গল্প । জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


 এম ইন লাইফ







কৌশিক গুপ্ত

বীরভূম, পশ্চিম বঙ্গ



 

শীতলপুর প্রাইমারি স্কুলে সেদিন মহা ব্যস্ততা। পরদিন স্কুল পরিদর্শনে আসছেন বিডিও অর্পণ চৌধুরী। স্কুল পরিদর্শনের পাট অনেকদিন আগেই উঠে গিয়েছে। নতুন বিডিও সাহেব এসে যেন খ্যাপামি শুরু করে দিয়েছেন। বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে সটান ঢুকে যাচ্ছেন স্কুলে। 

রান্নাঘরে গিয়ে থালা পেতে মিডডে মিল চেখে দেখতে বসে যাচ্ছেন। কখনও বা ক্লাসরুমে ঢুকে পড়াতে শুরু করে দিচ্ছেন। পড়াশোনার মান পরীক্ষা করতেও ছাড়ছেন না। গাফিলতি দেখলে মাস্টারমশাইদের দু-চার কথা শুনিয়েও দিচ্ছেন। আসলে মাস্টারি করতে করতেই পরীক্ষা দিয়ে নাকি বিডিও হয়েছেন তিনি। শিক্ষকমশাইরা তাই সদা তটস্থ হয়ে রয়েছেন। শীতলপুর স্কুলের শিক্ষকমশাইদের তবুও মন্দের ভাল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বিডিও সাহেবের স্কুল পরিদর্শনে আসার কথা বলে পাঠিয়েছেন এসআই সৈকত শাস্ত্রী। সেইমত তৈরি থাকতে বলেছেন তিনি। সেই খবর পাওয়ার পর থেকেই শিক্ষকমশাইরা কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছেন। খোদ হেড মাস্টারমশাই কৌশিক ভট্টাচার্য একদল ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঝাঁটা বালতি হাতে গোটা স্কুলচত্বর সাফ সুতরো করতে নেমে পড়েছেন। পরীক্ষার আগে শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতির মতো করে একদল ছেলেমেয়েকে জেনারেল নলেজ গুলে খাওয়াতে গিয়ে প্রসেঞ্জিত স্যারের নিজেরই দিশাহারা অবস্থা। স্কুলের মিডডে মিলের দায়িত্বে রয়েছেন সুব্রত স্যার। আগামীকাল ছেলেমেয়েদের মাংস-ভাত খাওয়ানো হবে। তিনি তাই মাংসের অর্ডার দিতে মোড়ের পোল্ট্রি ফার্মে ছুটেছেন

অনেকদিন পরে মিডডে মিলে মাংস-ভাত জুটবে বলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাজের উদ্দীপনা বেড়ে যায়। কাজ চুকতে চুকতেই বেলা গড়িয়ে আসে। সবার জ্যামাপ্যান্ট তখন ধুলো ধুসরিত। বাড়ি যাওয়ার মুখে হেডস্যার সবাইকে দাঁড় করিয়ে বলে দেন, ‘কাল সবাই সকাল সকাল পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে স্কুলের পোশাক পড়ে আসবে। ভালো করে দাঁত মেজে, নখ কেটে আসতে ভুলবে না।’

