গল্প । বৈশাখ ১৪৩২



 সত্যি ভূতের গল্প











তুহিন কুমার চন্দ  

দিনাজপুর, পশ্চিম বঙ্গ




 

নন্দদের বাড়ি থেকে বেড় হবার সময়ই বাইকটার কিছু সমস্যা হচ্ছিলো মনে হয়। এব্যপারে আমার যতটুকু জ্ঞান তাতে মনে হচ্ছে তেল শেষের দিকে। তেল নিচে নেমে গেলে এরকম ঝাঁকুনি দেয়। কিন্তু মুস্কিল হলো পেট্রোল পাম্প তো সেই অনেকদূরে।

রসুলপুরের হাটের ভেতরে অবশ্য একটা পাম্প আছে। দেখি ঐ পর্যন্ত যাওয়া যায় কিনা

হা তের ঘড়িতে বেলা প্রায় শেষ হবার মুখে বিকেল চারটা বেজে গেছে কখন রায়গঞ্জে আবার মঞ্জুদের বাড়ি একবার যেতে হবেসকালে বিশেষ করে মঞ্জু আমাকে ওদের বাড়ি একবার যেতে বলেছে

নতুন বাইপাস ঝাঁ চকচকে নিখুঁত রাস্তা গাড়ি যেন একটু স্পিডের প্রায় উঁড়ে চলে যাচ্ছে

রাবনের চায়ের দোকানটা পার করলেই রসুলপুরের মোড় মোড়ের ডান দিকেই মন্ডলদের পেট্রোল পাম্প যাক বাবা অন্তত তেল ভরে নেয়া যাবে

আজ আবার রসুলপুরের সাপ্তাহিক হাট

বাজার করার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে রায়গঞ্জে

আজ সকাল থেকেই আকাশটা বেশ মেঘলা কখন যে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামবে কিছুই বলা যায় না গাড়িতে পাঁচ টাকার তেল ভরে নিয়ে স্টার্ট দিতে যাবো দেখি এক থলে বাজার নিয়ে মঞ্জুর বাবা গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছে গলায় একটা কালো দাগ আমি তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম -আরে! ঝাঁ বাবু যে বাস পাচ্ছেন না বুঝি!!

- আরে না, ঠিক পেয়ে যাবো মশাই তা আপনি কোথা থেকে ফিরছেন

- আমার বড় শ্যালক নন্দকে তো চেনেন?

- হ্যাঁ চিনি তো

- সেই নন্দর আজকে পাকা দেখা ছিলো মেয়ে আর মেয়ের মা শ্বশুর বাড়িতে আজকের রাতটা রয়ে গেলো কাল ফিরবে আপনি এতদূরে হাট করতে আসছেন ভাবতেই পারছি না

- দিনকয় আগে মঞ্জু রিঠা মাছ খাবার কথা বলছিলো বিশ্বাস করুন কোন বাজারে রিটা মাছ পেলাম না মশাই আমাদের পাড়ার পন্ডিতমশাই বলেছিলেন এই রসুলপুরের হাটে নাকি পাওয়া যাবেই ঠিক পেয়েও গেলাম বেশ ভালো সাইজের মাছ মশাই

এভাবে কথার শেষ হবে না তাই আমি বাইকে ষ্টার্ট দিতে গিয়ে আবার সেই ঝাঁকুনি খেলাম

ঝাঁ বাবুকে বললাম পিছনে উঠে পড়ুন মশাই গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে আমি তো আপনাদের বাড়িতেও যাবো আচ্ছা দাদা আপনার গলায় কালো দাগটা কি কোন আঘাতের চিহ্ন নাকি!!

- আর বলবেন না, কাপড় মেলার তার জড়িয়ে গিয়েছিলো খুব বাঁচা বেঁচে গেছি দাদা

ঝাঁ বাবু পিছনে বসতেই একটা ঠান্ডা হাওয়ায় শরীরের ভেতরটা ছুঁয়ে গেলো

বললাম- বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে মনে হয়

ঝাঁ বাবু সম্মতি জানিয়ে বলল- হুঁ

ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলতে বলতে আমরা এগিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে

মোড়লডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলের কাছে জোরে বৃষ্টি শুরু হলো নামেই স্কুল দাঁড়াবার জায়গাও নেই পাশের বড় গাব গাছের নিচে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছি আর বৃষ্টি থামার প্রার্থনা করছি বৃষ্টি থামার কোন লক্ষনই নেই বরং আরো শক্তি নিয়ে ঝেঁপে নামলো

আমি ঠকঠক করে কাঁপছি ঝাঁ বাবুর ওসব কিছু নেই, চুপচাপ দাঁড়িয়ে গুনগুন করে যাচ্ছে

সন্ধ্যা নেমে এসেছে এখনো আবছা আলোয় চারদিকের কিছুটা দেখা যাচ্ছে

আমি বললাম- এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই রওনা দিতে হবে ঝাঁ বাবু

- আপনার কোন অসুবিধা না হলে রওনা হওয়াটাই ভালো

হেলমেটের কাঁচটা ভালোভাবে মুছে আবার চলতে লাগলাম যা: হেডলাইটটা আবার গন্ডগোল করছে

স্যুইচটা শক্ত করে টিপে না রাখলে নিভে যাচ্ছে অনেক কষ্টে সাহাপুরের শালবাগানের রাস্তায় এসে পড়লাম কিছুটা গেলেই ভট্টদীঘি শ্মশান এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় স্যুইচটা টিপেও রাখা যাচ্ছে না ঝাঁ বাবুকে বললাম আপনি এই স্যুইচটা টিপে রাখতে পারবেন দাদা, তাহলে আমার খুব সুবিধা হয় আর কি

- হ্যাঁ হ্যাঁ, কোন অসুবিধা নেই আমার

ঝাঁ বাবুর  সরু হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে স্যুইচটা টিপে রাখলো চারদিকে নিকষ অন্ধকার, মাঝেমাঝে বিদ্যুৎতের চমকে শ্মশানের পোড়া কাঠ, ছেঁড়া তোষক বালিশ আর পাশের কবরখানা থেকে টেনে আনা মাথার খুলি বুকের নিচের ধুকপুক যন্ত্রটা মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছে থেমে যাচ্ছে

পিছনে বসে থাকা ঝাঁ বাবু চুপচাপ বসে আছে

- ঝাঁ বাবু, ভয় পাচ্ছেন না তো?

- আপনি গাড়ি চালিয়ে যান কোন ভয় নেই

হুস করে একটা শেয়াল বাইকের সামনে দিয়ে চলে গেলো আর একটু হলে বাইকসহ আমরা পড়ে যেতাম

প্রচন্ড বৃষ্টিতে হেড লাইটের আলোতেও সবকিছু অস্পষ্ট

বাজ আর বিদ্যুৎয়ের ঝলকানি মাথায় নিয়ে খুব সাবধানে বাইকটা চালিয়ে যাচ্ছি বিদ্যুৎতের বিরাট ঝলকানিতে লাইটের স্যুইচটা ঝাঁ বাবু টিপে ধরে আছেন ঠিকই কিন্তু তার আঙ্গুলগুলো কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে অনেকটা কঙ্কালের হাতের মতো অনেক কষ্টে কাঁচামাটির রাস্তা থেকে পাকা রাস্তায় উঠে পড়লামএটাই জাতীয় সড়ক রেডিয়াম দেয়া ঘড়িটায় প্রায় আটটা বাজতে চলেছে সামনেই কুলিক ফরেষ্ট ব্রীজের ডানহাতে কুলিক শ্মশান চারদিক শুনশান লোডশেডিং চলছে বাতাসের শো শো শব্দ ভয়ে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে বারবার রাস্তায় কোন জনপ্রাণী নেই দুচারটে কুকুর বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তার পাশে চুপচাপ বসে আছে আমরা মোহনবাটি পৌঁছাতেই আলো চলে এলো যাক বাবা বাঁচা গেল বিদ্রোহী মোড়ের পাশের গলি দিয়ে মঞ্জুদের বাড়ির রাস্তায় ঢুকে পড়লাম আমরা

আর একটু গেলেই মঞ্জুদের বাড়ি এখন আর আলোর প্রয়োজন নেই ঝাঁ বাবু স্যুইচ আর টিপে রাখার দরকার নেই

- আচ্ছা

- বৃষ্টিতে এত ভিজেছি জ্বর না হলেই হয়

ঝাঁ বাবু কিছু একটা বলতে গিয়ে বার দুই হেঁচে আমায় বলল- দাদা আমাকে এখানে একটু নামিয়ে দিন, আমি রাজীবের বাড়ী হয়ে আসছি মাছের ব্যাগটা মঞ্জুকে দিয়ে দেবেন আমি এক্ষুনি আসবো

আমি ঝাঁ বাবুকে নামিয়ে দিয়ে সামনের বাঁকটা ঘুরে মঞ্জুদের বাড়ির রাস্তা ধরলাম রাস্তায় আলো খুব কম টিমটিমে আলোয় কর্ণেল নন্দীর বাড়ির পিচ্ছিল রাস্তাটা পেরুলেই মঞ্জুদের বাড়ি খুব সাবধানে বাইকটা চালিয়ে মঞ্জুদের বাড়ির গেটের সামনে এসে নামলাম

আধো আলোয় মঞ্জুকে ডাকতেই বাড়ির ভেতর থেকে মাঝবয়েসী যে ছেলেটি বেড়িয়ে এলো সে মঞ্জুর বড়দা

আমায় ডাকলে- আসুন দাদা, ভিতরে আসুন

সারাটা বাড়ি একটা নিকষ অন্ধকারে ডুবে আছে ঘরের ভিতরে গিয়ে আমি কিছুক্ষণ মেরে গেলাম মঞ্জুর মায়ের পড়নে সাদা শাড়ি, মঞ্জু মায়ের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে

জিজ্ঞেস করলাম- এসবের মানে কি মঞ্জু?

মঞ্জু হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মঞ্জুর বড়দা আমাকে বললো- দাদা কাল বাজার থেকে এসে বাবা মাছ কাটা নিয়ে এমন ঝামেলা  করছিলেন যে সেটা চুড়ান্ত আকার নিয়েছিলো রাতে খাওয়া দাওয়া করার পর রাজীবের বাড়ি যাচ্ছি বলে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন আমরা ভেবেছি বাবা রাজীবের বাড়ি থেকে ফিরে এসে তার নিজের ঘরে ঘুমিয়ে পরেছেন

সকাল হতেই কর্ণেল নন্দী প্রথম খবরটা দিতেই মাথায় বাজ ভেঙ্গে পরলো দৌড়ে গিয়ে দেখি শিরিষ গাছটায় বাবার দেহটা ঝুলছে

আমার সারাটা শরীর ভীষণ হাল্কা লাগছে একটা অজানা ভয় আমার প্রতিটি মজ্জায় বিদ্যুতের মতো খেলে যাচ্ছে

আমি বললাম- সেকি! দাদা তো আমার সাথে আমার বাইকে রসুলপুরের হাট থেকে এইমাত্র এসে রাজীবের বাড়ি যাবে বলে মোড়টায় নেমে গেলেন মঞ্জুর জন্য মাছের ব্যাগটা আমায় দিয়ে বললেন মঞ্জুকে দিয়ে দিতে আমি বাইকটার কাছে গিয়ে দেখলাম মাছের ব্যাগটায় তখনো মাছগুলো নড়ছে ঝাঁ বাবুর গলার দাগটা তাহলে কি সদ্য ফাঁসির চিহ্ন!!

আমার আজো সেদিনের ঘটনার কথা মনে হতেই শরীরের রোমকুপে ভয় চেপে বসে

এমন ঘটনা অন্য কারো জীবনে ঘটেছে কিনা জানিনা তবে আমার সত্যি ভূতের দেখা আমি আজো ভুলতে পারিনা বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলা ভার