গল্প ৩ । শ্রাবণ ১৪৩২



ভূতের মজা 













গৌতম সমাজদার

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ


 

দিবাকরবাবু যখন বাড়িটি তৈরী করেছিলেন, ফাঁকা জমির ওপর, সবুজে ঘেরা চারপাশ, আজ তা প্রায় কংক্রিটের জঙ্গল। ৩ কাঠার ওপর দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। আজ এই বাড়ির মূল্য অনেক। খালি জায়গা নেই বললেই চলে। 

দিবাকরের ছেলে স্বপনবাবু বাবার স্মৃতিরক্ষার জন্য বাড়িটির যথেষ্ট যত্ন নেন। স্বপনবাবু প্রাইভেট ফার্মে সাধারণ চাকুরী করেন। ফলে দুটো ফ্ল্যাট দুটো পরিবারকে ভাড়া দেওয়া আছে। এখানে প্রোমোটারের থাবা বাঁচিয়ে বাড়ির সংখ্যা নগণ্য, সবই ফ্ল্যাট। যাই হোক, হঠাৎ একদিন এক ভাড়াটে জিজ্ঞাসা করল, "স্বপনবাবু, এত বড় বাড়ি, মেইনটেনেন্সেও যথেষ্ট। এটা ফ্ল্যাট করে বিক্রি করলে তো অনেক লাভ!" স্বপনবাবু উত্তরে বলেন, "না, বাবা কখনোই বাড়ি বিক্রির পক্ষে ছিলেন না। চরম আর্থিক দুর্দশার সময়ও বলেছে, 'এটার জন্মদাতা আমি। সন্তানকে বিক্রি করতে পারব না।' "দুই চারজন প্রোমোটারও স্বপনবাবুকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছে, কিন্তু স্বপনবাবু পত্রপাঠ তা নাকচ করে দিয়েছেন। চায়ের দোকানে কয়েকদিন ঐ প্রোমোটার আর ভাড়াটেকে কথা বলতে দেখেছেন

স্বপনবাবুর একমাত্র ছেলে নীল নবম শ্রেণীর ছাত্র। এই বয়সেই কয়েকটি বিজ্ঞান ক্লাবের সাথে যুক্ত। নিজেও যুক্তিবাদী। হঠাৎই কয়েকদিন বাদে নজরে এল, মাঝরাতে বাড়ির ছাদে ইট পড়ার শব্দ। রাতে দরজা খুলে গিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। ভাড়াটে একদিন বলল, "স্বপনবাবু, এ কি শুরু হয়েছে বলুন তো। ভূতেরা বোধ হয় ইটবৃষ্টি শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে তো বাড়িতে থাকা যাবে না।" দিন দিন এই সমস্যা বাড়তে থাকায় থানায় স্বপনবাবু জানালো। পুলিশ অভয় দিল, রাতে পাহারায় থেকে লক্ষ্য রাখবে বলল। কয়েকদিন বাদে থানা জানালো, "না, কোনো মানুষকে দেখা যায়নি।" এরপর ভাড়াটে পরিবার বলাতে স্বপনবাবু বলল, "আপনার ভয় লাগলে আপনি অন্যত্র চলে যেতে পারেন।" এর মধ্যে সমস্যা বাড়তে থাকায় নীল বলল, "বাবা, আজকে আমি ছাদে লুকিয়ে দেখতে চেষ্টা করব। এটা ভূতের কাজ, না, মানুষের। যদিও আমি নিশ্চিত, এটা ইচ্ছা করে ঘটানো হচ্ছে।" সেই রাতে মাঝরাত অবধি জেগেও কাউকে খুঁজে পেল না নীল। ফিরে এল। ভোররাত্রে আবার ইটবৃষ্টি

একদিন পাড়ারই রাজনৈতিক কর্মী নিখিল এসে স্বপনবাবুকে বলে, "তোমার পাশের ঘরটা তো তোমার বাবার মৃত্যুর পর খালি পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন। ওটা যদি দুলালবাবুকে ভাড়া দাও। উনি যে বাড়িটায় থাকেন, ওটা ভেঙে ফ্ল্যাট হচ্ছে। হয়ে গেলেই ঘর ছেড়ে দেবে। এইটুকু সাহায্য চাইছি।" স্বপন 'না' বলতে পারল না। নতুন ভাড়াটে চলেও এল। দুই তিনদিন বাদে আবার নতুন এক সমস্যা দেখা দিল। সামনে যে কমন বারান্দা, সেখান থেকে মধ্যরাতে নানারকম অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল। ভূতেরা যেমন নাকি গলায় কথা বলে, সেইরকম। ছেলে, বউ খুব ভয় পেয়ে গেল। স্বপনবাবুও একটু ভয় পেয়ে গেল। একদিন নিখিলবাবু বাজারের এক কোণে স্বপনবাবুকে ডেকে নিয়ে বলল, "দেখ স্বপন, তোমার তো বয়স কম, তুমি হয়ত জান না বা তোমায় কেউ বলেনি, তোমার এক পিসি ছিল। তোমার পিসি বিয়ের পর পেটে বাচ্চা নিয়ে ফিরে আসে। শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই আঘাত তোমার পিসি সহ্য করতে না পেরে তোমাদের বাড়ির যে নিমগাছটা আছে, সেখানে পেটে বাচ্চাসহ গলায় দড়ি দেয়। হয়ত সেই খুকু পিসির অতৃপ্ত আত্মা বারবার ফিরে আসছে। ও-ই এইসব সমস্যা তৈরী করছে। তুমি বড় করে নারায়ণ পূজা দাও। এতে যদি খানিকটা কমে।" স্বপন ফিরে এসে বউ, ছেলেকে সব বলল। ছেলে বলল, "দেখছি, কেন এটা হচ্ছে।"

পরদিন ঘাপটি মেরে বারান্দায় থেকে নীল চেষ্টা করল। রাতে শব্দ পেল কিন্তু কোথা থেকে আসছে বুঝতে পারল না। স্বপনবাবু বলল, "নীল, কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না। এই উৎপাতে তো থাকা যায় না।" এরপর একদিন ভাড়াটেরা পিকনিকে গেলে নীল লক্ষ্য করল, ছাদের নীচে একটা ছোট মেশিন লুকিয়ে বসানো আছে। ও বুঝল, খোলা জানালা দিয়ে রিমোট কন্ট্রোলে রেকর্ডেড শব্দ বাজানো হয়। ঘরে বসেই ওরা এটা করে। বাইরে কাউকে দেখা যায় না। ও আস্তে করে sound box টা খুলে নিল। ভাড়াটেরা সেই রাতেই বুঝল, স্বপনবাবুরা সব জেনে ফেলেছে। পুরো মাসের ভাড়া দিয়ে ওরা চলে গেল। স্বপনবাবু ছেলেকে পিঠ চাপড়ে বলল, "সাবাস বেটা, তোর এই যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্কতাই বাবার বাড়িটা রক্ষা করল।"