গত কয়েক মাস থেকেই মাতামাতির শেষ নেই তাকে নিয়ে। সেও ব্যস্ত থাকে সবার ফাই ফরমাশ খাটতে।
সবার সব কাজ করে দেয় হাসিমুখে যত্সামান্য পারিশ্রমিকের
বিনিময়ে। যে কাজ অন্য কেউ করলে তিরিশ থেকে চল্লিশ টাকা দিতে হত, মাত্র দশ টাকা
দিয়ে সেকাজ করিয়ে নেওয়া হয় তাকে দিয়ে। অনেকে আবার বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করেন এতে। আর
সঞ্জীব রায়ের মত মানুষ তো চোখ রাঙিয়েই কাজ করিয়ে নেয় ছেলেটাকে দিয়ে, পয়সা দেবার
প্রশ্নই নেই। আর তাই তো মাতামাতি তাকে নিয়ে কারণ সে ‘আড়ুয়া’, মানে বোকা।
কেউ নাম জানে না ছেলেটার, জানার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনি কেউ। অন্তত
রজতের সেটাই ধারণা। নাম পড়েছে তার আড়ুয়া। সকাল হতে না হতেই এসে যায় রজতদের মহল্লায়, সন্ধেবেলা চলে
যায়। ‘আড়ুয়া ওবায় আয়’, ‘আড়ুয়া জাবরা
ফালাইয়া দে’, ‘আড়ুয়া নালা
পরিষ্কার করিয়া দিবে কাইল সকাল সকাল’, ‘আড়ুয়া বিকালে একটু আইস, শরীরটা কিলা কিলা করের। একটু মালিশ করিয়া দিবে’ – এতগুলো
ধরণের কাজের পারিশ্রমিক কিন্তু মোটামুটি এক ধরণের, দশ থেকে সর্বাধিক পঞ্চাশ টাকা, সঙ্গে কখনো সুখনো
টুকটাক তাচ্ছিল্য, গলমন্দ। কম পয়সায়
এত কাজ কেই বা করবে আর। তাই আড়ুয়ার চাহিদা বর্তমানে তুঙ্গে, সে সবার প্রিয়।
সব দেখে রজত কিন্তু মুখে বলে না কিছু, বললে ভালো চোখে দেখবে না সেটা অনেকেই। বলবে, স্কুলে করে করে
এখন পাড়াতেও মাস্টারি শুরু করেছে ব্যাটা।
তিনতলার উপরে গ্যাস সিলিণ্ডার উঠিয়ে সেদিন আড়ুয়াকে দশ টাকা
দিয়ে সে কি আত্মতৃপ্তি পরাণবাবুর, অথচ প্রতিমাসে এই কাজের জন্যই ডেলিভারির ছেলেটাকে দিতে হয়
পুরো তিরিশ টাকা। কুড়ি টাকা দিলেও মেজাজ দেখায় ছেলেটা। আগে শেষ হয়ে গেছে বলে ন’শো
টাকার সিলিণ্ডার এবার কিনতে হয়েছে দুশো টাকা বেশি দিয়ে কালোবাজারিতে। না কিনে উপায়
নেই, গুষ্ঠি উদ্ধার
করে ছাড়বে পরাণবাবুর মুখরা বউ।
সিলিণ্ডারটা উপরে তুলতে গিয়ে একেবারে ঘেমে চুপসে গেছিল
আড়ুয়া, তবু সেই দশ টাকাই
জুটেছে শেষমেশ। আসলে শোষণ জিনিসটাই এমন, সহজে পিছু ছাড়েনা।
ক’দিন আগে ওই একই কাজ করিয়ে আড়ুয়াকে পঞ্চাশ টাকা দেওয়ায় সে
তিরিশ টাকা ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিল রজতকে। রজত পুরো টাকা রেখে দিয়ে বলায় সে কি সংকোচ
আড়ুয়ার। পরে অবশ্য রেখেছে চোখেমুখে একরাশ কৃতজ্ঞতাবোধ নিয়ে। আর সেদিনই রজত বুঝেছিল
- এক, শ্রমের মূল্য কত
হতে পারে সেটা বোঝে আড়ুয়া আর তাই সে কুড়ি টাকা রাখতে চেয়েছিল; দুই, অন্তত মনের দিক
দিয়ে সে আড়ুয়া নয় মোটেই আর তা না হলে শ্রমের সঠিক বা বাড়তি মূল্য পেয়ে চোখেমুখে
ওরকম কৃতজ্ঞতাবোধ ফুটে উঠত না তার। হয়ত কোনও এক অসহায়তা থেকেই কাজগুলো করতে হয়
তাকে। রজত ঠিক করে, একদিন সে
ব্যাপারে কথা বলবে আড়ুয়ার সঙ্গে।
আজও আড়ুয়াকে ঘিরে ধরেছে সবাই সকাল সকাল সঞ্জীব রায়ের বাড়ির
সামনে। সঞ্জীবের মায়ের এক কথা সেই তখন থেকে, ‘আড়ুয়ায় বাঁচাইসে আমারে। নাইলে কারেন্ট এর শট খাইয়া মইরা
গেলাম নে। হে মানুষ না, ভগবান.........।’
মাটিতে কুকড়ে পড়ে আছে আড়ুয়া, শরীরে জড়িয়ে আছে বিদ্যুতের তার। শরীরটা কেমন
যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ভগবান তো দূর, মানুষ বলেই গণ্য করেনি তাকে আচমকা ধনী হয়ে যাওয়া সঞ্জীব।
ঘটনাটা ঘণ্টাখানেক আগের। অন্যদিনের মত আজও সঞ্জীবের মা সকালে ওঠে ফুল তুলতে গেলে
তার গায়ে লাগে গতকাল রাতের ঝড়ে ছিঁড়ে যাওয়া বিদ্যুতের তার। চিত্কার শুনে দৌড়ে আসে
আড়ুয়া। সাধারণত এসময়টাতেই আসে সে পাড়ায়।
ছুটে গিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে মাসিমাকে কিন্তু নিজেকে
ছাড়াতে পারেনি বিদ্যুতের ছোবল থেকে। ছটফট করতে করতে একসময় নিস্তেজ হয়ে যায় আড়ুয়া।
সঞ্জীবের মা সে কথাই বলছেন সবাইকে কেঁদে কেঁদে।
সকালের সময়, সঞ্জীবের মায়ের চিত্কারে এসেছে সবাই একে একে কিন্তু দেরি
হয়ে গেছে অনেকটাই। বিদ্যুতের সংযোগ কাটা হয়েছে। রজতও এসেছে, ১০৮ নম্বরে ফোন
করেছে এম্বুলেন্সের জন্য। আড়ুয়ার জ্ঞান নেই কিন্তু চোখেমুখে এক গভীর প্রশান্তি
তার। সঞ্জীবের মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তার পরম মমতায়, পাশেই মাটিতে বসে
সঞ্জীব। যে সঞ্জীব দিনের পর দিনে খাটিয়েছে তাকে বিনে পয়সায়, গলমন্দ করেছে
অকারণে তার মাকেই বাঁচাতে গেল? সে আড়ুয়া নয় তো কি? সঞ্জীবের মনে এসব প্রশ্ন এমুহূর্তে উঠছে কিনা, কে জানে।
এম্বুলেন্স আসে একসময়, স্ট্রেচার নিয়ে নামে দুজন। একজন পরীক্ষা করে বলে, ‘শ্বাস তো চলতাসে
এখনো, বাইচ্চা যাইতে
পারে কপাল ভালা থাকলে।’