ক্লাস টেন বোর্ড পরীক্ষাতে অনুভবের নাইনটিথ্রি পার্সেন্ট নম্বর পাওয়ার পুরষ্কার এই সাইকেল। নাইন্টির শর্ত পূরণ করেছে সে। বাবাও কথামতো গিয়ার দেওয়া সাইকেল কিনে দিয়েছেন।
বাবা বিডিও অফিসে চাকরি করেন। খুব বেশি মাইনে পান না। দিদি
ও ভাইয়ের পড়াশোনাতে ভালোই খরচ হয়। ঠাকুমার বয়স হয়েছে, প্রায় সময়ই অসুস্থ থাকেন। তাঁর ডাক্তার ও ওষুধে মাসে বেশ
টাকা লাগে। সংসার চালাতে বাবা-মাকে হিমশিম খেতে হয়। তাসত্ত্বেও বাবা সাড়ে সাত
হাজার টাকায় সাইকেল কিনে দিয়েছেন। মা হাজার দুই-তিনের মধ্যে কিনতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, ছেলের শখ মেটাতে এতগুলো
টাকা খরচ করার কোন কারণ আছে! বাবার কথা, এত ভালো রেজাল্ট করলো
ছেলেটা, সংসার চালাতে কষ্ট হবে, সে মানিয়ে নিতে হবে!
অভাব - অনটন, বাবা - মায়ের হিসেব - নিকেশ, যা কিছু সব ঘুমের মধ্যেও অনুভবের
মনে হানা দিয়েছে। সে ভাবনা হাওয়ায়
উড়িয়ে দিয়ে আরো জোরে পেডাল করেছে সে। উড়তে উড়তে সাইকেলটি কোথায় পৌঁছালো! সামনে তো পথ নেই, বিরাট এক নদী যে! কিন্তু সাইকেল যে আর থামছে না! অনুভব খুব জোরে দুই হাতে মুঠো করে ব্রেক কষলো। তাতেও থামছে
না সাইকেলটা! কী হবে! তাকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিল
সাইকেলটা। সে চিৎকার করে দিদিকে ডাকছে, কিন্তু গলা থেকে শব্দ
বেরোচ্ছে না!
দিদির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো অনুভবের! খাট থেকে লাফিয়ে নেমে ছুট
দিয়েছে সে। আগে সাইকেলটাকে দেখা চাই তার।
ভাইয়ের ছোটার লক্ষ্য যে নতুন সাইকেল, দিদির জানা! অনুভব চেয়েছিল, ঘরে তার বেডের পাশে
সাইকেলটা রাতে এনে রাখবে। কিন্তু মায়ের নিষেধে তা’ হয়নি, কিনা চাকাতে রাস্তার নোংরা থাকে!
রাতভ’র সাইকেলটা দেখা হয়নি, তায় আবার বাজে স্বপ্ন! সিঁড়ির পাশে
দাঁড়িয়ে থাকা সাইকেলটার কাছে পৌঁছে গেল অনুভব। সে জানে, স্বপ্ন সত্যি হয় না! নিশ্চিত সে যে, নদীতে সাইকেল সমেত তার ঝাঁপ দেওয়ার স্বপ্নও অলিক, সঠিক না!
কিন্তু সে দেখলো, তার নতুন সাইকেলের পেছনের
চাকা থেঁতলে আছে! কী হল? অনুভব ঘাবড়ে গিয়ে পেছনের টায়ারটা টিপে দেখলো, এক্কেবারে পাম্প নেই, চেক ভাল্ব ঢিলা হয়ে আছে! ওখান থেকেই হাওয়া বেরিয়ে গেছে!
দিদি তার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে হেসে বলেছে, কিরে, ভাই,
সাইকেলের স্বপ্ন দেখছিলিস নাকি?
স্বপ্নে দেখা অতকিছু দিদিকে বলবে, সেই সময় অনুভবের কোথায়! এদিকে সাইকেলটার চাকায় পাম্প দেওয়া দরকার! মোড়ের সাইকেল সারাইয়ের
দোকানে গেলেই হবে,
কিন্তু দু’টো টাকা লাগবে যে!
