দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে
যাচ্ছিলো দেখে ওখানের এক মুখিয়া বললো- দাদা দুপুরের খাবারটা আজ এখানেই না হয় খেয়ে
যান না। আমার স্ত্রী ভীষণ খুশী হবেন
এবং ভালো রান্নাও করেন।
আমি বললাম- ওখানে তো আমার
জন্য রান্না হয়ে গেছে ভাই।
- তা হোক। আপনি আমাদের এখানে একটু কিছু খেলে আমাদের ভালো লাগবে। অগত্যা আর কিছুই করার নেই। এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক একদমই নেই। ফোন করে যে বাকিদের এই খবরটা দিয়ে দেবো সেটাও পেরে উঠলাম
না।
মুখিয়ার বৌ ততক্ষনে বিশাল
ঘোমটা টেনে আমায় ডেকে নিয়ে গেলো পাশের ঘরে। মাটির ঘর। মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে আমাকে আর মুখিয়াকে খেতে দিলো। বড়ি দিয়ে আলু শাক, সজনে ফুলের বড়া, কুঁচো চিংড়ি দিয়ে পালংপোস্ত, জিয়ল মাছের
নতুন আলু দিয়ে পাতলা ঝোল আর শুকনো কুলের চাটনি। ভীষণ তৃপ্তি করে খেয়েছিলাম সেদিন।
- বেলা প্রায় গড়িয়ে যাচ্ছে। এবার তো ফিরে যেতে হবে।
- হ্যাঁ, তবে জমিদার বাড়ির রাস্তা
দিয়ে না যাওয়াই ভালো। জায়গাটা মোটেও
ভালো নয় দাদা।
আমি বললাম- না, না কিছু হবে না। ভালো মন্দ আমি ঠিক বুঝে নেবো।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা প্রায়
নামে নামে। আমি পাশের প্রাইমারি
স্কুলটা পেড়িয়ে সোজা রাস্তাটা ধরলাম। রাস্তার একপাশে জমিদার বাড়ির বিশাল পুরানো পাঁচিল। অন্যদিকে বিশাল বিশাল গাছ। গাছের পাতা পড়ে সারাটা রাস্তা দখল করে আছে। দেয়ালগুলো সেই কয়েকশো বছরে নোনা ধরে এখন জরাজীর্ন অবস্থায়
দাঁত বেড় করে হাসছে। শুকনো পাতার
খসখস শব্দ এই নিঝুম রাস্তাটাকে যেন একটা ভয়ের আবর্তে জড়িয়ে রেখেছে। একা একা ভীষণ ভয় ভয় করছিলো। আর একটু এগিয়েই আবছা আলোয় চোখের সামনে একটা পোড়ো বাড়ি দেখতে
পেলাম। এটাই সেই কামালপুরের বিখ্যাত জমিদার বাড়ি। এখন সাপ আর চামচিকার বাসস্থান। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বাড়িটার ভেতরে নিশ্চয়ই কেউ থাকে। কয়েকজনের আবছা কথাবার্তা কানে আসছিলো। যাক বাবা বাঁচা গেলো, এখানে তবু্ও মানুষের
উপস্থিতি আছে। আগামী কাল বাড়ির ভেতরটা
ভালোভাবে দেখতে আসবো।
আমি যখন আমাদের আস্তানায়
ফিরলাম তখন অনেকটাই রাত হয়ে গেছে। ঘরে ঢুকতেই দীপু জিজ্ঞেস
করলো- ওখানে খেয়ে এসেছিস নিশ্চয়ই।
- নারে! দুপুরে ওরা জোর করে খাইয়ে দিয়েছিলো। ওখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় তোদের সে খবর দিতে
পারিনিরে, আর আমি হাঁটতে হাঁটতে এলাম যে। সেজন্যেই রাত হয়ে গেছে। জানিস এখানে একটা বহু পুরানো রাজবাড়ি আছে কামালপুর রাজবাড়ি। ভাবছি কাল বাড়ীটা
দেখতে যাবো। যাবি নাকি!
