গত বছর ‘সামার প্রজেক্ট’ এর ঝামেলা থাকায় আন্দু ও বিন্দু মামাবাড়ি যেতে পারেনি। যখন থেকে বুঝতে শিখেছে, প্রতি গ্রীষ্মের ছুটির পুরোটাই মামাবাড়ি কাটিয়ে এসেছে। তবে মামাবাড়ির আম-জাম-লিচু বাগানে শুধু ঘোরাঘুরি, হুড়োহুড়ি, খাওয়া-খাই করেই সময় কাটায়নি।
সঙ্গে ক্লাসের পাঠ্যবইগুলো নিয়ে গেছে। সারাদিন মামার ছেলে
সন্তুর সঙ্গে বাগানে টো টো করে বেড়ালেও মায়ের শাসনে রাতে ঠিকঠাক পড়াশুনা করেছে।
তাই গতবছর গ্রীষ্মের ছুটিতে মামাবাড়ির আনন্দ থেকে বঞ্চিত
হওয়ায় এবারের গ্রীষ্মের ছুটিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কতক্ষণে ছুটি পড়বে আর কতক্ষণে দুইটা মিলে মায়ের
হাত ধরে মামার বাড়ি ছুটবে। হাত ধরে কেন বলছি? আন্দুর বয়স ১৫ বিন্দুর ১৩।
ওরা নিজেরাই মামাবাড়ি চলে যেতে পারে। কিন্তু মাকে ছাড়া ওরা কিছুতেই যাবে না।
মানে মা একা ওদের ছাড়বে না। সেক্ষেত্রে সবকিছু হলেও পড়াশোনাটা হবে না।
মায়ের সঙ্গে ওরা দুজনে মামাবাড়ি পৌঁছে গেল। গত বছর যেহেতু
মামাবাড়ি যায়নি, সেদিক থেকে এবারের যাওয়াটা ভীষণ কৌতূহলের ছিল। সর্বোপরি, এবারে গ্রীষ্মের ছুটিও এগিয়ে এলো। নির্দিষ্ট দিনের আগেই
গ্রীষ্মের ছুটি পড়ে গেল অনির্দিষ্টকালের জন্য। মানে স্কুল কবে খুলবে, সে কথা স্কুল ছুটির দিনে হেডমাস্টারমশাই বলে দেননি। সেটা
আরো আনন্দের। মামার বাড়ির আম, জাম, লিচু…তার সঙ্গে কচি ডাব, নারকেল ইত্যাদি খাবার পুরো
পার্ট চুকিয়েই ফিরবে। কমপক্ষে মে মাসটা পুরো তো ছুটি পাচ্ছেই। বাকিটা বোনাস!
মামাবাড়ির কাছাকাছি বাজার। বাজারে ঢুকেই ডান হাতে মামার
বহু পুরনো ঘড়ির দোকান, যেটা ওদের মামার বাপ-ঠাকুরদার পুরনো ব্যবসা। বরং মামার
হাতে পড়ে ঘড়ির ব্যবসা দিন দিন ফুলেফেঁপে উঠেছে। শুরুতে কেবলমাত্র পুরনো দিনের
ঢাউস-ঢাউস দেওয়াল ঘড়ি, সঙ্গে দেশি-বিদেশি ছোট-বড় সব ধরনের ঘড়ি মেরামতের দোকান
ছিল। আন্দু-বিন্দুর মামার বাবার সময় পর্যন্ত মেরামতের ব্যবসাই ছিল। ব্যবসা যখন
ওদের মামার দায়িত্বে এল,
সে দোকানের পেছনটা আরো বাড়িয়ে পাকা ঘর করে সুদৃশ্য শোকেস
করে নামিদামি ব্রাণ্ডের নতুন নতুন ঘড়িতে দোকান সাজিয়ে তুলল। মেরামতের কাজও চলল।
তবে বহু পুরনো তামা, ব্রোঞ্জ, কাঠ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি
কিম্ভুতাকার কিছু ঘড়ি দোকানে পড়েছিল। যেসব ঘড়ি সারাই করতে দিয়ে কাস্টমাররা আর
নিতে আসেনি। নতুন ঘড়িতে দোকান সাজানোর জন্য সেসব পুরনো ঘড়িগুলো বাড়িতে এনে
রাখলো। শুধু রাখলো বললে ভুল হবে। বাড়ির একটা ঘরে পুরনো ঘড়িগুলো সাজিয়ে সেটাও
একটা দোকানের রূপ দিল।
আসলে আন্দু-বিন্দুর মামার মনে একটা সুপ্ত স্বপ্ন ছিল। সৎ পথে ব্যবসা করে পৈত্রিক ব্যবসা বাড়িয়ে একদিন অনেক বড়লোক হবে। সমাজের
পাঁচজনে চিনবে। অনেক নামডাক হবে…
ওদের মামা সারাদিন দোকানে থাকে। রাত আটটায় দোকান বন্ধ করে
বাড়ি ফেরে। রাতে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত বাড়ির দোকানে বসে ঘড়ি মেরামতের কাজ করে।
তারপর সেগুলো ওয়াশিং লিকুইড দিয়ে ঘষেমেজে ঝকঝকে করে নতুনের মতো অবস্থায় এনে
দোকানে নিয়ে যায়। ‘পুরনো ঘড়ির মেকানিক’ বলে বাজারে ওদের মামার বিশাল খ্যাতি।
সেদিন বাজার বন্ধ ছিল। মামা বাজারে যায়নি। সকালে উঠে ওদের
সঙ্গে কিছু সময় গল্পগুজব,
খুনসুটি করে সকালের টিফিন শেষে দোকানে বসে ঘড়ি মেরামতের
কাজ শুরু করলো। আন্দু-বিন্দু দোকানে ঢুকে মামার সামনে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে ঘড়ি
মেরামত করা দেখছে, ঠিক যেমন শিক্ষানবিশ মনোযোগ দিয়ে কাজ শেখে।
মামা দুই-একটা ঘড়ির কাজ সেরে উঠে গিয়ে দোকানের কর্নারে
একটা তাক থেকে ধুলোবালি পড়া একটা বহু পুরনো ঢাউস ঘড়ি বের করে এনে দোকানের
মেঝেতে বসলো। ওরা খুব মনোযোগ দিয়ে এত বড় ঘড়িটা দেখতে লাগলো। মামা ওদের সামনেই
ঘড়ির ধুলোবালি মুছে ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বলতো, ঘড়িটা কী দিয়ে তৈরি?”
“সোনা দিয়ে মামা?” বিন্দু ঘড়িটা চিকচিক করতে
দেখে বলল।
“ধুর পাগলী। এটা সোনার হলে আমি তো বড়লোক হয়ে যেতাম। এটা
পেতলের তৈরি।”
হঠাৎ মামি হাঁক দেওয়ায় মামা ঘড়িটা রেখে উঠে পড়ল। এই
সুযোগে আন্দু-বিন্দু ঘড়িটা ভালো করে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো। মামা তখনো ঘড়িটার
পেছনটা মুছে উঠতে পারেনি। বিশাল বড় ঘড়ি ধরে উল্টে দেখে, পেছনটায় ধুলোবালি, নোংরা জমে কালশিটে হয়ে
গেছে। বিন্দু কাপড়ের ন্যাকড়াটা হাতে নিয়ে ঘড়ির পেছনটা ঘষাঘষি করতে লাগলো।
পেছনের ধুলোবালি ন্যাকড়ার ঘষায় উঠে যাওয়ার পর বিন্দু দেখলো, ঘড়ির পেছনে একটা অস্পষ্ট লেখা। লেখাটা আরো দুই-একবার ঘষার
পর চোখে পরিষ্কার দেখা দিতে লাগলো— ঘড়ির বন্ধ কাঁটাও সময় বলে। লাইনটা পড়েই বিন্দু দাদাকে
ডেকে বলে, “দেখ দেখ দাদা, এই লেখাটা পড়…”
আন্দু খুব আগ্রহের সঙ্গে লেখাটা পড়তে থাকে— ঘড়ির বন্ধ
কাঁটাও সময় বলে।
এরমধ্যে বিন্দু বলে ওঠে, “দাদা, ঘড়ির বন্ধ কাঁটা কী করে সময় বলে?”
“তা কখনো হয় নাকি? মামার কাছে জিজ্ঞেস করি…”
মামা ফিরতেই বিন্দু চোখ বড় বড় করে মামার দিকে তাকিয়ে বলে, “মামা মামা দেখো, ঘড়িটার পেছনে কী লেখা!”
