গল্প ৪ । শ্রাবণ ১৪৩২




চোর খুঁজতে বাটপাড়












অনির্বাণ জানা 

নদীয়া,  পশ্চিমবঙ্গ


 

চোরের গল্প শেষ পর্যন্ত লিখেই ফেললেন পটলবাবু। অবশ্য তার জন্য ভয়ানক খেসারত দিতে হলো তাঁকে। তাঁর গোড়াতেই যে গলদ। নামে কি আসে যায় একথাটা শেক্সপিয়ার সাহেব মোটেই ঠিক বলেননি।  

পটল পুরকায়স্থ কোনো একটা নাম হলো? নামটার জন্য অধিকাংশ সম্পাদক তাঁর লেখা ছাপাত না। কোনো সম্পাদকই বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেনা যে পটলকে আমিই তুলে এনেছি। পটল তোলা মোটেই ভালো জিনিস নয়। সিনেমা আর্টিস্ট, বড়ো খেলোয়াড় বা নামজাদা লেখকের সাফল্যের পেছনে কোনো পরিচালক, কোচ বা সম্পাদক থাকে। তারাও পরে বিখ্যাত হয়ে যায়। পটলবাবু পড়েছেন মহা ফাঁপরে। তাঁর লেখা বেশ কিছু জায়গায় ছাপা হলেও এখনও ঠিক হালে পানি পাচ্ছেন না তিনি। নামটা একেবারে মেরে দিয়েছে তাঁকে। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো পদবীটাও হয়েছে গোলমেলে। পুরকায়স্থ থাকলে হাফকায়স্থ থাকতে হবে। ওয়ানফোর্থ কায়স্থই বা দোষ করলো কোথায়? ব্রাহ্মণ, বৈশ্য বা শুদ্রদের এরকম অদ্ভুত ভগ্নাংশের অঙ্ক দিয়ে টাইটেল হয়না। অর্ধেক ওপরওয়ালা আর অর্ধেক ছোটঠাকুমা ওনাকে মেরে দিয়েছেন। পটল খেতে ভালোবাসতেন বলে নাতির নাম পটল দিতে হবে

তাও লেখার জোরে ইদানীং পটলবাবুর লেখা এদিক-ওদিক ছাপা হচ্ছে। এমনিতে পটলবাবু অঙ্কের শিক্ষক। বায়োলজিতে এমএসসি করলেও নিজের নামের জন্য বায়োলজি ক্লাস তিনি নেন না। একটা ফক্কড় ছাত্র তাঁকে ট্রাইকোসান্থিস ডিওইকা কিসের বৈজ্ঞানিক নাম জিজ্ঞেস করেছিল। গম্ভীর মুখে “ওটাই আমার নাম” বলে সটান হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘরে চলে এসেছিলেন। তারপর থেকে পটলবাবু অঙ্কের ক্লাস নেন। 

অঙ্ক কষার ফাঁকে ফাঁকে তিনি গল্পের প্লট ভাবেন। দুটো পিরিয়ডের মাঝে গল্পের চরিত্রগুলোর সংলাপ নিজের মনে ঝালিয়ে নেন। এমনকি রোল কল করার সময়ও মনের ভেতর রোলনম্বরের মাঝে মাঝে গল্পের মারপ্যাঁচ গুঁজতে থাকেন। বাড়ি ফিরে মুখহাত ধুয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়েন। একটা গল্প শেষ করতে মোটামুটি চারদিন সময় লাগে। এরপরে দুদিন সময় নেন নাম ঠিক করতে এবং লেখাটাকে গুছিয়ে নিতে। সপ্তম দিন ছোটঠাকুমাকে প্রণাম করে লেখাটাকে কোনো একটা পত্রিকা অফিসে মেল করে সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়িতে পুজো দিয়ে আসেন। গত কয়েকবছর ধরে এটাই পটলবাবুর সাপ্তাহিক রুটিন। তা, টুকটাক পটলবাবুর লেখা বেরোচ্ছে বটে। তবে কোনো পত্রিকাই এখনো পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে লেখা চায়নি। এদিক-সেদিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ইদানীং মাঝেমধ্যে ডাক পান পটলবাবু। তাঁর সঙ্গে যাঁরা লেখা শুরু করেছিলেন, সেই ইন্দ্রজিৎ মুখার্জি, গৌতম সিংহ, সৌমি সরকার ইত্যাদিরা এখন প্রতিষ্ঠিত লেখক। তাঁদের সাথে দেখাও হয়। এ-ই তো, ইন্দ্রজিৎ সেদিন বললেন যে যুগের ডঙ্কা পত্রিকা ওনার কাছ থেকে পূজাবার্ষিকীর জন্য ভূতের গল্প চেয়েছে। সৌমি চশমার ওপর দিয়ে পটলবাবুর দিকে তাকিয়ে জানায় যে ওর উপন্যাস মহানন্দ বাজারের অ্যাপে শিগগির ধারাবাহিক ভাবে বেরোবে। পটলবাবু হাঁ করে শোনেন। তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় নামকরা সাহিত্যিক। একটু সরল সাধাসিধেও আছে। বয়সে বেশ ছোটো। তাকে একদিন মনের কথা বলেই ফেললেন পটলবাবু-  আমাকে কেউ ফোন করে না। 

