সেনাপতি রায় কাচাগ ভাবতেও পারেননি যে থানাংচি দুর্গ জয় করা তো দূরের কথা, দুর্গকে ঘিরে রাখা বড় বড় পাহাড়গুলো ডিঙানোই দুঃসাধ্য হবে তাদের পক্ষে। পাহাড়ি অঞ্চলে জন্ম, বেড়ে ওঠা, নিয়মিত পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই ভাঙা যাদের অভ্যেস, তারা কিছুতেই দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছুতে পারছে না, দুর্গের উপর থেকে কড়া নজর রাখছে কুকিরা। এগোতে গেলেই কুকিদের বর্শা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় তাদের। ত্রিপুরার সৈন্যরা ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। মাসের পর মাস এখানে ত্রিপুরার সৈন্যরা ঘাঁটি গেঁড়ে বসে রয়েছে।
সেই কবে রাঙ্গামাটি থেকে রওনা হয়েছিল ত্রিপুরার রাজা ধন্য মানিক্যের এক হাজার সৈন্য। থানাংচি পৌঁছাতেও লেগে গেল বেশ কয়েকদিন। ত্রিপুরার পাহাড়ি এই পথ বড়ই দুর্গম। কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বা নৌকায় চড়ে, কখনও হাতির পিঠে, কখনও বা ঘোড়ায় চড়ে বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়েছে তারা। কুকি সম্প্রদায়ের মানুষেরা কেন যে সাদা হাতিটি মহারাজকে দিতে সম্মত হল না, কিংবা বিরোধিতা করার এত সাহস তাদের হলই বা কি করে, তা বুঝে উঠতে পারছেন না রায় কাচাগ।
অথচ মহারাজ চেষ্টা করেছিলেন সামান্য একটি হাতির জন্য একটা যুদ্ধ যাতে এড়ানো যায়। মহারাজের হাতি বড় প্রিয়। রাজধানী রাঙ্গামাটিতে ধন্য মানিক্যের হাতিশালে আছে দাঁতাল হাতি, রয়েছে কুনকি হাতি। অবশ্য মহারাজের ঘোড়াশালেও বিস্তর ঘোড়া। টগবগে সব ঘোড়া।
ত্রিপুরার মহারাজাদের বড় প্রিয় শখ হাতি শিকার। তার উপর সাদা হাতিকে অনেকে মনে করতেন পবিত্রতার প্রতীক, অনেকে একে ক্ষমতার মানদণ্ড হিসেবেও বিবেচনা করত একে। এখনকার থাইল্যান্ড, যার নাম ছিল শ্যাম দেশ, সেখানে প্রচুর সাদা হাতি পাওয়া যেত। এই হাতিটা কোথা থেকে এসেছিল রায় কাচাগ জানেন না৷
খবরটা পেয়েই নড়েচড়ে বসেছিলেন মহারাজা ধন্য মানিক্য। ত্রিপুরার উত্তরপূর্ব প্রান্তে থানাংচিতে সাদা হাতিটিকে নাকি আটকে রেখেছে কুকিরা। হেড়ম্ব রাজাও কুকিদের কাছে এই হাতিটি দাবি করেছিলেন। কুকিরা রাজি হয়নি। হেড়ম্ব রাজাও সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্গ অধিকার করতে পারেননি। তাই ত্রিপুরার সৈন্যরাও ব্যর্থ হবে, এটাই কুকিরা ভেবেছে।
তবে এই দুর্গ এতটা দুর্ভেদ্য হবে ভাবতে পারেননি রায় কাচাগ। একের পর এক যুদ্ধ জয় করেছে এতদিন তারা। মেহেরকুল, পাটিকারা, গঙ্গামন্ডল, শ্রীহট্ট জেলার বহু জেলার বহু প্রদেশ জয় করা হয়েছে। কুকিদের মতো দুঃসাহস দেখিয়েছিল খন্ডলবাসীরাও।
ত্রিপুরেশ্বরের লস্করকে ধরে গৌড়ের রাজার আদেশে হাতির পায়ের নিচে মেরে ফেলল তারা। পরিণাম কিন্তু সবারই জানা। খন্ডলের সর্দারদের হত্যা করে ওই অঞ্চল দখল করল ত্রিপুরার সৈন্যদল। সেই লড়াইও কম রোমহর্ষক ছিল না।
সেনা ছাউনি থেকে বেরিয়ে রায় কাচাগ এই পর্বতের দিকে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। সন্ধ্যা নামছে, গাঢ় হচ্ছে অন্ধকার। আজ রায় কাচাগের মন ভালো নেই। ছয়মাস সুদীর্ঘ সময়। মজুদ রসদের ভাঁড়ারে টান পড়েছে। আশেপাশে জঙ্গল থেকে বন্য পশু শিকার করে এতদিন খাওয়া দাওয়া হলেও এখন দূরে গভীর জঙ্গলে শিকারের খোঁজে যেতে হচ্ছে সৈন্যদের।
আর কতদিন এভাবে চলবে? থানাংচিতে সদর দরজা পাহারা দিচ্ছে জনা ত্রিশেক কুকি সৈন্য। কুকি সৈন্যরা হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। দুর্গের উপর থেকে তারা নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে। পা দিয়ে লাথি দেখায়, গালিগালাজ করে, টিটকিরি দেয়। রাগে কাঁপতে-কাঁপতে রায় কাচাগ কখনও নিজের সেনাদের প্রতি রাগ দেখান, বলেন, “সব কাপুরুষ, সব কাপুরুষ। একটা দুর্গ জয় করা যাচ্ছে না এত মাস হয়ে গেল! মহারাজাকে কি উত্তর দেব...?”