দিদির কাছে দু’পাঁচ টাকা থাকে, চাইলে পাওয়া যায়। অনুভব দিদিকে অনুনুয় করতে, দিদি ঘর থেকে পাঁচটাকার একটি কয়েন এনে ভাইকে দিয়েছে! ভাইয়ের অনুরোধ দিদি ফেলবে কীভাবে।
মা রান্নাঘরে দিনের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। বাবা রোজকার মতো
প্রাণায়াম করছেন। তাঁদের নজর এড়িয়ে অনুভব সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে
পড়লো।
অনুভব পৌঁছে দেখলো, সাইকেল সারাইয়ের গুমটিটা
তখনও খোলেনি। সারাইয়ের কাকু সবে দোকানের সামনে রাস্তা ঝাঁট দিচ্ছেন। স্ট্যান্ড
নামিয়ে সাইকেলটা দাঁড় করিয়েছে অনুভব। চেয়ে চেয়ে সে কাকুর কাজ করা দেখছে। ঝাঁট দেওয়া শেষ
হলে বালতির জলে হাত ধুয়ে
দোকানের বন্ধ ঝাঁপে প্রণাম করলেন কাকু। তারপরে তিনি তালা
খুলে খুঁটি লাগিয়ে ঝাঁপটি তুলে দিলেন।
কাকু তাঁর ছোট টিনের ক্যাশবাক্সের ঢাকনাটা খুলে গঙ্গা জল ছিটিয়ে দু’চারটে ফুল ছড়িয়ে পুজো করলেন। অনুভব খুব মন দিয়ে কাকুর পুজো দেওয়া দেখলো। চোখ বুজে হাতজোড় ক’রে কিছুক্ষণ চুপ রইলেন কাকু। দিনভ’র যেন ভালো
রোজগার হয়, মনে মনে সেই প্রার্থনা করছেন, অনুভব ভাবছে। কাকুর তোবড়ানো দু’গালে কাচা-পাকা দাড়ি। তাঁর পোষাক ও চেহারায় দারিদ্র্যের ছাপ।
কাকু এবার অনুভবের সাইকেলটা পরখ করে দেখলেন ও দেরি না করে
পাম্পারটি এনে চাকায় পাম্প দিয়ে দিলেন। পাম্প করার সময় কাকুর রোগা দু’হাতের পেশিগুলো ফুলে ফুলে উঠতে দেখে অনুভবের কষ্ট হচ্ছিল। সে নিজে পাম্প ক’রে নিতে চাইলে, কাকু বলেছেন, এতো তাঁরই কাজ! সাইকেলের পেছনের চাকার টায়ার আবার মজবুত হয়ে উঠতে দেখলো অনুভব। এই তো সবে তিন দিন হল, সাইকেলটা সে বাবার সঙ্গে গিয়ে কিনে আনলো। এর মধ্যে এই সমস্যা!
অনুভবের সাইকেলে পাম্প দেওয়া শেষ। অনুভব পকেট থেকে পাঁচটাকার কয়েনটি বার ক’রে কাকুকে দিল। কাকু তাকে তিন টাকা ফেরৎ দিলেন।
অনুভব বলল, টাকা ফেরৎ দিতে হবে না, কাকু।
তা’
তো হয় না, কাকু বললেন।
তিনি আরো যোগ করলেন, একটি চাকায় হাওয়া ভ’রতে দু’টাকা দাম যে! তোমার থেকে কীভাবে পাঁচ টাকা নেব!
কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন কাকু। তাঁর মুখে ভোরের আলো পড়েছে।
একজন সজ্জন মানুষ যে কাকু,
সে কথা অনুভবের বুঝতে দেরি হল না!
ফিরতি পথে অনুভব সাইকেল চালাচ্ছে আর কাকুর কথা ভাবছে। কাকুর
মলিন পোষাক ও শুকনো চেহারাতে বোঝা যায়, অভাব তাঁর সঙ্গী, কিন্তু মনে সেই ছাপ পড়েনি। কষ্ট-দুঃখ সহজ
ক’রে নিয়েছেন তিনি। অল্পেতে খুশী থাকার অভ্যেস তাঁকে প্রশান্তি দিয়েছে।
অনুভবের মনে হয়েছে, খামকা অত বেশি দামি সাইকেল
না কিনলে ভালো হতো। গিয়ার দেওয়া সাইকেলের বদলে সাধারণ সাইকেল কী খারাপ ছিল! এতে
বাবার ওপরে চাপ বেড়েছে ভেবে সে মনে মনে কষ্ট অনুভব করলো।