বিশেষ - এক বাউল সুরের মরমী রাজা - সৈয়দ রেজাউল করিম । মার্চ - ২০২৪



  এক বাউল সুরের মরমী রাজা





সৈ য় দ 
রে জা উ ল 
ক রি ম 

 

নামে রাজা, কিন্তু আদবে রাজা ছিলেন না কোনদিন। তাঁর বাবা ছিলেন জমিদার। পাঁচ লাখ বিঘা জমিনের। আধুনা বাংলাদেশের সিলেটে জেলার লক্ষ্মনশ্রী পরগণার অন্তর্গত সুনামগঞ্জ এলাকা জুড়ে ছিল তাঁর জমিদারি

এ ঘটনা আজ কালকার নয়, অনেক বছর আগের। ভারতবর্ষ তখন পরাধীন। সারা দেশ জুড়ে চলছে তখন ইংরেজ শাসন। রাজাদের জমিদারিটা চলে আসছে তাদের পূর্বপুরুষ থেকে। ইংরেজ সরকার খুশি হয়ে প্রদান করেছে 'দেওয়ান' উপাধি। সে উপাধি বংশের কেউ ব্যবহার না করলেও রাজার বাবা ব্যবহার করতেন তাঁর নামের সাথে। তাঁর নাম দেওয়ান আলী রেজা চৌধুরী (১২০৭-১২৭৬ বঙ্গাব্দ/১৮০০-১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দ)। সেকালে খুব নাম ডাক ছিল তাঁর । প্রায় ৫ লক্ষ ২৭ হাজার বিঘা জমির মালিক ছিলেন তিনি

দিনটা ছিল ৭ই পৌষ, ১২৬১ বঙ্গাব্দ। ইংরেজি ২১শে ডিসেম্বর ১৮৫৪ সাল। দেওয়ান আলী রেজা চৌধুরীর স্ত্রী হুরমত জাহানের (১২৩৫--১৩১০ বঙ্গাব্দ/১৮২৮--১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দ) কোল আলো করে জন্ম নিল তাঁদের দ্বিতীয় পুত্র-সন্তান রাজা। সেদিন যেন আনন্দের লহর বয়ে গেল সারা সুনামগঞ্জের শহর জুড়ে। তেঘরিয়ার লক্ষণশ্রী পরগনা জুড়ে 

ছোট ছেলে। বাবা মায়ের বড় আদুরে। বড় দুরন্ত। সারাদিন হৈ-চৈ করে কাটত তার দিন। বনজঙ্গলে বন্ধুবান্ধবের সাথে ঘোরা, শিকার করা, খেলাধুলা করা, ঘোড়ায় চড়া, এসব তার নেশায় পরিণত হল। আর লেখাপড়া, লবাডঙ্কা। কিছুতেই পড়াশোনায় মন বসত না তার। জীবনটা তার কাছে ছিল বন্ধনহীন, লাগামছাড়া ঘোড়া

সেই লাগামছেঁড়া ঘোড়া হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেই দুরন্ত, দামাল কিশোর হঠাৎ করে চুপসে গেল কাঁটায় বেঁধা বেলুনের মত। তার চঞ্চলতা, তার উচ্ছ্বলতা যেন নদীর অতল জলে হারিয়ে গেল। তার উচ্ছ্বাস, আনন্দ উদ্দিপনায় ভরা প্রাণবন্ত মনটা হঠাৎ নিঃশ্চুপ হয়ে গেল। রামপাশা থেকে খবর এল তার বড় ভাই দেওয়ান ওবায়দুর রেজা হঠাৎ করে এন্তেকাল করেছন। যদিও ওবায়দুর রেজা (১৮৩২-১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দ) ছিলেন তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই, তবুও রাজার কাছে তিনি ছিলেন আত্মার আত্মীয়। প্রেরনাদাতা। ভালোবাসার পাত্র। রামপাশা থেকে মাঝে মধ্যে যখন তিনি লক্ষনশ্রীতে আসতেন, তখন ছোট ভাইয়ের জন্য নিয়ে আসতেন তার ভালোবাসার জিনিস। ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়ে দিতেন তার সাথে। বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে মানসিকভাবে প্রচন্ড আঘাত পেলেন রাজা। সে আঘাতের রেশ তখনো বিদ্যমান। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর চল্লিশ দিন পার হয়নি, নিঃশব্দে, নীরব পরপারের পথে পাড়ি দিলেন তার পিতা দেওয়ান আলী রেজা চৌধুরী । রাজা আরও মুষড়ে পড়লেন

কিন্তু কতদিন? সে দুঃখ, সে বেদনা একদিন কালের নিয়মে স্তিমিত হয়ে গেল। সাংসারিক প্রয়োজনে দুঃখ, কষ্ট ভুলে হাল ধরতে নেমে পড়তে হল কাজে। বাবা, দাদার অবর্তমানে জমিজামা সামলানোর দায়িত্ব পড়ল তার উপর। তিনি হলেন বংশের ছোট জমিদার। পিতৃপুরুষদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির মালিক তিনি। তার হাতেই সব দায়দায়িত্ব। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫ বছর। এক নতুন জীবন শুরু হল রাজার। আর নতুন জমিদার হওয়ার কারণে দিনে দিনে তার বিলাশিতা গেল বেড়ে। তাকে নিষেধ করার মত কেউ ছিল না। ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে পড়লেন তিনি। শৌখিনতার চরম শিখরে পৌঁছে গেলেন একসময়। তার হাতিশালে হাতি এলো, ঘোড়াশালে এল ৭৭টা ঘোড়া । জং বাহাদুর ও চান্দমুশকি ছিল তার প্রিয় ঘোড়া। নৌকা বিহারের জন্য সাজানো গোছানো হল তার বজরা। সেই বজরাতে বসত গান বাজনার আসর। থাকত আনন্দের উপকরণ। বাড়িতে থাকলে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের আনন্দ, খুশি উপভোগ করার জন্য তিনি তাদের এক জায়গায় জড় করতেন। নিজের তবিল থেকে থেকে বার করতেন রুপোর টাকা। হরি লুঠের বাতাসার মত সেগুলো ছড়িয়ে দিতেন তাদের মাঝে। বাচ্ছারা যখন হুটোপুটি করে কুড়িয়ে নিত সেই টাকা, তা দেখে খুব মজা পেতেন তিনি । মোটকথা মনে তার যত শখ আহ্লাদ ছিল, তা এক এক করে পূরণ করতে ব্রতি হলেন রাজা। সেদিনের সেই দুরন্ত কিশোর ক্রমে হয়ে উঠলেন দুর্ধর্ষ, প্রতাপশালী জমিদার। কালক্রমে তিনি একদিন চিহ্নিত হলেন অত্যাচারী, নিষ্ঠুর জমিদার হিসাবে

আনন্দবিহার করতে গিয়ে রাজা ভুলে বসলেন তার গরীব প্রজাদের কথা। তাদের সুখ, দুঃখ, অভাব অভিযোগের কথা। তিনি শুধু নিজেকে নিয়ে, নিজের আত্মতৃপ্তি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এমনকি তিনি ভুলে বসলেন তার প্রিয় 'কুড়া' পাখির কথাটাও। ছেলেবেলায় যে পাখিটাকে ধরে এনে যত্ন করে খাঁচার ভিতরে রেখে দিয়েছেন। রোজ নিয়ম করে যাকে ছোলা ছাতু খাইয়েছেন, সেই পাখিটার প্রতি এখন নজর নেই তার। উৎশৃঙ্খলতার আবর্তে পড়ে তিনি এক এক করে হারিয়ে ফেললেন তাঁর মানবতার সব গুন । দয়া, মায়া, ভালোবাসার পাঠ

কিন্তু ঈশ্বর বোধহয় এটা চাইছিলেন না। একদিন রাজা স্বপ্ন দেখলেন। ঈশ্বর স্বয়ং 'কোড়া' পাখির ছলে বসে রয়েছেন তার খাঁচায়। করুণ তার দৃষ্টি। মনে খুব কষ্ট। এই স্বপ্ন দেখে খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন রাজা। কিসের জন্য, কি কারণে এই স্বপ্ন এল তার মাথায়? এর ব্যাখ্যা কি? স্বপ্নে ঈশ্বর তাকে কি বোঝাতে চেয়েছেন? তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল তার হৃদয়, তার মন। কেমন যেন একটা অস্থিরতায় ছেয়ে গেল তার চোখ মুখ। বদলে গেল তার চাওয়া পাওয়ার হিসেব নিকেশ । স্বপ্নের দিশা খুঁজতে তিনি বার হলেন পথে । এক বাউলের কাছে পেলেন পথের সন্ধান। আর তাতেই খুলে গেল তার মনের দুয়ার । তিনি ছেড়ে দিলেন তার বিলাসপ্রিয় জীবনযাপন। ত্যাগ করলেন আভিজাত্যের পোশাক আশাক। মখমলের চোগা চাপকান। জরির পাগড়ি। পরিবর্তে পরতে শুরু করলেন সাধারণ পোশাক। তার গায়ে তখন একটা হাতওলা গেঞ্জি। আর পরনে লুঙ্গির মত করে পরা একটা ধুতি। অত্যাচারী নিষ্ঠুর জমিদার ক্রমে পরিণত হল একটা মাটির মানুষ। মানবপ্রেমী মানুষ। সেসময় তিনি দিনের অধিকাংশ সময় বরাদ্দ করে রাখলেন তার প্রজাদের জন্য। তিনি মনোযোগ সহকারে তাদের অভিযোগ, অনুযোগের কথা শুনতেন। দুঃখ, বেদনার কথা উপলব্ধি করতেন । সাধ্য মত প্রতিকার, প্রতিবিধান করে দিতেন । ক্রমে বিষয়-আশয়ের প্রতি নিরাসক্ত হয়ে উঠলেন তিনি। প্রজাদের মধ্যে বিলি বন্টন করে দিলেন তার অধিকাংশ সম্পত্তি। একটা বৈরাগ্য ভাব জন্ম নিল তার মধ্যে। ঈশ্বর আরাধনায় মগ্ন হলেন তিনি

এতক্ষণে আমরা ভাবতে বসেছি, ভারতবর্ষের মত দেশে কোটি কোটি মানুষের বাস। এখানে অনেক মানুষ সাধু সন্ত, ফকির হয়ে জীবনযাপন করেছেন । পাপ কাজ থেকে বিরত হয়ে ঈশ্বর আরাধনায় মত্ত থেকেছেন। এর মধ্যে রাজার জীবনে বৈচিত্রতা কোথায়? কেন মানুষ তাকে মনে রেখেছে তার জন্মের সার্ধ শতবর্ষের পরেও? সেদিকে একটু ফিরে তাকানো যাক

বৈরাগী জমিদার এই রাজার নাম প্রথমে দেওয়া হয়েছিল অহিদুর রেজা। পরবর্তীতে রাখা হয় দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী। আমরা তাকে চিনি শুধু হাসন রাজা হিসাবে। যে হাসন রাজার পরিচিতি একজন জমিদার বা রাজর্ষি নয়, তিনি ছিলেন একজন মরমী কবি। বাউল শিল্পী। বিশ্ব প্রকৃতির মর্মে যিনি প্রবিষ্ট, তিনি হলেন মরমী। তিনি শুধু মরমী কবি নয়, মরমী সাধনার দর্শন ও চেতনার সাথে সংগীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছেন তিনি

 


কি এই মরমী সাধনা? কি তার বৈশিষ্ট্য? এ ব্যাপারে এককথায় বলতে গেলে বলতে হয়, মরমী সাধনার বৈশিষ্ট্য হলো জাত-ধর্ম, বর্ন-বিদ্বেষ, গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের বিভেদ ভুলে সর্বধর্ম লোকে বিচরণ করা। সকল ধর্মের নির্যাস, সকল সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক মাহাত্ম, আপন রসে জারিত করে নেওয়া হল মরমী সাধনা। যেটা হাসন রাজার মধ্যে পুরো মাত্রায় ছিল। অবশ্য তার পিছনে কিছু কারণও ছিল

হাসন রাজার বংশ পরিচয় খুঁজলে আমরা দেখতে পাব, তাঁর দাদু আনোয়ার খানের বাবা ছিলেন শ্রী বীরেন্দ্র চন্দ্র সিংহদেব। মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী। তাদের পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিল অযোধ্যায়। পরে তারা চলে আসেন দক্ষিনবঙ্গের যশোর জেলায়। বসবাস শুরু করেন কাগদি গ্রামে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে সিলেট জেলার কোনাউরা গ্রামে চলে আসেন তাদের পূর্বপুরুষ বিজয় সিংহ। পরে ওই এলাকায় তিনি একটি নতুন গ্রামের গোড়াপত্তন করেন। তাদের বংশের আদিপুরুষ রামচন্দ্র সিংহদেবের নাম অনুসারে গ্রামের নাম রাখেন রামপাশা। স্বভাবতই হাসন রাজা দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি সম্বন্ধে পুরো মাত্রায় ওয়াকিবহাল ছিলেন। তার প্রতিফলন পড়ে তার রচনায়

১ ।    "আমি যাইমুরে যাইমআল্লার সঙ্গে, ‌
                      
হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।"           

২ ।    "আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,
                      
আমি কি তোর যমকে ভয় করি
                      শত যমকে তেড়ে দিবসহায় শিবশঙ্করী ।"                  

আমরা জানি ঈশ্বর হলেন সমস্ত শক্তির আধার। এ দুনিয়ার সব কিছু তার সৃষ্টি। সেই সৃষ্টিকর্তাকে আমরা গড, আল্লা, ভগবান যে নামে ডাকি না কেন, তার দুয়ারে আমাদের ফিরে যেতে হবে। এটাই সার কথা। এ অন্যথা হবার নয়। তাই আমাদের ঘর বাড়ি, বিষয়- সম্পত্তি, সব কিছু পড়ে থাকবে এই দুনিয়ায়। কোন কিছু সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এই উপলব্ধিবোধ মানুষ অর্জন করে বয়সকালে। কিন্তু হাসন রাজা তা বুঝতে পেরেছিলেন বয়বৃদ্ধ হবার অনেক আগেই। তার লেখা গানের কলিতে খুঁজে পাওয়া যায় তার ছাপ                   

                 "লোকে বলে বলেরেঘর বাড়ি
                       ভালা নায় আমার
                       কি ঘর বানাইমু আমি
                       শূন্যের-ই মাঝার
                       ভালা করি ঘর বানাইয়াকয়
                      দিন থাকমু আর
                      আয়না দিয়া চাইয়া দেখি,
                      পাকনা চুল আমার"                  

               "যখন আসিয়া যমের দূত হাতে দিবে দড়ি
                    হায়রে হাতে দিবে দড়ি
                    টানিয়া টানিয়া লইয়া যাবে যমের পুরি রে
                    হাসন রাজা!
                    একদিন তোর হইবো রে মরণ                   

মরমী গানের ধারাই এরকম। গীতিকাররা সাধারণত অনুরক্ত হয়ে থাকেন ঈশ্বরের প্রতি। জগৎজীবনের মোহে পড়ে যৌবনকালে প্রমোদ মত্ততায় মেতে ওঠে মানুষ। ঈশ্বরের সাধন ভজন করা, নামগান গাওয়ার কথা তারা ভুলে যায় তারা। সেই অক্ষমতার খেদোক্তি ঝরে পড়ে তাদের গানে। তাদের কথায়। কোথাও বা তারা নিজেদেরকে দীনহীন মনে করে। প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েও হাসন রাজা তাই ফকির। তিনি যেন অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকের হাতে থাকা ঘুঁড়ি। সে কথাও প্রকাশ পেয়েছে হাসান রাজার মরমী লেখায়। তার গানে

"গুড্ডি উড়াইল
মোরেমৌলার হাতের ডুরি
হাসন রাজারে যেমনে
ফিরায়তেমনে দিয়া ফিররি ।।

মৌলার হাতে আছে ডুরি
আমি তাতে বান্ধা।।
জবেমনে ফিরায়তেমনি
ফিরিএমনি ডুরির ফান্দা।।"
 

দেওয়ান হাসন রাজা মারা গেছেন ইংরেজি ৬ই ডিসেম্বর ১৯২২ সালে। বাংলা ২২শে অগ্রহায়ণ ১৩২৯ সনে। মাত্র ৬৮ বছর বয়সে। তাঁর জন্ম বার্ষিকী ২০২০ সালে ১৬৬ বছর। তাঁর জমিদারি অধীনে থাকা ৫ লক্ষ ২৭ হাজার বিঘা জমি অধিকাংশ হস্তান্তরিত হয়ে গেছে। পড়ে আছে তাঁর উপলব্ধিবোধ। তাঁর লেখা গান 

            ১ ।   "মরিলে হইব মাটিতে বাসা,
                    পড়িয়া থাকিবে লক্ষ্মণশ্রী
                    রঙের রামপাশা ।

            ২ ।   "জানত যদি হাসন রাজা বাঁচব কতদিন,
                     হায়রে বাঁচবে কতদিন,
                     বানাইত দালান কোঠা করিয়া রঙ্গিন ।"     
              

কতটা জীবনবোধ থাকলে জীবদ্দশায় একটা মানুষ এই ধরনের মরমী গান লিখতে পারেন তা আজও ভাবনার বিষয় । তবে তাঁর ভাবনা ও কাজে ফারাক তেমন ছিল না, একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। নিজের জীবনের ভুল, ত্রুটিগুলো গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নির্দয়ভাবে। আত্ম সমালোচনা করেছেন নিজেকে। তাঁর মনের ভাবনা, হৃদয়ের সুর যেন গান হয়ে ঝরে পড়েছে তাঁর কলমে। তার জীবন যাত্রায়। আক্ষেপের সুর ধ্বনিত হয়েছে তার গানের কলিতে                   

।  "রূপের ঝলক দেখিয়া তার আমি হইলাম ফানা
        সেই অবধি লাগল আমার শ্যাম পিরিতির টানা
        হাসন রাজা হইল পাগল লোকের হইল জানা
        নাচে নাচে পালায় পালায় আর গায় গানা।"
                           

প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েও তিনি নতুন করে কোন রাজপ্রাসাদ গড়ে তোলেননি রামপাশায়। পিতৃপুরুষ প্রদত্ত বাড়িতেই অতিবাহিত করেছেন তাঁর স্বল্প জীবন। অযত্নে, অবহেলায় সে বাড়ি আজ জরাজীর্ন। ওই বাড়িতেই আছে ২টি ক্ষয়িষ্ণ কুঠির। যার একটি হল বৈঠকখানা, অন্যটি হল খাজনাখানা। বাংলা ১৩৫২ সনে হাসন রাজার প্রথম পুত্র খান বাহাদুর একলিমুর রাজা চৌধুরী নির্মান করেছিলেন, তাও আজ ভগ্নপ্রায়। অতীতের সেই স্মৃতি আজও নীরবে, নিভৃতে কাঁদে। আজও অসংখ্য পরিব্রাজক, ভক্ত-অনুরাগী অনেক আগ্রহ নিয়ে রামপাশায় যায় হাসন রাজার জমিদার বাড়ি দেখতে। কিন্তু বাড়ি দেখে হতাস হয় সকলে। জরাজীর্ন ভঙ্গুর সেই বিশাল বাড়ি কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে




          

প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না হাসন রাজা। তবে নিজের চেষ্টায় শিখেছেন অনক কিছু। এ ধারণা গবেষকদের। পারিবারিক নিয়ম অনুসারে প্রথমে আরবি এবং পরে বাংলা ভাষা তালিম নিয়েছেন হাসন রাজা। সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন তিনি। কিংবা তার চেয়েও অনেক বেশি। সেসব গান সব যে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে তা নয়। থাকার কথাও নয়। বজরায় সঙ্গী সাথীদের নিয়ে আনন্দ ফূর্তি করার সময় মুখে মুখে অনেক গান রচনা করেছেন তিনি। গেয়েছেন বহু। সেসব গান ছড়িয়ে পড়েছে বহুদূর। আজও লোকজনের মুখে মুখে ঘোরে সেসব গান। কিন্তু বেশ কিছু গান আজও সংকলিত হয় নি। তবে এটাও ঠিক, অধিকাংশ সময়ে হাসন রাজা যখন মুখে মুখে গান রচনা করতেন, তখন তাঁর সহচরবৃন্দ, নায়েব সাহেব, গোমস্তামশাইরা সেসব লিখে রাখতন। সেগুলো পুনরায় দেখার বা পরিবর্তন, পরিমার্জন করার সুযোগ সুবিধে মিলত না হাসন রাজার। ফলে তাঁর গানে কিছু ভুল ত্রুটি থেকে যেত। তা ছন্দপতন হোক, শব্দ প্রয়োগে অসতর্কতা হোক, গ্রামত্যা কিংবা অসংলগ্নতা হোক। তবুও সেই মরমী রচনা আমাদের কাছে অমূল্য। সার্ধ শতবর্ষের সাহিত্যের দলিল

তাঁর রচিত ৫৫৩টি গান নিয়ে হাসন রাজা নিজেই ১৯০৭ সালে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। বইটির নাম "হাসন বাহার"তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৩১ সালে তাঁর প্রথম ছেলে গনিউর রাজা কতৃক "সৌখিন বাহার" নামে আরেকটি বই প্রকাশ পায়। হাসন রাজা পরিবারের এক সদস্য, দেওয়ান তালেবুর রাজার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় "হাসন রাজা সমগ্র" নামক একটি গ্রন্থ

 নিজের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি নিজে যতটা সচেতন না ছিলেন, তার থেকে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন, আর পাঁচটা সাধারণ ছেলেপুলেদের শিক্ষার ব্যাপারে। তারা যাতে উপযুক্ত শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়, সে ব্যাপারে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়। এ ব্যাপারে তাঁর মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যথেষ্ট উদার। তাঁর অর্থ সাহায্যে এবং অন্যান্য সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে সুনামগঞ্জ জুবলি হাই স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার সম্পত্তি প্রদান এখনো মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে

হাসন রাজার জন্য রামপাশা আজ বিখ্যাত। তার ঘর বাড়ি, ব্যবহৃত জিনিসপত্র, বইপত্তর, গান ইত্যাদি দেখার জন্য দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন বহু কষ্ট করে আসেন রামপাশাতে। তাদের সুবিধার্থে বিশ্বনাথ থেকে সিলেট এবং গোবিন্দগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জে আসার রাস্তাঘাট যদি উন্নত করা যায়, তাহলে তাদের পক্ষে অনেক সুবিধা জনক পরিস্থিতি তৈরি হবে। এছাড়া সাহিত্য সংস্কৃতি প্রেমিদের জন্য তৈরী করা যেতে পারে একটা বিশাল কমপ্লেক্স। যেখানে থকবে, লোকসাহিত্য ইনস্টিটিউড, সেমিনার হল, আর্ট গ্যালারি, পাঠাগার ইত্যাদি। পরিব্রাজক, ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য থাকা, খাওয়ার হোটেলেরও প্রয়োজন। ইতিমধ্যে একটা যাদুঘর তৈরী হয়েছে। সেখানে সেসময়ে হাসন রাজার ব্যবহৃত পিতলের গ্লাস, ধূপদানি, বই, খড়ম, হাসন রাজার পোর্ট্রেট ইত্যাদি রাখা আছে। সগুলো আরো সিস্টেমেটিক ভাবে রাখা প্রয়োজন। তবেই তাঁর প্রতি আমরা যথার্থ সম্মান জানাতে পারব। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, দর্শন চেতনার নিরিখে লালনের পরে যে নামটি আসে, তিনি হলেন অহিদুর রেজা বা দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী। মরমী এই কবির ব্যাপারে যথার্তই বলেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বলেছেন- " পূর্ববঙ্গের একজন গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই যে, ব্যক্তি স্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্বসত্য।" সেই হাসন রাজার কথা আমরা ভুলে যাব কিভাবে ? 

 





  হাছন রাজার বাড়ী রামপাশা বিশ্বনাথ সিলেট।