রাগে তিনি সেনা ছাউনির চালা ফেলে দিলেন, যাতে বৃষ্টি ভিজে ঘুমিয়ে না পড়ে সেনারা। দিন-রাত যুদ্ধ চলতে থাকে। কিন্তু দুর্গ দখল করা যাচ্ছে না কিছুতেই।
রায় কাচাগ কখনও বিমর্ষ হন। কিন্তু তিনি আশা ছাড়বেন না কিছুতেই।
রাঙ্গামাটিতে তখন আশার প্রহর গুণছেন মহারাজা ধন্য মানিক্য। তার বিশ্বাস, রায় কাচাগ পারবেই পারবে। রাজ পুরোহিতের সেই কথা এখনও তার কানে বাজছে, “মহারাজা যতক্ষণ রায় কাচাগ আর রায় কছম আছেন, আপনার কোনও চিন্তা নেই। এই রিয়াং সেনাপতিরা যেমন পরিশ্রমী, তেমনি বিশ্বাসযোগ্য।”
গোমতী নদীর তীরে এখন হাঁটছেন মহারাজ ধন্য মানিক্য। রাঙ্গামাটির এই রাজধানীকে তিলে তিলে সাজিয়ে তুলছেন তিনি। সেই কবে লিকা জনজাতিদের হারিয়ে তাঁর পূর্বপুরুষরা রাঙ্গামাটি জয় করেছিলেন! তারপর গোমতী নদী দিয়ে কত জল বয়ে গেল।
তাঁর জীবনটাই অদ্ভুত। এই রাজ সিংহাসনকে ঘিরে কত লড়াই, কত যে ষড়যন্ত্র।
সেনাপতিরা বলিয়ান হয়ে ত্রিপুরার মহারাজাদের ভাগ্যের নির্ণায়ক হয়ে উঠছিলেন বারবার। পিতার মৃত্যুর পর তাকে বঞ্চিত করে ছোট ভাই প্রতাপ মাণিক্যকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন সেই দশ সেনাপতি। তারাই আবার প্রতাপ মাণিক্যকে এক রাতে গুপ্ত হত্যা করেছিলেন।
রাজ পুরোহিতের কথা, ধাত্রী-মায়ের কথা মনে পড়ছে মহারাজার এখন।
ধন্যমানিক্যের জীবন সংশয় আঁচ করতে পেরে রাজপুরোহিত সবার চোখে ধুলো দিয়ে রাজবাড়ি থেকে সরিয়ে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। সেকথা একমাত্র জানতেন ধাত্রী-মা। তিনি বলেছিলেন, “রাজকুমার ভয় নেই। রাজপুরোহিতের বাড়িতে অজ্ঞাতবাসে থাকবে তুমি। ভৃত্যবেশে থাকবে, বাইরের মানুষ আন্দাজও করতে পারবে না যে তুমি রাজপুত্র। প্রাণ থাকতে এ কথা কেউ জানবে না।”
কিন্তু সেনাপতিরা এবার নিজেরাই সিংহাসনে বসার লোভে লড়াই শুরু করলেন। এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরী হল।
প্রধান সেনাপতি দৈত্য নারায়ণ পরিস্থিতির সামাল দিতে ধন্য মানিক্যকে রাজা করা ছাড়া আর কোনও পথ খুঁজে পেলেন না। ধন্য মানিক্যের খোঁজে ধাত্রীমায়ের বাড়ি গেলে এত সৈন্য দেখে ঘাবড়ে গেলেন তিনি। ভয়ে তাঁর বুক কাঁপছিল। এরা পারে না এমন কোনও কাজ নেই। প্রতাপের পর কী এবার ধন্যের পালা?
