গল্প । জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২



পরমাত্মীয়





কৌশিক গুপ্ত

কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ



 

এই  ঝড় জলের রাতে দাদুর এমন চোখ মুখের অবস্থা আর দাদুকে এমন অস্বাভাবিকভাবে ঘামতে দেখে নীলু ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেলো।

দাদুকে যে এখুনি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে সেটা বুঝতে পারছে  কিন্তু এতো রাতে এই দুর্যোগের মধ্যে কিভাবে সেই কাজটা করবে সেটাই ঠাহর করে উঠতে পারলো না  বাড়িতে গাড়িও আছে কিন্তু যে গাড়ি চালাতে পারে সেই রতন কাকু যে বাড়িতে নেই  নীলু আর দাদু ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই  সল্টলেকের এই বিশাল বাড়ির আশপাশের বাড়িগুলোর অধিকাংশই খালি পরে আছে তাই সেখান থেকে কোনো সাহায্য পাওয়ার আশা করা বৃথা আর যেগুলোতে লোক থাকে সেখান থেকে সাহায্য আশা না করাই ভালো এখানে প্রতিবেশীরা কেউ কারো সাথে কথাই বলে না ভালো করে ভালো করে চেনেই না কেউ কাউকে নীলু কি করণীয় সেই চিন্তা করতে থাকে দ্রুত তার ১৪ বছরের মস্তিষ্ক এবং মন বলছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাদুকে হসপিটালে নিয়ে যেতেই হবে না হলে বড়ো কোনো অঘটন ঘটে যাবে দাদু কিছু বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছেনা ব্যাথার জন্য মুখচোখ বিকৃত করে বুকের বাঁ দিকটা খামচে ধরে আছে

নীলুর ভালো নাম নীলাঞ্জন ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠেছে সবে ওর একটা ছোট বোন আছে তার নাম ঝিনুক ক্লাস থ্রিতে পড়ে বোন আর মাকে নিয়ে ওদের সংসার সল্টলেকের সেক্টর লাগোয়া এক বস্তির ছোট্ট এক ঝুপড়িতে ওদের বাস নীলুর বাবা ওর ছোট বয়সেই মারা যায় আর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তার মা সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয় ছেলে মেয়েদের মানুষ করা থেকে তাদের পড়াশুনা খরচ জোগাড়, অন্নের সংস্থান করা সব কিছু তাকেই করতে হতো সল্টলেকেরই বাসিন্দা অমিয় চন্দ্র দত্তের বাড়িতে সে পরিচারিকার কাজ করতো যখন সে অমিয় বাবুর বাড়িতে কাজে নিযুক্ত হয় তখন ওনার শ্রী জীবিত ছিলেন তাও বছর আষ্টেক আগের কথা অমিয় বাবু তখন সদ্য রিটায়ার করেছেন নেভির বড়ো অফিসার ছিলেন উনি ফলে অর্থের কোনো অভাব ছিল না ওনাদের এক ছেলে আর এক মেয়ে, দুজনেই বিদেশে থাকে, ওখানেই সেটেল্ড বছর দুই তিনেক অন্তর একবার করে বাবা মায়ের সাথে এসে দেখা করে যায় তারা এটাকেই তারা বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন বলে মনে করে

