সাত ছেলের এই জননীর কোন
মেয়ে ছিল বলে তো জানা নেই। ছিল একারণেই বলছি, যদি জীবিত থাকতো তাহলে আমি
অন্তত জানতাম। এবার নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে করছে, আমি কে? আমি মানুষটা গত দু’বছর আগে বাবা মা আর ছোট বোন টুনির সাথে
তাদের পাশের বাড়িতে থাকতে এসেছি। গীতার মা বলে যাকে ডাকা হয়েছে, তাকে দিম্মা বলে ডাকি। সাত ছেলের সবচেয়ে ছোটো ছেলের বড় ছেলে
রণিতের সাথে কলেজে পড়ি। পাশাপাশি বাড়ি বলে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বটা খুব গভীর।
রণিতকে কোনদিন পিসির কথা বলতে শুনিনি।
যাইহোক, ‘গীতার মা’ নামের রহস্যটা
খুঁজে বের করতেই হবে। এই পণ করে আড়াল
থেকে দু'জনের কথা শোনার জন্য আড়ি পাতলাম। বিশ্বম্ভরবাবু দিম্মার
কাছে এসে বললেন
- কেমন আছ গীতারমা।
- দিম্মা মাথা নাড়িয়ে, ভালই আছি। তুমি কেমন আছ
ঠাকুরপো? কতকাল পর চরণের ধুলো পড়লো এবাড়িতে। আমার ছোট বোনটি কেমন আছে? তাকে সঙ্গে নিয়ে এলে না কেন?
- আহ! বৌঠান, তোমার আগের অভ্যাস আর গেল
না। উঠানে দাঁড় করিয়েই সব জানতে হবে।
- দিম্মা জিভ কেটে, এসো এসো ভেতরে এসো।
বিশ্বম্ভরবাবু চারদিকে চোখ
ঘুরিয়ে দেখলেন আগের ছনবাঁশের ঘরের জায়গায় টিনের ছাউনি দেয়া পাকা দালান। ছিমছাম ঘর।
খাটের উপর শীতল পাটি বিছানো। পাশেই কাঠের সোফাসেট। দেয়ালে মালা দেওয়া দাদার বড়
একখানা ছবি। খাটের পাশের ছোট টেবিলের উপর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা। মিনিট খানিক
পরে গলা হাঁকিয়ে সঙ্গে আসা ছেলেটিকে বললেন, কিরে মিষ্টির হাঁড়িটা দেয়। গীতারমা লেডিকেনি খেতে খুব ভালবাসে।
দিম্মা মিষ্টির হাঁড়িটা
রেখে বিশ্বম্ভর বাবুর জন্য চা নিয়ে এলেন। চা খেতে খেতে দু'জনের কথায় সব ছেলেমেয়েদের কথা আসলেও গীতা নামটা একবারও
উচ্চারিত হলো না। প্রায় ঘন্টাখানেক গোয়েন্দাগিরির পর ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলাম ঘরে।
অবশ্য একটা কারণও ছিল। দিম্মা সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করে আমার জন্যই নিয়ে আসছিলেন।
এরপরও তক্কে তক্কে ছিলাম কোন কিছু জানা যায় কিনা কিন্তু ঘুমানোর আগে পর্যন্ত শুধু
গীতারমা ডাকটাই শুনলাম।
রণিতের কাছে শুনেছিলাম, এই দাদুর প্রাত:ভ্রমণের অভ্যাস। ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে
দেখলাম রণিতদের বাড়ির সদর দরজা খোলা। বুঝলাম তিনি বেরিয়ে গেছেন। দেরি না করে নিম
গাছ থেকে ডাল ভেঙে চিবোতে চিবোতে আন্দাজে সামনের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম।
পরিশ্রম বিফলে যাওয়ার আগেই দেখি পাড়ার একজনের সঙ্গে কথা শেষে দাদু আবার শুরু করলেন