অঝোরে জল ঝরতে লাগল তাঁর দু’চোখ থেকে। দৈত্য নারায়ণ ও সেনাপতিদের প্রশ্নের মুখে কুলুপ সেঁটে রইলেন তিনি।
দৈত্য নারায়ণ বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরে বললেন, “বিশ্বাস করো, রাজ্যের পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ। এ অবস্থায় ধন্য মানিক্যই রাজা হিসেবে এ রাজ্যকে রক্ষা করতে পারবে।
ওরা কী সত্যি বলছে? নাকি রাজকুমারকে হত্যা করতে নতুন কৌশল, তা বুঝতে পারছিলেন না ধাত্রীমা। তিনি তখন বললেন, “প্রধান সেনাপতি মহোদয়, শালগ্রাম শিলা ছুঁয়ে বলুনতো সত্যি বলছেন কিনা?”
দৈত্য নারায়ণ শালগ্রাম শিলা ছুঁয়ে শপথ নেওয়ার পর ধাত্রীমা ধন্যমাণিক্যের সুলুক সন্ধান দিলেন।
ধন্যমাণিক্যের সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে পড়ছে। ভয়ে তিনি বাঁশের মাচার নিচে লুকিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে নাবালক ধন্যমাণিক্যকে বের করে আনলে তিনি বলেছিলেন, “আমি রাজা হতে চাই না। রাজপুরোহিতের ঘরে ভৃত্যের মতো দু’মুঠো খেয়ে থাকব। আমাকে রেহাই দিন।”
রাজপুরোহিত তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন সেদিন, বলেছিলেন, “রাজকুমার আপনার কোনও ভয় নেই।”
ধন্যমাণিক্য ত্রিপুরার রাজ-সিংহাসনে আসীন হলেন। সেনাপতি দৈত্য নারায়ণ তার কন্যা কমলা মহাদেবীকে মহারাণী করতে সমর্থ হলেন।
কিন্তু দশ সেনাপতিদের দাপট ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠল ধন্য মানিক্যের কাছে। তিনি যেন কাঠের পুতুল। দশ জন সেনাপতি মিলে রাজ্য চালাতে চাইছেন। ক্ষমতা তাঁদের হাতে কেন্দ্রীভূত।
প্রধান সেনাপতি দৈত্য নারায়ণও যেন তাঁদের সামনে অসহায়। ক্রমশ এই রাজমুকুট তাঁর কাছে কাঁটার মুকুট হয়ে দাঁড়াল। রাজার আর মন বসে না কোনও কাজে।
মহারাণী কমলা মহাদেবীও মহারাজার মনের যন্ত্রণা বুঝতে পারেন না। কিন্তু রাজপুরোহিত আন্দাজ করতে পারেন সব। তিনি বুদ্ধি দিলেন, “মহারাজা আপনি অসুস্থ হবার ভান ধরে মাস তিনেকের জন্য অন্তঃপুরে ঠাঁই নিন, আর সেই সুযোগে গোপনে মল্ল-বিদ্যা শিখুন।”
সেই পরামর্শ মেনে রাজাও অসুস্থতার দোহাই দিয়ে অন্তঃপুরে আশ্রয় নিলেন। সেখানে রাজপুরোহিত ছাড়া এবং তাঁর অতিবিশ্বস্ত ব্যক্তিরা ছাড়া কারওর প্রবেশের অধিকার ছিল না।
সবাই জানল রাজা গুরুতর অসুস্থ। দৈত্য নারায়ণও চিন্তাগ্রস্ত হলেন।
শেষ পর্যন্ত মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, “মহারাজের কি অসুখ হল যে কারও সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎকার বন্ধ? কেমন আছেন মহারাজা?”
“বাবা আমিও যেতে পারি না কাছে। ছোঁয়াচে রোগ কিনা তাও জানি না।
দেখিও না বহুদিন। শুধু একদিন দূর থেকে দেখেছি। আবছা অন্ধকারে মনে হলো শরীরটা একটু ফুলে গেছে।”
আসলে মল্লবিদ্যা চর্চা করতে-করতে মহারাজা ধন্যমানিক্যের শারীরিক গঠন পেশীবহুল হয়েছে ততদিনে। দূর থেকে মহারাণী তা বুঝতে পারেননি। দৈত্য নারায়ণ ভাবলেন মহারাজার পাণ্ডুর রোগ হয়েছে।
এসব খবর জেনে রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলেন সেনাপতিরা। দেখা করার অনুমতিও মিলল। রাজপুরোহিত দেখলেন এটাই সুবর্ণ সুযোগ। দশ সেনাপতিকে একসঙ্গে কাবু করতে গেলে এই সুযোগকে হারানো কিছুতেই চলবে না।
রাজা অসুস্থ। নিরস্ত্র অবস্থায় সেনাপতিরা দেখতে গেলেন। রাজপুরোহিত তাঁর বাছাই করা বিশ্বস্ত সৈনিকদের প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বেরিয়ে যাবার সময় যখন অভিবাদন করছিলেন সেনাপতিরা, তখনই ঝাঁপিয়ে পরে তাঁদের হত্যা করল রাজ পুরোহিতের বাছাই করা সেনারা।
এরপরই রাজা অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে এলেন। কর্মঠ, প্রাণচঞ্চল মহারাজাকে চাক্ষুস করল প্রজারা। তখনই সেনাপতি নিযুক্ত হলেন রায় কাচাগ ও সেনাপতি রায় কদম। সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও রাজ আনুগত্যের কারণে দ্রুত মহারাজার বিশ্বস্ত হয়ে উঠলেন সেনাপতি রায় কাচাগ। তার সৈন্যদল ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল। কিন্তু একটি ক্ষুদ্র জনজাতিগোষ্ঠীর সামনে তাঁর সৈন্যদল থমকে রয়েছে এতটা সময় ধরে, তা বিশ্বাস করতেও যেন কষ্ট হয় মহারাজা ধন্য মানিক্যের। মহারাজা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তাঁর বিশ্বস্ত সেনারা খানিকটা দূরে সতর্কভাবে পাহারা দিচ্ছেন। মহারাজার বিশ্বাস এখনও অটুট। রায় কাচাগ সফল হবেই। তাঁর কানে এখনও স্পষ্ট বাজছে সেনাপতি রায় কাচাগের কণ্ঠস্বর, “মহারাজা থানাংচি দুর্গ জয় করে এই শ্বেত হস্তি আপনাকে ভেট দেব, এই প্রতিজ্ঞা করলাম।”
দেখতে দেখতে আরো দু’মাস পেরিয়ে গেল। সেনাপতি রায় কাচাগ প্রতিদিনই দূরের পাহাড় আর দুর্গের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। মাসের পর মাস এভাবে ঘাপটি মেরে বসেছিল হেড়ম্ব রাজার সৈন্যরাও। তারাও ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে গেল।
কিন্তু রায় কাচাগ এর শেষ দেখে তবেই ছাড়বেন। তখন বিকেলের আলো মরে আসছিল। ঠিক এমন সময় সরসর করে একটা শব্দ শোনা গেল। পাহাড়ের ঢালে কোনও একটি প্রাণীর নড়াচড়ার শব্দ সেটি।
জঙ্গলে অনেক সাপ খুব বিষাক্ত সাপ তো আছেই, আছে ইয়া বড় বড় অজগর। সেই অজগর এক নিমেষে শিকারকে পেঁচিয়ে হাড়গোড় গুঁড়ো করে গিলে ফেলতে পারে। রায় কাচাগ সতর্কভাবে তাকালেন, দেখলেন, তার অনুমান ঠিক নয়। এটি এক বড় মাপের গোসাপ। কালো রঙের গোসাপটির চ্যাপ্টা লেজটিও বেশ বড়, বড়-বড় নখ। এত বড় গোসাপ কখনও দেখেননি তিনি।
লম্বায় সেটি প্রায় আট হাত, প্রস্থে তিন হাত। এত বড় গোসাপ কল্পনার বাইরে। এমন বীর যোদ্ধাও এই গোসাপ দেখে যেন হকচকিয়ে গেলেন।
কিন্তু রায় কাচাগ তো আর সাধারণ মানুষ নন। এই বয়সে এমন বীরত্ব, এমন বুদ্ধি ও প্রত্যুৎপন্নমতির জন্য তার নাম-যশ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রমে তিনি মহারাজ ধন্য মানিক্যের অন্যতম নির্ভরযোগ্য সেনাপতি হয়ে উঠেছেন।
এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে রায় কাচাগ তার সৈন্যদের ডাকলেন, বললেন, যত দ্রুত সম্ভব জঙ্গল থেকে বেত সংগ্রহ করতে।
যুদ্ধ করতে এসে বেতের কী প্রয়োজন ভেবে অবাক হয়ে গেলেন সৈন্যরা। কিন্তু রায় কাচাগকে ফিরিয়ে প্রশ্ন করবে এমন দুঃসাহস সেনাবাহিনীতে কারও নেই।
ত্রিপুরার জঙ্গলে বেতের অভাব নেই। বেত জোগাড় করে ক্রমে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করতে লাগলো সৈন্যরা “বেতগুলি একটার সঙ্গে একটা বেঁধে ফেলো,” গম্ভীরভাবে বললেন রায় কাচাগ। কয়েকজন সৈনিককে আদেশ দিলেন একে ধরতে। কিন্তু গো সাপ ধরা কী চাট্টিখানি কথা?
