গল্প । বৈশাখ ১৪৩২


সইকন্যা


সবিতা রায় বিশ্বাস

নদীয়া, পশ্চিম বঙ্গ



 

তুতুলের মামার বাড়িটা কুমারী নদীর ধারে। নদীটা আগে ওর মামাবাড়ি থেকে অনেকটা দূরে ছিল, কিন্তু প্রতি বছর একটু একটু করে এগোতে এগোতে বাড়িটার একেবারে কাছে চলে এসেছে। 

    বাড়ির সামনে ফুলের বাগান, তারপরে কংক্রিটের রাস্তা পার হলেই নদীর ঘাট সিঁড়ি নেমে গেছে জলের মধ্যে, রাত্রে সব শব্দ থেমে গেলে শোনা যায় জলের ছলাত্ ছলাত্ শব্দ আছড়ে পড়ছে সিঁড়িতে খুব বৃষ্টি হলে নদীটা উঠে আসে তুতুলের মামাবাড়ির বাগান সে যে কি মজা! মাছগুলো খলবল করে, ঝুড়ি চাপা দিয়ে বাগানের মালি বলাই দাদু কত্ত মাছ ধরে, হাত দিয়েও ধরা যায়!

কিন্তু জল কমে গেলে মাছগুলো বেশির ভাগই পালিয়ে যায় নদীতে তুতুলের দিদুন যেবার নতুন বউ হয়ে এবাড়িতে এসেছিল, সেবারও অনেক মাছ ঢুকে পড়েছিল বাগান দিদুনের খুব ইচ্ছে করছিল সবার মত মাছ ধরতে, কিন্তু নতুন এসেছে তাই সাহস করে মাছ ধরতে পারছিলনা কিন্তু এত মাছ দেখে আনন্দে ভয় ভুলে নেমে পড়েছিল বাগানে কিন্তু মাছ ধরা কি অতই সোজা! এই মনে হচ্ছে দুই হাতের মধ্যে ধরে ফেলেছে কিন্তু পুঁটি মাছগুলো পর্যন্ত খুব চালাক, পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে অনেক লাফালাফি করে, আছাড়-টাছাড় খেয়ে দিদুন একটা ছোট্ট পোনা মাছ ধরেছিল

মা! মাছটা কি বলেছিল জানো, ‘নতুন বউ, মামনি আমায় ছেড়ে দাও না গো, আমি মায়ের কাছে যাব এখন আমি তো খুবই ছোট, আমার গায়ে মাংসও নেই আমাকে ভেজে খেতেও ভালো লাগবেনা

এই কথা শুনে দিদুন মাছটাকে ছেড়ে দিয়েছিল আর মাছটা যাবার আগে বলে গিয়েছিল, ‘নদীতে স্নান করতে গেলে আমি তোমার সাথে দেখা করতে আসবো তুমি ফিসফিস করে আমায় ফিসু বলে ডেক

তুতুল, মিতুল, বিল্টু, বুবাই সবাই বলল, ‘তারপর কি হল দিদুন? সত্যি সত্যি ফিসু তোমার সাথে দেখা করেছিল?” 

করেছিল কি রে? এখনো আমার সাথে দেখা করতে আসে আমি তোদের দাদুকে বলে ওর নাকে একটা সোনার নথ পরিয়ে দিয়েছি যাতে ভুল করে জেলেদের জালে ধরা পড়লে ওকে ছেড়ে দেয়

দাদু এসে বলল, ‘কি গো গিন্নী, নাতি নাতনিদের রূপকথার গল্প শোনাচ্ছ বুঝি!’

বিল্টু বলল, ‘তোমার সাথে খেলবো না দিদুন, তুমি আমাদের গল্প বলছ? ধ্যাত্ আমি ভাবলাম একদম সত্যি কথা

শুধু তুই একা কেন? আমরাও তাই ভেবেছিলাম!’

আচ্ছা তোরা দাদুর কথা বিশ্বাস করবি না আমার কথা! ফিসু তো আমায় দেখা দেয়, আমার সাথে গল্প করে! ঠিক করে বল, ফিসুকে দেখতে চাস তোরা?’