“কই দেখি,” বলেই মামা চোখ বড় বড় করে
পড়তে থাকে। লাইনটা দুবার পড়ে ভীষণ চমকে যায়। স্বগতোক্তি করতে থাকে—ঘড়ির বন্ধ
কাঁটা কী করে সময় বলে দেয়! লাইনটা পড়ে সে মূক-বধির মতো আন্দু-বিন্দুর দিকে
তাকিয়ে থাকে। কী বলবে কিছুই ভেবে পায় না।! লাইনটার মধ্যে রহস্যের গন্ধ পাওয়া
যাচ্ছে।
মামাকে চুপ থাকতে দেখে বিন্দু জিজ্ঞেস করে, “মামা, বন্ধ ঘড়ি কী করে সময় বলে?”
“আমি সেটাই ভাবছি…”
মামি হঠাৎ আন্দু-বিন্দুকে ডাক দেয়। দুইটায় ছুটে গিয়ে
দেখে, মামি বড় বড় ডাঁসা লিচু ছুলে প্লেট ভরে সাজিয়ে রেখেছে।
প্লেটের পাশে বসে দুইটায় মিলে মস্তি করে খাওয়া শুরু করে। প্লেট ভর্তি এমন
মিষ্টি লিচু পেয়ে ওরা ঘড়ি-রহস্যের কথা ভুলে গেছে। লিচু খাওয়া শেষ করে দুইটায়
মিলে দিল বাগানের দিকে ছুট। ওখানে সন্তু গাছ থেকে ঝরে পড়া আমকুসি নিয়ে খেলা
করছিল। ওরা দুইটায় ছুটে গিয়ে সন্তুর সঙ্গ দেয়।
মামা এখনো পুরনো ঘড়িটা হাতে ঠায় বসে রয়েছে। ‘ঘড়ি বন্ধ
কাঁটাও সময় বলে’ এই লাইনটাই মাথার মধ্যে কিলবিল করছে।
কিছু ভেবে না পেয়ে নানান সাইজের স্ক্রুড্রাইভার নিয়ে
পুরনো ঘড়ির জংধরা স্ক্রুর জং ঘষে ঘষে সেগুলো খুলতে থাকে। প্রথমে ঘড়ির ওপরের
দিকটা খুলতে না পারায় পেছনের ঢাউস ছটা স্ক্রু খুলে ফেলল। স্ক্রু খোলার মুহূর্তে
তার মনে হল, বহু পুরনো ঘড়ি তার দোকানে রয়েছে। বিভিন্ন কারণে
কাস্টমাররা ঘড়িগুলো দিয়ে আর ফেরত নিতে আসেনি। সারাই করে চালু করে রেখে দিয়েছে। সেগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। সে সকল ঘড়ি পয়লা
বৈশাখের দিন দোকানঘর পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন করার সময় এদিক-ওদিক সরাতে গিয়ে হাতে
নিয়ে দেখেছে, ঘড়ির যেমন স্বাভাবিক ওজন হয় তেমনই মনে হয়েছে, কিন্তু হাতের এই ঘড়িটার পেছনের ছটা স্ক্রু খোলার সময় মনে
হল ঘড়িটার ওজন তুলনামূলক খুব বেশি। পিতলের ফ্রেমের ঘড়ি এতটা ওজন হওয়ার কথা নয়।
মনে হল ভেতরের বডিটা পুরো সলিড। ভাবতে ভাবতে ছোট্ট মেটাল হাতুড়িটা নিয়ে ঘড়ির
পেছনে ঠুক ঠুক করে টাকাতে থাকে। হাতুড়ির শব্দে মনে হল ভেতরে পুরোটাই সলিড ধাতু।
আর কয়েকবার ঠুকঠুক করে মারতেই ঘড়িটা ঝনঝন করে ওঠে। এবারে ভালো করে তাকিয়ে দেখে, একটা পাতলা পাত ঘড়ির পেছনের অংশ থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে।
পেছনের অংশের একদিকে পাতলা লোহার স্কেল ঢুকিয়ে চাপ দিতেই ঘড়ির পেছনের কভারের ওপর
থেকে একটা পাতলা কভার আলাদা হয়ে গেল। এই পাতলা কভারটা পুরো পেতলের। কভারটা
তোলার পর মামা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। ঘড়ির পেছনটা পুরো সোনার মতো ঝকমক
করছে। মুহূর্তের মধ্যে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বিন্দু বলেছিল, ঘড়িটা সোনার। তাই যেন হয়!