সল্টলেকের এই বিশাল বাড়ির বাসিন্দা হলো দুই বুড়োবুড়ি আর তাদের সর্বক্ষণের কাজের লোক কাম ড্রাইভার রতন একজন কাজের লোক আছে ঝর্ণা যে রোজ এসে ঘর সাফাই, বাসন মাজা ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজগুলো করে দিয়ে যায় এইভাবেই চলছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন অমিয়বাবুর স্ত্রীর কিডনির কঠিন অসুখ ধরা পড়লো এতদিন অমিয়বাবুর স্ত্রীই রান্না বান্নার কাজ করতেন আর অমিয়বাবুও অন্য কারোর হাতের রান্না খেতে পছন্দ করতেন না ফলে রান্নার লোক কোনোদিনই এই বাড়িতে ছিল না কিন্তু অসুখ ধরা পড়ার পর থেকে অমিয়বাবুই তাঁর স্ত্রীকে আর রান্নাবান্নার কাজ করতে দিতে চাইলেন না বাড়িতে নিত্য দিনের কাজের মহিলা ঝর্ণার মাধ্যমেই খোঁজ পেলেন নীলুর মায়ের নীলুর মায়েরও সেই সময় একটা কাজের খুব প্রয়োজন ছিল কারণ সদ্য স্বামীকে হারিয়ে কিভাবে সংসার চলবে সেই চিন্তায় তার রাতের ঘুম উড়ে গেছিলো ফলে অমিয়বাবুর বাড়িতে রান্নার কাজটা পেয়ে নীলুর মা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো প্রথমে দুবেলা রান্নার কাজ করতে যেতে হতো কিন্তু ঝর্ণা হঠাৎ কাজ ছেড়ে দেওয়ায় রান্নার সাথে ঘরের অন্যান্য কাজের দায়িত্বও ধীরে ধীরে নীলুর মায়ের ওপর এসে পড়লো যদিও নীলুর মা তার জন্য যথেষ্ট পারিশ্রমিক পেতো যা দিয়ে তার সংসারটাও ঠিকঠাক চলে যেত আসলে নীলুর মায়ের কাজ খুব পছন্দ হয়ে গেছিলো অমিয়বাবুর স্ত্রীর নীলুর মা প্রতিদিন সকালে গিয়ে কাজকর্ম করে দিয়ে দুপুরের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতো। আবার বিকেলের দিকে গিয়ে বিকেলের টুকটাক কাজগুলো করে দিয়ে আসতো তাদের বস্তি থেকে অমিয়বাবুর অট্টালিকা খুব বেশি দূরে ছিল না 

