উপন্যাস – যত বিপদ মালদায় - প্রীতম সরকার । মার্চ - ২০২৪








     যত বিপদ মালদায়



প্রী ত ম
স র কা র






....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -

 

 

।। ৮ ।।

          কালিয়াচক এলাকার এই ঘরটি বেশ বড়সর। আধুনিক সব আসবাব দিয়ে সাজানো। দেওয়ালের একদিকে লাগানো রয়েছে বস বড় আকারের এলসিডি টেলিভিশন। ঘরের একদিকে এক পেল্লাই সাইজের টেবিলের ওপাশে রিভলবিং চেয়ারে বসে রয়েছেন সুলতানদের ‘বস্‌’ ইসমাইল হক। জাল নোটের কারবার, স্মাগ্লিং, ড্রাগস্‌ এর ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন তিনি। সেই টেবিলের অন্যদিকে চেয়ারে বসে রয়েছে, তিনজন। দুলাল, হারুন আর সুলতান। এই তিন জনকেই তাঁদের বস্‌ ইসমাইল হক ডেকে পাঠিয়েছেন। গৌড়ের মতো শান্ত সীমান্তের ধারের এলাকায় বস্‌ এর জাল নোট মজুদ করার ঠিকানা এই তিনজন বাচ্চা কিভাবে জানলো আর তাঁদের মধ্যে থেকে একজন কিভাবে তিনজনের ক্ষপ্পড় থেকে পালিয়ে বেঁচে পালালো, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। সবারই মুখ ভার। বস্‌ কিছুতেই মানতে চাইছে না, এই ঘটনায় দুলাল, হারুন বা সুলতানের কোন গাফিলতি ছিলনা। বসে্‌র বিশ্বাস, এই তিনজনের কোন গাফিলতিতেই তাঁর বহুদিনের নিরাপদ গোপন ডেরার খবর শেষ পর্যন্ত পুলিশের নজরে এলো। তার উপরে বস্‌ আরও ক্ষেপেছেন, যখন জানতে পেরেছেন, সব ‘নকলি্‌’ নোট সেখানেই রেখে এঁরা ওই দুই বাচ্চাকে নিয়ে কালিয়াচকে এসেছে।

বিশ্বাস করো বস্‌, আমাদের কোন দোষই নেই। কিভাবে যে তিনজন ওই সুরঙ্গের ভিতরে ঢুকে এলো, আমরা নিজেরাও বুঝতে পারছি না,’ বললো দুলাল।

সুলতান সঙ্গে বলে উঠলো, ‘আমরা তখন এতটাই নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম, এমনকি যে ছেলেটা পালিয়ে গেলো, তাঁকে ধরতে পিস্তল থেকে এক রাউন্ড গুলিও চালানো হয়েছিল। তারমধ্যেও ছেলেটা ভেগে গেলো।’

দুলালের কথাকে সমর্থন করে হারুন বললো, ‘বস্‌, আমি নিজে দু নম্বর গর্তের উপর মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে উপরে মাটি চাপা দিয়েছিলাম। কিন্তু তা সত্বেও ওঁরা কিভাবে ভিতরে ঢুকলো, এখনও ঘটনাটা ভাবতে অবাক লাগছে।’

ইসমাইল হক ক্রুদ্ধ চোখে তিনজনের দিকেই ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছেন। দুলাল- হারুনের পরে সুলতান বস্‌কে খুশি করতেই বলে উঠলো, ‘তবে বস্‌, এটা মানতেই হবে, যে আমরা দুজনকে ধরে ফেলেছি। যেটা পালিয়েছে, সেটা এতটাই ভয় পেয়েছে, যে মুখ খুলবে বলে মনে হয়না। তাছাড়া বস্‌, তোমার কথা মতো দুজনকে কালিয়াচকের অন্য ডেরায় যে সরিয়ে এসেছি, তা তো নিজের চোখেই দেখে আসলে। ওঁদের পাহারায় ইকবাল আর মইনুদ্দিনকে রেখেছি। তুমি কোন চিন্তা করোনা। কোন ঝামেলা হবে না।’

এতক্ষন চুপচাপ সব শুনছিলেন ইসমাইল হক। এবার ক্ষেপে   দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, ‘খুব বড় কাম করেছিস তোরা ! মাল ওখানেই রেখে এসেছিস। যদি পুলিশ নিয়ে ঐ ছেলেটা ফের যায়, কি হবে তোদের ধারনা আছে ! তোদের ওইদিন যে ল্যাপটপটা দিলাম, সেটা কোথায় ! ফেলে এসেছিল তো ! ওতে কি আছে জানিস। পুলিশ যদি ওটার খোঁজ পায়, তবে তোদের সাথে আমাকেও ভিতরে যেতে হবে। আর এই যা কেস দেবে না, বিশেষ করে কেস যদি ইডি নেয়, তাহলে তো আর কথাই নেই, আর বলছিস, বেফিকর থাকবো আমি !’

