গল্প ২ । শ্রাবণ ১৪৩২


রস ঘনক











কল্যাণ সেনগুপ্ত 

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ


 

প্যান্টের দড়ি কষে বেঁধে, ঘুম চোখে দু চোখ কচলাতে কচলাতে রাস্তার মোড়ে মিষ্টির আর মুদির দোকানের দিকে রওনা  দেয় ভোম্বল। 

এই গরমে ভোর রাতে ঘুমটা এসেছিল জমিয়ে তবু যেতে হবে। দু ঘন্টা ওকে বসতে হবে বাবার দোকানে। বাবা আর কর্মচারী কাকু এলে তেরো বছরের ভোম্বলের ছুটি। তারপর স্নান করে খেয়ে স্কুল। গজগজ করতে করতে সাত সকালে মিষ্টির দোকানের চালা সরাতেই দুচোখ কপালে উঠে যায়।দোকানের তালা  খোলা, ভিতরে গুড়গুড় শব্দ। অর্ধেক দরজা সরাতেই ভূসো কালী মাখা, তেল চটচটে দুটো খড়খড়ে পা এলানো মাটিতেসঙ্গে ভরর, ফো, ভরর, ফো যেন কেটলিতে জল ফুটছেসাত সকালে কেমন ভয় ভয় করে।এ পাশেও পাশে কেষ্ট দার সেলুনমাকু দার পান বিড়ির দোকান এখনো খোলেনি। কি হবে এখনএকটা উটকো চোরনাকি ডাকাতরাস্তা থেকে একটা আধলা তুলে দুর থেকে মারবে নাকিচেহারাটা মনে হচ্ছে জাঁদরেল। এত সাহস আবার বেমালুম ঘুমোচ্ছেএ উত্তেজনা আর নেওয়া যাচ্ছে না। বন্ধ করতে গেলে যদি জেগে গিয়ে ঘ্যাঁক করে ধরে? ভোম্বল কি করবে? বাবা কে খবর দেবেউত্তেজনায় ভোম্বলের কেমন সকালের ডাক এসে যায়

এইযে, এইযে শুনতে পাচ্ছো? কি ঘুম রে বাবা। কুম্ভকর্ণের নাকি? ভোস ভোস করে ঘুমিয়েই চলেছে। দোকান খুলতে হবে। দোকানের মধ্যে এলো কি করে লোকটা? আরেকটু পরে বাবা চলে আসবে। লোকটা লোমশ খালি গায়ে একটা খাটো ধুতি পরে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। ভোম্বল ঘরের কোণে পা টিপে টিপে ঢোকে

গরমে মুনিয়ার মাথার দোষ দেখা দেয়। বর্ষা পড়লেই আবার সব ঠিক ঠাক। দোকানের দরজা টা আলতো ভেজানো। প্রথম মনেহয়েছিল কেউ আছে ভিতরে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ঢুকে পড়ে পা টিপে। ভোম্বল দের মহাকালী মিষ্টান্ন ভান্ডারের সঙ্গে মুদির দোকানে ঢুকে বেদম ক্ষিধে পেয়ে গেল। পাশাপাশি মুদির দোকানের আর মিষ্টির দোকান ছেলে আর বাবার

ভোম্বল এর অমায়িক ডাকে বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে মুনিয়া। মুহূর্তে মগজে ঝিলিক দিয়ে ওঠে এবার কি করা?

চুরি করতে ঢুকেছ? দাঁড়াও ডাকছি লোকজন। আড় ভেঙে দুটো হাত টান টান করে মুনিয়া বলে তোমায় বুঝতে হবে চুরি কাকে বলে। না বলিয়া পরের দ্রব্য নেওয়া কে চুরি বলে। ঠিক কিনা?