প্রথম দিন থেকেই নীলুর মায়ের বৃদ্ধ বৃদ্ধা দুজনকে বড়ো আপন মনে হয়েছিল তার মা বাবা বেঁচে থাকলে এনাদের মতোই বয়স হতো ফলে সব কাজকর্ম খুব যত্ন নিয়ে করতো সে আর এইভাবেই ধীরে ধীরে নীলুর মা পরিবারের প্রায় একজন হয়ে উঠলো অমিয়বাবুর স্ত্রীও ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকলেন ওনার ডায়ালিসিস চালু হলো হার্টের সমস্যা থাকায় কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব ছিল না ওনার বছর তিনেক আগে অমিয়বাবুর স্ত্রী চলে গেলেন বৃদ্ধ অমিতবাবু একেবারে একা হয়ে গেলেন ওনার স্ত্রী চলে যাওয়ার আগে নীলুর মাকে বলে গেছিলেন- তোর বাবুকে দেখিস খেয়াল রাখিস একটু বড়ো ভুলো মনের মানুষ উনি মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে অমিয়বাবুর ছেলে আর মেয়ে বিদেশ থেকে আসে সেই সময় অমিয়বাবুর ছেলে অনিন্দ্যর এক ছেলে আর মেয়ে তিয়াসার এক মেয়ে নিলুও গেছিলো সেই কাজে নীলুর বয়োস তখন এগারো নীলু খেয়াল করেছিল দাদুর নাতি নাতনিরা শুধু ইংরেজিতে কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে বাড়িতে যে একটা শোকের অনুষ্ঠান চলছে সে বিষয়ে তাদের কোনো নজরই নেই খারাপ লেগেছিলো নীলুর কিন্তু কিছু বলার ছিল না তার সে খেয়াল করেছিল দাদু খুবই অন্যমনস্ক, উদাস হয়ে আছে দাদুর এমন অবস্থা দেখে দুঃখ পেয়েছিলো সে স্ত্রীকে হারিয়ে অমিয়বাবু ভেঙে পড়েছিলেন খুব বেশ কিছুদিন কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন এমনকি নিজের ছেলে মেয়ে নাতি নাতনিদের সাথেও তেমন একটা কথা বলেন নি আর নাতি নাতনি গুলো সেই শোকের মুহূর্তেও যেভাবে হাসি তামাশা করছিলো সেটা ওনার মোটেই ভালো লাগে নি যাইহোক সময়ের সাথে সাথে ওনার শোক কিছুটা লাঘব হলো নীলুর মা সাধ্য মতো অমিয়বাবুর সেবা করতো একদিন অমিয়বাবু বললেন – ‘তোর ছেলেকে কাজের দিন দেখলাম খুব লাজুক না? কিসে পড়ে? নীলুর মা বলে - ক্লাস সিক্সে উঠলো অমিয়বাবু বললেন – ‘বাঃ খুব ভালো ওকে মাঝে মাঝে নিয়ে আসিস গল্প করা যাবে ওর সাথে সেই থেকে মাঝে মাঝে নিলুও ওর মায়ের সাথে এই বাড়িতে আসতে শুরু করলো ধীরে ধীরে অমিয়বাবুর সাথে নীলুর বেশ ভালো সখ্যতা হয়ে গেলো অমিয়বাবু তার অভিজ্ঞতার কত ঘটনা নীলুকে গল্পের মতো করে শোনাতো আর নীলু হাঁ করে সেইসব গল্প প্রায় গিলতো নীলুর মতো শ্রোতাকে পেয়ে অমিয়বাবুও মন খুলে কত কথাই না বলে যেতেন এইভাবে সময়ের সাথে সাথে স্ত্রী মৃত্যুর শোক অনেকটাই ভুলে গেলেন তিনি রতন যখন মাঝে মাঝে তার দেশের বাড়ি যেত তখন রাত্রিবেলা নিলুই অমিয় বাবুর কাছে থেকে যেত দাদুকে খেতে দেওয়া, ওষুধ দেওয়া সব নিলুই করতো এইভাবে বেশ ভালোই চলছিল কিন্তু মাস ছয়েক আগে নীলুর মা হঠাৎ ব্রেনস্ট্রোক হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে গেলো ডাক্তার বললো আবার নরমাল অবস্থায় ফিরতে তার অন্তত বছর দুয়েক সময় লাগবে। দাদুর সামনে কথাটা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল নীলু অমিয়বাবু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন-এই অবস্থায় কান্নায় ভেঙে পড়লে হবে না নীলু এখনতো তোকে শক্ত হতে হবে পরিস্থিতির সাথে লড়তে হবে এরই নামতো জীবন নীলু দাদুর কথাগুলোয় নীলু মনোবল ফিরে পেয়েছিলো ঠিক হলো যতদিন নীলুর মা আবার আগের মতো হয়ে কাজে ফিরে না আসছে ততদিন দাদু তার বেতন দিয়ে যাবেন শুধু তাই নয় নীলুর মায়ের চিকিৎসার জন্য যা খরচ হবে সমস্ত উনিই দেবেন পরিবর্তে নীলুকে মাঝে মাঝে এসে দাদুর সাথে গল্প করে যেতে হবে দাদুর প্রতি নীলুর প্রথম থেকেই ভক্তি ছিল অগাধ কিন্তু ওনার এমন সিদ্ধান্তে নীলু দাদুর প্রতি ঋণী হয়ে গেলো যেন নিজের পড়াশুনা, মা আর বোনের দেখাশুনা করে ঠিক সময় বার করে প্রতিদিন একবার করে দাদুর সাথে দেখা করে আসতো এর মধ্যে রতনদাকে কয়েকদিনের জন্য দেশের বাড়ি যেতে হলো ঠিক হলো নীলু এই কয়েকদিন রাতে দাদুর সাথেই থাকবে সেইমতো রাতে মায়ের দায়িত্ব বোনের ওপর ছেড়ে দিয়ে অমিয়বাবুর কাছে চলে আসতো  অমিয়বাবুও নীলুকে পেলে খুশি হতেন খুব যদিও বাড়িতে অনেকগুলো ঘর আছে তবুও নীলু অমিয়বাবুর ঘরেই মাটিতে বিছানা করে শুতো অমিতবাবু বারণ করা সত্ত্বেও শুনতো না ওনাকে ওষুধ দিয়ে ওনার খাটের পাশেই নিজের বিছানা পেতে শুয়ে পড়তো দাদুর কাছে গল্প শুনতে চাইতো দাদু ঘুম না আসা পর্যন্ত কত রকমের গল্প বলে যেত ওকে 