চাই, চাই আমরা সবাই ফিসুকে দেখতে চাই, ওর সাথে গল্প করতে চাই

বেশ! তাহলে আজ রাতে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড় কেননা মাঝরাত্তিরে চাঁদ যখন ঠিক মাথার উপর আসবে আমি চুপি চুপি তোদের নিয়ে যাব নদীর ঘাটে ফিসুকে দেখতে হলে ওটাই ঠিক সময় কি সবাই রাজি তো!’

রাজি মানে? আমরা সবাই রাজি, বলেই দুদ্দাড়িয়ে ছুটল রান্নাঘরে ওদের দেখে রাঁধুনি মাসি অবাক! ‘কি ব্যাপার, আটটা না বাজতেই খেতে চলে এসেছো! অন্যদিন তো রাত দশটাতেও ডেকে ডেকে আনা যায়না, এমন গল্পে মশগুল থাকো কিন্তু এখনো তো তোমাদের প্রিয় চিকেন কষাই হয়নি

তুতুল বলল, ‘আমাদের ঘি আর আলুসেদ্ধ দাও আর কিচ্ছু লাগবেনা

ওদের কলকল শুনে মা-মাসিরাও চলে এসেছেকি মতলব বলতো! সব্বাই লক্ষ্মীছানা পক্ষী হয়ে গেলি কোন জাদুমন্ত্রে?’

বিল্টু মুখ ফসকে বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মিতুল ওর হাতে চিমটি কেটে সাবধান করে হেসে বলল, ‘না গো মাসি, কোনো মতলব নেই দুপুরে বাগানে খুব ছোটাছুটি করেছিলাম, তাই ঘুম, খিদে দুটোই পেয়ে গেছে

তুতুলরা পুজোর সময় মামাবাড়ি এলে সবাই দাদুকে হঠিয়ে দিদুনের পালঙ্কের দখল নিয়ে নেয় আজকেও মাঝখানে দিদুনের জন্য জায়গা রেখে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল প্রথমে ভেবেছিল ঘুমোবে না, কিন্তু দিদুন বলেছে না ঘুমালে সবাই বুঝে যাবে তো!

তারপর চাঁদ যখন ঠিক মাথার উপর, সারা আকাশ জুড়ে তারার চুমকি ঝলমল করছে, তার মধ্যে একটি দুটি তারাকে মনে হচ্ছে কোহিনূর হিরে, সেই সময় ওরা দিদুনের আঁচল ধরে বাগান পেরিয়ে সদর দরজা খুলে চলে এল কুমারী নদীর ঘাটে দিদুনদের ভুলি তো রাত জেগে বাড়ি পাহারা দেয়, শব্দ না করে পিছন পিছন এল

মা! নদীটা রাতে যে কি সুন্দর দেখাচ্ছে! কত ময়ুরপংখী নৌকা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বৈঠার ঘায়ে জল যেন রুপোর মত হেসে উঠছে আচ্ছা, দিনের বেলায় তো কোনদিন এই নৌকো দেখেনি! মিতুলের মনে এই প্রশ্নটা এলেও দিদুনের কথামত মুখ চেপে রাখলো দিদুন ঘাটে বসে জলে পা ডুবিয়ে ফিসফিস করে ডাকলো, ‘ফিসু ফিসু কোথায় গেলি?’

অমনি দিদুনের পায়ের কাছে ভেসে উঠলো একটা মিষ্টি মেয়ে, তার নাকে ঝুলছে সোনার নথ সে তার মিষ্টি বাঁশির মত স্বরে বললো, ‘মামণি এখন বুঝি তোমার আসার সময় হল? আমি সেই কখন থেকে তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছি তুমি জানো, একটা দুষ্টু লোক রোজ রাতে চুপি চুপি আসে আমাকে ধরার জন্য ভুলির তাড়া খেয়ে পালিয়ে যায়

