বয়েসে বড় হওয়া সত্ত্বেও অমাদা আমাদের সাথে বন্ধুর মতোই মেশেন। বিভিন্ন বিষয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে ওঁর জুড়ি নেই। এছাড়া গুছিয়ে গল্পও বলতে পারেন। আমাদের ‘কিশোর সংঘ’ ক্লাবের উনি সভাপতি আর আমরা যখন নাটক করি তখন উনি নাট্যকার হন। অনেক সময় উনি আমাদের সাথে অভিনয়ও করেন। এইসব কারণেই উনি আমাদের বয়েসী ছেলেপিলেদের কাছে খুবই জনপ্রিয় এক মানুষ।
এহেন অমাদা আজকাল প্রাতঃভ্রমন শুরু করেছেন। বেশ কয়েকবার পেটের গ্যাসের ব্যথা আর বদহজমে ভুগে ডাক্তারের পরামর্শে উনি মর্নিওয়াকে বেরোচ্ছেন। রোজ সকাল পাঁচটায় বরাকর রোড ধরে হাঁটতে শুরু করেন আর তারপরে বুন্দলার ঝরনার ওপরের ব্রীজটা পেরিয়ে নতুনডি গ্রাম পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরতে শুরু করেন। অনেকবার নতুনডি আর বুন্দলা গ্রাম থেকে টাটকা সবজি কিনে ফিরতেও ওঁকে দেখেছি। গ্রীষ্মকালে ওঁর মর্নিংওয়াক সকাল পৌনে পাঁচটের সময় শুরু হয়। এখন নাকি ওঁর বদহজম আর গ্যাস একদম নেই, শুধু তাই নয়, সারাদিন প্রচুর খিদে পাচ্ছে। উনি যখন মর্নিংওয়াক থেকে ফেরেন, আমি তখন ছাতে ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম শুরু করি। অমাদাদের বাড়ি আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকেই বলা যায়।
অমাদার পেশা হল দোকানদারি। বরাকর রোডে অবস্থিত বি ডি ও অফিসের ঠিক উল্টোদিকে ওঁর নিত্যপ্রয়োজনী দ্রব্যের দোকান। সেখানে আটা, চাল, গুড়, চিনি, থেকে শুরু করে পাউডার, সাবান, শ্যাম্পুও মায় ঔষধও পাওয়া যায়। একদিন আমি যখন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরছি, তখন অমাদা আমাকে ডেকে বললেন, “অ্যাই সৌম্য, তুই অত সকালে ছাতে কি করিস বল তো?”
আমি বললাম, “ব্যায়াম।“
“আমার সাথে করনা? আমাকেও একা একা করতে হবে না। আর তুই অনেক নতুন নতুন ফ্রী হ্যান্ড ব্যায়াম শিখতে পারবি? কি? রাজি তো? তাহলে কাল থেকেই শুরু কর। আমি ভোর ঠিক পাঁচটায় তোকে ডেকে নেব। মাসিমাকে আগে থেকে বলে রাখবি।“ আমার আর না বলার কোনো উপায় ছিল না। কারন, অমাদা মানুষটাই ওইরকম। এমন একটা ব্যাক্তিত্ব যে, চট করে না বলা যায় না। অমাদার ভাই, মানে আমার সহপাঠী জুজু নাকি প্রথম প্রথম কয়েকদিন ওঁর সাথে মর্নিংওয়াকে যেত, তারপরে সর্দি হয়ে যাওয়ায় বন্ধ করেছে।
যাই হোক, ঠিক পরদিন থেকেই আমি অমাদার সাথে ঠিক সকাল পৌনে পাঁচটা থেকে প্রাতঃভ্রমন শুরু করলাম। প্রথম প্রথম আমার ভালো লাগত না। কারন, অত সকালে বিছানা ছেড়ে দেড় কিলোমিটার হাঁটা আর তারপরে ফ্রীহ্যান্ড ব্যায়াম করা আর তারপরে ফিরে আসা। আমাকে যখন অমাদা প্রশ্ন করতেন, তখন আমি বলতাম, “খুব ভালো লাগছে, আমার খিদে বেড়ে গেছে।“ ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু মাসখানেক যাবার পরে আমার মর্নিংওয়াক ভালো লাগতে শুরু হল। তখন ভোর সকাল হবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভোরে একদম ফাঁকা বরাকর রোড দিয়ে দ্রুতপায়ে হেঁটে বুন্দলার ঝরনার সেতু পেরিয়ে নতুনডি গ্রাম পর্যন্ত গিয়ে ফেরার সময় বুন্দলার সেতুর নীচে নেমে ঝরনার তীরের গাছে ঘেরা সবুজ ঘাসে বসে একটু জিরিয়ে তারপরে ফ্রীহ্যান্ড বা অমাদার ভাষায় “মুক্তহস্ত ব্যায়াম” করে তবেই বাড়ি ফেরা। আর অত ভোরে প্রকৃতিকে আলাদা ভাবে চেনা যায়, আর ভোরের সৌন্দর্যও সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার আলাদা একটা সুগন্ধ আছে। তবে পুজো এসে যাবার জন্যে কয়েকদিন মর্নিংওয়াকে যেতে পারি নি। তারপরে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো আর ভাইফোঁটার দিনেও আমরা মর্নিংওয়াকে যেতে পারলাম না। উৎসবের দিনগুলো শেষ হবার কয়েক দিন পরে আবার সকাল সকাল হাঁটা শুরু করলাম। অমাদা আরো অনেককেই আমাদের সাথে প্রাতঃভ্রমণ করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, কিন্তু তারা নানান অজুহাতে এড়িয়ে গেছে।
হেমন্তকাল শুরু হবার পরে একটু একটু শীত পড়তে শুরু হল। রোজ সকালে ভিজে ঘাসের ওপরে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অমাদা বলতেন, “শীত বাড়তে শুরু হলে শোয়টার আর মাফলার পরে আসতে হবে, বুঝলি?”
“ঠিক আছে অমাদা।“ বললাম।
রোজ ঠিক পৌনে পাঁচটার সময় আমি অমাদার গলার আওয়াজের জন্যে অপেক্ষা করি, আর অমাদা এলেই বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ি। সেদিন ছিল রবিবার, মানে ছুটির দিন। সাধারনতঃ অন্য শহরের মতো আমাদের মফস্বল শহরেও রবিবারে সবাই একটু দেরীতে ওঠে। তবে অমাদার ব্যাপার একটু আলাদা। উনি বলেন, “মর্নিংওয়াকের আবার শনিবার, রবিবার বলে কিছু নেই। স্বাস্থ্যই সম্পদ। ঠিক সময়েই যেতে হবে।“ কাজেই, দেরী করার উপায় নেই।
অন্য রবিবারের মতো সেদিন আমার ঘুম ভাঙে নি। তাই যখন অমাদার ডাক আমি শুনতে পেলাম না, তখন মা আমাকে ডেকে দিলেন। আমি দরজা খুলে বাইরে বেরোলাম আর বাবা দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আমি বেরিয়েই অমাদাকে দেখতে পেলাম। রোজকার মতোই আজও ওঁর হাতে একটা ছোট্ট লিকলিকে বাঁশের লাঠি। অনেক সময় রাস্তার নেড়ী কুকুরগুলো পেছু নেয়, বা তেড়ে আসে, তাই এই লাঠি হাতে নেওয়া। বাইরে বেরিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। তখনও মধ্যগগনে আধখানা চাঁদ রয়েছে আর তার সাথে তারার আলো মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের আশেপাশের প্রতিটি বাড়ি চুপচাপ ঐতিহাসিক স্মারকের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা বরাকর রোডে এসে পৌঁছলাম। হেমন্ত কাল বলে একটু একটু ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে, আমরা অবশ্য পাতলা শোয়টার আর গলায় মাফলার জড়িয়ে নিয়েছি। এখন আমরা সোজা হাটব তারপরে বুন্দলার ব্রীজ পেরিয়ে নতুনডি গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেব। আমি ডানদিকে তাকিয়ে বললাম, “একটা ব্যপার লক্ষ্য করেছ অমাদা? চারদিক কেমন যেন অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ। তোমার কি মনে হচ্ছে?”