আজকেও সেই রুটিনেই চলেছিল নীলু সকাল থেকেই মেঘলা করেছিল বৃষ্টিটা নামলো রাত এগারোটার দিকে সাথে তুমুল হওয়া আর মেঘের গর্জন। দাদু তখন ঘুমিয়ে গেছে  নিলুরও আজকে অনেক খাটাখাটনি গেছে তাই সেও বেশিক্ষন জেগে থাকতে পারলো না অন্য দিন হলে দাদু ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সে নাইট ল্যাম্প জ্বেলে পড়াশুনা করে  কিন্তু আজকে তার চোখদুটো ঘুমে জড়িয়ে এলো  মাঝরাতে জলের গ্লাস মাটিতে পড়ার আওয়াজ শুনে তার ঘুমটা ভেঙে গেলো  ঘরে আলো জ্বালিয়ে সে দাদুকে দেখে রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলো দাদু বিছানায় উঠে বসেছে চোখমুখ ব্যাথায় কুঁচকে গেছে। বা হাতটা বুকের সামান্য বাঁ দিকে খামচে চেপে ধরা সম্ভবত পাশের টেবিলে রাখা গ্লাসটা থেকে জল খেতে গেছিলেন  কিন্তু ওটা পরে যায়  নীলু দুএকবার জিজ্ঞেস করলো দাদু কি হয়েছে তোমার? দাদু কিছু বলতে গেলেন কিন্তু বলতে পারলেন না কিছু দর দর করে ঘামছে দাদু কি করবে চিন্তা করতে করতে নীলুর মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেলো দাদুর মোবাইলটা নিয়ে বাড়িতে ফোন করলো বাড়ির সাথে যোগাযোগের জন্য একটা পুরোনো ফোন বাড়িতে রাখা থাকে  প্রথমে বেজে গেলো কেউ ধরলো না  দ্বিতীয়বার বাজতে তার বোন ফোন ধরলো  জড়ানো গলায় হ্যালো বলতেই নীলু তাকে নির্দেশ দিলো দ্রুত ফোনটা নিয়ে পাশের বাড়ির নিতাই কাকার বাড়ি যেতে  নিতাই কাকা অটো চালায় তার ছেলে নীলুর সহপাঠী  নীলুর নির্দেশ পেয়ে তার বোন ফোনটা নিয়ে পাশেই নিতাই কাকুর ঝুপড়ির দরজায় গিয়ে করা নাড়লো কয়েকবার করা নাড়তেই নিতাই কাকু ঘুমজড়ানো চোখে বেরিয়ে এলো নিতাই কাকার হাতে ফোন দিয়ে নীলুর বোন বললো-কাকু দাদা একবার তোমার সাথে কথা বলবে নিতাই কাকা ফোনটা কানে দিতেই নীলু দাদুর অবস্থার কথা তাকে জানালো এবং বললো একবার তার অটোটা নিয়ে দাদুর বাড়ি আসতে নিতাই কাকা বাইরের দুর্যোগের দিকে একবার দেখে নিয়ে বললো – ‘এই অবস্থায় কি ভাবে যাই নীলু নীলু প্রায় কান্নার সুরে বললো কাকু দাদুর অবস্থা আমার একেবারেই ভালো মনে হচ্ছে না ওকে এখুনিই হসপিটালে না নিয়ে গেলে বড়ো কোনো অঘটন ঘটে যাবে তুমি দয়া করো একটিবার এস কাকু  নীলুর এমন কাকুতিভরা আবেদনে সারা না দিয়ে পারলো না নিতাই কাকা। একটা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো অটোতে উঠে স্টার্ট দিলো

সেই রাতেই দাদুর অপারেশন করতে হলো ডাক্তার বললেন আরেকটু দেরি করলে আর বাঁচানো যেত না অমিয়বাবুকে ম্যাসিভ হার্ট এটাক হয়েছিল ওনার খবর পেয়ে রতন ফিরে এলো পরদিন সে অমিয়বাবুর ছেলে আর মেয়েকে ফোন করে বাবার অবস্থার কথা জানালো কিন্তু দুজনেই  জানালো আপাতত তারা দেশে আসতে পারবে না আর বাবা যখন ঠিক আছে তখন দেশে ফেরার প্রয়োজন আছে বলে মনে করলো না তারা ফোনে বাবার সাথে কথা বলে নিয়ে তারা তাদের দায়িত্ব সারলো অমিয়বাবু ছেলে মেয়ের এমন ব্যবহারে কষ্ট পেলেন না কারণ উনি জানতেন এরকম হওয়ারই ছিল হসপিটালে উনি একদিন নীলুকে কাছে ডেকে তার গালটা টিপে দিয়ে বললেন তুই কি করে বুঝলি আমাকে ওই সময় হসপিটালে ভর্তি করতে হবে? নীলু বললো অনেক সিনেমায় দেখেছি বয়স্ক লোকেরা ওরকম করলে তার হার্ট এটাক হয় আর হার্ট এটাক হলেতো হসপিটালে নিয়ে যেতে হয় ওর কথা শুনে প্রশংসাসূচক হেসে উঠলেন অমিয়বাবু। যেদিন বাড়ি ফিরলেন সেদিনিই উকিলের সাথে যোগাযোগ করলেন। উইলে কিছু পরিবর্তন করতে হবে।