- নারে, কাল আমরা দামোদর দেখতে
যাবো। তুইও চল।
- না তোরা যা। আমি তাহলে একাই যাবো কামালপুর।
রাতের খাবার শেষ করে আমরা
যে যার ঘরে শুতে গেলাম। বাইরে অসহ্য
হাওয়া বইছে। তার ওপর বাড়তি পাওনা
লোডশেডিং। যাক সেকথা। সকালের ব্রেকফাষ্ট সেরে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সারতে সারতে সকালটা একদম ফুরিয়ে
গেলো। আজ দুপুরে সবার জন্যই পাতলা ডিমের ঝোল আর ছোট মাছের চচ্চরি
রান্না হয়েছে। মুসুরির ডাল, পাতি লেবু সঙ্গে সজনে ফুলের বড়া। আ: কি স্বাদেই না খেলাম। একে একে ওরা সবাই দামোদর দেখতে বেড়িয়ে গেলো। আমিও আমার ব্যাগে ছোট একটা টর্চ, এক বোতল জল ঢুকিয়ে নিয়ে চললাম কামালপুর রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। সরু পথ, শনশনে হাওয়ায় কেমন যেন একটা এডভেঞ্চার অপেক্ষা করে আছে। বাড়িটার কাছাকাছি যেতেই ভেতর থেকে খুটখাট শব্দ কানে ভেসে
এলো। বাড়িটার সংস্কার চলছে মনে হলো। জং ধরা বিশাল লোহার গেটটায় ক্যাচ ক্যাচ শব্দে ঠেলে অনেক
কষ্টে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। হ্যাঁ সত্যি
বাড়িটার সংস্কারের কাজ চলছে। রাজমিস্ত্রীরা পলেস্ত্ররায় তালি দিতে ব্যস্ত। একজন লম্বা চওড়া লোক আমার সামনে এসে বলল- কিছু বলবেন কি?
আমি বললাম- আমি রায়গঞ্জ
থেকে এসেছি এই বাড়িটা ঘুরে দেখবো বলে।
- তা বেশ। কিন্তু এখন তো কাজ চলছে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার
বললেন- আচ্ছা চলুন যতটুকু সম্ভব দেখে নেবেন।
পলাশী যুদ্ধের কিছুটা পরে
প্রথম এখানে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন কামালপুরের জমিদাররা। এখন এই ভাঙ্গাচোরা বাড়ির যেটুকু আছে তাও মানুষজন খুলে নিয়ে
যাচ্ছে। এটা কিশোর বসুর জমিদার
বাড়ি। কামালপুরের রাজবাড়ী নামেই সবাই চেনে। চারদিকের দেয়ালে বটগাছ গজিয়ে দেয়ালগুলোকে আরো ভৌতিক করে
তুলেছে। যে ঘরটার সামনে আমরা আছি তার ভেতরটা দেখলেই বোঝা যায় এটা
কোন রানী বা রাজকুমারীর ঘর ছিলো। দেয়ালে বড় বড় গর্ত হয়ে আছে। এখানে হয়তো সেযুগে আয়না লাগানো ছিলো। জানলা দরজার কোন পাল্লা নেই। সব খুলে নিয়ে গেছে।
ভদ্রলোক আমায় বললেন- একটু
চা খাবেন তো?
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। ভাঙ্গা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গেলে সিঁড়িগুলো কাঁপছে। কোনভাবে উপরে উঠে দেখলাম জমিদারের সোবার ঘর। খাটটা এখনো ওভাবেই রাখা থাকলেও ধূলোর আস্তরনে ঢাকা।
ভদ্রলোক জোরে ডেকে বললেন- আত্মারাম আমরা ওপরে আছি, চা এখানেই নিয়ে আয়।
দোতলা থেকে বাড়িটার পিছনে
একটা বড় দিঘি। দিঘির চারপাশে ভীষণ জঙ্গল। আমি জিজ্ঞেস করলাম- দিঘিটা পরিস্কার করছে না কেন?