হেডস্যারের কথা শুনে খুব চাপে পড়ে যায় নয়ন। দাঁত মাজা, নখ কাটাটা তার কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। এমনিতে সে রোজ সকালবেলায় নিমকাঠি দিয়ে দাঁত মাজে। মা নিয়মিত নখও কেটে দেয়। তার চিন্তা অন্য জায়গায়। স্কুলের পোশাক বলতে রয়েছে স্কুল থেকে দেওয়া একটাই নীল সাদা জামা প্যান্ট আর কালো জুতো। প্রতি রবিবার সেই জামা-প্যান্ট কাচা হয়। কাচতে কাচতে জামা প্যান্টটা রঙ চটে পাতলা ফিনফিনে হয়ে গিয়েছে। জুতোটার অবস্থাও শোচনীয়। মোজাটা তো কবেই ছিঁড়ে গিয়েছে। যাবে নাই বা কেন? একটা জামা প্যান্ট আর জুতো মোজা দিয়ে কি আর সারা বছর চলে? স্কুলের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সব দু-তিনটি করে স্কুলের পোশাক রয়েছে। স্কুলের দেওয়া পোশাকের পাশাপাশি তাদের বাবা-মায়েরা বাজার থেকে কিনে দিয়েছেন। স্কুল পোশাকের বাইরে নয়নেরই কেবল একটাই জামাপ্যান্ট রয়েছে। বাইরে কোথাও গেলে সেটা পরে যায়। কোনদিন স্কুলের পোশাক না শুকোলে সেটাই পরে আসতে হয়। সেদিন খুব সংকোচ লাগে তার। আজ বাড়ি গিয়ে জামাপ্যান্ট কেচে দিলে কাল কি আর স্কুলে আসার আগে শুকোবে? সেই দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফেরে সে

গ্রামের মধ্যে তারাই সব থেকে গরিব। এক ছটাকও জমিজিরেত নেই তাদের। থাকার মধ্যে রমণদীঘির পাড়ে পাট্টা পাওয়া জমিতে ছোট্ট একটি চালাঘর। বাবা খোঁকারাম বাগদি মুনিস খাটে। কিন্তু সবদিন খাটনিও মেলে না। মিলবে কি করে? শীতলপুর বানডোবা দেশ হিসাবে পরিচিত। বর্ষায় প্রায় প্রতিবছর লাঙ্গলহাটার বিল আর কুঁয়ে নদীর জলে তলিয়ে যায় বেশিরভাগ জমি। চাষ হয়না বললেই চলে। এলাকার মানুষকে তাই খরার চাষের উপরে নির্ভর করে থাকতে হয়। তাতেও বিশেষ সুবিধা হয় না। খরার চাষ আবার ক্যানেলের জল নির্ভর। জল পেলে চাষ হয়। না হলে মাঠের ধান শুকিয়ে বাবুই। হালে মুষ্টিমেয় কয়েকটি সাবমার্শিবল পাম্প হয়েছে। তাতে আর ক’বিঘেই বা জমি চাষ হয়! আর ক’দিনই বা খাটনি জোটে? অনেকেই তাই মজুর খাটতে বাইরে চলে যায়। নয়নের বাবাই কেবল তাদের ফেলে রেখে যেতে পারে না। বিলে মাছ ধরে কিম্বা অবস্থাপন্নদের বাড়িতে ফাইফরমাশ খেটে দিয়ে কিছু রোজগার করার চেষ্টা করে। তাতেও বিশেষ সুবিধা করতে পারে না। বাবুরা তাকে ভালো মানুষ পেয়ে যৎসামান্য কিছু টাকা দিয়ে ভালো মাছগুলো হাতিয়ে নেয়। কেউবা ইচ্ছা করে হিসাবে ভুল করে বেশি মাছ নিয়ে নেয়। ধারে নিয়েও অনেকে শোধ করে না। কেউ আবার দিনভর খাটিয়ে নিয়ে চাট্টি শুকনো মুড়ি আর কয়েকটা টাকা ধরিয়ে দেয়। হাঁকারাম কিছু বলতে পারে না। যে যা দেয় তাই নিয়ে খুশি মনে বাড়ি চলে আসে। লোকেরা তাই তার নাম দিয়েছে বোকারাম

তার অবশ্য তাতে কোন রাগ নেই। বরং দাঁত বের করে হাসে নির্ভেজাল হাসি। স্ত্রী তিলকা মাঝেমধ্যে মুখ ঝামটা দেয়, ‘তুমি একটা বোকার হদ্দ। পাগলেও নিজের ভালোটা বোঝে। সাধে কি আর লোকে তোমাকে বোকারাম বলে?’

খোঁকারাম তবুও দাঁত বের করে হাসে। তিলকা তত তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। লোকেদের কথা শুনে রাগ মাঝেমধ্যে নয়নেরও হয়। সে রাগ বাবাকে দেখায়, ‘তোমাকে সবাই ঠকায়, তারপরেও বোকারাম বলে। তুমি ওদের কিছু বলো না কেন? তুমিও তো ওদের ঠকিয়ে শোধ নিতে পারো?’

ছেলের কথা শুনে খোঁকারাম হাসে। তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, ‘বাবার নিন্দে শুনে তোর বুঝি খুব রাগ হয়?’

খুউব। ওদেরও আচ্ছা করে দু’কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।’

খবরদার না। ওঁরা সব গুরুজন হন। ওঁদের মুখের উপরে কথা বলতে নেই। যে যা বলছে বলুক গে। বোবা আর আর বোকার শত্রু নেই। বোকা পেয়ে আমাকে সবাই ঠকিয়ে নিচ্ছে নিক। আমি কাউকে ঠকিয়েছি এ কথা তো কেউ বলতে পারবে না। বোকারা সব ভালোমানুষ হয়। শুনিসনি লোকে বলে বোকা ভালোমানুষ। তোকেও সেইরকম ভালোমানুষ হতে হবে।’

বাবার কথাগুলো নয়নকে খুব ভাবিয়ে তোলে। এমনিতেই সে বড় নির্বিরোধী। খেলাতে বন্ধুদের চিক দিতে পর্যন্ত তার খারাপ লাগে। তাই ইচ্ছা করেই সে চিক খেয়ে বাড়ি আসে

ছেলের এহেন স্বভাব তিলকার দু’চোখের বিষ। কথায় কথায় প্রায় বলে থাকে, ‘বাপের মতো অমন মেনীমুখো বোকার হদ্দ হয়ে থেকো না। তাহলে জান কাঠকয়লা হয়ে যাবে।’

নয়ন জানে মা অমন ধারা গজগজ করে বটে তবে বাবাকে প্রচ্ছন্ন প্রশয়ও দেয়। তাকে আড়াল করে মাকে সে বলতে শুনেছে, ‘তোমার মতো মানুষকে ঘরসংসার করতে কে যে সাধ্যসাধনা করেছিল কে জানে? তোমার সাধু-সন্ন্যাসী হওয়া উচিত ছিল।’

বাবা হাসতে হাসতে বলে, ‘মুনি-ঋষিদের মতো সেই সাধনাই তো করছিলাম গো। মাঝখান থেকে তুমিই আমার ধ্যান ভাঙিয়ে দিলে।’

আহা, মরণ! ধ্যান ভাঙানোর প্রতিফল আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।’

ওই কথা শুনেই বাবা-মায়ের মধুর সম্পর্কের ব্যাপারটা আঁচ করে নয়ন। মায়ের মুখেই সে শুনেছে বাবার বন্ধুর বিয়েতে বর‍যাত্রী গিয়ে দুজনের আলাপ পরিচয় হয়েছিল। আজ অসময়ে মাকে জামা-প্যান্ট কাচতে বললে বাবাকে নির্ঘাত খোঁটা শুনতে হবে। তাই সে বাড়ি ফিরে নিজেই চুপিচুপি কাচতে বসে যায়। ঠিক সেই সময় বাবুদের বাড়ি থেকে কাজ সেরে মা বাড়ি ফিরে আসে। তাকে জামা-প্যান্ট কাচতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি রে নিজেই আজ কাচতে বসে গেলি? কিছু লাগিয়েছিস বুঝি? তাহলে তোলা জামাপ্যান্ট পড়ে গেলেই তো হত।’

তা হবে না। কাল বাইরে থেকে বড় বড় সব অফিসাররা আসবে। মাস্টারমশাই বলে দিয়েছে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে স্কুলের পোশাক পড়ে যেতে হবে।’

মাস্টারদের আর কি? বলে দিয়েই খালাস। একটা জামা-প্যান্টেই যেন সারা বছর চলে যাবে? তোর বাবাকে বলেও লাভ নেই। বাজার থেকে যে বাড়তি একপ্রস্থ পোশাক কিনে এনে দেবে সে মুরোদ তো নেই।’

ছেলেকে সরিয়ে দিয়ে জামা-প্যান্ট কাচতে কাচতে সমানে গজগজ করে তিলকা

সেদিন রাতে উত্তেজনায় ভালো করে ঘুমোতে পারে না নয়ন। বিডিও সাহেব কি জিজ্ঞেস করবেন কে জানে? সে ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারবে তো! তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের খুব গর্ব। তারা কেউ স্কুলের চৌকাঠ মাড়ায়নি। শুধু তারাই নয়, তাদের পরিবারের কেউই পড়াশোনার ধারে পাশে যায়নি। সেই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। সেই জন্য স্কুলের মাস্টারমশাই বিশেষ করে ক্লাসটিচার প্রসেঞ্জিত স্যার তাকে খুব স্নেহ করেন। তাঁদের উৎসাহেই সে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেও প্রতিবছর ভালোই রেজাল্ট করে। তাই বাবা-মায়ের মতো প্রসেঞ্জিত স্যারেরও তাকে ঘিরে অনেক আশা। সেই আশাপূরণ করতে পারবে তো সে? চিন্তাটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। পরদিন সকাল সকাল উঠে স্নানটান করে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে নেয় সে। জামা-প্যান্ট দুটো ঘরের মধ্যে দড়িতে শুকোতে দেওয়া ছিল। সেগুলো টেনে নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখে প্যান্টের কোমর আর জামার কলারটা তখনও ভালো করে শুকোয়নি। একটু ভিজে ভিজে হয়ে আছে। সে চুপিচুপি তাই পরে নেয়। মা জানতে পারলে ফের গজগজ করবে। আলাদা জামা প্যান্ট কিনে দিতে না পারার জন্য বাবাকে দুষবে। সেই জন্য জুতো-মোজা পরে দ্রুত স্কুল অভিমুখে রওনা দেয়। সেদিন স্কুলের ছেলেমেয়েরা তো বটেই, শিক্ষকমশাইরাও সব ঝা-চকচকে পোশাক পড়ে এসেছেন। সেই মুহুর্তে তাদের পাশে নয়নের নিজেকে খুব ম্যাড়মেড়ে লাগে। মনে হয়, তারও যদি ওইরকম একটা জামাপ্যান্ট থাকত!

মাস্টারমশাইরা তখন চরম ব্যস্ত। ঘনঘন মিডডে মিলের তদারকির পাশাপাশি কি করে বিডিও সাহেবকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে তা শেষবারের মতো ছেলেমেয়েদের ঝালিয়ে দিচ্ছেন। স্কুল শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই এসে পৌঁছোয় বিডিও সাহেবের গাড়ি। বিডিও, এসআই-এর সঙ্গে এসেছেন এমএলএ শুভজিৎ সিংহও। নয়নরা এগিয়ে গিয়ে ফুল দিয়ে তাঁদের বরণ করে অফিসঘরে নিয়ে যায়। আলাপ-পরিচয়পর্ব শেষে তাঁরা সটান চলে যান মিডডে মিল রান্নার জায়গায়। মাংস-ভাত একটু চেখে দেখেই শুরু করে দেন ক্লাস পরিদর্শন। নয়নরা তখন তাঁদের অপেক্ষায় ক্লাসঘরে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে। অন্যান্য দিন যার যেখানে ইচ্ছা বসলেও মাস্টারমশাইরা সেদিন বেছে বেছে পড়াশোনায় যারা ভালো তাদের সামনের বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। নয়ন সচরাচর পিছনের বেঞ্চেই বসে। প্রসেঞ্জিত স্যারের কথা মতো সেদিন তৃতীয় বেঞ্চে বসতে হয় তাকে। বিডিও সাহেব ঘরে পা রাখতেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে ‘সুস্বাগতম স্যার’ বলে অভ্যর্থনা জানায়। বিডিও সাহেব মিস্টি হেসে বলেন, ‘থ্যাঙ্কিউ। বসো তোমরা।’

ছাত্র-ছাত্রীরা বসার পর তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা “এম ইন লাইফ” মানে কি জানো?’

প্রথম বেঞ্চের সুস্মিত হাত তোলে। সে ক্লাসের ফার্স্টবয়। তার বাবা পুস্পিত রায় হাইস্কুলের মাস্টার। বিডিও সাহেব তাকে বলেন, ‘বেশ, মানেটা কি বলো তো দেখি?’

সুস্মিত উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘এম ইন লাইফ মানে জীবনের লক্ষ্য স্যার।’

 

মাস্টারমশাইরা এতক্ষণ একটা দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন। সুস্মিতের জবাব শুনে তাঁদের চোখেমুখে স্বস্তির ছাপ ফুটে ওঠে। বিডিও সাহেবও বাহবা দেন, ‘ঠিক বলেছ। এবার বলো দেখি, তোমার জীবনের লক্ষ কি?’

সুস্মিতের জবাব যেন ঠোঁটের ডগায় লেগেই ছিল। একটুও না ভেবে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেয়, ‘আমি বাবার মতো শিক্ষক হতে চাই।’

কেন শিক্ষক হতে চাও তুমি?’

শিক্ষককে মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয়। আমি সেই কারিগর হতে চাই।’

বাহ, খুব সুন্দর বলেছো।’

তারপর কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার আবার কেউ বা ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করে। পাঁচজনের পর পালা আসে নয়নের। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমি বোকা হতে চাই স্যার।’

তার উচ্চাশার কথা শুনে মাস্টারমশাইরাই বোকা বনে যান। তাঁদের তখন তীরের কাছে গিয়ে তরী থেকে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। হেডস্যার হতভম্ব হয়ে অলক্ষ্যে ক্লাসটিচার প্রসেঞ্জিতবাবুর মুখের দিকে চান। প্রসেঞ্জিতবাবু স্তম্ভিত

গোটা ক্লাস হেসে ওঠে। বিডিও সাহেব হাত তুলে থামান তাদের। কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে তিনি সবিষ্ময়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কি-কি, বললে তুমি?’

আমি বোকা হতে চাই।’

বোকা হলে তোমাকে তো সবাই ঠকিয়ে নেবে।’

নেয় তো নেবে। আমিও তো কাউকে ঠকাব না।’

ওইটুকু একটা ছেলের মুখে এমন গভীর জীবনবোধের কথা আশা করেননি বিডিও সাহেব। কৌতূহলবশতঃ তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার বন্ধুরা সব কত কিছু হতে চায়। তুমি তাদের মতো হতে না চেয়ে বোকা হতে চাও কেন?’

নয়ন ধীরে ধীরে বলে, ‘আমার বাবাকে যে যেমনভাবে পারে ঠকিয়ে নেয়। তাই সবাই বাবাকে বোকা বলে। বাবাকে কাউকে ঠকাতে শুনিনি। বাবা বলে, বোকারা ভালোমানুষ হয়।’

হেডস্যার আর নিতে পারেন না। নয়নের কথাগুলোকে তাঁর পাকামি মনে হয়। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই বিডিও সাহেব দু’হাত বাড়িয়ে নয়নকে ডেকে নেন। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘তুই ঠিকই বলেছিস বাবা। বোকারা বড় ভালো মানুষ হয়। আজ আমাদের সমাজে ভালো মানুষের খুব অভাব। তুই সেই অভাবটা পূরণ কর।’

দু’জনের চোখেই তখন জল