হাঁটা। পিছু নিলাম। কিছুটা এগিয়ে যেতেই বললেন, 'কী হে ছোকরা, তোমারও প্রাত:ভ্রমণের অভ্যেস আছে নাকি! তা বেশ। তোমার সাথে
গল্প করতে করতে হাঁটা যাবে। কয়েক বছরে গোটা এলাকাটাই কেমন যেন পাল্টে গেছে।' বাড়ির কাছাকাছি আসতেই সাহস করে নানা কথার ছলে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা দাদু, আমি যতদূর জানি রণিতের
বাবারা সাত ভাই। তাদের কোন বোন নেই। তাহলে আপনি দিম্মাকে গীতারমা বলে ডাকেন কেন? তিনি হো হো করে হেসে উঠে বললেন, 'সে অনেক বড় কাহিনী। এখন বলা যাবে না। পরে সময় নিয়ে বলবো।'
পরপর তিনদিন একথা সেকথা
বললেও গীতারমার কাহিনী না বলেই বিশ্বম্ভর দাদু কোলকাতা নিজ বাড়িতে ফিরে গেলেন। আর
আমিও আস্তে আস্তে রূপান্তরিত হয়ে গেলাম গোয়েন্দা থেকে সাধারণ মানুষে।
কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমে
আচ্ছন্ন গোয়েন্দা ছয়মাস পর জেগে উঠলো হঠাৎ রণিতের বড় জেঠাকে ফোনে কথা বলতে শুনে, ‘ঠিক আছে জেঠিমা, আপনার আসার কথা গীতারমাকে
বলে দেবো।’ এবার নিশ্চয় গীতা সম্পর্কে নতুন তথ্য পাবোই। প্রয়োজনে এই মহিলার
কাছাকাছি থাকতে কলেজ কামাই করবো তবু একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বো।
বড় দিম্মাকে দেখার পর থেকে
গোয়েন্দাগিরি একপ্রকার ছেড়ে দেবার উপক্রম। এমন দজ্জাল মহিলা এজীবনে দ্বিতীয়টি আর
দেখিনি। একটা কথার জবাবে দশটা উত্তর দেন। শুনেছিলাম একজন মহিলা প্রতিদিন প্রায় ষোল
হাজার শব্দ ব্যবহার করেন কথা বলতে। এই মহিলা তার তিন গুন শব্দ ব্যয় করেন। না জানি
গীতা নাম শুনা মাত্রই কীসব বলবেন। তবে একটা জিনিস ভাল। আসার সময় সঙ্গে একটা
জ্যান্ত পাঠা নিয়ে এসেছেন। এটার মাংস খেতে মন্দ লাগবে না।
আমি টুনি চার মামা চার মামি
বাচ্চা কাচ্চা সহ মোট একুশ জন একসাথে খেতে বসেছি। বড় দিম্মাই সবাইকে খাবার পরিবেশন
করছেন আর হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছেন বাড়ির দিম্মা। রণিতের পাতে মাংস কম দেখে বড়
দিম্মা বললেন, গীতারমা মাংসের বাটিটা দাও তো। ওমনি টুনি খাওয়া বন্ধ করে বড়
বড় চোখে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে বড় দিম্মা রাসভারি গলায় বলে উঠলেন, কীরে টুনি, খাচ্ছিস না যে। রান্না ভাল
হয়নি?
টুনি-হ্যাঁ, খুব স্বাদ হয়েছে। রান্নার কথা না। আমি ভাবছি অন্য কথা।
বড় দিম্মা - তাহলে কি? খাওয়া ছেড়ে কী এত ভাবছিস। তাড়াতাড়ি খাবার শেষ কর।
টুনি-গীতাদিকে তো কোনদিন
দেখলাম না। দেশের বাইরের তিন মামাও মাঝে সাজে আসেন। গীতাদি তো একবারের জন্যও এল না।
বড় দিম্মা - গীতাদি আসবে
কীভাবে। থাকলে তো আসবে।
আমতা আমতা করতে করতে আমিও
জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, থাকলে মানে, গীতাদির কি হয়েছে?
হঠাৎ ঘরময় নিরবতা নেমে এল।
পিন পড়ার মতো। সেই নিরবতায় আমার ভিতরকার গোয়েন্দার যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিল। কয়েক
মুহূর্ত পর বড় দিম্মা হা হা হা.. করে হাসতে হাসতে বলে উঠলেন, তোদের গীতাদির তো জন্মই হয়নি। আসবে কী করে। কথাটা শুনে আমার
হাত থেকে যে কখন ভাতের গ্রাস পড়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। কান ছাড়া বাকি শরীর অসাড়, স্থানুবৎ। তিনি এবার কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে বলতে শুরু করলেন, আমাদের দাদাশ্বশুর আমার মেয়ের
জন্মের পর থেকে আমাকে ডাকতেন রীতারমা। তোদের এই দিদিমা মানে সৌদামিনী বিয়ে হয়ে
আসার পর দিদিশাশুড়ি বাড়িতে না থাকাতে দাদাশ্বশুর কোনো স্বর্নলংকার দিতে পারেননি।
তার বদলে সৌদামিনীর হাতে ভগবত গীতা তুলে দিয়ে বলেছিলেন ‘আজ থেকে নিজের সন্তানের
মতো আগলে রাখবে। দেখবে একদিন গীতা মানবী রূপ ধারণ করে তোমার কোলে আসবে।‘ একথা শোনার পর থেকে সবাই সৌদামিনীকে ডাকতে শুরু করে
গীতারমা বলে। প্রথমে আড়ালে আবডালে। তারপর প্রকাশ্যে। কিন্তু সাত পুত্র সন্তানের
জননীর ঘরে কোন কন্যা সন্তানের জন্ম হয়নি। মানে, গীতা এ ঘরে মানবী রূপ ধারণ
করে আসেনি। আমরা পাঁচ জা। আমি রীতারমা, সৌদামিনী গীতারমা, পরের জন সীতারমা, তার পরের জন মীতারমা এবং
সবচেয়ে ছোটোজন হীতারমা। গীতা ছাড়া বাকি সবাই আছে। দাদাশ্বশুর গীতাকে না দেখার
আক্ষেপ নিয়েই চলে গেছেন। তাই তাঁর ইচ্ছেকে সম্মান জানাতে আমরা গীতাকে বাঁচিয়ে
রেখেছি। কী গো, গীতারমা, আমি কি কিছু ভুল বললাম? সাত ছেলে থাকতে কারোর নামে না ডেকে আমার দেবরও তো তোমাকে
গীতারমাই ডাকতো। লজ্জায় দিম্মা আঁচলে মুখ ঢেকে নিয়েছে দেখে বড় দিম্মা এক ধমক দিয়ে
বললেন, তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর তোরা। আমাদের কী ক্ষুধা তৃষ্ণা নাই
নাকি।
রাতে বারান্দায় পায়চারি
করছিলাম। ঘুম যেন চোখে আসতেই চাইছিল না। বার বার মনে হচ্ছিল, কী সাংঘাতিক ঘটনা। যার জন্মই হয়নি। যে মেয়েকে চোখে দেখেনি
তার নাম ধরে কীভাবে কাউকে সম্মোধন করা যায়। আর আমি শুধু ভেবে গেছি গীতা নামের
মামাদের দিদি বা বোন মারা গেছে। এর বাইরে যে কোনো ঘটনা থাকতে পারে ভাবতেই পারিনি।
সকালে কলেজে যেতে হবে মনে
পড়তেই শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম বিছানায়। স্বপ্নে দেখলাম গীতারমা তাচ্ছিল্যের সুরে
বলছেন, তোকে দিয়ে আর যাই হোক গোয়েন্দাগিরি হবে না তারচেয়ে বরং
পড়াশোনাটা মন দিয়ে কর।