“আরে না, না। অন্যান্য দিনেও তো এমনই থাকে। হ্যাঁ, কয়েকটা গাড়ি অবশ্য রাস্তা দিয়ে যায়। আসলে আজ তো রবিবার, আর বাঙালিরা এই দিনটিতে একটু বেশী দেরী করেই ওঠে। ছুটিটা উপভোগ করতে চায় আর কি? তুই ও নিয়ে আর চিন্তা করিস না। চল, আমরা হাঁটা শুরু করি।“
আমরা হাঁটতে হাঁটতে শহরের সীমানা পেরিয়ে বুন্দলা ব্রীজের দিকে এগিয়ে চললাম। হঠাৎ মনে হল, সাঁকড়া গ্রামের রাস্তা দিয়ে কে যেন আসছে। মেঠো রাস্তাটা ঠিক ডানদিকেই। ওই রাস্তা দিয়ে এক কিলোমিটার গেলেই সাঁকড়া গ্রাম। ওই গ্রামে আমার একজন বন্ধু থাকে। যাইহোক, যে লোকটা আসছিল ওই রাস্তা দিয়ে ওর গা আর মাথা চাদরে জড়ানো। লোকটা সাইকেলটা ধরে আস্তে আস্তে আসছিল, ওর হাঁটার ধরণটা খুব চেনা লাগছিল। অমাদা বলল, “অ্যাই সৌম্য, লোকটা কে বলতো?”
আমি বললাম, “ঠিক চিনতে পারছি না।“ আমরা দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। লোকটা যখন রাস্তায় উঠল তখন আমরা ঠিক ওর কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। অমাদা প্রশ্ন করল, “ আরে, যুগলকাকু না?”
যুগলকাকু অর্থাৎ সাঁকড়া গ্রামের যুগলকিশোর মণ্ডল। অমাদার মতো যুগলকাকুরও দোকান আছে। অমাদার প্রশ্নের উত্তরে চাদরের ঘোমটার আড়াল থেকে যুগলকাকু বললেন, “হ্যাঁ, আমিই বটে। তোমরা মর্নিংওয়াক করতে বেরিয়েছ বুঝি?”
“কিন্তু আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“গিরি মাড়োয়ারির কাছে দু’বস্তা আলুর অর্ডার দেওয়া আছে, সেগুলো নিতে যাচ্ছি।“
“এতো সকালে?”
“সকাল? আমার মাল সাপ্লাই নিয়ে কথা, তা সে যখনই হোক। চলি রে।“ বলে যুগলকাকু রঘুনাথপুরের দিকে দ্রুতগতিতে হাঁটতে শুরু করলেন। তারপরে সাইকেলে চড়ে একপ্রকার অদৃশ্য হয়ে গেলেন। অন্ধকারে আর তাঁকে দেখা গেল না, ওঁর সাইকেলের আওয়াজটাও মিলিয়ে গেল।
“ব্যপার গোলমেলে বুঝলি? আমিও তো গিরিধারী সিংঘানিয়ার কাছে মাল নিতে যাই। কিন্তু সেতো বেলা বারোটার আগে মাল দিতেই পারে না?”
আমরা আবার দ্রুতগতিতে চলতে শুরু করলাম। মর্নিংওয়াক এইভাবেই করতে হয়, যাওয়ার সময় জোরে জোরে হাঁটতে হয়, আর আসবার সময় ধীরে ধীরে চলতে হয়। কিছুদূর গিয়ে যেই ছোট কালভার্টটার দিকে যাব, অমনি সেখানে কাউকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমরা কাছে যেতেই লোকটা উঠে দাঁড়াল।
“কে বট হে চিনতে লারছি?” অমাদার মুখ দিয়ে মাঝে মাঝে পুরুলিয়ার মানভূম ভাষা বের হয়। বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও অমাদা পূর্ববঙ্গের ভাষা একেবারেই বলতে পারেন না। বরং মানভূম ভাষা দারুণ বলতে পারেন।
“আইজ্ঞা, আমি মদন বটি।“
“মদনা? তা, এতো সকালে এইখেনে কি কইরছ?”
“অল্প জিরাছি। অল্প পরেই ছেইলাগলা পইড়তে আইসব্যাক।“ মদনদা বাড়িতে টিউশানি পড়ান।
আমি তো অবাক, মদনদাকে বললাম, “কিন্তু ছেলেগুলো তো বিকেল তিনটের সময় তোমার কাছে পড়তে আসে? এখন তো অনেক দেরী আছে?”
“দেরী কথায় সমু? এখন দুটা পনেরো বাইজছে। তিনটা বাইজতে আর কত বাকী আছে?” বলে মদনদা তাঁর সেই হাড় জ্বালানো হাসিটা হাসতে লাগলেন। অন্ধকারেও ওঁর সাদা বড় বড় দাঁতগুলো দেখা গেল।
আমরা এগিয়ে চললাম। “নাঃ, মদনার মাথাটা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে।“ বললেন অমাদা। আকাশে দু’এক জায়গায় হালকা সাদা রংয়ের মেঘ। আধখানা চাঁদটা আস্তে আস্তে পূর্বদিকে এগোচ্ছে। চারদিক একদম চুপচাপ, রাস্তা দিয়ে একটা গাড়িও যাচ্ছে না। আমার কেমন যেন লাগছিল। অমাদাকে সে কথা বললাম। শুনে অমাদা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “অনেক ভাগ্য করেই এই দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়, চল।“
বুন্দলার ব্রীজ তখন দেখা যাচ্ছে, এমন সময় মনে হল, গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে কে যেন আমাদের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি লম্বা, আর পাতলা। অমাদা আস্তে আস্তে সেই লোকটির পেছনে গিয়ে বলল, “আরে পূর্ণদা যে, এতো ভোরে তো তোমাকে পাওয়া যায় না?” শুনে লোকটি তড়িৎগতিতে সামনের দিকে ঘুরল। আর তাকে দেখতে পেলাম। আমাদের পূর্ণকাকু, অর্থাৎ পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য। ভটচাজবাড়ির মেজোছেলে। পূর্ণকাকু বি ডি ও অফিসে গ্রামোন্নয়ন বিভাগে চাকরী করেন। এইজন্যে ওঁকে প্রায় এই অঞ্চলের গ্রামগুলোতে ঘুরে বেড়াতে হয়। কিন্তু এতো ভোরে উনি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কি করছেন? অমাদার প্রশ্নের উত্তরে ‘খক, খক’, করে একটু কেশে পূর্ণকাকু ঘড়ঘড় আওয়াজ করে বললেন, “নতুনডি গ্রাম থেকে আসছি, সেখানে একটু কাজ ছিল।“
“এই অসময়ে নতুনডি গ্রামে কাজ ছিল?” অমাদার সাথে আমিও অবাক।
“অসময় কি হে? এটাই তো কাজের সময়?” বলে আমাদের আর কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে পূর্ণদা হনহন করে রঘুনাথপুরের দিকে চলে গেলেন। আমরা অবাক হয়ে গেলাম, কারণ, সরকারী কাজে বিভিন্ন গ্রামে যেতে হলে পূর্ণদা অফিসের গাড়িতেই যান।
আমরা হেঁটে হেঁটে বুন্দলা বীজের ওপরে গিয়ে দাঁড়ালাম। এই ব্রীজটি সত্তর বছরেরও বেশী পুরোনো। এর নীচ দিয়ে বুন্দলার ঝরনা, স্থানীয় ভাষায় ‘জোড়’ তির তির করে বয়ে চলেছে। সারা বছরের মধ্যে বর্ষা কালে জলের স্রোত একটু বেড়ে যায়। তখন এটা একটা ছোট্ট নদী হয়ে যায়। চাষীভাইয়েরা এর জল কৃষিকাজে ব্যবহার করেন। এই ঝরনা এখান থেকে সোজা কিছুদূর গিয়ে ডানদিকে বেঁকে চিনপিনা গ্রামের কাছে বাঁকুড়া রোডের ব্রীজের নীচে বয়ে গেছে। সেখানে একে “ভূতামার জোড়” বলা হয়। বাঁকুড়া রোডের ওই ব্রীজের নীচে ঝরনার ধারে আছে শ্মশান, সেই জন্যেই হয়তো ওই নাম হয়েছে। আমি ব্রীজের দু’দিকে তাকালাম। এখন দুদিকেই চাঁদের আলোতে ধুধু করছে ধানক্ষেত, আর দূরে দূরে পলাশ গাছের ঝোঁপগুলো দেখা যাচ্ছে। ধানক্ষেতে পাকাধান পাহারা দেবার জন্যে সশস্ত্র প্রহরীরা থাকে। ওরা অবশ্য বাঁশ আর খড়ের তৈরী ছোট ছোট গুমটির মতো করে তাতে শোয়। অমাদা বললেন, “চল, সৌম্য, নতুনডি গ্রাম পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে আসি।“ আমরা সোজা এগিয়ে চললাম। রাস্তার দু’ধারে রয়েছে বেশকিছু বট আর ইউক্যালিপটাস গাছ। আকাশের চাঁদের আলোর সাথে রাস্তায় গাছের ছায়া যেন লুকোচুরি খেলছে। গাছের ডাল মৃদু হাওয়ার সাথে দুলছে। এখনও পর্যন্ত একটাও গাড়ির দেখা মিলল না, এই কথাটা যখন অমাদাকে জিজ্ঞাসা করব ভাবছি, ঠিক তখনই নতুনডির দিক থেকে একটা গাড়িকে আসতে দেখলাম। যাক, এতক্ষনে অন্ততঃ একটা গাড়ির দেখা তো পাওয়া গেল। গাড়ি দেখে আমরা রাস্তার বাঁদিকে সরে গেলাম। আর গাড়িটা আমাদের ঠিক পাশ দিয়ে হুস করে চলে গেল। আমি স্পষ্ট দেখলাম, গাড়ির পেছনের আসনে রাজাবাবু বসে রয়েছেন আর ড্রাইভার মিহিরদা গাড়িটা চালাচ্ছেন। রাজাবাবুর আসল নাম ডাক্তার রাজকিশোর রায়। নতুনডির বিখ্যাত রায়বাড়ির ছেলে। পেশায় ডাক্তার রাজাবাবু খুবই বিখ্যাত মানুষ। এই অঞ্চলের নামকরা চিকিৎসক। উনি তো রঘুনাথপুরে থাকেন, তাহলে এতো ভোরে নতুনডি থেকে ফিরছেন কেন? কথাটা অমাদাকে বলাতে উনি বললেন, “মনে হয় রাজাবাবু জয়চন্ডীপাহাড় স্টেশনের দিকে যাচ্ছেন। সকাল সাতটার আদ্রা আসানসোল প্যাসেঞ্জার ধরে আসানসোলে যাবেন। প্রতি সপ্তাহে দু’দিন উনি ওখানের একটা হাসপাতালে রুগি দেখেন।“
তারপরে উনি বললেন, “অ্যাই সৌম্য, ঘড়িতে কটা বাজে রে?”
“ঘড়িটা আনতে ভুলে গেছি অমাদা।“ আমি বললাম।
“সেটাই তো সমস্যা রে, আমিও আজ ঘড়ি আনি নি। তবে মনে হয়, সাড়ে চারটে বেজে গেছে। আমরা নতুনডির ফাঁকা বাসস্ট্যান্ডে একটু দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম, তখন কেষ্টোপিসিকে আসতে দেখলাম। কেষ্টোপিসির আসল নাম কৃষ্ণদাসী সূত্রধর। নতুনডির পাশের গ্রাম বাথানে ওঁর বাড়ি। সেই অল্পবয়েস থেকেই রঘুনাথপুরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মুড়ি, চিঁড়ে বিক্রি করা ওঁর পেশা। তখন কেষ্টোপিসির স্বামী ভালো চাকরী করতেন না, তাই তিনি মুড়ি, চিঁড়ে বিক্রি করে সংসার চালাতে শুরু করেন। পরে ওঁর ছেলেরা পড়াশুনো করে ভালো চাকরী পায়, মেয়েদের ভালো বিয়ে হয়ে যায়, তবুও তিনি নিজের পেশাকে ছাড়েন নি। বলেন, “এই কাজের মধ্যেই আমি মা লক্ষ্মীকে পেয়েছি, তাই যতদিন বাঁচব, কাজ করে যাব।“
কেষ্টোপিসি প্রায় দৌড়ে দৌড়ে আসছিলেন, এই বয়েসেও উনি এতোটা পথ হেঁটেই আসা যাওয়া করেন। আমরাও এবার ফিরছিলাম। বুন্দলার ব্রীজের কাছে এসে ফ্রী হ্যান্ড ব্যায়াম করার জন্যে যেই নীচে নামব, অমনি পিসি আমাদের ধরে ফেললেন। একগাল হাসলেন, অমাদা ওঁকে প্রশ্ন করলেন, “হ্যাঁগো পিসি, এতো সকালে যাইছ ক্যানে?”
“অনেকগলা কাজ বাকী আছে রে অমা। চৌধুরীদের বাড়িতে মুড়হি, দেবাবু আর মুখার্জিদের বাড়িতে চিঁড়া পৌঁছাইতে হব্যাক। আইজ ওয়াদের ঘরে কুটুম আইসব্যাক। চলি রে।” বলে কেষ্টোপিসি দ্রুতপায়ে বরাকর রোড ধরে রঘুনাথপুরের দিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষন পরে গাছে ঘেরা অন্ধকার রাস্তায় ওঁকে আর দেখা গেল না।
অমাদা পুর্বদিকে তাকালেন, সেখানে এখনও দিগন্তের অনেক উঁচুতে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। আমি নীচে নামছিলাম, হঠাৎ অমাদা আমার হাতটা ধরে বললেন, “সৌম্য, জলদি চল, গতিক সুবিধের মনে হচ্ছে না।“
আমি প্রশ্ন করলাম, “মানে?”
“আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ। চাঁদ এখনও অস্ত যায় নি। বাকীটা পরে বলব।“
অমাদার সাথে আমিও জোরে জোরে চলতে শুরু করলাম। অমাদা পেছন ফিরে দেখে বললেন, “সৌম্য, দৌড়তে শুরু কর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের দোকানে পৌঁছতে হবে।” দৌড়তে শুরু করার আগে আমিও পেছন ফিরে দেখলাম, কে যেন ব্রীজের ওপর দিয়ে আসছে। ওর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার ধরণটা চেনা চেনা ঠেকছে। বাকী রাস্তাটা আমরা কেমন করে যে অমাদার দোকানের কাছাকাছি পৌঁছলাম বলে বোঝাতে পারব না।
আমি অমাদার সাথে ওঁর দোকান ঘরে ঢুকলাম। এর ঠিক উল্টোদিকে আছে বি ডি ও সাহেবের অফিস, ইন্সপেকশান বাংলো, আরো গোটা তিনেক দোকান। অমাদা দোকানে ঢুকে লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে মেঝেতে বিছানা পাতলেন। আমি তখন দোকানের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছি। অমাদা আমাকে শুধোলেন, “যুগলকাকু, পূর্ণদা, মদন, রাজাবাবু, মিহির, কেষ্টোপিসি, এরা কে বলতো?”
আমার তখন সবকিছু মনে পড়ে গেল। আমি আস্তে আস্তে বললাম, “ওঁরা সবাই মারা গেছেন অমাদা।“
যুগলকাকু বছর চারেক আগে, পূর্ণদা বছর তিনেক আগে, মদনদা, রাজাবাবু আর মিহির বছর আড়াই আগে, আর কেষ্টোপিসি গত বছর মারা গেছেন। যুগলকাকু ম্যালিগনেন্ট ম্যালেরিয়ায়, মদনদা আন্ত্রিকে, পূর্ণদা জন্ডিসে, রাজাবাবু আর ওঁর ড্রাইভার অ্যাক্সিডেন্টে, আর কেষ্টোপিসি পা পিছলে পাথরের ওপর পড়ে গিয়েছিলেন। তাতেই ওঁর মাথায় চোট লাগে আর মৃত্যু হয়।
“এ আমরা কাদের দেখলাম বলতো? এও কি সম্ভব? আর ব্রীজের ওপর দিয়ে যে আসছিল, তাকে চিনতে পেরেছিস?”
“হ্যাঁ, পেরেছি। উনি হামিদখুড়ো। মাত্র ছয়মাস আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।“ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক হামিদখুড়ো, তাঁর মেয়ের বাড়ি থেকে হেঁটে ফিরছিলেন। রাস্তাতেই ওঁর হার্ট অ্যাটাক হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথেই উনি মারা যান। হঠাৎ অমাদা শুধোলেন, “ক’টা বাজে দেখতো?”
আমি দেয়াল ঘড়ি দেখে চমকে উঠে উঠলাম। ঘড়িতে এখন সবে রাত দুটো বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়েছে। ভোর হতে এখন অনেক দেরী আছে। সেকথা শুনে অমাদা বললেন, “এতো ভুল কি করে করলাম বলতো? যাওয়ার সময় মনে হল, ঘড়িতে পাঁচটা বাজছে, আসলে তখন রাত দুটো বাজছিল। আর রাতের বেলাতেই তো ওঁরা বেরোন, তাই ওঁদের দেখতে পেলাম। মদনা তো ঠিকই বলেছিল, দুটো বেজে পনেরো মিনিট। তাই না?“
হঠাৎ মনে হল, অমাদার দোকানঘরের ঠিক পরেই কামারশালার পাশ দিয়ে কেউ আলতো পায়ে হেঁটে আসছে। বটগাছের নীচে শুকনো পাতার ওপর দিয়ে সে হাঁটছে। হামিদখুড়ো একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। বাতের ব্যথার জন্যে ওঁর হাঁটতে অসুবিধে হত। অমাদা ফিসফিসিয়ে আমাকে বললেন, “দাঁড়িয়ে কি শুনছিস? তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে কানে আঙ্গুল দিয়ে শুয়ে পড়। খুড়ো আসছেন। ডাকলেও উত্তর দিবি না। ওঁদের ডাক শুনতে নেই, উত্তর দিতে নেই।“
আমি তাড়াতাড়ি দোকানঘরের ভাঁজকরা চার পাল্লার দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে সব ছিটকিনিগুলো দিয়ে বাতি নিভিয়ে কাউন্টারের পেছনে অমাদার পাশে কম্বল ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাস্তার আলো দরজার পাল্লার ফাঁক দিয়ে দোকান ঘরের ভেতরে ঢুকছে। আর সেই পদশব্দ দরজার বাইরে থামল। আমি সভয়ে দেখলাম, রাস্তার লাইটের আলো আর দেখা যাচ্ছে না, মানে, কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয় হামিদখুড়ো, কিন্তু অত্যন্ত ভালো স্বভাবের মানুষ হামিদখুড়োর ভূত নিশ্চয় আমাদের কোনো ক্ষতি করবেন না। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষ বা আত্মাটি দরজায় বার কয়েক ধাক্কা দিয়ে আর অমাদার নাম ধরে ডেকে শেষে চলে গেলেন। আমি ওঁর চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। অমাদা, এতক্ষন ঠাকুর নাম করছিলেন। এবারে আমাকে বললেন, “ওঃ, খুব জোর বেঁচে গেছি। কালই মায়ের মন্দিরে এক কেজি প্যাঁড়া ভোগ দেব, হরির লুট দেব। এবারে শুয়ে পড়, রাত এখন অনেক আছে।“
আমি শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে ছয়টায়। অমাদা স্টোভ জ্বেলে চা বানাচ্ছিলেন। আমাকে এক কাপ দিয়ে নিজে কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “শোন, কালকের ঘটনার কথা কাউকে বলবি না। কেউ বিশ্বাস করবে না। বরং সবাই ঠাট্টা করবে।”
আমি তখন নোনতা বিস্কুটে কামড় দিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছি, এমন সময় কামারশালার ছেলে রতনদা এসে বলল, “কাল রাতে তোমরা কোথা থেকে আসছিলে বলতো? অত রাতে কোথায় গেছিলে? আমারও ঘুম আসছিল না, ভাবলাম, তোমাদের সাথে দুটো কথা বলব। তাই তোমরা ভেতরে ঢোকার পরে আমি এসে দরজায় কত ধাক্কা মারলাম, ডাকলাম, তোমরা তো দরজাই খুললে না? ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?”
রতনদার কথা শুনে অমাদা আমার দিকে তাকাল।