আরে! তো একটা মেয়ে দিদুন যে বললো মাছ! তুতুলরা যখন এই কথা মনে মনে ভাবছে, ফিসু বলল, ‘কি হল? অবাক হলে বুঝি!’ এই বলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, ওরা চোখ গোলগোল করে দেখল যে মত্স্যকন্যা! উপরের অংশ মিষ্টি মেয়ে হলেও নিচের অংশ মাছের মত গায়ের আঁশে রামধনু রঙ, কি অপূর্ব যে লাগছে! ওদের খুব ইচ্ছে করছে ফিসুর গায়ে হাত বুলোতে, কিন্তু দিদুন না বললে কি হাত দেওয়া যায়?

মত্স্যকন্যা ফিসু বলল, ‘মামনি তুমি একটু বোসো, তোমার নাতি নাতনিদের আমি আমার বাড়ি দেখিয়ে আনি দেরি করবো না, যাবো আর আসবো এসো এসো তোমরা আমার পিঠের পরে বোসো

তুতুল, মিতুল, বিল্টু, বুবাই তো হাতে চাঁদ পেলেও এত খুশি হতনা অবশ্য চাঁদটাও ওদের সাথে জলে ডুব দিল

কি মজা! কি মজা! জলের নিচেটা যে এত সুন্দর হতে পারে ওদের কল্পনাতেও ছিলনা ওরা অবশ্য ডিসকভারি চ্যানেলে ছবি দেখেছে, কিন্তু আজ তো ছবি নয়, সত্যি সত্যি ছুঁয়ে দেখতে পাচ্ছে কোরালের বাড়ি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট মাছ বেরিয়ে এসে হাতে হাত মেলালো সবাই ফিসুকে রাজকুমারী বলে ডাকছিল আর মাথা নীচু করে সম্মান জানাচ্ছিল

আচ্ছা, দিদুন কেন এলোনা? তাহলে আরো মজা হত! ফিসু কি থট রিডিং জানে! নাহলে বললো কি করে, ‘মামনি তো প্রায়ই আমাদের প্রাসাদে আসে আমার মায়ের সাথে মামনি সই পাতিয়েছেমাছপাতাসই তোমরা বাঁশপাতা মাছ দেখেছো? সেইরকম, বুঝলে?’

জলের নিচে আলো ছিল, লন্ঠন মাছ, ইলেকট্রিক মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাই সবকিছু ভালোই দেখা যাচ্ছিল কিন্তু ফিসু যেখানে এসে থামলো, সেই জায়গাটা দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলের থেকেও বেশি আলো আরে বাপরে! জলের নিচে এত বড় রাজপ্রাসাদ? তুতুলদের দেখেই দ্বাররক্ষী মাছেরা শঙ্খ বাজিয়ে দিল শাঁখ তো ওদের সবার বাড়িতেই আছে, সন্ধ্যেবেলা মা রোজ বাজায় কিন্তু এত বড় শাঁখ ওরা কস্মিনকালেও দেখেনি

এরপরে যা হল! মত্স্যকন্যারা এসে বরণ করে রানী মানে ফিসুর মায়ের কাছে নিয়ে গেল ফিসু আর কি দেখতে! ওর মা অপূর্ব সুন্দরী, মিষ্টি করে ওদের সাথে কথা বললেন, ‘তোমরা আমার মাছপাতা সইয়ের নাতি-নাতনি মানে আমারও নাতি-নাতনি বলো আমাদের রাজ্য তোমাদের কেমন লাগছে? ওরা সবাই একসাথে বলল, ‘খুব খুব সুন্দর আমরা এসব কোনোদিন দেখিনি, মাছদিদুন তুমি কি সুন্দর দেখতে বিল্টু বলল, ‘খুব ভুল হয়ে গেছে রে! মোবাইল নিয়ে এলে মাছদিদুনের সাথে একটা সেলফি তুলতাম, বন্ধুদের দেখাতাম, দারুন মজা হত

ফিসুমাসি বলল, ‘এই হয়েছে তোমাদের এক ফ্যাশন! মনে রেখে খাতায় ছবি আঁকবে, যার ছবি খুব ভালো হবে, নিঁখুত হবে সে আরেকদিন আমাদের রাজ্যে আসতে পারবে কি রাজি তো!’

