প্রবন্ধ - প্রতিবাদী রানি রাসমণি - অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় । জানুয়ারি - ২০২৪


 প্রতিবাদী রানি রাসমণি

অ রূ প
বন্দ্যোপাধ্যায়






....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -

 

 

প্রায় একশো আশি বছর আগের কথা। ভারতে তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ জাঁকিয়ে বসতে চলেছে। পুরোপুরি শাসনক্ষমতা দখল না করলেও, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে রাজত্ব চালাচ্ছে ইংরেজরা। দিল্লির সিংহাসন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোলকাতার বুকে প্রচুর জমির ইজারা নিয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্যে মোটা টাকা কামিয়ে শুধু যে কোম্পানি ফুলে ফেঁপে উঠছে তা নয়, এই দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ চলে যাচ্ছে ইংল্যান্ডে, ভরছে ইংরেজ কোষাগার।

আমাদের দেশে তখনো জমিদারি প্রথা চলছে। কিন্তু সেই সব জমিদারদের ডানা ছেঁটে ফেলতে ইংরেজরা নিত্যনতুন আইন জারি করে অত্যাচারের মাধ্যমে আরও বেশি মুনাফা করে চলেছে। যদিও কোলকাতার বুকে বেশ কিছু জমিদার তখনও সরাসরি ইংরেজদের প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে, কিন্তু এর পাশাপাশি কিছু জমিদার পরিবার বজায় রেখে চলেছেন তাঁদের স্বকীয়তা। এমন এক জমিদারি ছিল কোলকাতায় জানবাজারের দাস পরিবারের।

তখন জানবাজারের জমিদার, বাবু রাজচন্দ্র দাস প্রয়াত হয়েছেন। জমিদারি সামলাচ্ছেন তার তৃতীয় স্ত্রী রাসমণি। প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই নারী প্রজাদের বড় ভালবাসেন, তাঁদের সুখ-দুঃখে তিনি যতদূর সম্ভব পাশে থেকে সাহায্য করেন। কোলকাতার লোক তাকে রানি রাসমণি নামে ডাকে। রানি তাদের বড় আপনজন। তার কাছে সব কষ্ট খুলে বলা যায়। তিনি প্রাণপণ প্রতিকার করার চেষ্টা করেন।

রাসমণির কোনও পুত্রসন্তান না থাকায় তাঁর তৃতীয় কন্যার শিক্ষিত স্বামী মথুরবাবু রানিকে মাতৃজ্ঞানে সবসময়ে পাশে থেকে সাহায্য করতেন। দাস পরিবারের এত বড় জমিদারি রানির একার পক্ষে দেখাশুনো করা সম্ভব ছিল না। তবে মথুর বাধ্য ছেলের মতই রাসমণিকে জিজ্ঞেস না করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতেন না।

দুর্গাপুজো এল। জানবাজারের জমিদার বাড়িতে বিরাট আয়োজন। পুজো শুরু হতে কলা বউ স্নান করাতে পুরোহিতেরা চলল বাবুঘাট। এই বাবুঘাট রাসমণির স্বামী বাবু রাজচন্দ্র দাস বানিয়ে দিয়েছিলেন প্রজাদের স্নানের সুবিধার জন্য। জানবাজার থেকে বিশাল শোভাযাত্রা বেরোল। প্রথমে পঞ্চাশ জন ঢাকি আর কাঁসি বাদক, তার পিছনে পুরোহিতের দল, তারপর চললেন গৃহবধূরা মঙ্গল-শঙ্খ বাজাতে বাজাতে। শোভাযাত্রার একদম শেষে পুরুষেরা নতুন পট্টবস্ত্র পরে চলেছেন। জমিদার বাড়ির লেঠেলরাও চলল সাথে। বন্দুকধারী পেয়াদা জনাদশেক। লেঠেল আর বন্দুকবাজরা না থাকলে এত বড় জমিদারি রক্ষা করা দায়।

তখন সবে ভোরের আলো ফুটছে। জানবাজার থেকে বাবুঘাট অনেকটা পথ। শোভাযাত্রা যেই পার হল জানবাজারের ইংরেজ কুঠির পাশ দিয়ে, ওমনি ঘটল বিপত্তি। ঢাক, কাঁসি আর শঙ্খের আওয়াজে গোরা সৈন্যদের ঘুম ভেঙে গেল। ছুটে এল গোরারা। রক্তচক্ষু দেখিয়ে পথ অবরোধ করে দাঁড়ালো তারা। বাজনা বাজিয়ে রাস্তায় শোরগোল করা চলবে না, ইংরেজ কুঠির পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না কোনও বিচিত্র শোভাযাত্রা। বাজনা গেল থেমে, শোভাযাত্রাও।