তমাল বোধহয় কোনো সম্পাদককে পটলবাবুর দুঃখের কথা বলেছিল। দুদিনের মধ্যে ঘটমান পত্রিকার সম্পাদকের ফোন। পটলবাবুর কাছ থেকে ‘চোর'-এর গল্প চান। ঘটমান পত্রিকা একটা ‘চোর’ সংখ্যা বার করছে। তবে কারও কাছে জানানো যাবেনা যে তিনি আমন্ত্রিত লেখক। তাহলে সম্পাদকের নাম জড়িয়ে যেতে পারে। 

তাই সই। কিন্তু চোর কি একটা বিষয় হলো? শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পে বেশ ভালো ভালো চোর পাওয়া যায়। কিন্তু ওনার সাথে কারো তুলনা চলে না। খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন পটলবাবু। এদিকে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে চরিত্রকে কাছ থেকে না জানলে তাকে সাহিত্যে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। তিনি নিজে না বলে অপরের জিনিস জীবনে নেননি

পরেরদিন সেভেনের ক্লাস নিতে নিতে হঠাৎই প্রশ্ন করে বসলেন - “তোরা কে কে চুরি করেছিস?” সারা ক্লাস চুপ। কিছুক্ষণ পরে সমবেত প্রতিবাদ - আমরা কেউ অন্যের খাতা দেখে অঙ্ক করিনা স্যার। টুকলি করাকে কি আদৌ চুরি করা বলা চলে? পটলবাবু আপনমনে বিড়বিড় করেন- আমি সে চুরির কথা বলিনি। স্কুলের ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন শান্তনু উঠে বলে যে শচীন, সৌরভ, রোহিত, কোহলির অনেক সেনচুরি আছে। এদেরকে দিয়ে হবেনা। স্কুল ছুটির পরে একবার থানায় যাবেন ঠিক করেন পটলবাবু। 

থানার দারোগা সুশোভন তরফদার প্রচন্ড ব্যস্ত মানুষ। নিজের পরিচয় দিয়ে পটলবাবু জানান যে তিনি চুরির ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন। ফাইল থেকে মুখ না তুলেই সুশোভন নবীন বলে একজনের সাথে কথা বলতে বলেন। নবীন কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিল। দাঁতে কাঠি রেখেই বলে - “এফ আই আরটা লিখে যান।” 

মহা ফাঁপরে পড়ে যান পটলবাবু। গলা খাঁকরে বলেন যে চুরিটা এখনো হয়নি। তিনি চোরদের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন। এবার সরু চোখে তাকায় নবীন। “আপনি বরং ডক্টর দয়াল মুখার্জির কাছে চলে যান।”

কেন? দয়াল মুখার্জির বাড়িতে রিসেন্টলি চুরি টুরি হয়েছে নাকি?”

এবার নবীনের মুখে ফিচেল হাসি। “দয়ালবাবু পাগলদের ডাক্তার। বাড়িতে চুরি যাবার আগেই এই প্রথম কেউ থানায় ডায়েরি করতে এলো তো।” 

বেশ মনখারাপ নিয়ে বাড়ি ফেরেন পটলবাবু। ল্যাপটপ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসেও থাকেন। কিন্তু গল্প কই? কারো পরামর্শ নিলে ভালো হয়। তমালবাবুকে ফোন করলে কিছু মনে করবেনা তো? কিছুটা মরিয়া হয়ে ফোন করে ফেলেন পটলবাবু। তমালবাবু অবশ্য ভালোভাবেই কথা বলে। হাতের কাছে যদি চোর না পাওয়া যায় তাহলে ওদের ওয়ার্কিং আওয়ারের পরিবেশটা দেখা উচিত। অর্থাৎ রাত্রিবেলা আশেপাশে একটু ঘুরে দেখলে ভালো। 