আর আমি কি করেছি? ভোম্বল রীতিমত রেগে গনগনে হয়, বাবার দোকানে ঢুকে ঘুমোচ্ছ। আর কিকি খেয়েছ তার কি জানি? দাঁড়াও, বাবা কে ডাকচ্ছি। ওমা! মুনিয়া মাথার চুলগুলো আঙুল দিয়ে পাট পাট করতে করতে বলে একটু দই আর চিঁড়েই তো খেয়েছি। তাই নিয়ে ভাইটির এত রাগ? প্রমাণ করতে পারবে চিঁড়ে আর দই খেয়েছি? দু পা ফাঁক করে গেঞ্জি টান টান করতে করতে খ্যাঁক, খ্যাঁক করে হাসে। পারবে না। কারণ গতকাল বাড়ি যাবার আগে কত দই আর চিঁড়ে ছিল সেটা ওজন করা ছিল না। ঠিক বলছি তো?

থতমত ভোম্বল কথা ঘোরায়

তুমি ঢুকেছ কেন? তার জন্যেই তো দিন সাতেক জেল হবে। এবার কিছুটা সাহস ফিরে পায় মুনিয়া

কান খোঁচাতে খোঁচাতে  হাসতে হাসতে গলা নামিয়ে বলে পিছনের দর্মার দরজা ঠিকমত বন্ধ না করলে আমার দোষ? বলব নাকি তোমার বাবা কে, যে তুমি কাল বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল? ব্যাটা বলে কি? চোরের মায়ের কি যেন বলে? খানিক ব্যাক গিয়ার দেয়। তাই বলে তুমি অন্যের দোকানে ঢুকে তাদের জিনিষ খেয়ে নেবে? কোনো আইন, বিচার নেই দেশেতোমাকে চোর ছাড়া আর কি বলব? তারপর আবার মুখে মুখে তর্ক। দাঁড়াও বাবা কে ডাকছি

ভোম্বল দরজার বাইরে পা বাড়ায়। এই দেখো, এই দেখো রাগ করে। ভাইটি, ভাইটি বলতে বলতে বাইরে এসে হাত ধরে। অমন কাজ টি একদম করোনা। বিপদে পড়লে আমার আবার মাথার ঠিক থাকে না। বলেই দেব যে খোলা ছিল তাই রাতবিরেতে কেউ আছে কিনা খোঁজ নিতে ঢুকেছিলাম। আর মিষ্টি দেখলে নিজেকে সামলাতে পারিনা সেটা তো জানোই। ভোম্বল এর গোঁজ হয়ে ঘাড় গুঁজে থাকাতে মুনিয়া একটু আন্তরিক হয়। ঠিক আছে তাহলে আমিও বলব না তুমিও বলবে না। বুঝলে নটবর। আবার কি? নটবর ও আছে নাকি তোমার সঙ্গে? চারিদিকে তাকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে নটবর কে? কোথায় সে? ঠাট্টা করছিলাম। তবে আছে, আছে। উনিই আমার গুরুদেব। একবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গের মিষ্টির বিপ্লব তো উনিই এনেছেন। নিজেকে বাঁচাতে বেমালুম গুলিয়ে দেয় মুনিয়া। দারুন গুণী লোক। আসলে তোমাদের মিষ্টি খেয়ে দেখছিলাম ওনার মিষ্টির চেয়ে কত টা খারাপ

বলছ কি?

ওনার নামতো তোমাদের জানা উচিত। তুমি না জানলেও তোমার বাবা নিশ্চই জানে। এ রাজ্যের ময়রারাজ। সোনে কি হাত! একবার ওর করা মিষ্টি খেয়ে দেখো, জিভে লেগে থাকবে। ভুলতে পারবে না। কোথায় থাকে নটবর? কত জায়গায় থাকে সেকি বলা যায়? তবে এই মুহূর্তে উনি পাকুরে আছেন নিজেরই একটা দোকানে। পশ্চিম বর্ধমানের এক জমিদারের কিছু জাম্বো রস ঘনক তৈরি করে পাঠাতে হবে তার জন্যে আছেন। রস ঘনক? সেটা কি মিষ্টি? ক্ষীরের না ছানার? নাকি ময়দার? গালে হাত দিয়ে চোখ কপালে তুলে মুনিয়া বলে এমা, রস ঘনক এর নাম শোনো নি? তোমরা তো তাহলে গাঁইয়া শুধু নয় সেকেলেও বটে। বল দেখি

রসগোল্লা দেখেছো? এতো রোজ দেখি। কেমন দেখতে? কেন? বলের মত। এটা জানো না? রস ঘনক হচ্ছে সাদা ছানার কিউব। সোজা কথা গোল্লা নয় কিউব

ভোম্বলের চোখ কপালে উঠে যায়। বল কি রস কিউব? ওই হল। ওনার সাথে দেখা করা যায়? খুব কঠিন। সারা বাংলা জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। বলতে বলতে ভোম্বল এর বাবা দিগম্বর উদয় হয়। কিরে আজ স্কুল ছুটি নাকি? এখনো বাড়ি যাস নি? ভোম্বল দৌড়ে যায় বাবা তুমি নটবর ময়রা কে চেন? কে ইনি? দিগম্বর দোকানের বাইরে এরকম বিটকেল লোকের মুখ দেখে বিরক্ত প্রকাশ করে। ইনি এসেছেন নতুন সব মিষ্টির খবর নিয়ে। নটবর ময়রার খবর নিয়ে। মিষ্টির রিপ্রেজেন্টেটিভ। আমরাও তৈরি করতে পারি সেসব। এজেন্সি নিলে তোমার দোকানের নাম ছড়িয়ে পড়বে জেলায়। নাম ছড়ানোর কথায় একটু মনোযোগ আসে

বলি কি কি এস্পেশাল করেন উনি?

মুনিয়া কর গোনে রস ঘনক, রস প্যাঁচ, রস লিপি, ভিগান রসগোল্লা বিজ্ঞান না কি বললে আজ্ঞে ভিগান। ওটা হচ্ছে সয়াবিনের দুধ থেকে তৈরি। যেমন ধরুন দুধের জিনিষ সহ্য হচ্ছে না। আবার অনেকদিনের রসগোল্লার মায়াও ছাড়া যাচ্ছে না। তখন প্লেটে চলে এল এক প্লেট ভিগান রসগোল্লা। আহা! মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। ঠিক কিনা? দিগম্বর এর মুখ ঝুলে যায়। নিজের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় একদম ঠিক। তারপর ধরুন রস প্যাঁচ, জিলিপি কিন্তু সাদা ছানার। তুলতুল করছে। মুখে দিলেই মন খুস। পরিবেশ বুঝে এবার উৎসাহ নিয়ে মুনিয়া বলতে থাকে  পুজোয় নটবর দাদা নতুন মিষ্টি এনেছে

রস ত্রিভুজ

বল কি? সে কি করকম? খ্যাঁক খ্যাঁক করে ছোপ ছোপ দাঁত বার করে হাসতে থাকে চলছেও মার কাটারি। সাদা ছানার ত্রিভুজ রসে সিক্ত। মুখে দিয়ে যদি ভেবেছেন এখন নয় পরে খাবো। কিন্তু সেই হবার নয়। মুখের মধ্যে কোথায় যে হারিয়ে যাবে খুঁজেও পাবেন না

তাহলে আমাদের কয়েকটা এনে খাওয়াও। তারপর দেখি

সেতো আনাই যায়। তবে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে লজ্জায় রাঙা হয়ে বললে আজ্ঞে পকেটে টাকা থাকলে কি আর এই ঘুর ঘুর করি? না বলতে হত? এনে দুচার পিস কাল ই খাইয়ে দিতে পারতাম। দিনকাল ভালো না। টাকা পয়সা পকেটে নাই। বুঝতেই পারছেন কত্তা। ভোম্বল বায়না করে চুপি চুপি বাবা খাবো, বাবা, বাবা। সেই সুযোগে মুনিয়া শেষ চাল টা দেয় আরেকটা কথা আপনারা কেউ গঙ্গাজলি খেয়েছেন নটবরের? ওটা না মারাত্মক। ভাবলেই জিভে জল আসে

এবার কিছুটা মাটি পায় দিগম্বর সে আর খাইনি? কলকাতায় গেলে একটা ডুব তো দিতেই হবে। ট্রেনে উঠবার আগে দু তিন বোতল তো আনাই হয়। কই তেমন স্বাদ তো পাইনি? বরং এক একবার ডুব দিয়ে খেয়ে গিয়ে খড় বিচালী মুখে চলে গিয়েছিল। ইস, ছি, ছি প্রবল ভাবে মাথা নাড়িয়ে মুনিয়া বললে নাগো বাবু ও তো গঙ্গাজল? আমি বলছি গঙ্গাজলি। সে একবার মুখে গেলে অন্তর্জলী যাত্রা ছেড়ে উঠে আসবেন গটগটিয়ে। সেটা কিরকম? ছেলে, বাবার মুখ পাঁচের মত হয়ে যায়? ছানার বুঝি? উঁহু ঘাড় নাড়ে

ভোম্বল উৎসাহে ছুঁড়ে দেয় তাহলে কি ক্ষীরের?

