় বেলগাছ। ওই গাছে সারাদিন নানা রকমের পাখি এসে বসে, কিচির মিচির করে। ঈশান মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে পাখি দেখে। সুন্দর দেখতে  কোন পাখি এলে দাদুকে  ডেকে এনে পাখিটার নাম জিজ্ঞেস করে। 

তারপর বোন আর  ভাইকেও এনে দেখায়। ঈশানই বাড়ির বড় ছেলে। এই কদিন আগে ওর ছয় বছরের জন্মদিন গেল। বোন জোহানা ওর থেকে দু  বছরের ছোট আর ছোট ভাই সৌভিকের বয়স আড়াই  বছর।  সৌভিক ভীষণ দুরন্ত, সারা বাড়ি চৈ চৈ করে ছুটে বেড়ায়। জোহানা খুব ঠান্ডা মেয়ে। 

বারান্দার মাথায় ঠিক মাঝখানে আলো লাগাবার জন্য খানিকটা তার বার করা আছে। আলো লাগেনি তাই পাকানো তারটা অনেকদিন ধরে ওই ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে

একদিন দাদু ঈশানকে ডেকে দূর থেকে দেখাল— ভূতো, ঐ দেখ বারান্দায় কি সুন্দর ছোট্ট একটা  পাখি।  

ও বলা হয়নি। তিন নাতি নাতনির জন্যে দাদুর নিজের দেওয়া আলাদা নাম আছে। ভূতো, ভূতনি আর ভূতুন। 

দাদু ওটা কি পাখি? –ঈশান জিজ্ঞেস করে

মৌটুসি। মনে হয় ওখানে বাসা করবে। 

-- বাঃ, কি মজা কি মজা।  

দাদুর অনুমান সত্যি হল। 

দু এক দিনের মধ্যেই মা পাখি আর বাবা পাখিতে মিলে ইলেকট্রিকের ওই কুন্ডুলি পাকানো তারটাকে জড়িয়ে ঘাস, কাঠি, আরো কত কিছু মুখে করে এনে এনে বাসা তৈরি করতে শুরু করল। বাবা পাখিটা নীল রঙের আর মা পাখিটার গা ধূসর রঙের আর পেট হলুদ। সারা দিন বাসা বুনে যাচ্ছে, কোন ক্লান্তি নেই। ঈশান আর জোহানা প্রায়ই দূর থেকে চুপটি করে দেখে। পাখিরা ভয়  পেয়ে যাবে বলে দাদু কাছে যেতে বারণ করেছে। শৌভিকের অত ধৈর্য নেই। এক আধবার দাদা দিদিদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওদের আদর খায়, আবার সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় সারা বাড়িতে  চক্কর লাগাতে

দিন পনেরর মধ্যে বাসা তৈরি। প্রায় দেড় ফুট মত লম্বা, ওপর নিচে সরু আর মাঝখানটা গোল বলের মত

ঈশান বাসাটা ভাল মত দেখার পর দাদুকে জিজ্ঞেস করে— দাদু পাখিরা মাঝখানে ওই গোল যায়গাটাতে একটা গর্ত রেখেছে কেন

-- ওটা ওদের বাড়ির দরজা। ওইখান দিয়েই বাসার মধ্যে ঢুকবে বেরবে। ভেতরে গিয়ে ডিম পাড়বে, ডিমে তা দেবে। তারপর ডিম ফুটে ছানা হলে তাদের খাওয়াবে। 

-- দাদু তা দেওয়া কি?  

-- ডিমের ওপর পাখিটা মাঝে মাঝে গিয়ে বসবে। ওদের শরীরের গরমে ডিমের ভেতর বাচ্চাটা ধীরে ধীরে বড় হবে। তারপর একদিন ডিমের খোলাটা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসবে। ডিমের ওপর  এই বসাটাকে তা দেওয়া বলে। 

একদিন ঈশান দাদুর কোলে উঠে পাখির  বাসার ফুটোটার সামনে চোখ রেখে ভেতরে তাকিয়ে দেখে দুটো ছোট ছোট ডিম। জোহানাও দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। এর মধ্যে সৌভিকও এসে দাদুর কোলে ওঠার জন্য হাত বাড়িয়েছে। যদি টান মারে এই ভয়ে ওর দর্শনটা একটু দূর থেকেই হল

একদিন পাখি দুটো অনেকক্ষণ টানা ডাকছিল। ওদের ডাক শুনে দাদু বারান্দার কাছে গিয়ে দেখেওরা বারান্দার গ্রিলের একধারে বসে আর্তনাদ করছে। দুটো চড়াই ওদের তাড়িয়ে বাসাটার দখল নিতে চাইছে। চড়াই অতটুকু একটা পাখি সেও সুযোগ বুঝে তার থেকে আর একটু ছোট মৌটুসির ওপর জোর  ফলাচ্ছে। চড়াই দুটোকে তাড়িয়ে দিতে মৌটুসিরা আবার ঘরে ফিরে এল। 

উদ্বিগ্ন নাতির দিকে তাকিয়ে দাদু বলল— প্রকৃতির এটাই নিয়ম রে ভূতো। যার জোর তারই সব। তার মধ্যে কায়দা করে যারা নিজেদের  সামলাতে পারে তারাই পৃথিবীতে টিকে থাকে।   

স্কুলে থাকার সময়টুকু বাদ দিয়ে ঈশান সারাদিন কেবল পাখির বাসার কাছে ঘুর ঘুর করে। লক্ষ  করে মা পাখিটা মাঝে মাঝেই বাসার মধ্যে ঢুকে কেবল ঠোঁটটুকু বাইরে বার করে চুপটি করে বসে আছে। ও বুঝতে পারে যে পাখিটা তা দিচ্ছে। একদিন ওর কানে আসে কিচ কিচ শব্দ। দাদুকে  ডেকে এনে শোনায়। দাদু বলে যে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে এসেছে, ওটা ওদেরই ডাক। এরপর পাখি দুটো ঠোঁটে করে নানারকম খাবার এনে সারাদিন বাচ্চা দুটোকে খাওয়ায়। ওরা এলেই বাচ্চারা ঠিক বুঝতে পারে। ছোট মুখদুটো হাঁ করে বাইরে বার করে আর মা বাবা অল্প অল্প করে তাতে খাবার ঢুকিয়ে দেয়। একদিন কাউকে না জানিয়ে ঈশান একটা চেয়ারে উঠে খুব কাছ থেকে বাচ্চা দুটোকে দেখেছে। কি সুন্দর দেখতে। এইভাবে আস্তে আস্তে ছানাগুলো বেড়ে উঠল। দু একদিন হল একটা ছানা মাঝে মাঝে বাসার দরজাটার ওপর এসে বসছে। ঈশানের ভয় লাগে, যদি পড়ে যায়।  

একদিন দাদুর সাথে ঈশান বাসাটার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এমন সময় মনে হয় সেই ছানাটাই বাসা থেকে বেরবার মুখটায় এসে বসল। বাইরের সুন্দর জগতটাকে দেখার পর হয়ত ভেতরের অন্ধকার কোটর ওর আর ভাল লাগছে না। কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ ছানাটা বাসা থেকে বেরিয়ে বারান্দার গ্রিলে গিয়ে বসল। ওইটুকু উড়তেই ও পড়ে যাচ্ছিল। ওখান থেকে উড়ে গিয়ে যেই বেলগাছটায় বসতে যাবে, একটা কাকা এসে ছোঁ মেরে ওকে ধরে নিয়ে চলে গেল। 

ঈশান হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করল।  

দাদু সান্ত্বনা দিয়ে বলল— কাঁদিস না ভূতো। প্রকৃতিতে সব কিছুর জন্যই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। ওই সময়টুকু না দিলেই বিপদ। ছানাটার ডানা এখনো ওড়ার মত শক্ত হয়নি। আরো কিছুটা সময়ের দরকার ছিল।  বাইরের রং বেরং এর জিনিস দেখে, লোভ সামলাতে না পেরেআগেই বেরিয়ে এসে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনল। 

কিছুদিন বাদে দ্বিতীয় ছানাটাও ফুড়ুক করে উড়ে চলে গেল। ওকে কিন্তু  কেঊ ধরতে পারল না। 

- ও পুরো সময় বাসায় থেকে ডানা শক্ত করে বেরিয়েছে। ওকে আর কেউ কিছু করতে পারবে না। তাই না দাদু

দাদুর স্নেহের পরশে ভূতো পেয়ে গেল তার সব উত্তর।