এরপরে মস্ত বড় ধবধবে সাদা স্ফটিকের ডাইনিং টেবিলে বসে ওরা খাওয়া-দাওয়া করল কি দারুন প্লেট, বিশাল বড় ফুলের মত সাদা ঝিনুকের প্লেট, আর রান্নাগুলোর কি নাম! কিমচি জিগগে, বুল্গোগী, তাকিকমই গোহান এই সব নাম যাকগে বাবা নাম দিয়ে কি হবে? খেতে খুবই টেস্টি, তুতুল বুঝতে পেরেছিল, জলের তলায় তো গ্যাস ওভেন নেই, তাই বিভিন্ন রকম মাছ বা জলের প্রাণী মশলার সাথে মিশিয়ে খেতে দিয়েছে চীনে যেমন সুইফট পাখির বাসা দিয়ে রান্না করা স্যুপ খুব জনপ্রিয় আসলে ওগুলো পাখির লালা ওরা যখন খাচ্ছিল মাছ দিদুন এইসব গল্প করছিলেন আচ্ছা মাছ দিদুন থাকে জলের তলায় তাহলে এসব খবর জানে কি করে?

বিল্টু খুব বুদ্ধিমান, বুবাইকে বলল, ‘রানী হওয়া কি অতই সোজা! সব খবর রাখতে হয়কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, দিদুন নিশ্চয় খুব চিন্তা করছে, আবার চাঁদ ডুবে গেলে পথ চিনে ফেরা মুশকিল! এবার তো ফিসু ওদের সাথে যাবেনা মাছ দিদুন ওদের সকলকে একটা উপহার দিয়ে বিদায় জানাল বললো, ‘এখন হাত খুলবেনা কাল সকালে দেখবে আমি কি উপহার দিলাম সেটাকে কানের কাছে নিলে নদীর জলের শব্দ শুনতে পাবে

সকালবেলা তুতুল, মিতুল, বিল্টু, বুবাই অবাক হয়ে দেখল, ওরা সবাই দিদুনের পাশেই শুয়ে আছে আচ্ছা মত্স্যপুরী থেকে কখন ফিরল ওরা? এটা তো কিছুতেই মনে পড়ছে না তবে সবার হাতের মুঠোর মধ্যে একটা করে ছোট্ট ছোট্ট শাঁখ হ্যাঁ মনে পড়েছে, মাছ দিদুন বলেছিল সকালে হাত খুলতে

সবাই আস্তে আস্তে উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে বসে গেল ছবি আঁকতে

কেন কি গো? এর মধ্যেই ভুলে গেলে? যার ছবি সব থেকে ভালো হবে তাকে ফিসু আবার নিয়ে যাবে অতএব এটা একটা চ্যালেঞ্জ ওদের কান্ড দেখে দাদু বলল, ‘দিদুন তাহলে ভালোই ব্রেন ওয়াশ করেছে| তোদের ভাগ্য খুব ভালো, রূপকথার দেশ ঘুরে এসেছিস!

তাহলে আজ সকালেই হয়ে যাক মালপোয়া যার ছবি সব থেকে ভালো হবে সে দুটো মালপোয়া বেশি পাবে

কি তোমরাও যাবে নাকি তুতুল-মিতুলদের মামার বাড়ি, কুমারী নদীর পারে দিদুনের গল্পের ঝুলিতে কি শুধু মত্স্যকন্যা ফিসু আছে নাকি! সেই ঝুলিতে আছে নীলকুমার, আগডুম বাগডুম রাজকুমার, কঙ্কনকন্যা কাঞ্চনকুমারী আরো কত

তাহলে আর দেরী কেন? পরীক্ষা হয়ে গেলেই চলো কুমারী নদীর পারে কমলপুরে মত্স্যকন্যা ফিসুকুমারীর সাথে দেখা করতে