গল্প । আষাঢ় ১৪৩২



মাটির মানুষের কীর্তি 









ইন্দ্রনীল মণ্ডল

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ


 

বিবিদীননাথ বাগ, নির্বিরোধী, প্রতিবাদহীন, সহনশীল একজন চরিত্র। নাকাশিপারার পূর্বদিকে একটা ছোট বাড়ির মালিক তিনি। বলা যেতে পারে তার নির্ঝঞ্ঝাট সংসারে তার কোন অভিযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। তাদের বাড়ির থেকে ঝগড়া-ঝাঁটির, উচ্চস্বরের আওয়াজ আশপাশের প্রতিবেশীরা পেয়েছে কী না বলা শক্ত। মাঝেসাজে একটু গিন্নির বা ছেলের গলা চড়লেও তাতে দীননাথ বাবুর গলা পাওয়া যায় না।

তার এই নির্বিরোধী মানুষ হওয়ার খেসারত মাঝে মাঝেই দিতে হয়। শীতের শুরুতে নিতাই মোদকের দোকান থেকে পনেরোটা নতুন গুড়ের রসগোল্লা কিনেছিলেন, দামও দিয়েছিলেন সঠিক। কিন্তু বাড়ি এসে দেখেন পনেরোটা জায়গায় তেরোটা রসগোল্লা দিয়েছে। স্ত্রী খানিক চেঁচামেচি করায় তিনি বলেন “যাক গে, ভারী তো দুটো রসগোল্লা, ছেড়ে দাও। হয়তো আমারই ভুল। আমি মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকেছি, কীআর করা যাবে!” মাটির মানুষ দীননাথবাবু তাই জোর গলায় তর্কাতর্কি, চেঁচামেচি করতে পারেননি। 

মাছ বাজারেও সেদিন দশটা পাবদার মধ্যে দুটো পচা পাবদা দিয়ে দিয়েছিল। মাছ বিক্রেতা কখন হাত সাফাই করে ভালো দুটো বের করে খারাপ দুটো ঢুকিয়ে দিয়েছিল তা তিনি বুঝতেও পারেননি। বাড়িতে এসে গিন্নির চেঁচামেচিতে তিনি প্রতিবাদও করতে পারেননি। কারণ তিনি তো জানেন, তিনি ভালো মাছ কিনেছিলেন। পরে মাছ বিক্রেতার পচা মাছ গছিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ করলেও, মাছ বিক্রেতা উল্টে তাকেই বলে যে, “আপনিই তো বেছে দিলেন। তাহলে কীকরে আমি পচা মাছ দিলাম? আপনারা ভুলভাল কাজ করে আমাদের ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে আমাদের বদনাম করেন।” দীননাথবাবু উচ্চস্বরে চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাঁটি করার লোক নন। তাই তাকে নির্বিবাদে লোকসান এবং অসম্মান, দুটোই মেনে নিতে হয়েছিল। 

কিছুমাস আগে বাস কন্ডাক্টারও তাকে ঠকিয়েছিল। তিনি বাসে করে কলকাতায় যাচ্ছিলেন, ভাড়া ৪০ টাকা। তিনি একটি ১০০ টাকার নোট কন্ডাক্টারকে দেন। কন্ডাক্টার তাকে টিকিট দিয়ে বলেন, “বাকি টাকাটা দিচ্ছি।” গন্তব্যস্থল এসে যাওয়ায় কন্ডাক্টারকে বললেন “এবার টাকাটা দিন।” কন্ডাক্টার তাকে একটা দশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলে তিনি বললেন, “আমি তো ১০০ টাকা দিয়েছিলাম, ৬০ টাকা ফেরত পাব।” না, আপনি তো ৫০ টাকাই দিয়েছেন, ১০০ টাকা দেননি।” গন্তব্যস্থল এসে যাওয়ায় দ্রুত নেমে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন ওই ১০ টাকা নিয়েই

নিজেকে অনেকবার তিনি প্রশ্ন করেছেন, তার এই সরলতা, এই নির্বিরোধীতা, সহনশীলতা— এই স্বভাব কি এই যুগে অচল? তিনি কি বোকা? নাকি তিনিই সঠিক, জগতটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে? ভবিষ্যতই এর উত্তর দেবে। আর সেই উত্তর তিনি পেয়ে গেলেন একদিন। তারপরেই তার এই স্বভাবের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল তার পাড়ার আশেপাশে সকলের মধ্যে। তার এই মাটির মানুষ হবার সুবাদেই সেদিন তাদের পরিবারটা ডাকাতির হাত থেকে বেঁচে গেছিল। 

সেদিন ছিল মাঘ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। কদিন বাদেই তাদের এক আত্মীয়ের বিয়ে থাকায়, সেখানে যাওয়ার জন্য বেশ কিছু সোনার গহনা-গাটি, টাকা-পয়সা ব্যাংক থেকে বাড়িতে এনে রেখেছিলেন। বাগ পরিবার মোটামুটি রাত্রি এগারোটা সাড়ে এগারটার মধ্যে সব কাজ মিটিয়ে শুতে চলে যায়। দীননাথবাবু সামান্য একটু লেখালেখি করেন বলে তার শুতে অনেক সময় রাত বারোটা সাড়ে বারোটা বেজে যায়। সেই রাত্রে ঠান্ডাটা একটু জোরদার হওয়ায় তিনি তাড়াতাড়ি লেখা পত্রের কাজ মিটিয়ে, আলো নিভিয়ে শোওয়ার জন্য তোড়জোড় করছিলেন। তখন হঠাৎই দেখেন কোন জাদুবলে আপদমস্তক কালো কাপড়ের ঢাকা দুজন ষন্ডামার্কা লোক ছাদের দিক থেকে তার ঘরের দিকে নেমে এসেছে। প্রথমে তিনি একটু হকচকিয়ে যান। এর মধ্যে দেখেন যে, লোক দুটোর একজনের হাতে একটা বাঁকানো বড় ছোরা, যেটা বাইরে থেকে বারান্দায় এসে পড়া আলোয় মাঝে মাঝে চকচক করে উঠছে। আর আরেকজনের হাতে একটা রিভলভার বা পিস্তল জাতীয় কিছু। 

ফ্যাসফ্যাসে গলায় ছোরাধারি লোকটা বলে উঠলো, “এই, সব টাকা পয়সা গয়না-টয়না কোথায় রেখেছিস বের কর, না হলে এক্ষুনি তোর গলার নালী কেটে দেবো।” ভেতরে ভেতরে দীননাথ সামান্য চিন্তিত হলেও, কিঞ্চিৎ ভয় পেলেও তখনই কোন উত্তর করলেন না। তিনি নির্বিরোধী, মৃয়মান স্বভাবের হলেও তার বুদ্ধি খুব তীক্ষ্ণ। শুধু তিনি উচ্চস্বরে সঠিক সময়ে প্রতিবাদ করতে পারেননা এই যা। তিনি খুব মৃদু স্বরে তাদের বলতে লাগলেন, “তা বাপু, তোমরা যখন এসেই পড়েছ তাহলে মারামারি করার দরকার কী? আমি তোমাদের দেখিয়ে দিচ্ছি কোথায় আমি ঐসব টাকা-পয়সা, গহনা রেখেছি। ঘরে আমার স্ত্রী ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে, তাকে জাগানো উচিত হবে না। তার ঘুম ঠিকমতো না হলে অসুবিধা হয। পরের দিন চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে তুলবে। তোমরা দাঁড়াও। আমি এনে দিচ্ছি।” 

পিস্তলধারি জোরে বলে উঠলো, “ওসব ন্যাকামো ছাড়। এক্ষুনি বল, কোথায় রেখেছিস সব? নইলে মাথার খুলি ফুটো করে দেব এক্ষুনি।” চালাক দীননাথবাবু বুদ্ধি করে তাদের রান্না ঘরের দিকে নিয়ে যেতে চাইলেন। 

ছোরাধারি বলে উঠলো, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? শোবার ঘরে না গিয়ে?” 

আমি আলমারিতে এসব রাখি না। এর আগে একবার আলমারি ভেঙ্গে বাড়িতে চুরি হয়ে গেছিল। তারপর থেকে এখন রান্নাঘরের ক্যাবিনেটের মধ্যে একটা গোপন কুটুরিতে রাখি। তোমরা এসো আমার সঙ্গে। নিজেরাই ওখান থেকে বের করে নাও। কিন্তু বাপু আঘাত-টাঘাত করোনা। ওটার খবর আমি ছাড়া কেউ জানে না। আমাকে মারলে কিছুরই হদিশ পাবে না।” 

এই বলে তিনি আধো অন্ধকারে ডাকাত দুটোকে তার সঙ্গে রান্নাঘরে নিয়ে এলেন। যদিও একজন তার পিঠে ছোরাটা ধরেছিল। রান্নাঘরে ছোট্ট আলো জ্বেলে দিয়ে একটা কেবিনেটের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “ওইখানে একটা বাক্সের মধ্যে লুকানো আছে। তোমরা একটু কষ্ট করে উঠে নিয়ে নাও। আমি বৃদ্ধ মানুষ পারবো না।” ডাকাতের মধ্যে একজন অন্যজনকে বলল, “এই ঘনা, তুই টুলটা নিয়ে ওপরে উঠে দেখ তো আধবুড়োটা ঠিক বলছে কিনা? আমি এদিকটা দেখছি।” এই কথার মধ্যে ঘনা ঘরের কোনা থেকে একটা টুল নিয়ে তাড়াহুড়া করে উঠতে যাওয়ায় পা পিছলে যায়, আর আরেকজন সেই দিকে “কী হলো রে” বলে সামান্য নজর ঘোরাতেই তাদের অন্যমনস্কতার সুযোগে দীননাথ আওয়াজ না করে ধীরে ধীরে পেছনের দিকে এসে, অতি দ্রুততার সঙ্গে রান্নাঘরের দরজা পেরিয়ে রান্নাঘরের দরজা দুটোকে টেনে বন্ধ করে হুড়কো লাগিয়ে দেন। প্রায় চোখের নিমেষে কাজটা করে উত্তেজনায় হাঁপাতে থাকেন।  

তাড়াতাড়ি ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে সব ঘটনাটা জানিয়ে বললেন, “আমি ১০০তে ফোন করে দিয়েছি। মনে হয় পুলিশ এক্ষুনি এসে পড়বে।” 

ছেলে উত্তেজিত হয়ে চেঁচামেচি করতে যাচ্ছিল, কিন্তু মাটির মানুষ দীননাথবাবু বলেন, “বাবা, এখন তো অনেক রাত হয়েছে, এখন আর চেঁচামেচি করে লাভ নেই। ওরা তো বন্দী হয়ে রয়েছে। ওদের চেঁচামেচি, দরজা ধাক্কাধাক্কিতে বাকিরা উঠে পড়লো বলে। তার মধ্যে তুইও যদি আরো চেঁচামেচি করিস তাহলে পাড়া-প্রতিবেশীরা ঘুম থেকে জেগে উঠবে, অকারণে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ওই দুটো পাষণ্ড তো আটকা পড়েছে। তুই বরঞ্চ পাশের বাড়ির থেকে তোর বন্ধু নীলুকে ডেকে আন। পুলিশ যতক্ষন না আসে ততক্ষণ আমরা পাহারা দেব।” 

ছেলে বলল, “আর গহনা, টাকা-পয়সা? ওরা তো সব নিয়ে নেবে!” 

ধুর, বোকা। রান্নাঘরে ওগুলো রাখাই নেই। ওগুলো আমার শোবার ঘরের আলমারিতেই রয়েছে।” 

সত্যি বাবা! সবাই তোমাকে এত কিছু বলে, তুমি প্রতিবাদ করো না, নিশ্চুপ থাকো। কিন্তু তোমার এত বুদ্ধি ভাবতেই পারছি না। তুমি সাংঘাতিক দুঃসাহসের কাজ করেছো।” ডাকাতরাও তার এই নিরীহ স্বভাবকে বুঝতে পারেনি বলেই তাদের এই পরিণতি। দীননাথের সহনশীল, নির্বিরোধী স্বভাবই তার পরিবারকে ডাকাতির হাত থেকে সেদিন রক্ষা করেছিল