গল্প । জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২




 রমিজ দাদুর বরইগাছ









মুহিব্বুল্লাহ কাফি

ঢাকা, বাংলাদেশ



 

চারজন ছুড়লাম চারটে ঢিল। মগডালে। ধ্যাত, কারোর নিশানা লক্ষ্যে পৌঁছাল না। পড়ল কেবল গুটিকয়েক বরই। না, পোষাবে না। আরোকিছু বরই পাড়তে হবে। আমি এদিকসেদিক ঢিল খুঁজতে লাগলাম। এরি ফাঁকে হাসান আরেকটি ঢিল ছুড়ল বরইগাছে। ওর নিশানা এবার লক্ষ্যচুত হল না। 

ঢিলটা পড়ল গিয়ে মগডালে ঝাঁকবাঁধা একটা বরই ছড়িতে। তাতে অনেকগুলো বরই পড়ল নিচে। আমি, হাসান ও মেরাজ ছড়িয়ে পড়া বরই কুড়াতে ব্যস্ত। রফিকও ছুড়ল ঢিল। আমরা ওর দিকে তাকানোর ফুরসত পাইনি। বরই পড়ল আরো কিছু। এবার রফিকও আমাদের সাথে শরিক হল বরই কুড়াতে। 

এমন সময় রমিজ দাদুর হাঁক শুনতে পেলাম। আমরা জানি দাদু লাঠিতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসতে একটু সময় লাগবে। সে সুযোগে আমরা চার বাঁদর দিকবিদিক লুকিয়ে থাকা বরই বাবাজিদের কুড়ানোর গতি বাড়িয়ে দিলাম।। 

বরই কুড়ানো শেষ। দাদুও আসছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তেড়ে। আমাদের বাপদাদাদের নাম ধরে বলতে বলতে, ওই তো জলিলের নাতি, আসাদের পুলা, জাব্বারের পুলা খাড়া তোদের ঠ্যাং আমি ভাঙতাছি

আমরা যেই ছুট দেবো, রফিক চেঁচিয়ে উঠল, আমার জুতা কোথায়?

মুহূর্তে ইলেক্ট্রিসিটির মতো তড়িৎ গতিতে আমার মাথায় 'আমার জুতা কোথায়?' শব্দটা শর্ট খেল; সর্বশেষ ঢিল তো রফিকই ছুড়েছে, তাহলে কি...

হুম, যেই ভাবনা, জুতা বরইগাছের মগডালে। 

উপরে তাকিয়ে বললাম, ওইতো তোর জুতা। বেটা গাছে ঝুলে আছে। 

ওরাও তাকাল মগডালে। বিরক্ত প্রকাশ করে হাসান বলল, কিন্তু পায়ের জুতা গাছে কীভাবে! 

পালা... না হয় দাদুর লাঠির বাড়ি এই বুঝি পড়ল পিঠে, বলেই দিল ছুট মেরাজ

আমি ও হাসান নিলাম ওর পিছু। সবার পেছনে ছুটছে রফিক। এক পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। 

একটু আড়ালে গিয়ে হাঁটুতে ধরে নুয়ে ঘনঘন গরম শ্বাস ছাড়তে লাগলাম। পিঠে স্কুলব্যাগটা এতো ভারী মনে হল যেনো আস্ত একটা পাথর

রফিক হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমার জুতার কী হবে?

বাজখাঁই গলায় মেরাজ বলে উঠল, তুই জুতা ছুড়তে গেলি কেনো? তোকে কি আর শুধু শুধু ফেলটুসবাবা বলি। জায়গা বুঝিস না। না বুঝিস পরিস্থিতি; ফেল মারস সব জয়গায়

হতাশার মধ্যেও এক চিলতে হাসি দিয়ে রফিক বলে বসল, দাদুর গাছের বরই দেখলে কি আর হুঁশ থাকে, জুতা ছুড়ছি না ব্যাগ!