এবার কিছুটা শান্ত হয়ে ইসমাইল বলে ওঠে, ‘তার চেয়ে এক কাজ কর, যে টাকা ওঁই বাচ্চাদের বাড়িতে চেয়েছিস, সেটা দ্বিগুন বাড়িয়ে দে। একদিকের লোকসান অন্যভাবে তো পোষাতে হবে আমাকে ! আর পুলিশের থানাগুলোও হয়েছে এখন এক চিড়িয়াখানা ! আগে কোথাও কিছু করতে যাওয়ার আগে খবর দিত। এখন আর দেয় না। নকলি্‌ নোটের বিষয় নাকি এখন সব দিল্লি না কলকাতার অফিসাররা দেখভাল করে।’

দুলাল এবার আমতা আমতা করে বললো, ‘ কিন্তু বস্‌, ছেলে মেয়ে দুটোই মহা বিচ্ছু। ওঁদের নিয়ে কি করবো সেটা তো বলবে !’

ইসমাইল ভেবে বলে, ‘আজ রাতটা আটকে রাখ্‌। দেখছি কি হচ্ছে !!’

এবার কথা বললো সুলতান। দীর্ঘদিন বিহারের জেলে থাকার পরে ছাড়া পেয়ে কিছুদিন আগে মালদায় এসেছে ইসমাইলের হয়ে কাজ করতে। ও দুলালকে বললো, ‘বস্‌এর কাছে তো ওঁদের বাড়ির টেলিফোন নম্বর আছে। এখান থেকেই আবার ফোন করে কুড়ি লাখকে চল্লিশ লাখ বলে চাপ দে। তবেই খেল জমবে। আমরাও কয়েকদিনের জন্য গা-ঢাকা দিতে পারবো। এদিকে নকলি্‌ নোটের কিসসা ঠান্ডা হতেই আবার ফিরে আসবো বসে্‌র কাছে।’

ওঁদের গা ঢাকা দেওয়ার বিষয়টা মনপুতঃ না হলেও ইসমাইল হক পাঞ্জাবির পকেট থেকে নম্বর লেখা কাগজটা দুলালের দিকে এগিয়ে দিলেন। বস্‌ টেবিলের ফোন সাধারনত ওঁরা ব্যবহার করেনা, কিন্তু এই বিষয়টা আলাদা বলে বস্‌ বিশেষ আপত্তি তুললেন না।

দুলাল টেলিফোনের নম্বর ডায়াল করলো। ততক্ষনে গৌড়ের সমীরবাবুর গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছে টিপুরা। ফোনের রিং হতেই ফোন তুললেন সমীরবাবু। আসলে সবাই টেলিফোনকে ঘিরেই এতক্ষন বসেছিলেন। যদি কোন খবর পাওয়া যায় পুলিশের পক্ষ থেকে ! দুলাল যতটা কঠিন গলা তাঁর পক্ষে করা সম্ভব, সেভাবে ‘বস্‌’এর শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলি আওড়ে গেল। কথা শুনে, শুধু ‘দেখছি’ বলে টেলিফোনের রিসিভারটাকে ক্রেডেলে রেখে দিলেন। ঘরে উপস্থিত সবাই তখন উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়ে রয়েছেন সমীরবাবুর দিকে। ‘আবার কি ওঁরা’, ‘কি বলছে আবার’- প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন ঘরে থাকা সবাই। সমীরবাবু এই ঘটনা গ্রামের আর পাঁচজনকে বলেননি। তাঁর মনে হয়েছিল, সেটায় বিপদ আরও বাড়বে। সমীরবাবু ঘরে উপস্থিত সকলের সামনে ফোনের ওপাড় থেকে শোনা কথাগুলো বলতেই ঘরে ফের গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো। ডুকরে কেঁদে উঠলেন অমিতাদেবী। সমীরবাবু সেই অবস্থাতেও মাথা ঠান্ডা করে নিজের বুক পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে থানার ও সি পরেশবাবুর নম্বরটা ডায়াল করলেন। বিকালেই থানার ও সি পরেশবাবু তাঁকে  নিজের সেলফোন নম্বরটি দিয়েছিলেন। এখন সেটা কাজে লাগলো।

ওপাড়ে দুবার রিং হতেই পরেশবাবুর গলা পেলেন সমীরবাবু। প্রায় এক নিঃশ্বাসে মুক্তিপনের টাকা বেড়ে যাওয়ার সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন আমরা কি করবো ! এতটাকা এভাবে এখুনি জোগাড় করা আমাদের কারোর পক্ষেই সম্ভব না। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না !’ পরেশবাবু সমীরবাবুকে আস্বস্ত করে বললেন, ‘একটু ধৈর্য্য ধরুন। পুলিশের উপরে একটু ভরসা রাখুন। আশাকরিআমরা কিছু একটা করতে পারবো। আমি কিছুক্ষন পরে আপনাকে রিংব্যাক করছি।’

।। ৯ ।।

         থানার ওসি পরেশবাবু সব শুনে সমীরবাবুকে বললেন, ‘এবার ফোন করলে কিন্তু আপনি ছেলেমেয়ে দুটোর সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন। ওদিকে আমি দেখছি, ফোনের লাইন ট্যাপ করে কোন লোকেশনের হদিশ করতে পারি কি না!’ এরমধ্যেই ওসির মোবাইলে একটা ফোন ঢুকছিল। তিনি দেখলেন, এস পি সাহেব ফোন করছেন। তিনি তাড়াতাড়ি সমীরবাবুর ফোনটা ছাড়ার জন্য বললেন, ‘বড় সাহেব কোন কারনে ফোন করছেন। আমি পরে আবার কথা বলছি।’ ফোন ছেড়েই পরেশবাবু ঘুরিয়ে এস পি কে ফোন করতেই, ‘কোন খবর পাওয়া গেল! তোমার সব সোর্স কি বলছে!’ পরেশবাবুর কাছে এস পি সব শুনে বললেন, ‘এদিকে তো সাংঘাতিক ব্যাপার জানা গিয়েছে। ওঁরা যে বাচ্চা দুটোর জন্য একটা এরকম কিছু চাইবে, সেটা আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। তুমি একবার আমার অফিসে এসো তো!’

বড় সাহেবের জরুরী তলব পেয়ে তড়িঘড়ি পরেশবাবু ছুটলেন এস পি অফিসের দিকে। সেখানে পৌঁছে দেখলেন, কনফারেন্স রুমে মিটিঙএ রয়েছেন এস পি সাহেব। পরেশবাবুর কথা বোধহয় আগে থেকেই বলা ছিল দরজার সামনে পাহারায় দাঁড়ানো সিপাইটিকে। তাই সে পরেশবাবুকে সোজা কনফারেন্স রুমে ঢুকে যেতে পরামর্শ দিল। ঘরে এস পি ছাড়াও বসে রয়েছে আরও দুজন ডি এস পি পদমর্যাদার অফিসার আর সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ এক অফিসার। তাঁদের সামনে খোলা রয়েছে বিকালে গৌড়ের ওই মাটির নীচের ঘর থেকে পাওয়া ল্যাপটপটি। ল্যাপটপটি রীতিমতো চলছে। এস পি পরেশবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এদিকে তো বিরাট কান্ড! ওই যেখানে রেড করতে গিয়ে আমরা এই ল্যাপটপ কম্পিউটারটি পেয়েছিলাম, সেটা চালু করতেই মেল বক্স খুলে যায়। আমাদের বেশি কসরত করতের হয়নি। ইমেল গুলো দেখে জানা যাচ্ছে, ওখানে মালদা এজেন্ট থেকে মেল গিয়েছে, আজ রাতেই বড়মাপের জালনোট পাচারের কথা রয়েছে। হয়তো আমরা সেই জালনোট কিছুটা উদ্ধার করতে পেরেছে। কিন্তু এই চক্রের কিং পিন কে তো ধরতে হবে! তোমার সোর্স তো কিছুই বলতে পারছে না!’ সাইবার ক্রাইম থানার অফিসার এবার এস পির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যদি একটা কোন ফোন  নম্বর পাওয়া যেত, তবে আমি ঠিক ট্র্যাক করে নিতে পারতাম সেই ফোন কোথা থেকে করা হচ্ছে বা আসছে!’

পরিতোষবাবু এতক্ষন বড় সাহেবের ঝাড় খাচ্ছিলেন। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। নিজেই বলে উঠলেন, ‘স্যার, কিছুক্ষন আগেই ওঁদের গৌড়ের বাড়িতে ফোন এসেছিল কিডন্যাপারদের। আমার কাছে ছেলেটির বাবার মোবাইল ফোনের নম্বর রয়েছে। আমি এক্ষুনি ওদের বাড়ির ল্যান্ড লাইনের নম্বর জেনে নিতে পারবো!’

তবে সেটাই করুন!’

পরেশবাবুর হাতে ততক্ষনে সমীরবাবুকে ফোন করার জন্য মোবাইল ফোন উঠে গিয়েছে। পরেশবাবু ফোন নম্বর জেনে বলতেই সেটা নোট করে নিলেন সাইবার ক্রাইম থানার ঐ অফিসার। এস পি কে কিছু বলে উঠে গেলেন বাইরে কোথাও। 

এস পি বললেন, ‘আজ একটা বড় কাজ হয়েছে। তোমার  থানার লোকজনেরা কোন খবর রাখে না! ওই তিনটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে আজ পুলিশের কাজে খুব উপকার করে দিয়েছে, যে করেই হোক, ওঁদের উদ্ধার করতেই হবে। সেই দায়িত্ব তোমার একার উপর ছাড়ার ভরসা আমি করতে পারছি না! তোমাকে আরও অফিসার দিচ্ছি।’ এস পি’র কথা শেষ হতেই ঘরে ফের এসে ঢুকলেন সাইবার ক্রাইম থানার ওই অফিসার। ঢুকেই এস পি’কে একটা চিরকুট দেখিয়ে জানালেন, ‘স্যার, ওই ল্যান্ড লাইনে শেষ ফোনটা এসেছিল কালিয়াচক থেকে। নম্বরটাও আমি লিখে এনেছি।’

ওই নম্বরে একবার ফোন করে দেখবো স্যার!’ পরেশবাবু কথাটা বলা মাত্র রেগে উঠলেন এস পি।

আপনাকে পুলিশে চাকরিটা কে দিয়েছে বলুন তো! ওখানে কেউ এই সময় ফোন করে! সামান্য বুদ্ধিটুকু কি আপনার নেই!’

পরেশবাবু বুঝতে পারলেন, তিনি ভুল সময়ে ভুল কথা বলে ফেলেছেন! মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেন!

এতক্ষন প্রায় চুপ করেছিলেন দুজন ডি এস পিই। তাঁদের থেকে একজন বললেন, ‘স্যার, আমি তো কালিয়াচক এলাকাটা নিয়ে কাজ করি, আমি একবার আমার সোর্স লাগিয়ে দেখবো! এই কাজ কে করতে পারে, সে সম্পর্কে যদি কোন খবর নিতে পারি!’

দেখুন তো চেষ্টা করে,’ এস পি পরেশবাবুর সামনেই ডি এস পিকে দায়িত্ব দিলেন।

।। ১০ ।।

আবার ল্যান্ড লাইনের টেলিফোনটি বেজে উঠেছে সমীরবাবুর বাড়িতে। এখন রাত প্রায় আটটা। টেলিফোনের রিং টোন এত কর্কশ এর আগে কখনো লাগেনি! সবাই উদগ্রিব হয়ে উঠেছেন টেলিফোনের আওয়াজ শুনেই। জানাই যাচ্ছে, আবার সেই কিডন্যাপারদের ফোন! এবার অর্ক আর মৌএর সঙ্গে কথা বলতে হবে। সেই মতোই বলে রেখেছেন থানার ওসি।

সমীরবাবু ফোনের ক্রেডেল তুলতেই সেই আবার একই গলার স্বর। টাকাটা নিয়ে আসতে বলছে ফারাক্কা ব্রিজের পরে একটা লাইন হোটেলে। নিজের নার্ভ ঠিক রেখে এবার পালটা প্রশ্ন করলেন সমীরবাবু, ‘বাচ্চা দুটো কেমন আছে, আগে সেটা আমাদের জানতে হবে! তারপরে টাকার কথা আপনারা ওঁদেরকে কিভাবে রেখেছেন, সেটা আমাদের জানা দরকার!’

ঠিক আছে! কোন রকম চালাকি করার চেষ্টা করলে কিন্তু বিপদ বাড়বে! আমি কিছুক্ষন পরেই আবার ফোন করছি। খবরদার! পুলিশ লাগিয়ে যেন ফোন ট্র্যাপ করানোর চেষ্টা না করা হয়!’

ফোনটা কেটে গেলো।

এবার কথা বললেন উত্তমবাবু, ‘কি বললো, কথা বলাবে ওঁদের সাথে! অন্তত জানতে তো পারবো, ছেলে মেয়ে দুটো কেমন আছে!’

ওদিকে সুলতানকে সঙ্গে নিয়ে ফের ফিরে গেলো সেই ডেরায়, যেখানে অর্ক আর মৌকে ওঁরা আটকে রেখেছে। দুটো বাচ্চাকে এভাবে শুধুমাত্র বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলানোর জন্যে বস্‌ এর অফিসে নিয়ে আসা ঠিক হবেনা! তাই সঙ্গে মোবাইল নিয়ে ওঁরা গাড়িতে চেপে গেল কালিয়াচকের সেই বাড়িটাতে। সেখানে ছুকেই মইনুদ্দিনকে সুলতান জিজ্ঞাসা করলো, ‘বাচ্চা দুটো এখনও ওই ঘরেই ঠিকঠাক আছে তো!’

জি সুলতান,’ মইনুদ্দিন জবাব দেয়।

খেতে দিয়েছিস কিছু!’

তুই তো সেটা বলে যাসনি, আমিও তাই ও ঘরে ঢুকিনি।’

ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি সামনের এই ঘরটাতে বসছি। তুই ঘরের তালা খুলে নিয়ে আয় তো মেয়েটাকে! বলবি, ওঁর বাড়ির লোকের সাথে কথা বলাবো’ সুলতান জবাব দেয়।

দুলাল এখন ঘরে এসে ঢুকলো। মইনুদ্দিন একা ছেলেটাকে তালা খুলে নিয়ে আসবে, সেই বিষয়টা ওঁর পছন্দ তেমন হলো না। সে সুলতানকে বললো, ‘ছেলেটাকে দিয়েই তো কথা বলাতে পারতিস। শুধু শুধু ছলেটাকে এভাবে একা ঘরে রেখে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে! কিছু যদি আবার হয়ে যায়, বস্‌ কিন্তু আমাদেরকে ছাড়বে না!’

কিচ্ছু হবেনা! মেয়ের গলা শুনলে বাড়ির লোকের প্যানিক বাড়বে। এটাও কি বুঝিস না!’

যাই বলিস সুলতান, আমাদের নক্‌লি নোটের ধান্ধাই কিন্তু অনেক ভালো ছিল। একটা ফালতু ঝামেলায় গিয়ে এভাবে ফিরৌতির ধান্ধাটা আমার ভালো লাগছে না!!’ দুলাল বললো।

আরে বা! ফিরৌতি ভাষাটা তুই কোথায় শিখলি রে দুলাল! এটা তো বিহার ইউপি তে লোকে বলে! তুইও তবে খুব কম জলের মছলি না!’ সুলতান হাসতে হাসতে বলে।

শিখেছি কোথাও! তুই কি একাই ভিতরে ছিলি নাকি! আমার অভিজ্ঞতা কম না!’ দুলাল বলে, ‘যাই একটু বাইরে থেকে বিড়ি খেয়ে আসি!’

দুলাল বাইরে বেরিয়ে যেতেই সুলতান শুনতে পেলো, বাড়ির ভিতরে ধ্বস্তাদ্বস্তির শব্দ হচ্ছে। এই বাড়িতে তো ওই দুটো বাচ্চা ছাড়া আর মইনুদ্দিন ছাড়া কেউ নেই। তবে কি মইনুদ্দিনের সঙ্গে পাঙ্গা নিচ্ছে নাকি, ওই ছেলেমেয়ে দুটো! হঠাৎ সুলতানের কানে এলো মইনুদ্দিনের চিৎকারের আওয়াজ। শব্দ পাওয়া মাত্র সুলতান ছুটে বাড়ির ভিতর দিকে ওই ঘরের দিকে যেতে যেতে নিজের পকেট থেকে পিস্তলটা হাতে নিয়েছে। কিন্তু ঘর অন্ধকার থাকায় ভিতরে ঢুকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথায় একটা আঘাত পেয়ে চোখে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো আলো দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়তে পড়তে বুঝতে পারলো, তাঁর হাতের পিস্তলটা ছিটকে মেঝেতে কোথাও পড়ে গিয়েছে আর নিজেও মাটিতে পড়েছে।

এতক্ষন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল অর্ক। ওঁদেরকে বয়সে ছোট ভেবে আগে থেকেই হাত পা সব খুলে বাঁধন  মুক্ত করে রেখেছিল ওঁরা। সেসময়ই অর্ক আর মৌ গোটা ঘরে হাতড়ে হাতড়ে মোটা কাঠের বাটামটা পেয়েছিল। কেউ  ঘর খুলতে আসলে সেই বাটামে দিয়েই আঘাতের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল অর্ক আর মৌ। এটাই একমাত্র শেষ চেষ্টা এখান থেকে পালানোর! যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ। সুযোগও পেয়ে গেলো আর অর্ক আর মৌ সেই সুযোগের সদ্‌ব্যবহার করতে কসুর রাখলো না!

বাটামের মোক্ষম আঘাতে সুলতান অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেই অর্ক মৌ এর হাত ধরে টেনে সোজা দৌঁড়ে রাস্তায় হাজির হলো। রাস্তায় বেশ লোকজনের চলাচল রয়েছে। কিন্তু ওঁরা কাউকে কিছু না বলে জোরে হাঁটতে লাগলো সামনের রাস্তার দিকে, যেখান থেকে অনেকক্ষন ধরেই ওঁরা গাড়ি চলাচলের আওয়াজ পাচ্ছিল। তখনই দু’জনে আলোচনা করে রেখেছিল, যেখানে ওঁদের আটকে রাখা হয়েছে, তার কাছেই বড় রাস্তা রয়েছে।

রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই ওঁদের চোখে পড়লো, পুলিশের পোষাক গায়ে দুজন রাস্তার গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। মৌ বুঝতে পারলো, এঁরা ট্রাফিক পুলিশ। অর্কের চোখে পড়লো, কিছু দূরে দুলাল নামের ওই লোকটি দাঁড়িয়ে তাঁদের অবাক হয়ে দেখছে। মৌ একছুটে ট্রাফিক পুলিশকে গিয়ে বললো, ‘পুলিশ কাকু, আমাদের তিনজন দুষ্টু লোক ওই বাড়িটাতে অন্ধকার ঘরের মধ্যে তালা বন্ধ করে আটকে রেখেছিল। আমরা কোন মতনে পালিয়ে এসেছি। আমাদের দুজনকে তোমরা বাঁচাও!’

অন্যদিকে, ততক্ষনে পুলিশের নিজের নেট ওয়ার্কে কিডন্যাপের ঘটনা জেলাজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। তবে মালদার এস পি বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে থেকেছেন। এমন কি, জালনোট উদ্ধারের ঘটনাও চেপে গিয়েছেন, শুধুমাত্র এই দুটি বাচ্চার কথা ভেবে। তাই সাধারন মানুষ কিছুই না জানতে পারলেও, পুলিশ মহলে বেশ ভালো রকমই হেলদোল পড়েছে। সেই কারনে কালিয়াচকের মোড়ের ডিউটিতে থাকা দুজন ট্রাফিক পুলিশও জানতো কিডন্যাপের ঘটনা একটা ঘটেছে। তবে সেটা যে এখানেই সেটা তাঁদের অজানা ছিল।

দুজন ট্রাফিক পুলিশ অর্ক আর মৌকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের উদ্যোগে কালিয়াচক থানায় খবর দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে থানা থেকে বিশাল পুলিশের টিম সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন সেই ডি এস পি। সঙ্গে অবশ্য গৌড় থানার ওসি পরেশবাবুও ছিলেন। অর্ক আর মৌ এর কাছ থেকে সেই বাড়িটার হদিস জেনে সেখান থেকে মইনুদ্দিন আর সুলতানকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করে একসঙ্গে কালিয়াচক থানায় গেলেন।

সুলতান আর মইনুদ্দিনের, দুজনেরই মাথা ফেটে যাওয়ায় পুলিশের একটা দল তাদের নিয়ে মালদা মেডিক্যাল কলেজে গেল। মৌ আর অর্ক বসেছিল থানার ঘরের বেঞ্চিতে। পরেশবাবু ওঁদের টিফিন খাওয়ানোর আয়োজন করতে করতেই সমীরবাবুর বাড়ি থেকে সবাই মিলে হাজির হলেন কালিয়াচক থানাতে। প্রায় কয়েক ঘন্টার রুদ্ধশ্বাস অবস্থার শেষে বাবা মাকে সামনে পেয়ে অর্ক আর মৌ দুজনেই মা এর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

সমীরবাবুর বাড়িতেই সেরাতে সবাই ফিরে এসেছিল। একটু রাত হলেও বাড়িতে এসে আবার টিপুর সঙ্গে অর্ক আর মৌ এর খুব ভালো লাগছিল। সারাদিনের এত ধকলের পরেও টিপু কিভাবে গুলির নিশানা থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছে, সেই কথা শুনতে একটুও কম আগ্রহ দেখালো না দু’জনেই।

আজ ভাইফোঁটা। ভাইফোঁটার আয়োজন করা হয়েছে অর্কদের বাড়িতেই। এত রাতে ঘুমিয়েও ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির সামনের ঘাষ থেকে শিশিরের ফোঁটা সংগ্রহ করে জমিয়ে এনে চন্দন বেঁটেছে। টিপুর সঙ্গ অর্ককেও আজ ভাইফোঁটা দেবে মৌ। আজ রাতের ট্রেনেই টিপুদের কলকাতা ফিরে যাওয়ার টিকিট কাটা রয়েছে। কথা হয়েছে, ভাইফোঁটার অনুষ্টানের পরে দুপুরের খাবার খেয়েই মৌদের বাড়ি মালদায় ফিরে যাবে টিপুরা।

টিপু অর্ক তাড়াতাড়ি স্নান সেরে সকালে কিনে আনা জামা কাপড় পড়ে ফোঁটা নেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে রয়েছে। বাড়ির মহিলারা রান্না ঘরে লুচি তরকারির সঙ্গে দুপুরের রান্না তৈরি করতেই ব্যস্ত। এমন সময় হঠাৎ বাড়ির সদর দরজার কলিং বেল বেজে উঠলো!

অর্ক সদর দরজা খুলতেই ভিতরে ঢুকলেন থানার ওসি পরেশবাবু। তাঁকে দেখে বাড়ির সবাই হইহই করে উঠলেন। টিপুর মা পরেশবাবুকে ঘরে বসিয়ে চা জলখাবার এনে দিলেন।

পরেশবাবু উত্তমবাবু, সমীরবাবুদের সাথে গল্প করতে করতে বললেন, ‘জানেন, আপনাদের এই তিনজন ছেলেমেয়ে কি উপকার করেছে সারা দেশের! আমাদের পুলিশ সুপার তো এঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ! মালদার মাধ্যমে জালনোট সারা দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে, সে খবর আমাদের সবার কাছেই ছিল। মাঝে মাঝে দু একজন আড়কাঠি ধরা পড়েছে। কিন্তু গতকাল এঁরা জালনোটের মূল চাঁইকে ধরে দিয়েছে। কিডন্যাপ হওয়ার পরেও এঁরা যে স্বভাবিকভাবে ঘাবড়ে যায়নি, সেটা সত্যি প্রশংসার যোগ্য।’

টিপুর মা এবার সবাইকে তাড়া দিলেন। ‘দ্বিতীয়ার সময় তো চলে যাচ্ছে। কি রে মৌ, ভাইফোঁটা দিবি না!’

ঘরের মেঝেতে দুটি আসনে পাশাপাশি বসেছে অর্ক আর টিপু। তাঁদের সামনে লুচি, তরকারি আর মিষ্টির প্লেট। পাশে পিলসুচে জ্বলছে ঘি এর প্রদীপ। মৌ তাঁর বাম হাতের কড়ি আঙ্গুলে চন্দন নিয়ে আগে অর্কের কপালে ও পরে টিপুর  কপালে ছুঁইয়ে বললো, ‘ভাই এর কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা............।।