তমালের কথাটা বেশ মনে লাগে পটলবাবুর। রাত দুটোয় মোবাইলে অ্যালার্ম সেট করে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েন উনি। 

আবহাওয়াটা ঠান্ডা ঠান্ডা। দুটোয় যখন ঘুম ভাঙলো তখন আবার ঘুমিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। কোনোমতে পাঞ্জাবির ওপর একটা চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পড়েন পটলবাবু। রাস্তাঘাট শুনশান করছে। দু'একটা কুকুর বেশ সন্দেহের চোখে তাকায় ওঁর দিকে। তবে রাতের বাতাস বেশ বিশুদ্ধ লাগে পটলবাবুর। বড়সড় কয়েকটি শ্বাস নিয়ে কাছের পার্কে ঢুকে পড়েন। 

পার্কটা ফাঁকা থাকার কথা। কিন্তু কি আশ্চর্য, একজন ভদ্রলোক একটা বেঞ্চে বসে আছেন। ধিরে ধিরে তাঁর দিকেই এগিয়ে যান পটল। কালো টি শার্ট আর কালো জিন্সে পেটানো চেহারার ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে তাকান ওঁর দিকে। এইরে, পটলবাবুকেই চোরছ্যাঁচড় ভেবে বসেননি তো আবার। পটলবাবু নমস্কার করে তাঁর রাতে ঘোরাঘুরির কারণ প্রথমেই ব্যাখ্যা করে দেন। 

ভদ্রলোক নড়েচড়ে বসেন- “কি আশ্চর্য! আমিও লেখক। আমার নাম গিরিধারী গড়গড়ি। আমি ভূতের গল্প লিখবো বলে রাতদুপুরে বেরিয়েছি।”

গিরিধারীর নাম শোনেননি পটলবাবু। গিরিধারী নামটাও বিদঘুটে। সমবেদনায় ককিয়ে ওঠেন পটল

-তা, ভূতের দেখা পেলেন? পটলবাবু প্রশ্ন করেন

পেয়েছি।” - উত্তর দেন গিরিধারী। “ভূত, প্রেত, শাঁকচুন্নি, স্কন্ধকাটা, ব্রহ্মদত্তি সব একেবারে গিজগিজ করছে। এখানে না আসলে জানতেই পারতাম না যে এতো ধরনের ভূত আছে পৃথিবীতে।”

গা ছমছম করে ওঠে পটলবাবুর। খুব জোর হিসু পেয়ে যায়। পরের কথাটায় আরও বিপদে পড়ে যান। গিরিধারী ফিসফিস করে বলেন - “ঠিক আমাদের পাশেই একটা অতৃপ্ত আত্মা বসে রয়েছে।” 

আঁতকে উঠে একটু গিরিধারীর গাঘেঁষে বসেন পটলবাবু। আমতা আমতা করে বলেই ফেলেন - “আমাকে একটু বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেবেন?” 

গিরিধারী বেশ সজ্জন ব্যক্তি। সাহসীও বটে। পটলবাবুকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেন। পরামর্শ দেন যেন তিনি দরজা জানালা ভালো করে বন্ধ করে নেন। “বাড়িতে কোনো দরজা জানালা ভাঙা নেই তো? ভাঙা দরজা দিয়ে ভূত ঢুকতে ভালবাসে।” 

সর্বনাশ করেছে। সিঁড়ির ঘরের দরজাটা তো নড়বড়ে! কি হবে এখন?

গিরিধারী বলেন যে  সন্ধ্যার পরে দরজাটায় না হাত দেওয়াই ভালো। 

শুভরাত্রি জানিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়েন পটলবাবু। মনে হয় যেন কেউ ছাদের দরজাটা খুললো। ভয়ে রামনাম জপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েন পটলবাবু। 

ঘুম ভাঙলো সবার চিৎকার চেঁচামেচিতে। বাড়িতে বিরাট চুরি হয়ে গেছে। সিঁড়ির ঘরের দরজা ভেঙে চোর সব চুরি করে নিয়ে গেছে। এমনকি পটলবাবুর গল্প লেখার ল্যাপটপটা শুদ্ধ। 

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন পটলবাবু। কাউকে বলতেও পারেননা যে চোরকে উনি চেনেন। খুব মনখারাপ নিয়ে ঘটমান পত্রিকার সম্পাদককে ফোন করেন। গল্প রেডি। কিন্তু মেল না করে কাগজে লিখে গল্পটা পাঠালে চলবে তো