শোভাযাত্রা থেমে যেতে মথুরবাবু রেগে গেলেন। তিনি ইশারায় থেমে যাওয়া বাজনদারদের বললেন বাজনা শুরু করতে। পঞ্চাশটা ঢাক বেজে উঠল আবার। কাঁসি আর শঙ্খও বাজতে লাগল। বাজনা শুরু হতে গোরা সেপাইরা আরও ক্ষেপে গেল। তারা জমিদার পরিবারের লোকদের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য গালাগাল ছোটাতে লাগল।

শোভাযাত্রা এগোতে গিয়ে আবার বাধা পেল। এবার কুঠি থেকে বেরিয়ে এলেন খোদ কর্নেল সাহেব। তিনি কোমর থেকে পিস্তল বার করে উঁচিয়ে ধরে হুকুম দিলেন, “আর এক পা-ও এগোবে না তোমরা। যদি এগোও, গুলি চলবে। কর্নেলের দেখাদেখি গোরা সেপাইরা তাদের বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়ালো শোভাযাত্রার পথরোধ করে। রাসমণির বন্দুকধারী সেপাইরাও কম যায় না। বন্দুক উঁচিয়ে তারাও দাঁড়ালো গোরা সেপাইদের সামনে। মথুরবাবু তাদের নিরস্ত করলেন। কানে-কানে এক লেঠেলকে ডেকে নির্দেশ দিলেন কিছু। সে ছুট দিল জানবাজারে জমিদার বাড়ির দিকে।

কিছুক্ষণ ধরে দুর্গাপুজোর শোভাযাত্রী দল আর ইংরেজরা দাঁড়িয়ে রইল একই ভাবে। রানির কাছ থেকে আদেশ নিয়ে ফিরে এল লেঠেল। মথুরবাবুকে জানাতেই তিনি কর্নেলের সামনে গিয়ে ইংরেজিতে বললেন, “রাস্তা তোমাদের নয়। এই রাস্তার ইজারা রানি রাসমণি আইনগত ভাবে নিয়ে রেখেছেন। কাগজপত্র সব আছে। যদি প্রয়োজন বোঝ, আদালতে মামলা ঠুকে দাও। এখন পথ ছাড়। হিন্দুদের পবিত্র পুজোর শোভাযাত্রা আটকানোর ফল কিন্তু তোমাকে ভুগতে হবে। এবার গোল না বাধিয়ে আমাদের যেতে দাও।”

কর্নেল বিপদ বুঝে ইশারায় সৈন্যদের সরে যেতে বলল। সে বুঝে গিয়েছিল, শোভাযাত্রা আটকানোর ফল ভালো হবে না। বীরদর্পে জমিদার বাড়ির কলাবউ নিয়ে শোভাযাত্রীরা চলল বাবুঘাট। ঢাক, কাঁসি আর শঙ্খের আওয়াজে কাঁপতে থাকল জানবাজারের রাস্তা।

দুর্গাপুজো মিটতে না মিটতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মামলা করল রানির বিরুদ্ধে। বিচারক কাগজ পত্র খতিয়ে দেখে মামলার রায় দিলেন রানি রাসমণির পক্ষে। কিন্তু তাঁকে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দিতে হল শহরে শান্তি ভঙ্গ করার অপরাধে। সেই কালে পঞ্চাশ টাকা কিছু কম ছিল না।

এরপর কোম্পানি সতর্ক হল। আইন করে কোলকাতার রাস্তায় শোভাযাত্রা বার করার জন্য আগে থেকে কর্তাদের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হল। রানি এক অদ্ভুত উপায় বার করলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধাচারন করার জন্য। তিনি জানবাজার থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত রাস্তার দুই দিকে বেড়া দিয়ে দিলেন কাঠের খুঁটি পুঁতে। ফলে অন্য রাস্তা দিয়ে যানবাহন এই প্রধান সড়কে আসতে করতে বাধা পেল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজকম্ম পণ্ড হতে বসল। কোম্পানি বাধ্য হয়ে রানির কাছে ক্ষমা চেয়ে জরিমানার পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিয়ে অনুরোধ করল বেড়া খুলে দিতে। ইংরেজদের বিরুদ্ধাচারনের এই খবর শুধু কোলকাতায় নয়, আশেপাশের গায়ে গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। রানির জয় জয়াকার হল চতুর্দিকে।

