গল্প ৪ । আশ্বিন ১৪৩২



দোস্তজী














অভিজ্ঞান দাস

পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ


 

আজকের গল্পটি কোনো ঝাঁ চকচকে এলিট ক্লাসের নয়, আজকের গল্পটা ফ্লাইওভার লাল হলুদ সবুজ বাতির সিগন্যাল, যানজটে নাজেহাল কোনো মেট্রো শহরের নয়, গল্পের সূত্রপাত শহর ছাড়িয়ে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরের সবুজে মোড়া - শহর নয় গ্রাম ঝিনুকখালি। এক কথায় মফঃস্বল কেন্দ্রিক।

ঝিনুকখালি উচ্চতর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পাঠরত শিবু ওরফে শিবশঙ্কর পাণিগ্রাহী ঠাকুমার দেওয়া এই নাম নিয়ে বরাবরই অভিযোগ তার ক্লাসের আর পাঁচটা আবির, অরিত্র, সৌমাল্যর পাশে শিবশঙ্কর নাকি বড্ড বেমানান  নামকরণের পিছনে অবশ্য একটা গল্প আছে  প্রথম দুজন নাতনির পর নাতির মুখ দেখতে ঔৎসুক, তিনি পাড়ার দেড়শো বছরের পুরোনো বটতলার শিবমন্দিরে জল ঢালতেন ফি সোমবার  ঘটনাক্রমে শিবরাত্রির দিন জন্ম নি আদরের আহ্লাদের শিবশঙ্কর, ছোট করেশিবু

অত্যন্ত নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার, মা-বাবা দুই দিদি  ঠাকুমাকে নিয়ে এক কামরার ঘরে বেশ মানিয়ে থাকে শিবু। ঠাকুরদা গত হয়েছেন শিবুর জন্মের আগেই দিনযাপনের লড়াইয়ে অভাবী টিউশন মাস্টার বাবার নিত্যদিনের সঙ্গী শিবুর মামা বাড়ি থেকে যৌতুক হিসেবে পাওয়া ছাব্বিশ ইঞ্চির হিরো সাইকেল সময়ের সঙ্গে আজ ওতেও মরচে ধরেছে সকাল থেকে রাত প্যাডেলের ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজে এপার থেকে ওপাড়া টিউশনি করে যেটুকু আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় বাবাকে

শিবুর দুই দিদি ছোট থেকে মেধাবী, মুখচোরা স্বভাবের প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে পা রাখেনা বললেই চলে অন্যদিকে বাড়ির কনিষ্ঠতম একমাত্র ছেলেটা ঠিক উল্টো দুরন্ত দামাল ছেলে বাড়িতে থাকেন খুবই কম স্কুল থেকে ফিরে আসার পর বই ব্যাগটা যে কোথায় গিয়ে পড়ে তার ইয়ত্তা থাকে না কোনোরকমে গোগ্রাসে দুটো ভাত খেয়ে ছুটে যায় খেলার মাঠে  সবদিনের মতো এদিনও ছুটে যায় সে  মাঠের মাঝে কাশফুলের দোলন, বাড়ির ছোট্ট বাগানে শিউলির কার্পেট, দিগন্ত জুঁই ছুঁই নীলাকাশ সবমিলিয়ে সময়টা শরৎকাল  মাস অশ্বিন দুর্গাপুজো আর বেশি দূরে নয়। মাত্র কয়েকটা দিন

এদিন খেলার শেষে শিবু-পল্টন-গণেশ-রবিন'রা ফুটবলটা মাঝে রেখে গোলটেবিল বৈঠকে বসে শুরু হয় পুজোতে ঠাকুর দেখা অষ্টমীর অঞ্জলিতে পাড়ার পুজোয় একসাথে অঞ্জলি দেওয়া, রোল চাউমিন ফুচকার দোকানে ভিড় জমানোর প্ল্যানিং। সবচাইতে বেশি উৎসাহ দেখায় শিবুর কাছের বন্ধু পল্টন, পল্টন মুর্মু  সেদিনের বৈঠক শেষে সিদ্ধান্ত হয় অষ্টমীর সকালে, ঘড়িতে ঠিক 'টায় পাড়ার মোড়ের তরুণ সংঘের প্যান্ডেলে পুজোর নতুন জামা পরে আসবে সবাই এতক্ষণ এক অদ্ভুত বাঁধনহারা আনন্দ উৎসাহ ধরা পড়ছিল পল্টনের মুখে নিমেষেই তাতে যেন ভাটা পড়ে কোনো এক অজুহাত দেখিয়ে সেদিনের মতো সবার আগে বাড়ির দিকে দৌড় দেয় সে দুরন্ত দামাল অবাধ্য শিবুর চোখ এড়িয়ে যায়নি বিষয়টা পল্টনের চোখের কোনায় আসা জল ভালো ভাবেই লক্ষ্য করে বছর তেরোর সুহৃদ শিবু সেদিনের মতো রাত কেটে যায় কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও যেন একটা খচখচানি থেকে গেল শিবুর  ঠিক পরের দিন ইস্কুলের পুকুরঘাটে একা বসে থাকতে দেখে মনমরা প্রিয় বন্ধুকে শিবুর চোখ যে ভুল দেখেনি তা আরো নিশ্চিত হলো বন্ধুর মুষড়ে পড়ার কারণটা বোধহয় সে আন্দাজ করতে পারে

প্রতিবছর পুজোর আগে দুই দিদি শিবুর জন্য একখানা করে নতুন জামা আসে বাড়িতে কথা প্রসঙ্গে এবার দুটো চেয়ে বসে শিবু মা অনেক বোঝালেন। অভাবের সংসারের কথা, পারিবারিক টানাপোড়নের কথা, তিনি এও বোঝালেন শিবুকে এনে দিলে তার দুই দিদিকেও এনে দিতে হবে, তখন কতটা টান পড়বে বাবার পকেটে  কিন্তু শিবু এবার নাছোড়বান্দা  শিবুর মা কথাটা তোলেন বাবার কানে বাবাও ছেলের আবদারে মুখের ওপর না বলতে পারলেন না  দেখছি বলে আশ্বাস দিলেন তারপর বেশ কিছুদিন পেরিয়ে যায়  নিয়ে বাড়িতে আর কথা তোলেনা শিবুবুঝতে পারে সবটা বাবার কষ্টকরে সঞ্চয়ের কথা। মনে মনে ভেবে নেয় নতুন আরেকটি জামার জন্য যা করার সে নিজেই করবে একদিন বিকেলে বাড়ির লোকের আড়ালে, ধুলো ঝেড়ে চুপিচুপি বিক্রি করে দেয় পুরোনো ক্লাসের বেশ কয়েকটি বই খাতা কিছু টাকা জোগাড় হয় কিন্তু মোটামুটি ভালো জামা কিনতে যে এই টাকা যথেষ্ট নয় তা জানতো শিবু ইস্কুল থেকে ফেরার পথে বুড়ো শিবতলার 'মা মহামায়া বস্তুালয়এর বাইরে ঝুলতে থাকা লাল টুকটুকে একখানা জামা পছন্দ হয়েছে তার নাহ্ নিজের জন্যে নয়, কল্পনায় বন্ধু পল্টনের গা'য়ে খুব মানানসই লেগেছে। কিন্তু দাম যে বেশ কিছুটা বেশি। কেবল বই, খাতা বিক্রির টাকায় তা কেনা সম্ভব নয়

 

দেখতে দেখতে পুজো এগিয়ে আসে আকাশ বাতাস মুখরিত হয় পুজোর গন্ধে, চারিদিকে সাজো সাজো রব মনমরা পল্টন আর বন্ধুর মুখে হাসি ফোটানোর চিন্তায় চিন্তিত শিবু এই পরিবেশে, উৎসবে আনন্দে ঠিক যায় না বড়ই বেমানান

সেদিন রাত্তিরে টিউশনি করে বাড়ি ফেরার সময় বাবা হাতে নিয়ে ঢুকলেন, ‘মা মহামায়া বস্ত্রালয়’-এর একটি চটের থলে। দুই মেয়ে গুণধর ছেলের হাতে মা তুলে দিলেন পুজোর বকশিস একটি করে নতুন জামা খুশিতে আত্মহারা কিশোর শিবু ছুট দিল নতুন জামার ট্রায়াল দিতে

নতুন বই, নতুন জামা, সোঁদা মাটির গন্ধ বরাবরই মাতাল করে শিবুকে নতুন জামা গায়ে চাপিয়ে আয়নার সামনে যেতেই ভেসে ওঠে বন্ধু পল্টনের মুখ চোখ থেকে গাল বেয়ে নেমে আসে জল এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় সময়। শিবুর বুকের ভেতর এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা  খাঁ খাঁ করে ওঠে চারপাশটা গায়ে কাঁটা দেয় পারবে তো বন্ধুর মুখে হাসি ফোটাতেশঙ্কা হয় শিবুর আনমনা মনে

 

পরদিন ইস্কুল থেকে ফেরার পথে তিনকড়ি কাকুর ফাস্টফুডের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় সে লজ্জা জড়িত ভয় নিয়ে কাকুকে বলেই ফেলে কিছুটা টাকার বিনিময়ে এঁটো বাসন-কোসন মেজে দেওয়ার কথা শর্ত থাকে বাবাকে জানানো চলবে না  কাকু প্রথমে রাজি হননি  হাতে-পায়ে পড়ার পর রাজি হন তিনি  কথা হয় দৈনিক পঞ্চাশ টাকা বিনিময়ের সেদিন থেকে বেশ কয়েকদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে দেরি হয় শিবুর মা জিজ্ঞেস করাতে এক্সট্রা ক্লাসের অজুহাত দেয় কিছুদিন এভাবেই চলতে থাকে নতুন জামার টাকা জোগাড় করে ফেলে শিবুর অপটু দু'হাত

এদিকে ঢাকের বাদ্যি পড়েছে  ঢ্যাং কুরাকুর আওয়াজে মাতোয়ারা ঝিনুক খালি পাড়ার অলিতে গলিতে যেখানে শিক্ষার নিয়ন আলো পৌঁছায়নি, সেগুলিও আজ সেজে উঠেছে মধ্যবিত্তের টুনি বাল্বে

পঞ্চমীর বিকেলে অবশেষে বন্ধুর জন্য সাধের লাল জামাটি কিনে ফেলে শিবু বন্ধু পল্টনের অভাবের ঘর দিন আনে দিন খায় ওরা  পল্টনের বাবার প্যাডেল দেওয়া রিকশা, একালের অটো টোটোর ভিড়ে তা আজ ফিকে রিক্সার চেইনে জং ধরেছে, জং ধরেছে পল্টনের বাড়ির আয়ে  সেই বন্ধুর মুখের হাসি দেখার জনোই এতো প্রয়াস প্রচেষ্ঠা

ষষ্টীর দিন পুজোর সকাল স্কুলে ছুটি পড়বে ছুটির পর সাইকেল-স্টান্ডে পল্টনের অপেক্ষাই করছিল শিবু পল্টনের হাতে একটা কাগজের প্যাকেট ধরিয়ে বলে, ‘এই নে পল্টু আমার দুটো বই আছে তুই পড়তে চেয়েছিলিস এখানে খোলার দরকার নেই বাড়িতে গিয়ে দেখিস কেমনপল্টু, 'ঠিক আছে বলে সম্মতি জানায়

বাড়িতে ফিরে পল্টন দেখে প্যাকেটের ভিতর যে বই নয় জামা সাথে একটি চিরকুট ওতে লেখা অষ্টমীর সকাল ঠিক টায় নতুন জামা পরে বেরিয়ে আসবি পল্টু একটা লম্বা হাইফেন দিয়ে নীচে লেখা শিবু  ফের একবার চোখে জল এলো তার, আনন্দের পাড়ার অলিতে গলিতে খুশি অন্যদিকে, শিবুর বাবা জানতে পারেন ছেলের বাসন মেজে টাকা নেওয়ার কথা প্রথমে বকাবকি করেন, পরক্ষণে যখন জানতে পারেন সবটা, গর্বে বুকে টেনে নেন ছোট্ট শিবুকে বিকেলে খেলার মাঠে শিবু-পলটু একে অপরকে কাছে টেনে নেয় জড়িয়ে ধরে বুকে কাঁদতে থাকে

হিসাব মতো আসে অষ্টমীর সকাল ঘড়িতে ঠিক 'টা পাড়ার মোড়ে তরুণ সংঘের প্যান্ডেলের সামনে নতুন জামায় শিবু-পল্টন-সইলেশ-রবিনেরা অঞ্জলির শেষ ফুল অর্পণ করে মায়ের কাছে পল্টনের আর্জি, ‘ঠাকুর ভালো রেখো আমার বন্ধুকে, ভালো রেখো শিবুকে‘