সকাল থেকেই অর্চির দুষ্টুমি বেড়েই চলেছে। আজ রবিবার স্কুল ছুটি, তাই পড়াশোনার কোনোরকম বালাই নেই তার। সকালে এক্টু সরগম আর তাহান প্র্যাকটিস করেই মার বকাঝকায় কোনোরকমে নাকেমুখে দুটো গুঁজেই সে বেরিয়ে পরে পাড়া চড়তে।
অর্চির সবথেকে পছন্দের
লালদীঘির পাড়ে সে চলে আসে,
এইসময় শাম্ব, অরিত্র সবাই চলে আসে কিন্তু
এখনও কেউ কোথাও নেই দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। সে কি অনেকটা আগেই চলে এসেছে! যাকগে, অর্চি পাড় বেয়ে বেরিয়ে থাকা গাছের শিকর ধরে ধরে কোনোভাবে
নেমে এলো প্রায় ঝুলতে থাকা বটগাছটার গোড়াটায়, চারিদিক শুনশান মৃদুমন্দ
হাওয়ায় হাল্কা সবজে জলের মৃদু ঢেউকে দেখতে থাকে, ছলাত ছলাত ঢেউ
টাকে ভীষণ ভালো থাকে ওর। সে পা দুটো ঝুলিয়ে বসলো, এখনও জল ওর
থেকে খানিকটা নিচে কিন্তু ঢেউয়ের স্নিগ্ধ স্পর্শ তার পা দুটোকে ছুঁয়ে যেন তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে তুমি এখানে একা নও। দূরে অন্যপারে
কোন জেলে তার জালটাকে ঝুপ করে ফেললো সেদিকে তাকিয়ে অর্চির মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল।
অর্চির বরাবরই এই জায়গাটা প্রিয়, সে পারলে প্রতিদিনই আসে
কিন্তু স্কুলের চাপে তো আজকের দিনটা ছাড়া আর আসাই হয়না। গাছের স্নিগ্ধ ছায়ায় তার
ভীষণ ঘুম ঘুম পেল,সে জলের দিকে তাকিয়ে রইল ফ্যাল ফ্যাল করে। হটাত জলের মধ্যে
কিছু একটা নড়ে উঠলো, অর্চি মনে হল কোন বড় মাছ বুঝি তার ঠিক পায়ের কাছে চলে
এসেছে। আবার কুণ্ডলী পাকিয়ে জলটা ছলকে উঠলো, অর্চি মাথাটা খানিক ঝুঁকিয়ে
পরে বোঝার চেষ্টা করল- মাছই মনে হচ্ছে। হটাত রঙ্গিন একটা লেজ বেশ খানিকটা ওপরে
জেগে উঠে ছপাত শব্দে আবার জলটাকে ঘূর্ণি পাকিয়ে তলায় ঢুকে গেল, অর্চির মুখে সেই জলের ছিটে এসে পুরো মুখটাকেই খানিকটা
ভিজিয়ে দিলো। অর্চির ঘুম ঘুম ভাবটা জলের ছিটে পড়ায় কেটে গেলো, ওর এবার মনে হল এখান থেকে লেজটা ধরতে পারলেই কেল্লা
ফতেহ।অরিত্র কয়েকদিন আগেই বলেছিল ওর বাবা নাকি এই দীঘিতেই একটা পেল্লাই কাতলা মাছ
ধরেছিল গত বর্ষায়, আজ ও নিজে ওদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই রঙ্গিন পেল্লাই
মাছটা ধরবেই। জেদটা চেপে জেতেই আবার মাছটা ছলকে উঠলো, লেজটা আরেক্টু ওপরে, অর্চি তাকেতাকেই ছিল, তড়িৎ গতিতে হাতটা বাড়িয়ে লেজটা ধরতেই মাছটার হ্যাঁচকা টানে
হুরমুর করে সে জলেই গেলো পরে। সে এখন ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে কিন্তু হাতটা শক্ত করে
লেজেই ধরা আছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাছটা প্রবল শক্তিতে ওকে নিচের দিকে টেনে জলের
