গল্প ৫ । শ্রাবণ ১৪৩২








লাইকা কে লাইক













তপন তরফদার 

খড়্গপুর,  পশ্চিমবঙ্গ


 

বাংলা শব্দ ভান্ডারে এমন অনেক শব্দ আছে যা আদি শব্দকে সরিয়ে পাকাপাকি স্থান করে নিয়েছে। আমরা কেদারা বললে কেউ বুঝতে পারবে না। যদি বলি চেয়ার, সবাই বুঝবে। ইদানীং রিকশা চালকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে চল বললে থতমত হয়ে যায়। ইউনিভার্সিটি বললে মুখে হাসি ফুটে ওঠে। 

ইদানীং ‘লাইক’ বললে সহজেই সবাই বুঝতে পারে পছন্দের থেকে সহজ সরল। মাথায় ঢুকে যায় সহজে। কিন্তু “লাইকা” শব্দটি কেমন খটমট। ওই লাইকার কীর্তিকে প্রতিবেশীরা “লাইক” করতে এসেই “লাইকা” কে নিয়ে আলোচনা। কেন “লাইকা” আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু তা সংক্ষেপে এইরকম।

চন্দ্রনাথ আর সোমনাথ দুই ভাই। জ্যাঠতুতো ভাই। তবে ওদের বয়স এক, ক্লাস, স্কুল, বাড়ি ও এক। যৌথ পরিবার। গরমের জন্য এখন মর্নিং স্কুল। চন্দ্রনাথ টিফিনের সময় নিজের টিফিন খেয়ে সবার সঙ্গেই স্কুলের মাঠে হাডুডু খেলে সময় কাটায়। ওদিকে সোমনাথ ক্লাসের মধ্যেই অক্ষয়ের সঙ্গে কাটাকুটি খেলা খেলতে খেলতে টিফিনের সময় পেরিয়ে যায়।

স্কুল ছুটির পরে দুজনে বাড়ি ফিরছে। সোমনাথ বলে টিফিন খাওয়া হয়নি। চন্দ্রনাথ বলে, আয় টিফিন কৌট খুলে, খেয়ে নিই। জেঠিমা জানতে পারলে বকবে। টিফিন কৌটোয় দুটুকরো মাখন মাখানো পাউরুটি, একটা কলা। চন্দ্রনাথ কলাটা খায় কারন ও জানে কলা খেলে দেহের শক্তি তত্ক্ষণাত বৃদ্ধি পায়। ছোট কাকা বলেছিল। সোমনাথ পাউরুটির এক টুকরো মুখে অন্য টুকরো হাতে ধরে এগোচ্ছে। হঠাৎ এক বাদামী রংএর কুকুর সোমাশীষের হাতের পাউরুটির দিকে তাকিয়ে কেঁয়ুও, কেঁয়ুও আওয়াজ করে। চন্দ্রনাথ কলার খোসাটা ছুঁড়ে মারে কুকুরটাকে। মুখে বলে, ভাগ, ভাগ এখান থেকে। সোমনাথ বলে, কুকুরটা খুব দুঃখ পেয়ে চলে গেল। মনে মনে আপশোস হয়, এক টুকরো কুকুরটাকে দিলে কোনো ক্ষতি হতোনা।

রাতে খাওয়ার সময়ে ঠাকুমাকে সোমনাথ সব বলে। ঠাকুমা বলে, আহা অবলা জীব, ওদের কে আমাদের দেখা উচিত। একশোবার জীব হয়ে জন্মাবার পরে মানুষ জন্ম হয়। সোমনাথ ঘুমের ঘোরে স্বপন দেখে ওর প্রিয় ঠাকুরদা ওই কুকুর হয়ে জন্মেছে। স্পষ্ট শুনতে পায়, কিরে আমায় কিছু খেতে দিবিনা। সোমনাথ কাউকে কিছুই বলেনা। পরের দিন সোমনাথ ইচ্ছে করেই টিফিন না খেয়ে কুকরটাকে টিফিন খাওয়ায়। মজার কথা হলো চন্দ্রনাথ খাওয়াতে গেলে কুকুরটা খায়না।

খাওয়ার টেবিলে বসে সোমনাথ ঘটনাটা ছোট কাকাকে বলে। ছোট কাকা এখন চাকরি পাওয়ার জন্য পরীক্ষা দিচ্ছে, সব কিছুরই খোঁজ রাখে।

ছোটকা বলল, আমরা পাঁচটা অনুভুতি বুঝতে পারি, স্পর্শঅনুভুতি চামড়ার সাহায্যে, শুনি কানের সাহায্যে, গন্ধ বুঝি নাকের সাহায্যে, স্বাদ বুঝি জিভের সাহায্যে, আর দেখি চোখের সাহায্যে।এছাড়া সবকিছুর সমন্বয়ে আমাদের একটা অনুভূতি হয়, কি হতে যাচ্ছে বা কেন হচ্ছে। একে বলে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। মন। মন অন্য সব ইন্দ্রিয়গুলোকে কাজ করায়। মনই সব সিদ্ধান্ত নেয়, বুঝলি? কুকুরটা প্রথম দিনের ঘটনাটা ভোলেনি।

ছোটকা বললো, জেনে রাখ কুকুর খুব প্রভুভক্ত হয়। দেশে বিদেশে ওদের মনিবের প্রতি ভালবাসা আর প্রভুভক্তির অনেক সত্য ঘটনা আছে যা কল্পনাতীত। জাপানে হাচিকো নামে একটা কুকুর পুষেছিলেন হিদিসাব্যুর উয়েনো। প্রত্যেকদিন হাচিকো ওনার সঙ্গে শিবুয়া স্টেশনে আসতো। বাড়ি যাওয়ার সময় ওনার সঙ্গে বাড়িতে ফিরত। উয়েনো একদিন অফিসে খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। হাচিকো বসে আছে কখন ওর মনিব আসবে তার অপেক্ষায়। কুকুরটা একটানা দশ বছর ধরে ওর মালিকের জন্য অপেক্ষা করে গেছে। হাচিকোর কথা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে ওর কথা সবাই জানতে পারে। হাচিকোকে নিয়ে তৈরি সিনেমার নাম, ‘হাচিকো-এ ডগস টেল’। ২০০৯ সালে ১৬ মিলিয়ন ডলার খরচ হয় ছবিটিতে। শিবুয়া স্টেশনে এখনো আছে হ্যাচিকোর ব্রোঞ্জের মূর্তি।   

অবাক হবি জেনে, রিন টিন টিন, নামের কুকুরটা অভিনয়ের জন্য অস্কার পুরস্কার পেয়েছে। ১৯৩২ সালে ওর মৃত্যুতে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়। রিনটিন অবশ্য শায়িত আছে তার জন্মভূমি ফ্রান্সের মাটিতে ইউরোপের সবচেয়ে পুরাতন পোষা প্রাণীদের বিখ্যাত কবরস্থানে।

এক ছুটির দিনে গ্রাহাম তার পোষা কুকুর রুশওয়ার্পকে নিয়ে ঘুরতে বের হলেন। ওরা ফিরে এল না। শেষে তিন মাস পরে, একটা ঝর্ণার ধারে দেখা গেল, রুশওয়ার্প তার মনিবের মৃতদেহ আগলে চুপ করে বসে আছে। তিন মাস প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর তুষার বৃষ্টি সহ্য করেও রুশওয়ার্প প্রভুকে ছেড়ে একচুলও নড়েনি।

জেনে রাখ, পৃথিবী যতদিন থাকবে মৃত কুকুর লাইকা ততদিন জীবিত থাকবে। রুশ বিপ্লবের ৪০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে নভেম্বর মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল “লাইকা” কে। লাইকা মারা যায়।

কেউ খেয়াল করেনি। ঠাকুমা কখন থেকে এইসব কথা শুনছে। ঠাকুমা নিদান দিল, কুকুরটাকে নিয়ে আসবি। ওর থাকার খাবারের কোনো খামতি হবেনা। ভেবে দেখ ওই কুকুর সাহায্য করে ছিল বলেইতো আমরা বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহর সন্ধান পাচ্ছি মানুষ যেতে পারছে। লাইকাকে মনে রেখে ওর নাম থাকবে “লাইকা” লাইকা ও বাধ্য ছাত্রর মতো ওদের পিছনে পিছনে স্কুলে যায়। টিফিনের সময় ওদের সঙ্গে টিফিন খায়।

শনিবার স্কুলের “হাফডে”। ওরা কয়েকজন বাড়ি না গিয়ে স্কুলের মাঠেই খেলতে থাকে। ফেরার সময় দেখে রাস্তা শুনশান। দুজনে বেশ জোরে জোরে হাঁটছে বাড়ি ফেরার জন্য। পিছনে লাইকা।

হঠাৎ এক কালো মারুতি ভ্যান ওদের সামনে দাঁড়ায়। দুজন ষন্ডাগন্ডা লোক গাড়ি থেকে নেমে দেবাশীষের মুখে একটা রুমাল চেপে ধরে চোখের পলকে গাড়িতে ঢুকিয়ে নেয়। সোমনাথ চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। লাইকাও ভৌ ভৌ করে চিৎকার করতে থাকে। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে দেখে লাইকা লাফিয়ে গাড়ির ছাদে উঠে পরে। ছাদের উপরেই লাইকা আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ভৌ ভৌ করে যাচ্ছে। পঞ্চানন তলার ট্রাফিক পুলিশ গাড়িটা থামাতেই ড্রাইভার দরজা খুলেই দৌড়ে পালাতে যায়। লাইকা, মহাশূন্যে ঝাঁপ দেওয়ার ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ড্রাইভার কে ধরে। রাস্তার লোকেরাই ঘিরে ধরে গুন্ডাদের। কে খবর দিল কে জানে। পুলিশ ওদেরকে পাকড়াও করে নিয়ে গেল।

পাড়ার লোকজন লাইকা কে লাইক করতে এসে ঠাকুমার কাছ থেকে এই বৃতান্ত জানতে পারল।