- সে অনেক কাহিনী দাদা। জমিদারের সেজো মেয়ে এই দিঘিতে মরে পরে ছিলো সেসময়। তারপর থেকে এই দিঘির জল এখন বিষের সমান। কেউ ভুল করেও জলে হাত দেয়না।
পরে সেই কাহিনিও আপনাকে বলবো দাদা।
- আচ্ছা আপনি এতসব জানলেন কি করে।
- কেন জানবো না। আমি তো এই জমিদার বংশেরই একজন। কথার মাঝে আত্মারাম চা নিয়ে
এলো। বেশ লম্বা গড়ন, মাথায় ঝাকড়া চুল। চোখ দুটি যেন ঠিকড়ে বেড়িয়ে আসছে। দেখলেই ভয় ভয় করে।
- আত্মারাম কথা বলতে পারেনা। স্নান কবে করেছিলো কে জানে।
- হ্যাঁ দেখে তো তাই মনে হয়। চা'য়ে চুমুক দিতেই একটা পোড়া গন্ধ নাকে এলো। অনেকটা কফি কফি গন্ধ।
- এই চা কিন্তু সেই আমলের দাদা। যত্ন করে রেখেছি। বিশেষ কেউ এলে এই চা'টা করি।
- ও তাই!
কথায় কথায় দিনের আলো ফুরিয়ে
যেতে থাকলো। আমি বললাম -অনেকটা পথ যেতে
হবে তাই আজ আর নয়।
কথাটা শেষ না হতেই ভদ্রলোক বললেন- কোন চিন্তা করবেন না। আমি নিজে আপনাকে দিয়ে আসবো। চলুন বৈঠকখানায় বসা যাক। আমিও কোন কথা না বলে বৈঠকখানাতে গিয়ে বসলাম। পুরানো দিনের আসবাবপত্র। দেয়ালে একটা বন্ধ ঘড়ি হেলে পড়ে আছে। হরিন আর বাঘের মাথা টাঙ্গানো আছে সারা ঘরটায়। মাকড়সার জালে মোড়ানো আলমারীর পাশে একটা নরকঙ্কাল দাঁড় করানো
আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম- এই পরিবারের কেউ ডাক্তারী
পড়তেন বা ডাক্তার ছিলেন নাকি?
- কেন বলুন তো?
- ঐযে ওখানের কঙ্কালটা।
- ও কিছু নয়। ওটা আমাদের পারিবারিক কঙ্কাল।
- তার মানে? কথাগুলো শেষ না হতেই
আত্মারাম চা নিয়ে এলো। চা দিয়ে আত্মারাম ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে আমাকে কিরকমভাবে
যেন ড্যাবড্যাব করে দেখছিলো। টিমটিমে আলোয় ঘরের মাকড়সার
জালে আমার চোখ পড়তেই আমি জিজ্ঞেস করলাম- এগুলো পরিস্কার করে রাখলে তো বেশ হতো। ও হ্যাঁ আপনার নামটাই তো শোনা হয়নি।
ভদ্রলোক বললেন- আমার নাম! একটা বিকট হাসি হাসলেন ভদ্রলোক।
- আমার নাম নিশিকান্ত। নিশিকান্ত বসু। আপনার?
- আমি দূর্জয় সামন্ত।
- আপনি কি করেন?
বললাম আমি একজন ভূত
বিশেষজ্ঞ।
- আচ্ছা আপনি তো ভূত টূত নিয়ে গবেষণা করেন। কখনো ভূত দেখেছেন কি?
- না,
তেমনভাবে দেখিনি ঠিকই, তবে অনুভব করেছি তাদের
স্পর্শ। কথায় মাঝেই চ্যাঁ চ্যাঁ করে গোটাকয় চামচিকে আমার মাথার ওপর
দিয়ে উঁড়ে গেলো। আমি ভীষণরকম ভয় পেয়েছি দেখে
নিশিকান্ত বললেন- ভয় পাবেন না। ওগুলো আমার পোষা।
- বলেন কি! চামচিকে কারো পোষ মানে নাকি?