গভীরে নিয়ে জেতে লাগলো, অর্চির যখন সম্বিত ফিরে এলো তখন সে প্রথমটায় প্রবল অস্বস্তি
অনুভব করল কিন্তু একবারও নাকে মুখে জল ঢুকে যাওয়ায় দম আটকে আসার
মত কোন বিষয় অর্চির সাথে হলোনা, বুকের ধুকপুকুনি খানিক
কমতেই সে আরও অবাক হল কারন জলের গভীরেও সে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে আর যেই লেজটা ও
শক্ত করে ধরে আছে সে দেখলো সেটা কোন মাছ নয় তবে শরীরের অর্ধেকটা মাছের মত আর সেটা
বিশালাকায় সাতরঙা রঙ্গিন। শরীরের সামনের অংশটা অনেকটা মানুষের মতই,অর্চির আবার ভয় করতে লাগলো, সে চিৎকার করে কেঁদে
উঠলো কিন্তু সেই কান্নার কোন আওয়াজ সে নিজেই শুনতে পাচ্ছেনা! সে আরও খেয়াল করল তার
মুখ দিয়ে কোনরকম জলও ঢুকছে না, এই ভয়ার্ত অনুভুতিতেও সে
অবাক হচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে। ঠাম্মার কাছে আরও ছোটবেলাতেই ভূত, পরীর সাথে সাথে শুনেছিলো লাল দীঘির সব বিচিত্র বিচিত্র গল্প,তার মধ্যে ছিল মৎস্যকন্যার গল্পও। তাহলে কি যাকে সে শুধু
মাছ ভেবে ভুল করেছিল সে কি তবে মৎস্যকন্যা!
আরও অনেকটা গভীরে এসে মাছটা, না না মৎস্যকন্যাটি ডাইনে ঘুরে গেলো, এদিকটায় জলের তোড় বেশ কম, অর্চি মুখ
ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো চারিদিকে রঙ্গিন অজানা সব জলের গাছ আর শ্যাওলায় ভর্তি, লাল লাল পাথরের ফাঁক বেয়ে উঁকি দিচ্ছে ক্যাকটাসের মত কোন
গাছ তাতে হাল্কা ফুলের মত সামনের দিকে, এরকম গাছ সে তার
প্রিন্সিপাল স্যারের টেবিলের দুদিকে সাজানো দেখেছে। একটা বেশ বড় মাছ ঠিক ওর গা
ঘেঁষেই বেরিয়ে গেলো, কি ঠাণ্ডা ওর গা টা। অর্চি হটাত ভাবল সে অনেকক্ষণ জলে
থাকলেও তার তো ঠাণ্ডা লাগছেনা এই শীতে তার তো গরম জল ছাড়া মোটেই স্নান করা হয়না
অল্পেই ঠাণ্ডা লাগে। এখন ভয়টা কেটে গেছে, বেশ কিছু রঙ্গিন ছোট বড়
মাছের দল ঠিক অনেকটা পম্ফ্রেট মাছের মত ঘুরে ফিরে যেন ওকেই দেখছে, অর্চি একটা হাত দিয়ে কয়েকটাকে ছুঁয়ে দেখল। তার মনে হল
মাছগুলো যেন ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে, বেশ মজা লাগতে শুরু হল
ডানপিটে অর্চির। একটা হ্যালোজেন লাইটের মত হাল্কা জোরালো আলো যেন একটা কোণ ঠিকরে
বেরিয়ে আসছে, অর্চি বুঝতে পারে ওরা ওদিকেই যাচ্ছে। একটা বড় পাথরের সামনে
ওরা এসে দাঁড়ালো, একটা বড় গুহার মত জায়গাটা। অর্চি দেখল গুহাটার ভেতর থেকেই
লাইটটা বেরোচ্ছে, নীল সবজে আলোটায় জায়গাটা ‘মাশা অ্যান্ড
দা বিয়ারে’ দেখা রুপকথার দেশের মত লাগছে। সে একটা চ্যাপ্টা পাথরের ওপর
দাড়িয়ে অভিভুত হয়ে চারদিক দেখতে লাগলো,মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ওয়াও!
কিন্তু এ কি, সে তার নিজের কথাই শুনতে পেলোনা কেন! সে কি কথা বলার ক্ষমতা
হারালো নাকি! হটাত লক্ষ্য করলো সেই মৎস্য কন্যাটা ওর দিকেই ঘুরে দাড়িয়ে ওকে মুগ্ধ
দৃষ্টিতে দেখছে, সে এতক্ষণ খেয়ালই করেনি। কি অপরুপ দেখতে ওকে, টানা টানা বড় দুটো চোখ, হাল্কা সোনালি লাল চুল
ছাপিয়ে নেমেছে ঠিক যেন দিদিভাইয়ের বারবি ডলের মত ওর রুপ, এবার সে কিছু বলছে মনে হল কিন্তু সে তো কিছু শুনতেই
পারছেনা। অর্চি চিৎকার করে বলল, আমি কিছু শুনতে পারছি না
কিন্তু অর্চির ভাষা সে বুঝবে কিভাবে! হটাত অর্চির অনুভব করল কানের মধ্যে আস্তে
আস্তে কিছু শব্দ আসছে, কয়েক মুহূর্ত কাটতেই অর্চি স্পষ্ট শুনতে পেলো, মৎস্যকন্যাটি ওকে বলছে তুমি
ভয় পাচ্ছ নাতো? আমার নাম রুসি, আমি এইখানেই থাকি আর এটা হল
আমাদের বাড়ি। অর্চি অবাক হল সে ওদের ভাষা জানে না, রুসি বাংলায়
কথা বলছে না কিন্তু কি অবাক কাণ্ড সে রুসির ভাষা বুঝতে পারছে! রুসি বলল, আমরা মানুষের থেকে অনেক দূরে লুকিয়ে থাকি কিন্তু আজ অনেক
বিপদে পরে তোমাকে এখানে এনেছি।অর্চি বলল, কিন্তু আমি কি তোমাকে বিপদ
থেকে বের করতে পারবো! আমি তো নিজেই ছোট,আমার কিছু বিপদ হলে বাবা
মাকেই বলি। রুসি বলল, এসো আমাদের বাড়ির ভিতর। ওকে পথ দেখিয়ে গুহাটার মধ্যে রুসি
প্রবেশ করল, গুহাটার চারিদিকে লতাপাতা যেন বিচিত্র সব ছবি এঁকেছে, কিছু বেগুনি লালচে ফুল পাথরের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে ওকে
দেখছে। অর্চির মনে হল সবাই যেন ওর দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে, একটা ফুল পাশের ফুলটার কানে কানে বলার মত একে অপরের দিকে
হেলে যাচ্ছে! রুসি বলল, ওরা তো কোনদিন তো মানুষ দেখেনি আর তোমায় দেখে খানিক অবাকই
হয়েছে। রুসি ওদের কাছে এগিয়ে গিয়ে কিছু একটা বলল, তারপর হাসিটা
যেন কমে গেল। অর্চি জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওদের কি বললে? রুসি বলল, আমি বললাম তুমি আমাদের
সাহায্য করতে এসেছ, ক্ষতি করতে নয়। গুহার আরেকটু
ভেতরে যেতেই ও একটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ পেলো, ঠিক যেন জুঁই ফুলের গন্ধ।
অর্চির বেশ লাগলো গন্ধটা,
রুপকথার পরিবেশটায় এসে নিজেকে মোগলির মত মনে হচ্ছে।
রুসি এসে দাঁড়ালো একটা
প্রকাণ্ড পাথরের সামনে, একটা কিছু বলল আস্তে আস্তে তারপর অর্চি কে বলল, মা তোমায় ভেতরে যেতে বলছে। রুসি এরপর বড়
পাথরটার পাশের একটা ছোট ফাঁকা অংশ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল পেছনে অর্চিও। অর্চি
মুগ্ধ হয়ে দেখল গুহার ভেতর এটা যেন আরেকটা গুহা, এখানের একটা
কোণ থেকে গোলাপি আলো ঠিকরে বেরিয়ে গোটা গুহাটায় একটা গোলাপি আভা এনে দিয়েছে আর
আলোটা আসছে একটা বড় কাঁচের পিণ্ড থেকে, অনেকটা মায়ের হাতের হীরেটার
মত দেখতে। অর্চি এতক্ষণ খেয়াল করেনি, একটা আওয়াজে তার যেন
মুহূর্তের স্বপ্ন ভাঙল। অর্চির মা বলল, তোমার আসতে কোন সমস্যা হয়নি
তো? আর রুসিকে বলেছিলাম তোমাকে যেন ভয় না দেখায়,রুসি ওকে ভয় দেখাও নিতো? রুসি বলল, না মা কিন্তু প্রথমে ওর মুখ দেখে মনে হয়েছিল ও খুব ভয়
পেয়েছিল। অর্চি লজ্জা পেয়ে বলল, না না সেসব কিছু না। এরপর
রুসির মা বলল, কদিন ধরেই রুসির ভাই আস্পের মুখে একটা কিছু আটকে আছে, আমরা অনেক চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারিনি, ছেলেটার খাওয়াদাওয়া সব বন্ধ হয়ে পরে আছে, তুমি কিছু একটা করো। অর্চি দেখল গুহাটার একটা কোনায় একটা
ছোট পাথরে হেলান দিয়ে আছে একদম রুসির মত দেখতে একটি মৎস্যপুত্র, ওই তাহলে আস্প। কাছে এগিয়ে গিয়ে অর্চি ভালো করে দেখল একটা
কালো শক্ত প্লাস্টিক ওর মুখে আটকে আছে আর সেই প্লাস্টিকের সামনেটায় একটা সাদা ‘টাই’
ওর সাথে লেগে থাকায় কোনোভাবে টান
পরে চেপে টাইট হয়ে গেছে আর সেইকারনেই এরা কোনভাবেই এটা খুলতে পারছেনা। অর্চির খেয়াল হল বাবার দাড়ি কাটার বক্স থেকে সকালেই সে
কাঁচিটা এনেছিল মুকুল কাকুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে থাকা গোলাপ ডাল চুরি করবে বলে কিন্তু
সেটা কি আছে না পরে গেছে! পকেট হাতিয়ে সে কাঁচিটা পেতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে
সন্তর্পণে ‘টাই’
টাকে কাটতে শুরু করল, বেশ শক্ত ‘টাই’। এরকম ‘টাই’
সে স্মার্ট বাজারে দেখেছে, বেশ খানিকক্ষণ
চেষ্টা করার পর অর্চি ‘টাই’
টা অবশেষে কাটতে পারল। রুসি দূরে দাড়িয়ে বড় বড় চোখে দেখছিল, কাটার সঙ্গে সঙ্গে সে উৎফুল্ল হয়ে হাততালির মত কিছু একটা
করে উঠলো। অর্চির চোখেমুখে তখন গর্বের হাসি, রুসির মা কাছে এসে অর্চিকে
জড়িয়ে ধরে ওর গালে মুখ ঘষে আনন্দ প্রকাশ করতে করতে বলল, আমি খুব খুশি হয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল আস্প ওর মাকে
জড়িয়ে ধরল,ওর মায়ের চোখে তখন জল। খানিক পরে অর্চিকে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসার
কথা বলেই রুসি-আস্পের মা একটা নিলাভ পাথর এনে অর্চির হাতে দিয়ে বলল, এটা নাও এটা তোমার উপহার।
মার ধাক্কাতে অর্চি ধড়ফড় করে উঠে বসে পড়ল। মা বলল, তোর কি হয়েছে, শরীর খারাপ লাগছে? অর্চি বলল, আমি কোথায় মা? মা বলে, কেন তুই তো ঘুমিয়েই ছিলি, আমি সেই ডেকেই যাচ্ছি উঠছিলিস না কেন! বলেই মা কেঁদে ফেললো।
মা বলল, জামাটা পাল্টে এই জামাটা পর, তোর জামা তো
শীতেও পুরো ভিজে গেছে। চল,
একবার ডাক্তার দাদুকে দেখিয়ে আনি, বলেই মা গেলো রান্নাঘর থেকে জল আনতে। অর্চির মনের আঁধার
মোটেই কাটছেনা, তাহলে কি ও স্বপ্ন দেখছিল! হটাত অর্চির পকেটে হাত চলে গেলো, কিছু একটা আছে! বাইরে আনতেই অর্চি একটা আলুর মত পাথর পেলো, পাথরটা ‘নিলাভ’ আর সেটা থেকে একটা আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। সামনের ড্রেসিং
টেবিলের আয়নাতে চোখ পড়তেই সেই নীলাভ আলো ভেদ করে সে দেখল বেশ কিছু রঙ্গিন মাছ ওর
দিকে তাকিয়ে হাসছে, ওদের দিকে চোখ পরতেই ওরা মিলিয়ে গেলো। পম্ফ্রেটের মত দেখতে
মাছগুলোকে সে গুহার ভেতরে দেখেছিল।