হঠাৎ মনে পড়ে, বাবা বোতলে করে একটা লিকুইড
এনে বলেছিল, “এটা দিয়ে সোনার আসল-নকল পরীক্ষা করা যায়। ঘড়িটা রেখে উঠে
গিয়ে দোকানের তাক থেকে লিকুইডের বোতলটা এনে ঘড়িটার পেছনের অংশে দু-এক ফোঁটা
ফেলতেই বুঝতে পারল, পুরোটাই সোনা। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে নোংরা ন্যাকড়া দিয়ে
ঘড়িটা ঢেকে চোখ বন্ধ করে বসে রইল। তার সামনে বিশাল আকৃতির সোনার খড়ি। ওজন করা না
থাকলেও বেশ কয়েক কেজি হবে! এত সোনা দিয়ে তো কেউ ঘড়ি বানাবে না! তাহলে সোনার
দোকানদার অবৈধ সোনা লুকিয়ে রাখার জন্য এই ঘড়িটাকে ব্যবহার করেছিল। ঘড়িটার
পেছনের অংশ খুলে পুরো সোনাটা ফ্রেমের আকৃতি দিয়ে সেট করে তারপর ওপরটা পেতলের পাতি
দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল। তার যে ছেলে ঘড়িটা সারাই করতে দিয়েছিল, সে হয়তো জানতোই না এর ভেতরে কী সম্পদ লুকিয়ে রয়েছে…”
কেজি কেজি সোনা তার হাতের কাছে! এবার ধীরে ধীরে উঠে দোকানের
দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে আবার এসে ঘড়িটার সামনে বসলো। স্ক্রুড্রাইভার হাতে নিয়ে ঘড়িটার ওপরের মডেল পুরো খুলে
ফেলল। ওপরের মডেল বাদ দিয়ে বাকিটা পুরোটাই সলিড সোনা। যদ্দূর মনে পড়ছে, বাবা একবার বলেছিল, “এই ঘড়িটা যে ছেলেটা সারাই
করতে দিয়েছিল তার বাবা একজন সোনার দোকানদার। ঘড়িটা সারাই করতে দেওয়ার কিছুদিন
পরে নাকি ছেলেটা মারা যায়। তারপর থেকে দোকানটা বন্ধ। দোকানদার অন্য গ্রামের
মানুষ। এখানে দোকান ভাড়া নিয়ে সোনার দোকান দিয়েছিল। পরে একদিন শুনলাম, দোকানটা বিক্রি হয়ে গেছে।”
যাইহোক, এদিকে সময় অনেকটা গড়িয়ে
গেল। আন্দু-বিন্দু যদি এসে দেখে, দোকান ভিতর থেকে বন্ধ, তো ওরা সন্দেহ করবে। নানান রকম প্রশ্ন করবে। ঘড়িটা
তড়িঘড়ি নোংরা ন্যাকড়ায় পেঁচিয়ে দোকানের একটা গোপন বাক্সে রেখে তালা মেরে দিল।
সম্পূর্ণ চুপচাপ কাউকে কিছু বলল না।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সকলে শুয়ে পড়বো। আন্দু-বিন্দুর
মামার কিছুতেই ঘুম আসছে না! দুচোখ বুজে ওপরের দিকে মুখ করে শুয়ে রইলো। একটু ঘুম
ধরতেই স্বপ্ন— দেখছে, আন্দু-বিন্দু বাক্স খুলে সোনার ঘড়িটা নিয়ে লিচুবাগানের
দিকে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে,
ছুটতে ছুটতে লিচু বাগানের নিচে তৈরি করা মাচাটায় গিয়ে ওরা
বসল। তারপর ঘড়িতে প্যাঁচানো ন্যাকড়াটা সরিয়ে ওরা বলতে শুরু করল, “কী মজা, কী মজা! ‘ঘড়ির বন্ধ কাঁটাও
সময় বলে’। অনেক বছর পড়ে থাকা বন্ধ ঘড়িটা যেন বলে দিল, সে সোনার তৈরি। আমাদের মামার বড়লোক হওয়ার সময় হয়েছে, সেই সময়ের কথা ঘড়িটা কাজেকম্মে কেমন বুঝিয়ে বলে দিল! এটা
বিক্রি করে মামা অনেক টাকা পাবে। অনেক। আমার মামা বলছিল, ‘ঘড়িটা সোনার হলে আমি অনেক বড়লোক হয়ে যাব’। সত্যি তাই
মামা, তুমি আজ সোনার ঘড়ির মালিক, অনেক বড়লোক, বড়লোক…”