বেশ তো এবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্কুলে চলেন, বলে পকেট থেকে একটা বরই আমি মুখে পুরলাম। মুখে পুরল ওরাও। চললাম এবার। স্কুলে গিয়ে যে যার ক্লাসে প্রবেশ করলাম

যে যার ক্লাস বলতে, আমি, হাসান ও মেরাজ ঢুকলাম সেভেন ক্লাসের রুমে। আর রফিক গেল ক্লাস সিক্সের রুমে

কারণ, গত বার্ষিক পরীক্ষায় রফিক সবকটা সাবজেক্টে ফেল মেরে বসেছে। আগেও ফেল মারত কিন্তু এবার রেকর্ড গড়েছে

তাইতো হেডস্যার কিছুতেই সেভেনে উঠাবেন না। 

রফিকের মা-বাবা অনেক ইনিয়েবিনিয়ে বলেও লাভ হল না। হেডস্যার তার কথায় অটল, অনড়। শেষে ওর মা-বাবা অন্য স্কুলে ভর্তি করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বেঁকে বসল রফিক। আমাদের আদরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়-ই পড়বে ও। প্রয়োজনে দুইবার পড়বে সিক্স। তবুও অন্য স্কুলে যাবে না। রফিকের বেঁকে বসার অন্যতম কারণ অবশ্য আমরা তিনজন। শুধু ক্লাস টাইমটাই রফিক আমাদের থেকে পৃথক থাকে। তাছাড়া যেখানেই যাই, যাই একসাথে। খেলার মাঠ, পুকুর ঘাট, মেলার আসর থেকে রমিজ দাদুর বরই গাছতলা; সব জায়গায় আমরা একতাবদ্ধ। 

আমাদের বাড়িও খুব বেশি দূরে নয়। পাশাপাশি। মেরাজ, হাসান ও আমাদের বাড়ি রমিজ দাদুর বাড়ি থেকে উত্তর-পুবে। আর রফিকদের বাড়ি রমিজ দাদুর বাড়ি থেকে দক্ষিণ-পুবে। রমিজ দাদুর বরই গাছতলাতেই আমাদের স্কুল টাইমে মেলবন্ধনের স্থান। যদিও রফিকদের বাড়ির পাশেই খেলার মাঠ আছে। ওখানে আমরা খেলাধুলা থেকে শুরু করে যেকোনো বিষয়ে সলাপরামর্শ করি। তাই আমরা স্কুল টাইম রমিজ দাদুর বরই গাছতলায় এসে একে অপরের জন্য অপেক্ষা করি। যখন একসাথে হই ঝাঁপিয়ে পড়ি দাদুর বরইগাছে। অন্য ছেলেপেলেরাও ছুড়ে ঢিল। কিন্তু আমাদের উৎপাত একটু বেশিই বটে। 

দাদুর বরইগাছে ঢিল কেনোই-বা পড়বে না। গাছটি দাঁড়িয়ে আছে বেশ জায়গা নিয়ে।শাখা-প্রশাখাগুলো ছড়িয়েছে দিকবিদিক। আর ঝাঁকবেঁধে ঝুঁকে আছে মিষ্টি বরই। কিন্তু মগডালের বরইগুলো পাকা এবং বড়সড়। একেকটা যেনো রসগোল্লা। কামড় দিলেই হারিয়ে যাই। নিচের ডালগুলোতেও আছে ঢের বরই। কিন্তু সেগুলো অপরিপক্ক না হলেও আকারে ছোট। খেতে রমিজ দাদুর বরইগাছের ফ্লেভার আসে না। তাইতো আমাদের মিশন বরাবরই মগডালে। 

রমিজ দাদুর বয়স শুনেছি এক'শ ছুঁইছুঁই। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও দাদুর দম আছে বেশ। আমাদের যখন দৌড়াতে তেড়ে আসেন তখন বোঝা যায় বয়স যেন তার কাছে সংখ্যা মাত্র। 

দাদুর ছাত্র ছিলেন নাকি আমাদের বাবা চাচারা তো বটেই দাদারাও। আদরপুর গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ তিনি। তার সমসাময়িক বলতে যাদের বোঝায় তাদের কেউই বেঁচে নেই। তাইতো রমিজ দাদু আমাদের নাম না জানলেও আমাদের বাপদাদাদের নাম ধরে আমাদের সম্মোধন করেন। 

রমিজ দাদু অবশ্য থাকেন একাই। বিশাল বাড়ি। উঠোনও বেশ চওড়া। বাড়ির মুখেই বিষণ্ণবদনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া। অবশ্য বসন্তকালে শাখায় শাখায় কৃষ্ণচূড়ার সতেজ ফুল তার লাল পাপড়িগুলো মেলে ধরে। কৃষ্ণচূড়া বসন্তের সাজে সজ্জিত হয়ে প্রকৃতিকে রঙিন করে তোলে। অপরুপ রুপে সেজে উঠা কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে বসন্তেরকোকিল এসে বসে। তার মধুর কু কু তানে মুখরিত হয়ে উঠে রমিজ দাদুর উঠোন

উঠোন পেরিয়েই যাতায়াতের রাস্তা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বরইগাছটা। রাস্তার ওপাশে পরিত্যক্ত, নিস্তব্ধ পুকুর। পুকুরভরা কচুরিপানা। শেওলায় পুকুরের চারপাশে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব

দাদুর একটাই ছেলে। কী যেন নাম। বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে কানাডা। বছর পাঁচেক পরপর সপরিবারে আসে বেড়াতে। 

মেয়েও আছে একজন। দেশেই আছে স্বামীর ঘরে। মাঝেমধ্যে এসে দুচারদিন থেকে যায়। 

-দুই-

স্কুল ছুটি হল। হৈ-হুল্লোড় করে বের হলাম ক্লাস থেকে। ওই তো দেখা যায় আমাদের ফেলটুসবাবা। স্কুলের মেইন ফটকে দাঁড়িয়ে আছে একপায়ে। আমাদের প্রতীক্ষায়। শামিল হলাম ওর সাথে। 

আমাদের দেখেই রফিক বলে উঠল, বন্ধু তাড়াতাড়ি চল, আমার জুতাটা উদ্ধার করতে হবে। 

হাসান হেসে হেসে বলল, বেচারার জুতা আটকা পড়ে আছে বরইগাছে। যদি না দাদুর নজর পড়ে!

মেরাজ বলল, চল তো দ্রুত। ফেলটুসবাবা জুতা ছাড়াই ক্লাস করেছে, এটাই বেশি

ব্যাগ পিঠে চললাম আমরা চারজন। এখন মিশন, ফেলটুসবাবার জুতা উদ্ধার। 

গেলাম রমিজ দাদুর বাড়ির সামনে। দাঁড়িয়ে আছি বরই গাছতলায়। মাথার উপর ঝুলছে ঝাঁকবাঁধা লোভনীয় বরই। হাতে ঢিল নিয়ে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে চারজন। ঝুলছে ফেলটুসবাবার জুতাও। তর আর সয়ছে না। কীভাবে ঢিল ছুড়ি ভাবছি। কারণ, এখন এই তিন রাস্তার মোড় ভারি ব্যস্ত। মানুষের সমাগম ঘনঘন। তাই বরইগাছে ঢিল ছুড়তে ভারি মুশকিল। সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় মানুষ খুব একটা চোখে পড়ে না। 

হঠাৎ দেখলাম একজন লোক চলে যাচ্ছে আরেকজন আসছে। মাঝে আমরা গাছতলায়। দুইজনের মাঝে পঞ্চাশ গজ দূরত্ব। রাস্তা বেঁকে যাওয়ায় আমরা দেখলেও আসার জন আমাদের দেখছেন না। এরি ফাঁকে রফিক বলল, তাড়াতাড়ি ঢিল ছোড়। 

ছুড়লাম ঢিল। হুরহুর করে কয়েকটি পাকা বরই পড়ল গাছতলায়। মেরাজ, হাসান মুহূর্তে বরইগুলা পকেটে পুরে নিল

রফিক ফের চেঁচিয়ে উঠল, আরে রই-এ ছুড়ছিস কেনো, জুতায় ছোড়। 

আরে তাইতো। ঢিল ছুড়ার কথা জুতায়, তা না করে ছুড়লাম বরই-এ। 

আড়চোখে তাকালাম রফিকের দিকে। বললাম, বন্ধু, রমিজ দাদুর গাছের এমন লোভনীয় বরই দেখে কি মাথা ঠিক থাকে। ঢিল বরইয়ে ছুড়ছি না জুতায়। ওর কথা ওকে ফিরিয়ে দিলাম। 

পেছনের লোকটিও আমাদের ওভারটেক করে চলে গেল। বাহ, রাস্তা দেখা যায় এখন সকালের মতই ফাঁকা। ছুড় ঢিল গাছে। এখন কি আর ফেলটুসবাবার জুতার কথা মনে আছে। মাথায় বরই আর বরই। আমরা চারজন একসাথে ছুড়লাম ঢিল। তিনজন বরই-এ ছুড়লেও ফেলটুসবাবা প্রথম ঢিলটি তার জুতোতেই ছুড়ল। তাতেই সফল। পড়ে গেল জুতা। আমরা তো ঢিল ছুড়ছি আর বরই কুড়াচ্ছি। এমন সময় ফের রমিজ দাদুর হাঁক, শয়তানগুলো আবার আইছোস। 

দাদুর হাঁক শুনে এবার আর দাদু আসার অপেক্ষা করলাম না। দলবেঁধেই দিলাম ছুট। দৌড়ের মধ্যেই রফিক ডানে মোড় নিল। আমরা বাঁয়ে চলে গেলাম যার যার বাড়িতে। 

বাদ আসর মাঠে আসল মেরাজ ও হাসান। ফেলটুসবাবা তখনও আসেনি। আমি বললাম, কিরে ফেলটুসবাবা আসলো না?

মেরাজ আমাকে ইশারা করে বলল, ওই দেখা যাচ্ছে ফেলটুসবাবা আসছে

রফিক এসেই বলল, শেষ। রমিজ দাদুর বরই খাওয়ার দিন শেষ

আমি বললাম, দাদুর ছেলে এসেছে?

আমার কথার পিঠে মেরাজ বলল, নাকি মেয়ে এসেছে ওই বাঁদর ছেলেকে নিয়ে। কি সাংঘাতিক ছেলে রে বাবা! গতবার এসেছিল বেড়াতে। সারাক্ষণ বরইগাছে ঝুলে থাকত। আর আমাদের দেখলেই দৌড়াত

রফিক বলল, আরে ওসব না। 

তাহলে কেনো বললি বরই খাওয়ার দিন শেষ। বললাম আমি। 

রফিক বলল, মাঠে আসার পথেই রুস্তম কাকার সাথে দেখা হল

কোন রুস্তম? ওই যে, রমিজ দাদুর বাড়িতে যে আসাযাওয়া করে, সে? বলল মেরাজ

রফিক বলল, হ্যাঁ, সেই রুস্তম কাকাই। কথায় কথায় বললেন তিনি নাকি কোন ব্যাপারির সাথে আলাপ করেছেন রমিজ দাদুর বরই বিক্রির বিষয়ে। দাদুর শরীর নাকি খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাই দুএকদিনের ভেতর নাকি দাদু বরই ব্যাপারির কাছে বিক্রি করে দিবেন

কী বলিস, এতো তাড়াতাড়ি দাদু বরই বিক্রি করে দেবেন! বলল হাসান। গতবার তো আরো পরে বিক্রি করেছিলেন। 

মেরাজ বলল, হ শরীর খারাপ! আমাদের যখন দৌড়ান তখন তো.... 

আমি মেরাজের কথা শেষ করার আগেই বলে বসলাম, চল আজ রাতে অভিযানে চালাই

হাসান বলল, কোথায়

মেরাজ বলল, কোথায় আবার। দাদুর বরইগাছে

আমি বললাম, হুম। আজ রাতেই দাদুর বরই সাবাড় করে দেব

রফিক বলল, এতো বরই রাখব কোথায়?

আমি বললাম, সেটা দেখা যাবে

এবার আমরা প্ল্যান করলাম কীভাবে, কখন, কোত্থেকে, কীভাবে অভিযান শুরু করব। প্ল্যান এ ও বি এর পরিকল্পনা আঁটলাম। প্ল্যান এ ফেল করলে প্ল্যান বি-য়ের দিকে হাঁটব। 

প্ল্যানমত রাত ঠিক বারোটায় আমরা তিন রাস্তার মোড়ে একত্রিত হলাম। গ্রামে বারোটাই অনেক রাত। রাস্তায় কেউ নেই। থাকারও কথা না। ঝিঁঝিঁর ডাক শুনা যাচ্ছে মৃদুস্বরে। তার সাথে থেমে থেমে ভেসে আসছে হুক্কাহুয়া শিয়ালের হাঁক

চারজন দাঁড়িয়ে আছি রমিজ দাদুর গাছতলায়। পূর্ণিমারচাঁদের স্নান আলোয় আশপাশের সবকিছু দেখা যায়। সেজন্য কিছুটা ভয়ও কাজ করছিল। কেউ দেখে ফেলল কি না। দেখলে কেলেঙ্কারির হয়ে যাবে

মেরাজ কিছু না বলেই তরতর করে উঠে গেল গাছে। একেবারে মগডালে। যেনো আস্ত একটা বানর

আমিও উঠলাম, বলেই রফিকও মাথায় গামছা বেঁধে চড়ল গাছে। হাসান উঠতে যাবে। বাধা দিয়ে বললাম, সবাই গাছে উঠলে বরই কুড়াবে কে শুনি?

হাসান বলল, তাই তো। ওরা দু'জন তো উঠলই। ওরাই নিচে ফেলুক আমরা কুড়াই। 

আমাদের কথার মাঝেই বৃষ্টির মতো বরই পড়তে লাগল। তাকিয়ে দেখি মেরাজ মগডাল উঠে বরইগাছের ডাল ধরে দেদারসে ঝাঁকি দিচ্ছে। আর বরই হুরহুর করে পড়ছে। দুটো বস্তা নিয়েছিলাম। আমি আর হাসান বরই কুড়িয়ে কুলাতে পারছিলাম না। রফিককে ডাকলাম। ও মেরাজের অনেক নিচের ডালে একটা একটা বরই ধরে পাড়ছে। নিচের ডালগুলোতে বরই খুবই কম। বেশি থাকবেই বা কীভাবে। আমাদের হাত থেকে কি আর নিস্তার পেয়েছে নিচের ডালগুলো। রাতে খেতে ভুলে গিয়েছি, দুপুরে খেলতে গিয়ে গোসল ভুলে গিয়েছি, হোমওয়ার্ক ভুলে গিয়েছি, মাঝেমধ্যে স্কুলে যেতেও ভুলে গিয়েছি; রমিজ দাদুর বরই গাছতলা দিয়ে গিয়েছি কিন্তু দুতিনটে ঢিল ছুড়তে ভুল করেও কোনোদিন ভুলিনি

          বরই কুড়াচ্ছি আর রফিককে ডাকছি। রফিক আমার ডাক হয়তো শুনছে। কিন্তু ও নিচে নামতে চাচ্ছে না। আকস্মিক টপাস করে শব্দ শুনলাম। আমার পিলে কেঁপে উঠল ভয়ে। হাসান-ও আঁতকে উঠল। দুজনই সমস্বরে বলে উঠলাম, ইন্না-লিল্লাহ! 

তাকিয়ে দেখি বরইগাছে থাকা রফিক গাছতলায়। চিৎপটাং। চার হাতপা চার দিকে ছুড়ে আমার পাশেই পড়ে আছে। হাসান ছুটে এল। মেরাজ মগডালে থেকে ধীরে ধীরে নামছে আর পড়ছে, লা-ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নিকুনতুম মিরাজ জলিমিন। 

হাসান ডাকছে রফিক রফিক বলে। ধাক্কা দিচ্ছে। মেরাজ এসে হাত-পা ঘষছে। কিন্তু রফিক সাড়া দিচ্ছি না। রফিকের সাড়াশব্দ না পেয়ে আমরা ঘাবড়ে গেলাম। মুহূর্তে আমাদের চিবুক ভিজে উঠল ভয়ে, আতঙ্কে। আমি রফিকের নাকের সামনে হাত দিলাম। মেরাজ ভয়ার্ত স্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আছে না গেছে?

আমি বললাম, আছে। নিশ্বাস নিচ্ছে। বাতাস বের হচ্ছে। 

হাসান ও মেরাজ গরম নিশ্বাস ছাড়ল, আলহামদুলিল্লাহ। 

তিনজন ধরাধরি করে রাস্তার ওপাশে পরিত্যক্ত পুকুরের কাছে নিয়ে গেলাম। আমি পানি এনে রফিকের চোখেমুখে দিলাম। হাসান রফিকের দুগাল ধরে কয়েকবার ডাকল। রফিক এবার চোখ খুলল। আমাদের কলিজায় পানি এল। রফিক উঠে বসল। বলল, কে যেনো আমার গামছা ধরে টান দিল। আমি ভূত ভেবে সামনের নরম ডালে পা দিতেই মর্মর করে ডালটা ভেঙে গেল। তারপর আর কিছু বলতে পারব না। কিন্তু আমার গামছা কোথায়! ভূত বোধহয় আমার গামছা রেখে দিয়েছে

হ্যাঁ, ভূতের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই, তোমার গামছা নিতে বরইগাছে উঠবে, বলেই রফিকের মুখে গামছাটা ছুড়ে মারল মেরাজ। বলল, তোর হালত দেখে আমিও ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তুই যাকে ভূত বলছিস সেটা হল বরইগাছের কাটা

কাটা! বরইগাছে কাটা আবার ভূত হয় কীভাবে? বিস্ময়-বিহ্বল হয়ে উঠল হাসান

মেরাজ বলল, হুম কাটা। আমি নিচে নামার সময় দেখি রফিকের গামছা বরইগাছের কাটার সাথে ঝুলে আছে। গামছা কাটাতে লেগে টান পড়ায় রফিক ভূত ভেবে চিৎপটাং। 

এবার আমাদের ভয় ও বিরক্ত ক্ষোভে পরিণত হল। রফিক কিছু বলতে যাবে ওমনি আমি দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলাম, আপনার আর কিছু বলা লাগবে না। যে ভয় আমাদের দেখিয়েছেন বরই খাওয়ার সাধ মিটে গেছে। 

হাসান বলল, তুই রমিজ দাদুর বরইগাছে উঠেও ফেল মারলি। ভাগ্যিস, জীবনের সাথে ফেল মারতে পারলি না। তাহলে আমাদের কিযে বেহাল দশা হত!

শেষে বরই, গামছা ও বস্তার ভেতর কিছু বরই নিয়েই বাড়িতে যাই। আর বরইগাছে উঠতে যাইনি। ফিরেও তাকাইনি। 

-তিন-

সকাল ন'টায় চোখ খোলে দেখি মেরাজ ডাকছে। হাসান ও রফিকও সাথে। চোখ কচলিয়ে উঠে বসি। 

কী ব্যাপার এতো সকাল তোরা? হাই দিতে দিতে বললাম

মেরাজ বলল, বেলা ন'টা বাজে। তুই বলছিস সকাল

হাসান বলল, জানিস, রমিজ দাদু বেশ অসুস্থ। 

আমি বললাম, সে আর নতুন কী। বয়স তো কম হয়নি

মেরাজ বলল, তা ঠিক আছে। কিন্তু দাদু এবার মৃত্যুশয্যায়। ক্ষীণস্বরে কথা বলেন। গাঁয়ের মানুষ এখন সব রমিজ দাদুর বাড়িতে। কেউ দাবি ছাড়াচ্ছে। কেউ মাফ চাচ্ছে। কেউ আবার দেখতে যাচ্ছে

আমাদের বাঁদরামির কথা আমাদের মায়েরাও জানেন। বিচার-আচারও কম আসেনি। তাই পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সব শুনে আম্মু বললেন, যা বাবা তুইও যা। গিয়ে মাফ চেয়ে আয়। বলাতো যায় কখন মরে যান। তার আগেই মুরুব্বির পা ধরে মাফ চেয়ে আয়। জ্বালাতে তো আর কম জ্বালাসনি তাকে

চল তাড়াতাড়ি মাফ চেয়ে আসি। আমাদের মা-ও তাই বলেছেন। সমস্বরে বলে উঠল ওরা তিনজন

গেলাম দৌড়ে। ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢোকলাম। রমিজ দাদু বিছানায় শুয়ে আছেন। তার মেয়ে পাশে বসে মাথা হাতাচ্ছেন। নাতি নানার শিথানে বসে আছে। ঠোঁট নেড়ে কী যেন পড়ছে ও। হয়তো সুরা, দুআ। রমিজ দাদু আমাদের দেখে ইশারায় ডাকলেন। গেলাম কাছে। তিনি আমাদের চারজনের মাথায় হাত বোলিয়ে ক্ষীণস্বরে বললেন, আমারে মাফ করে দিও। তোমাদের অনেক গালাগালি করছি

দাদুর মাফ চাওয়ার কথা শুনে রফিক হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ওর কান্না দেখে আমাদেরও কান্না হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আমরা চারজন দাদুর পা ধরে কেঁদে কেঁদে বললাম, দাদু আপনি আমাদের মাফ করে দিন। আমরা আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছি। কষ্ট দিয়েছি। আপনার বরইগাছে ঢিল ছুড়েছি। চুরি করে বরই খেয়েছি। আমাদের মাফ করে দিন

আমাদের কান্না ও ভুলের স্বীকারোক্তি শুনে উপস্থিত সবাই হু হু করে কেঁদে দিলেন। রমিজ দাদুও চোখের কোণে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, আমি কিছুই মনে করিনি