- হ্যাঁ পোষ মানে। দেখে রাখুন ভবিষ্যতে আপনার কাজে লাগবে।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আত্মারাম আবার ঘরে ঢুকে দু'বাটি মুড়ি আর
চানাচুর দিয়ে সটান বেড়িয়ে গেলো। নিশিকান্তবাবু বললেন- নিন
মুড়ি খান। আরেকবার চা খাবেন তো?
আমি বললাম- না, আর নয়। অপরিস্কার মুড়ির বাটি থেকে
একমুঠ মুড়ি মুখে দিয়েই আমি অনুভব করলাম একটা চুলপোড়া গন্ধ। অনেকদিনের পুরোনো।
- এবার তো উঠতে হবে নিশিকান্তবাবু।
- উঠবেন! তা বেশ একটু নিচে অপেক্ষা করুন আমি গাড়িটা বেড় করে
আনি।
- ওকে,
আমি নিচে আছি।
আমি নড়বড়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে
নামছি আর আমার ঠিক পিছনেই নেমে আসছে আত্মারাম। নিচের ভাঙ্গাচোরা পোড়োবাড়িটার নিচে আমি নিশিকান্তবাবুর জন্য
অপেক্ষা করতে লাগলাম। আবছা আলোয় আমার পায়ের কাছে
একটা কাটামুন্ডুর মতো কিছু একটা দেখতে পেলাম। ওপরে তখন চাপা কান্নার শব্দ শুনছি। শুনছি কিছু কথোপকথন। ঠিক কিছু বুঝতে পারলাম না। একটা ফিটন গাড়ি নিয়ে নিশিকান্তবাবু ডাকলেন- আসুন। আমি গাড়ির দিকে পা বাড়াতেই আত্মারাম হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলে
উঠলো- আবার আসবেন।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আত্মারাম তো কথাই বলতে পারে না। তবে কি নিশিকান্তবাবু আমায়
মিথ্যে বলেছেন!! নিমেষে আত্মারাম কোথায় যেন
মিলিয়ে গেলো। আবছা আলোছায়ায় গাড়িতে পা দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম
নিশিকান্তের হাতের আঙ্গুলে যে আংটিটা পড়া আছে সেটা আঙ্গুল থেকে অনেকটা নিচে ঝুলছে।
ফুলহাতা সার্টটা দেখে মনে হচ্ছে কোন কাকতাড়ুয়ার শরীরে লাগানো।
- ভালোভাবে বসুন দূর্জয়বাবু। রাস্তার অবস্থা খুব ভালো নয়।
বললাম- ঠিক আছে। গাড়িটা দ্রুত গতিতে চলছে দেখে আমি সাবধান করে বললাম- ধীরে
চলুন নিশিকান্তবাবু।
- ভয় পাবেন না। আমি খুব একটা খারাপ চালাই না। আচ্ছা দূর্জয়বাবু আপনি সাক্ষাৎ ভূত দেখেননি তো। তাই না!!
- না।
- পাবেন পাবেন দেখতে পাবেন। আমি ষ্টিয়ারিংয়ের দিকে তাকাতেই দেখি একটা কঙ্কালের হাত স্টিয়ারিংটা ধরে আছে। নিশিবাবুর মুখের দিকে তাকাতেই আমার আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমার চারপাশে আমার সঙ্গীরা আর কিছু
স্থানীয় মানুষজন আমাকে ঘিরে আছে। ঘটনাটা সবাই শোনার পর
স্থানীয় মুখিয়া বললো- এই জমিদার বাড়িতে বহুদিন কোন মানুষ থাকেনা। এই পোড়োবাড়িতে মাঝেমাঝেই কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। বাঈজির ঘুংগুরের আওয়াজ শুনেছে অনেকেই। আর ঐযে নিশিকান্তবাবু সে ছিলো জমিদারের আপন শ্যালক। এক মোটর দূর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছিলো। আমি ডেরায় ফিরে শুধু এটাই ভাবছিলাম যে একজন ভূত গবেষক
হিসেবে আমি সার্থক। এই ঘটনা আমাকে ভূত সম্পর্কে
আরো আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছিলো।