গল্প । আষাঢ় ১৪৩২





আদরে যত্নে আমার প্রকৃতি







নন্দিতা দত্ত

আগরতলা, ত্রিপুরা


 

একটি ছোট পাহাড়ি গ্রাম—নিদয়া। পাহাড়, জঙ্গল আর নদীর কোলে নিভৃতে থাকা এই ছোট্ট গ্রামে বাস করে খুব কম মানুষ। তবু প্রকৃতি ছিল সজীব—পাখির ডাক, ঝর্ণার স্রোত, বনভূমির গন্ধে ভরপুর।

অরণ্য সেন পেশায় ছিলেন স্কুলশিক্ষক। এ গ্রামের ছেলে কর্মসূত্রে বাইরে ছিলেন। অবসর নেওয়ার পর স্থায়ীভাবে ফিরে এসেছেন নিজের গ্রামে

শহরে থাকতে থাকতে একসময় তাঁর মনে হয়েছিল, মানুষ যেন ভুলে গেছে তারা কাকে ঠকাচ্ছে। তিনি বলতেন—

"আমরা প্রকৃতিকে রক্ষা তো করছি না, আমরা ওকে ধ্বংস করছি—আমরা ওর পথেই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছি!"

প্রতিদিন সকালে তিনি জঙ্গলের দিকে হাঁটতে যেতেন, কোথাও কিছু ফেলতেন না, কিছু তুলতেন না। একটি শুকনো পাতা পর্যন্ত নাড়াতেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিল—প্রকৃতিকে ভালোবাসা মানেই তাকে নিজের মতো থাকতে দেওয়া

একদিন গ্রামে একদল লোকের আনাগোনা। তারা দেখে, পুরো জায়গাটা পর্যটন প্রকল্পের জন্য আদর্শ। ঝর্ণার ধারে বিলাসবহুল রিসোর্ট হবে, বনে অ্যাডভেঞ্চার পার্ক, নদীতে স্পিডবোট চালানো হবে। প্রথমে গ্রামের কিছু লোক উৎসাহ দেখায়। তাদের রুটি-রোজগার হবে

অরণ্য সেনের মুখ তখন অদ্ভুত রকমের শান্ত। তিনি শুধু বললেন—

"প্রকৃতিকে বিক্রি করতে গেলে প্রকৃতি একদিন তোমাকে কিনে নেবে। তারপর দাম হাঁকবে সে।"

কিন্তু কে শুনে কার কথা?

একটি একটি করে গাছ কাটা শুরু হয়। নদীর ধারে মাটি কেটে রাস্তা তৈরি হতে থাকে। পাখিরা আর আসে না, বানরের দল নেমে আসে লোকালয়ে, সাপ-খোপ দেখা যেতে থাকে বাড়ির উঠোনে। তখন সবাই বুঝতে শুরু করে, কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে

তারপর আসে সেই বিপর্যয়ের রাত

টানা তিন দিনের বৃষ্টির পর পাহাড় থেকে ধসে নামে মাটি। ঝর্ণার উৎস বন্ধ হয়ে যায়। নদী উপচে ভাসিয়ে নিয়ে যায় রিসোর্টের আধা-তৈরি কাঠামো। বিদ্যুৎ চলে যায়। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে

বেঁচে থাকেন শুধু তারা, যারা পাহাড়ের ওপরে ছিল। আর যারা প্রকৃতিকে জয় করতে নেমেছিল, তারা নিজেই হয়ে যায় পরাজিত সৈনিক

গ্রামবাসীরা ভয়ে অরণ্য সেনের কাছে আসে। তিনি একটা পুরনো গাছের গুঁড়িতে বসে ছিলেন, মাথায় ভেজা চুল, হাতে ধরা একটা শুকনো পাতা

তিনি তাদের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর খুব আস্তে আস্তে বললেন—

"তোমরা ভাবছিলে, প্রকৃতি তোমাদের কিছু বলবে না। প্রকৃতির অনুভূতি নেই। প্রকৃতি কি করে বলো তো? প্রতিশোধ নেয় না। সে শুধু তার ভারসাম্য ফেরায়। মানুষই নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।"

তারপর একটা কথা বলেন—

"তোমাদের কিছুই করতে হবে না। শুধু আর কিছু কোরো না। ওকে নিজের মতো থাকতে দাও। তাতেই মঙ্গল।"

বছরখানেক পর ফের পাখিরা আসে, বনফুল ফোটে, নদীর জল স্বচ্ছ হয়

গ্রামবাসীরা কেউ আর গাছ কাটে না, নদীতে স্বচ্ছ জলের টলমলে মুখ। অরণ্য সেন গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে সময় কাটান। এই গ্রাম আদর্শ গ্রাম হয়ে ওঠে

এর তিন বছর পর… অরণ্য সেন আজ আর নেই। তাঁর রেখে যাওয়া কাঠের ফলকে খোদাই করা আছে—

"প্রকৃতিকে ভালোবাসা মানেই তাকে নিজের মতো থাকতে দেওয়া।"