মুনিয়া মাথার নাড়ে হল না। হতাশ দিগম্বর বলে তাহলে তুমিই বল

ওটা হচ্ছে সম্পূর্ণ নারকোলের?

বল কি?

সেইতো। নারকোল কুড়িয়ে, অল্প আঁচে জ্বাল দিয়ে, নারকেলের দুধটা বার করে। তারপর আরো অনেক কিছু আছে। তবে মুখে দিয়েছো কি গলে পাউডার হয়ে মিশে যাবে। ভীষণ স্পর্শ কাতর যাকে বলে। তাহলে ঝটপট কটা এনে দাও দিকি। দেরি কোরো না। মুনিয়া লজ্জা পায় টাকা তো নেই

তাহলে এই রাখো বলে ঝট করে হাত বাক্স খুলে কয়েকশো টাকা দিগম্বর তুলে দিতে যায়। ভোম্বল আঁতকে ওঠে না, না, বাবা টাকা দিয়ো না। মুগ্ধ দিগম্বর পাত্তাই দেয় না। ওরে টাকা দিয়ে এডভ্যান্স না করলে আনবে কি করে? দেখ, শেখশুধু মেডিকেলের রিপ্রেজেন্টেটিভই হয় না। এখন মিষ্টির ও হয়। দেশ কেমন এগোচ্ছে বল? ভোম্বল কে পাত্তাই দেয় না। তারপরই মুনিয়া কে বলে তাহলে কবে আসবে নিয়ে?

মিনমিন করে ছেলে।বাবা দোহাইওকে টাকা দিয়ো না, দিয়ো না। ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয় দিগম্বর। ব্যবসার ব্যাপারে তুই বড় নাদান। মুনিয়া বলে এই যাবো আর আসবো। ভালই হল। নটবর ময়রা এদিকে ব্রাঞ্চ খুলতে চাইছিল। তাহলে আপনার কথা বলি যে রাজি আছেন নিতে? হ্যা, হ্যা, লাও দিকি তাড়াতাড়ি। বলে জিভের জল টানে সুরুৎ করে। কাল কখন আসবে ভাই? টাকা গুনতে গুনতে মুনিয়া বলে ধরুন হুরুৎ করে গেলাম। ওনার দোকানে মিষ্টি নিয়ে সুরুৎ করে কাল সকালেই চলে আসছি।  তারপর তো অনেক কাজ। ঠিক আছে যাও, যাও। মুনিয়া হাসতে হাসতে শিস দিতে দিতে হাঁটা লাগায়

ঠিক দুদিন বাদে কাঠ ফাটা রৌদ্রে দিগম্বর এর কাছে ধুতি আর ফতুয়া পরিহিত এক প্রৌঢ় নেমে জিজ্ঞেস করলে আপনি দিগম্বর গায়েন? দিগম্বর জিজ্ঞেস করলে আপনি? আমি নটবর ময়রা

সবে বলতে যাচ্ছিল আসুন আসুন কি ভাগ্যি আমার। কিন্তু  সে বললে করুন স্বরে দাদা মিষ্টি তো পাঠিয়ে দিয়েছি কয়েক হাজারের রস ঘনক আর রস ত্রিভুজ। আপনার কর্মচারী মুনিয়া আপনার ঠিকানা দিয়ে বলে গেল আপনি নিজে এসে দিয়ে যাবেন। দুদিন চলে গেল এলেন না। তাই দাম নিতে আসতে হল

ভোম্বলের বাবা এখন নিজের বুক বাজিয়ে সত্যি দিগম্বর হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে