গল্প ৪ । ভাদ্র ১৪৩২


ছোট্ট ভূতের বাড়ি












তূয়া নূর

লেহাই একর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র


 

আমার বিড়াল নিকি ঝাঁপ দিয়ে উড়ে এসে পড়লো ডেক্সটপ কম্প্যুটারের মাউসের ওপর। মনে হলো এই মাউসটাই তার জাতশত্রু 'ইঁদুর'। নিকি এমনতো আগে কখনো করেনি। মনিটরটা ছিলো স্লিপ মোডে। তখন সকাল সাতটা পনেরো।

রোববারের সকাল। চারদিক শান্ত। ভেবেছিলাম স্কুল ছুটির দিন অনেকক্ষণ ঘুমাবো। ঘুম ভাঙলো খুব সকালে। ডেস্কে বসলাম। কম্প্যুটার অন করলাম। একটা লেখা পড়তে গিয়ে আলসেমি লাগলো। চেয়ারে পা তুলে আরাম করে হেলান দিয়ে বসলাম। কতক্ষণ এরকম কাটলো খেয়াল নেই। তাকিয়েছিলাম মনিটরের দিকে উদাস হয়ে। সাদা ধোঁয়াশে ছায়া। ঠিক তখনই ঝাঁপ দিয়ে পড়লো নিকি কাঁধের উপর দিয়ে। নিকিকে বকা দিয়ে কোলে তুলে নিলাম। পিছনে তাকালাম। কেউ নেই। দেখার ভুল হতে পারে। কিংবা এটা বিড়ালের নিজেরই ছায়া হতে পারে। এই বলে নিজেকে বুঝালাম

নিকিকে ওর বাক্সে রেখে এলাম খাবার দিয়ে। জানলার পর্দা টেনে দিলাম। অনেক সময় জানালার পাশ দিয়ে বক উড়ে গেলে এমন ছায়া খেলে যায় মনিটরের ওপর

'দি গ্রেট গেটসবি' বইটা নিয়ে পড়ছি। একটু চোখ তুললাম। আমার কাঁধের ওপর আবার সাদা ধোয়া। মনিটরে তার ছায়া স্থির হয়ে আছে এখন। বললো, ভয় পেও না,  ইভা! আমি একদিন ছিলাম এই বাড়ির ছোট ছেলে। এখন সবাই বলে ক্ষুদে ভুত! আমার একটা নাম ছিলো। টনি

ভুতের সাথে আমার কথা হচ্ছে। আমি তখন এক মহা ঘোরের ভেতর। আমার বাবা নিউট্রিসনিস্ট। নতুন চাকরী নিয়ে এসেছে এই শহরের বড় হাসপাতালে। রিভার ওয়ের তেরো নম্বর রোডের দোতলা বাড়িটা বাবার খুব পছন্দ হলো। বেসমেন্ট আছে। এখান থেকে দেখা যায় পাহাড়, পাহাড় ঘেঁষে নদী। রিয়েল্টর বললো, এই বাড়িতে কেউ বেশী দিন থাকতে পারেনা। সবাই বলে এই বাড়িতে ভূতের আছর আছে। বাবা বললো, আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। আমি জেনেছি প্রায় একশ বছর আগে এই বাড়ি থেকে একটা সাত বছরের ছেলে নিখোঁজ হয়। এদিক ওদিক ঘুরে দেখে বাবা বললো, বাড়িটা আমার পছন্দ হয়েছে। ব্যাস!

ক্ষুদে ভূত টনি বললো, সবাই ভাবে আমি বাইরে কোথাও নিখোঁজ হয়েছি। বাবা-মা অনেক খুঁজেছে। সব পত্রিকাতে খবর ছেপেছে। রেডিও টিভিতে ঘোষণা দিয়েছে। হেলিকপ্টার দিয়ে  খুঁজেছে পাহাড়ে, জঙ্গলে। কোথাও পায়নি আমাকে

আমার খুব মায়া হল টনির ওপর। আগ্রহ নিয়ে বললাম, কি হয়েছিলো আসলে তোমার? সে বসলো আমার ডেস্কের ওপর। টনি বললো,  সব কথা বলবো তোমাকে। আগে বলো তুমি আমার বন্ধু হবে? বললাম, বন্ধু হলাম। হাত বাড়ালাম টনির দিকে। আমার হাতের আঙুল গুলো মেঘের মতো পেঁজা তুলা ছুঁয়ে গেলো। বললো তোমার ডেস্কে রাখা 'দি গ্রেট গেটসবি’ বইটা আমি পড়েছি। তোমাকে কষ্ট করে পড়তে হবে না। পড়ে শোনাবো। তোমার সব হোম ওয়ার্কে সাহায্য করবো। উপরে পশ্চিম দিকের ঘরটা আমার। এখন তালা লাগানো। আমার গিটার আছে। খুব ভাল বাজাতে পারি। যদি চাও শেখাবো তোমাকে। আমি ঘরে বসে বাজাই যখন খুব খারাপ লাগে

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, এতদিন কাউকে বলিনি এসব কথা? আমার মনটা পড়ে ফেললো যেন টনি। প্রশ্ন করার আগেই সে বললো, হ্যা! যাকে বলতে গেছি, সেই ভড়কে গেছে। এক মাসের ভেতর বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। এই বলে টনি খিলখিল করে হেসে উঠলো। বললো, অনেক বছর পর হাসলাম

আবার শুরু করলো টনি। আমার প্রিয় সিরিয়ালের নাম গ্রানুলা। এটা দিয়ে হতো সকালের নাস্তা, দুধ দিয়ে। এটা আমার কেন প্রিয় ছিল জান?

বললাম, কেন?

গ্রানুলা সিরিয়ালের বাক্সের ভেতর আলাদা একটা প্যাকেট থাকতো। এর ভেতর থাকতো নানারকম জন্তুদের ছোট ছোট পাথরের মূর্তি। আমার আছে এক বাক্স ভরা। আজকে সব আমি দিয়ে দিলাম তোমাকে

আমি বললাম, কোথায় কি করে হারালে তুমি সেটা বলো!

টনি বলতে শুরু করলো, আমাদের খালাতো ভাইবোনেরা এসেছিলো স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে। আমি আর আমার আপু ওদের সাথে লুকোচুরি খেলছিলাম। আমি ভালো করে লুকাতে পারছিলাম না। যেখানে লুকাই না কেন— সবার আগে আমাকে খুব সহজেই খুঁজে বের করে ফেলে সবাই। মনে পড়লো বেসমেন্টের এক কোণে একটা কাঠের বাক্স আছে। মা শীতের কাপড় তুলে রাখে। ভাবলাম এখানে লুকোলে কেমন হয়! সহজে কেউ খুঁজে পাবে না

একটা টুলের উপর দাঁড়ায়ে আংটা খুলে ঢাকনা খুলে ভেতরে নামলাম। ঢাকনা নামায়ে দিলাম। ঢাকনা বন্ধ হলো। ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গেলো। আংটাও আটকে গেলো। অনেকক্ষণ পার হয়ে গেলো। খুঁজতে কেউ এলো না। রং মিস্ত্রিরা কাজ করছিলো। দু’জন কথা বলতে বলতে এলো। বাক্সের ওপর একটা ভারী লোহার মই রেখে চলে গেলো। ঠক ঠক শব্দ করলাম। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। ভয়ে চিৎকার করে ডাকলাম। একটু থেমে কি বুঝে চলে গেল। খুব কান্না পেলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমায়ে গেলাম

আমাকে না পেয়ে পুলিশকে জানানো হলো। কত জায়গায় খবর দেয়া হলো। মা সারাদিন আমার ঘরে বসে কাঁদে। একদিন মা বললে, এই বাড়িতে আমি থাকতে পারবো না। সবখানে টনির স্মৃতি। দু মাস পর বাবা অন্য শহরে চাকরী নিয়ে চলে যায়। আমি থেকে গেলাম একা। লুকোচুরি খেলতে গিয়ে এমন লুকোলাম কেউ আর আমাকে খুঁজে বের করতে পারিনি

ছোট টনির ছবি চোখে ভেসে উঠলো। আহা! কী অসহায় বালক! আমার সব মায়া তার জন্য উছলে পড়লো। আমি ডেস্ক থেকে উঠে সিঁড়ি বেয়ে বেসমেন্টে নামলাম। লাইট জ্বালালাম। মাকড়শার জাল আর ধুলো বালিতে ভরা। এই জগতে এই মাকড়শাকে আমি সবচেয়ে বেশী ভয় পাাই। জাল কেটে ময়লা ঝেড়ে কোণায় কাঠের বাক্সটার কাছে এলাম। বাক্সের ওপর ভারী লোহার মই। মইটা নামালাম। কাঠের বাক্সের বাইরে আংটা লাগানো। খুললাম কসরত করে। কাঠের ঢাকনাটা তুলতাম। কাপড়ের ওপর একটা ছোট মানুষের কঙ্কাল। আমার মাথা ঘুরে গেলো। টনি বললো, ঢাকনাটা খোলা থাক! বন্ধ করোনা! আমি ঢাকনাটা খুলে রেখে এসে বিছানায় বালিশে মাথা গুঁজে গুমরে কাঁদতে থাকি

মা-বাবা ঘুম থেকে উঠেছে। মা নাস্তার টেবিলে। রেডি করে খেতে ডাকছে। চোখ মুখ ধুয়ে আমি এলাম। মা তখন কাপে চা ঢালছে বাবার জন্য। চেয়ার টেনে বসলাম। আমার বাটিতে সিরিয়াল। দুধ ঢেলে নিলাম। বাবা আমার মুখোমুখি চেয়ারে। বাবাকে জিগ্যেস করলাম, গ্রানুলা সিরিয়াল এখন পাওয়া যায়? বাবা বললো, এতো একশ বছর আগের সিরিয়াল। জেমস জ্যাকসন নামে এক নিউট্রিসনিস্ট বের করেছিলেন ১৮৮৩ সালে। এখন কেলগ কোম্পানি অন্য নামে বের করে

বাবা যখন শুরু করে কিছু বলতে, তখন পুরোটা শেষ না করে থামে না। আমি বাবাকে থামিয়ে খুব সিরিয়াস হয়ে বললাম, তুমি ভুত বিশ্বাস করো না! আসো আমার সাথে। বাবার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। মা আমাদের পেছন পেছন আসছে। সে খুব উৎসুক। সাত সকালে মেয়ে ও বাবার কাণ্ডকারখানায় মা বেশ মজা পাচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলাম। বেসমেন্টের বাতি জ্বালালাম। বাক্সের ঢাকনা খোলা। বাক্সের কাছে টেনে এনে বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে ঘোষণা দিয়ে বললাম, দেখো বাবা! বাবা, মা দুজনেই দেখলো। মুখে অবাক হবার কোন চিহ্ন না দেখে আমি নিজেই অবাক হলাম প্রায় একসাথেই দুজনে বললো, এখানে তো শুধু কাপড়-চোপড়। আগে যারা থাকতো, তারা ফেলে রেখে গেছে। সামনে এসে বাক্সের ভেতর তাকালাম। সত্যি কঙ্কালটা সেখানে নেই। উধাও!