গল্প । জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২






 এবার নির্ঘাত পাস











কৃপাণ মৈত্র

মেদিনিপুর, পশ্চিমবঙ্গ



 

ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। সব ছাত্ররা হল্লা করে বাড়ি ফিরছে। বসন্তর মনে সুখ নেই। সে মুখ চুন করে বাড়ি ফিরছে। 
অবশ্য এমন নয় যে এই অভিজ্ঞতা  তার এই প্রথম। সে খুব খেটে পড়েছিল তবুও পাস হলো না। বসন্ত বুঝতে পারে না এত লেখা সত্ত্বেও সে পাশ করে না কেন।
গত পরীক্ষায় খাতায় লাল দাগের বাগান দেখে সে অবাক হয়ে স্যারকে জিজ্ঞাসা করেছিল কেন সে নম্বর পাইনি। স্যার তাকে কাছে ডেকে একটা আস্ত ছড়ির পরমায়ু শেষ করে  তার আবিষ্কারের আদম ইভ এর জীবন চরিত পড়তে শুরু করলেন। বাকি ছেলেরা তো হেসে খুন। বসন্ত সারা শরীরে নবীন বাঁশের অত্যধিক আদরে এমন জর্জরিত ছিল যে স‍্যারের পাঠ বা সহপাঠীদের ঠাট্টা রসিকতা তার কানে ঢুকছিল না

রাস্তার ধারের শোভা কম নয়। অযত্নে বেড়ে ওঠা বাবলা শিরিষ তেঁতুল তো আছেই তার সঙ্গে বাঁশ বাখারির সীমা ছাড়িয়ে কচি জামরুল আম লিচু দিব‍্যি ঝুলে আছে। বসন্ত একটু কষ্ট করলে, ওগুলোর নাগাল পাওয়া এমন কিছু নয়। তার হাতদুটো নিশপিশ করছে। কিন্তু সে নিজেকে শাসন করল। সে ফেল করেছে। তার সমস্ত পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিত। আজ বাবা মা কি খুব বকবে! ঠাকুমা যতদিন ঢাল হয়ে থাকবে ততদিন কারও সাধ‍্য নেই বসন্তের গাএ হাত তোলে। সে মাঝে মাঝে ভাবে অংকের স‍্যারের অতিরিক্ত আদরের কথা ঠাকুমাকে বলে। কিন্তু অংকের স‍্যারের দোষ কোথায়। তিনি তো শেখানোর কসুর করেননি। তিনি কতবার তাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বাগানের আম, সবেদা, লিচু খাবিয়ে তাকে মনোযোগী হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। কালিদাসের অধ্যবসায়ের গল্প বলেছেন। বোপদেবের গল্প বলেছেন। পড়াশোনা করলে কী কী উপকার হতে পারে তার বিস্তর ফিরিস্তি দিয়েছেন। এখন স্যারের সব উপদেশ লুকিয়ে কেবল শাসনের কথা সে ঠাকুমাকে বলে এবং ঠাকুমা যদি 'রণং দেহি' হয়ে স‍্যারের উপর চড়াও হয় তাহলে স্যারের বিরুদ্ধে কি বসন্তের বেইমানি করা হবে না! বসন্ত ভাবে ছলেবেলায় একটু আধটু শাসন ভাল। ঘরেরটাও না হয় স্কুল পুষিয়ে দেয়

রাস্তা বাঁক নিয়ে তাদের বাড়ির দিকে ঢুকেছে। বড় রাস্তা ধরলে তিন গুন শ্রম। জমির সিঁথি চিরে সরু রাস্তা। বর্ষায় ডুবে যায়। অন্য উপায় নেই বলে ওই রাস্তা ধরেই  লোকেরা যাওয়া-আসা করে। বর্ষাকালে বসন্ত অতিরিক্ত পোশাক বয়ে নিয়ে যায়। পড়াশোনায় নজর কাড়তে না পারলে ও ঝড়-বৃষ্টি বাদলা যেমনি আবহাওয়া হোক না কেন বসন্ত স্কুলে হাজির হয়ে স‍্যারদের নজর কাড়ে। কোনো কারণে যদি সে অনুপস্থিত হয় তাহলে স‍্যার এবং সহপাঠীদের কৌতূহলের শেষ থাকে না। পরেরদিন হাজারো প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে অনুপস্থিতির কারণ সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতে হয় তাকে

বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে আছেন মূর্তিমান অশেষদাদু। অশেষদাদুর নাকি অনেক বয়স। কিন্তু দেখে বোঝা যায় না। সোজা হয়ে চলেন। খালি চোখে আধ মাইল দূরের জমির ফসল কেমন বলে দিতে পারেন।  কনকনে শীত হোক বা গা জ্বালানো গরম হোক তাঁর পরণে আটহাতি ধুতিএবং ফতুয়া। অশেষদাদু দাঁত বের করে বললেন, "এবারও ও পাস করতে পারলি না। বলেছিলাম পাস করতে পারবি না। লাগলো কিনা। আমার কথা কখনো মিথ্যা হয় না। বামুন ঘরে গাধা কোথাকার।"

বসন্ত পালাবার উদ্যোগ করলে অশেষদাদু তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেন, "পালালে হয় না রে। পাস হলে না হয় এগোতিস কিন্তু ফেল তো তোর পিছু পিছু ছুটবে। না কী। এক কাজ কর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে মাঠে মাঠে গরু চরা। কি আনন্দ বল দিকিনি! বাঁশি বাজাবি, গরু চরাবি, গোবর কুড়াবি... আর কী চাই।" 

বসন্ত একটু আলগা পেতে ছুটতে শুরু করল। অশেষ দাদু চিৎকার করে বললেন, "আমার কথাটা ভেবে দেখিস কিন্তু।"

পরের দিন সকালে বসন্ত মুড়িতে নলেনগুড় মাখিয়ে মৌতাত করে রোদলাগা উঠনে খাবে  বলে সবে সদর দরজা খুলেছে, দেখে অশেষদাদু দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে স্মাইল প্লিজ হাসি। তিনি বললেন, "কী রে তাহলে ঐ কথাই রইল।"

বসন্ত বাটি ফেলে দিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। মগ বলল, ষাঁড়ে তাড়া করেছে বুঝি

বসন্ত কোন মুখে সাধু যুধিষ্ঠির হয়। কোন উত্তর না দিয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল

দুপুরবেলা বসন্ত বন্ধুদের সঙ্গে ডাংগুলি খেলছিল। গ্ৰাম‍্য অলিম্পিকের সেরা আইটেম। বোধন এ্যয়সা জোরে মারল  যে কড়েটা গিয়ে পড়ল পঞ্চাশ হাত দূরের ঝোপের মধ্যে

বোধন বসন্তের সঙ্গে একই ক্লসে পড়ে। ফাইভের গেরোয় তিন বছর। আইনের আলগা ফাঁসের দৌলতে ছয় ছোঁয়ায় সৌভাগ্য হয়েছে তার। পড়াশোনায় বসন্তর থেকে খারাপ। বসন্তর ঠাকুমার ধারণা ঐ রকম বকাটে ছেলেদের সঙ্গে মিশে বসন্ত খারাপ হয়ে গেছে। বসন্তকে ওর ঠাকুমা কতবার নিষেধ করেছেন কিন্তু বসন্ত শোনে নি। কতবার আঘাত নিয়েও বাড়ি ফিরেছে। বাবা প্রহার করেছেন। বসন্ত মনে মনে পণ করেছে, আর যাবে না। কিন্তু যেই ছায়া পশ্চিমে বড় হতে শুরু করে রায়বাবুদের তিনবিঘল খামার ওকে নিশিডাকের মতো আকর্ষণ করে। সেখানে যেন খেলার কন্ঠিমালা। দলে দলে খেলা হয়

বসন্ত ছুটল কড়ের পেছন পেছন। সে ঝোপের মধ্যে ঢুকে দেখে অশেষদাদু ঝোপের আড়ালে বসে আছেন। বসন্ত থমকে দাঁড়িয়ে গেল। পালাবার কথাটাও ভুলে গেল

অশেষদাদু দাঁত বের করে বললেন, "তাহলে ওই কথাই রইল। আমার দশটা গরু আছে। গোবর আধাআধি বামুন ঘরের বৃষভ কোথাকার।"

বসন্ত চোঁ চোঁ করে ছুট দিল। বন্ধুরা হাঁক পাড়ল, "কি রে কী হল! অমন পালাচ্ছিস কেন? ভূত দেখলি  না কী?"

পৌষখোলানে খামারে ল‍্যাবা টানার ধূম পড়েছে। মা বললেন, "বসন্ত, যা না বাবা, গোবরের বালতিটা  নিয়ে। ন‍্যাতা দিবি পলদন্ড থেকে সোজা গাদা পর্যন্ত। তারপর গাদা থেকে মোরাই পর্যন্ত। পারবি না। তারপর চালপিটুলির আলপনা। একটু শুকনো হলে আমি দিয়াসবখন।"

বসন্ত উৎসাহের সঙ্গে বলে, "পারব না কেন। খুব পারব।" পড়াশোনা ছাড়া সে বিষয়ে পাযঙ্গত

তার মনজুড়ে গনগনে আঁচে কড়াই জুড়ে চালপিটুলির শিল্প। পেটে নারকেল ছই পোরা পেটফোলা আদুরে গোপাল। এছাড়া আরও কত কী। কড়াই থেকে সদ‍্য জন্ম নেওয়া নৈবেদ‍্যে হাত পড়লে মা হা হা করে তেড়ে এসে বলে, এগো জিনিস আগে ঠাকুরকে দিতে হয় রে। ঠাকুমার বিধান, ঠাকুর শিশুর রূপে ভোগ গ্ৰহণ করেন। ওতে দোষ নেই। সুপ্রিম কোর্টের স্বীকৃতি

বসন্ত সবে গোবরের বালতিটা মাথায় নিয়ে খামারে এসেছে এমন সময় গাদার আড়াল থেকে অশেষদাদু বেরিয়ে এসে  দাঁত বের করে বললেন, "কী রে মনে আছে তো আধাআধি।"

হতবুদ্ধি হয়ে বসন্ত পুরো বালতির পুণ্য নিজের মাথায় ঢেলে ছুটে ঘরে ঢুকে পড়ল।

অশেষদাদু খ‍্যাক খ‍্যাক করে হাসতে হাসতে বললেন, "বামুন ঘরের বলদ কোথাকার।" তারপর চলে গেলেন

     বসন্তের মনে সুখ নেই। সবসময় মন মরা হয়ে সে ঘুরে বেড়ায়। একদিন পুকুর ঘাটে বসে সে একটা একটা করে ঢিল ছুঁড়ছিল পুকুরে। ঢেউগুলো  বুক ফুলিয়ে পাড় ছুঁয়ে স্বস্তি পাচ্ছিল। তার বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। মধুপকাকু ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। মধুপকাকু কলকাতার একটা কারখানায় কাজ করেন। জ্ঞাতি সম্পর্কে তিনি বসন্তর বাবার ভাই। তিনি দাঁড়ালেন বসন্তের পেছনে। বসন্তের খেয়াল নেই। মধুপকাকু তার পিঠে হাত রাখলেন। বসন্ত চমকে উঠল

মধুপকাকু বললেন, "বসতে হলে ছিপ নিয়ে বস।"

বসন্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল

"কী রে এত মনমরা কেন? "   

বসন্ত কোন কথা না লুকিয়ে সব কথা মধুপ কাকুকে বলল। মধুপকাকু হাসতে হাসতে বললেন, "ও এই কথা। তবে কী জানিস তোর মনে যখন দাগ কেটেছে, তখন খাতায় দাগ কাটা অসম্ভব নয়। কিন্তু তার আগে তোকে রাহুমুক্ত হতে হবে। এক কাজ কর দিকিনি। অশেষদাদুকে দেখলে একটা কথা বলতে পারবি।"

বসন্ত হ্যাঁ বা না বলার আগে মধুপকাকু তার কানটা মুখের কাছে এনে এক মহা মন্ত্র দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলেন

অশেষদাদু সেই পাখিজাগা ভোরে ওঠেন। সারা পাড়ায় ঘুরে বেড়ান। কার-বাগানের ফসলে কেমন মড়ক লেগেছে জানান। প্রতিবিধানের উপায়ও বাতলে দেন। রাতের ঝড়ঝাপটায় রাস্তার উপর পড়া ভাঙা ডালপালা পরিষ্কার করে রাস্তা সুগম করে দেন। বসন্ত রাতের মোড়কখোলা ভোরে অশেষদাদুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রইল। অশেষদাদু দরজা খুলে বসন্তকে দেখে চমকে উঠে সবে বলতে যাবেন 'তাহলে তোর বোধোদয় হয়েছে' কিন্তু তার আগেই বসন্ত মরা কান্না শুরু করে দিল। অশেষ দাদু অবাক হয়ে বললেন, "কী রে, কী হল তোর!"

বসন্ত বলে, "আমি ভোর বেলার স্বপ্নে দেখলাম তুমি মারা গেছ। সকালের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়।"

অশেষদাদুর মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি ঘরে ঢুকে দুমকরে দরজা বন্ধ করে দিলেন

সারাদিন অশেষদাদুর দেখা পাওয়া গেল না। 

পরের দিন বিকেলবেলা বসন্ত অশেষদাদুর দরজায় টোকা দিল। দরজা খুলে অশেষদাদু বেরতে বসন্ত ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে কাঁদতে  বলে, "এই নাও কামরাঙ্গা। গাছের। খাও। শেষ খাওয়া। দুপুর বেলার স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। আমি দেখলাম শ্মশানযাত্রীরা তোমাকে নিয়ে শ্মশানে যাচ্ছে। ঘুমটা ভেঙে গেল। হ‍্যাঁ গো দাদু সত্যি সত্যি, দুপুরের স্বপ্ন সত্যি হয়?"

অশেষদাদু দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন

বসন্ত পর পর তিন দিন অশেষদাদুর দরজায় টোকা দিয়েছে কিন্তু অশেষদাদু দরজা খোলেন নি। ডাকাডাকি করেও সাড়া পায়নি সে। বসন্তর অশেষদাদুর জন্য খুব দুঃখ হল। সে মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। মধুপকাকুর পরামর্শে এমন করাটা উচিত হয়নি। বুড়োলোক চাপ নিতে না পেরে যদি হালকা হয়ে ভূত হয়ে যান!

কয়কদিন পর মাঠচেরা রাস্তা দিয়ে বসন্ত চলেছে স্কুলে। দেখে অশেষদাদু আসছেন। কেমন যেন বিধ্বস্ত চেহারা। বেশ কিছুটা কাছাকাছি আসার পর প্রায় একশ হাত ফারাকে অশেষদাদুর চোখ গেল বসন্তের দিকে। অশেষদাদু দু'কানে আঙ্গুল দিয়ে উল্টো পায়ে দ্রুত ছুটতে লাগলেন। বসন্ত ও ছাড়বার পাত্র নয়। বসন্ত ও ছুটতে লাগল। অশেষদাদু হোঁচট খেয়ে রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে পড়লেন মাঠে। বসন্ত ছুটে গিয়ে দেখে অশেষ দাদুর চেতনা নেই। কপালে চোট লেগে  রক্ত বেরোচ্ছে। বসন্ত স্কুল ব্যাগ থেকে  জলের বোতল বের করে  অশেষ  দাদুর চোখেমুখে দিতে তিনি চোখ খুললেন। চোখ খুলে বসন্তকে দেখে  ইঁ ইঁ শব্দ করে কানে আঙুল দিয়ে চোখ বুঝলেন। বসন্তের চোখে জল এসে গেল। সে জোর করে অশেষদাদুর কান থেকে হাত সরিয়ে বলল, "আজ ভোরে স্বপ্ন দেখলাম সে তুমি নয়। সে তো বিপিন দাদু। ওই যে গো গতবছর যে কলেরায় মারা গেল। মাঝিপাড়ার

অশেষদাদু তড়াক করে উঠে বসে হাসতে হাসতে বললেন, "তাই বল। আমার তো এখন মৃত‍্যুযোগ নেই। আর বাবা পৃথিবীর কতকিছুই না দেখার আছে। মরলেই হল। হ‍্যাঁ, এবার কিন্তু কোন সন্দেহ নেই তুই পাস।  দে দিকিনি তোর জলের বোতলটা। তেষ্টায় একেবারে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বাপরে বাপ দারুণ ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলি।"

"তোমার কপালে তো রক্ত। দাঁড়াও মুছিয়ে দিই।"

"ও নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই ইস্কুলে যা। এবার তোর পাস কে আটকায় দেখি।"

বসন্তর মনটা খুব হালকা লাগছে। সে স্কুলের পথে রওনা দিল