বড়সড় প্রাণীটি ভয় পেয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল। জঙ্গলপথে সৈন্যদের সঙ্গে এই যেন লুকোচুরি খেলা! গো সাপ ধরতে গিয়ে কেউ পিছলে পড়ে গেল পাহাড়ি ঝর্নায়, কেউ বা হোঁচট খেয়ে পড়ে চিৎপটাং হয়ে রইল। বহু সৈন্যের হাত পা ছড়ে গেল, বহু সৈন্য মাটিতে গড়াগড়ি খেল। সে এক অসহনীয় পরিস্থিতি!
অবশেষে গো সাপ ধরা পড়ল। বেতের এক প্রান্ত তার শরীরে বেঁধে একে ধাওয়া দিল সকলে মিলে। ছাড়া পেয়ে ভয়ে দ্রুত পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল সে। শেষ পর্যন্ত দুর্গের উপরে উঠে কোথাও লুকিয়ে পড়ল সেই গোসাপ। বেতটিও আটকে গেল দুর্গের কোথাও। সেই বেতের শেষ প্রান্ত ধরে টানাটানি করে ত্রিপুরার সৈন্যরা দেখল যে সেটি দৃঢ়ভাবে আটকে গেছে দুর্গের কোনও খাঁজে।
কুকি সৈন্যরা টের পেল না কিছুই। রাত গভীর হল। দুর্গের মধ্যে কুকি সেনারা তখন আনন্দে মশগুল। বেত আঁকড়ে ধরে বেয়ে বেয়ে দুর্গের শীর্ষে পৌঁছাতে লাগল ত্রিপুরার সৈন্যদল।
সাবধানতা সত্বেও সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র দুর্গের গায়ে ঘষা খেয়ে আওয়াজ হল।
একবার, দু’বার আওয়াজ পেয়েও কুকি সৈন্যরা গায়ে লাগানো না। কিন্তু পরপর কয়েকবার এমনটা হতেই এক কুকি সেনা ভুরু কুঁচকে বলল, “কোনও কিছুর আওয়াজ হচ্ছে বাইরে!”
বাকিরা গায়ে মাখলো না, একজন বলল, “ও কিছু নয়, গরু-মহিষ দুর্গের দেওয়ালে শিং ঘঁষছে।”
ক্রমশ রাত গভীর হল। ক্লান্ত কুকি সেনাদের চোখে ঘুম। তখন অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল রায় কাচাগের নেতৃত্বে ত্রিপুরার সেনারা।
কুকি সেনারা কোনও প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময় পেল না। তার আগেই নিমেষে কচুকাটা হয়ে গেল তারা। থানাংচি দুর্গ দখল করল রায় কাচাগের নেতৃত্বে ত্রিপুরার সেনারা।
অবশেষে সেই সাদা হাতির নাগাল পেল ত্রিপুরার সৈন্যদল। সেই সাদা হাতি নিয়ে সেনাপতি রায় কাচাগের নেতৃত্বে সেনারা ফিরে চলল রাঙ্গামাটি। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মুহুর্মুহু ধ্বনিত হতে লাগল, “জয় মহারাজ ধন্য মানিক্যের জয়, জয় সেনাপতি রায় কাচাগের জয়।”
(রাজমালার কাহিনী অবলম্বনে)