অসামান্য ব্যক্তিত্বশালী রানি রাসমণির ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আর একটি সাড়া জাগানো গল্প বলার আগে তাঁর তদানীন্তন সামাজিক অবস্থানটি জেনে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ গরিব পরিবারের মেয়ে রাসমণি যে শৈশব থেকেই বুদ্ধিমতী ছিলেন সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। কিন্তু জমিদার পরিবারে তাঁর বিবাহ একটি কাকতালীয় ঘটনা বলা যেতে পারে।

কয়েকবছরের মধ্যে পরপর দুই বার বিবাহিত স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বাবু রাজচন্দ্র দাস তৃতীয়বার বিবাহবন্ধনে জড়িয়ে পড়তে একেবারেই রাজী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর বাবা প্রীতিরাম দাস হালিশহর গ্রামে বালিকা রাসমণিকে দেখে পুত্রকে তৃতীয়বার বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। রাসমণির সাথে রাজচন্দ্রের প্রায় এগারো বছরের ব্যবধান ছিল। রাজচন্দ্র সেই সময়ের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এক উচ্চ মনের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন, সামাজিক চেতনার সাথে সাথে যার গড়ে উঠেছিল প্রবল ব্যক্তিত্ব এবং বৈষয়িক দক্ষতা। জমিদারী সামলানোর সাথে সাথে স্ত্রী রাসমণিকে নানা বিষয়ে অবহিত করে শিক্ষিত করে তোলেন রাজচন্দ্র। রাসমণির সান্নিধ্য তাঁর শ্বশুর জমিদার প্রীতিরামকেও প্রভাবিত করে। দাস পরিবারের সব মানুষই ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিলেন। রামমোহন ও উইলিয়াম কেরির কাজ ও চিন্তাভাবনা রাজচন্দ্রকে প্রভাবিত করে, ফলে সরাসরি সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধাচারন করেন বাবু রাজচন্দ্র।

রাজচন্দ্র দাস তদানীন্তন নব চেতনায় দীক্ষিত প্রতিভাশালী যুবকদের সংস্পর্শে এসে নানা সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। রাসমণি এমন পরিবারের ছত্রছায়ায় এসে খুবই অনুভূতিশীল মানুষ হয়ে ওঠেন। দাস পরিবারের বেশিরভাগ দায়িত্ব নিজে হাতে তুলে নিতে রাসমণির সময় লাগেনি। বাবু প্রীতিরামও প্রতিটি কাজে কন্যাসম রাসমণির সাথে পরামর্শ করতেন।

ব্যবসাবাণিজ্য করে এই জমিদার পরিবার অনেক টাকার মালিক হয়। ক্রমে জমিদারী বাড়ানোর জন্য প্রীতিরাম অনেক জমি কেনেন কোলকাতায়। এর পাশাপাশি প্রজাদের কল্যাণে বিবিধ গঠনমূলক কাজ করতে থাকেন তিনি। দাস পরিবারের এক বিরাট অতিথিশালা ছিল। সেই অতিথিশালার উপর নজর পড়ল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। তখন সারা ভারতবর্ষ জুড়েই কোম্পানি বিভিন্ন আইন করে জমি ও জমিদারী অধিকার করার জন্য আগ্রাসী নীতি নেওয়া শুরু করে। এই অতিথিশালা জোর করে কেড়ে নেবার জন্য হটাত প্রীতিরামের কাছে দুজন নিম্নস্তরের ইংরেজ আধিকারিক পাঠায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অতিথিশালার মালিকানা নিয়ে আলোচনা চলাকালীন দুই ইংরেজ অত্যন্ত অভব্য আচরণ করতে থাকে জমিদার প্রীতিরামের সাথে। রাসমণি অন্তঃপুর থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি ইংরেজ পুরুষদের অশালীন আচরণের প্রতিবাদ করেন। পালটা তারাও রাসমণিরকে নানা অপমানজনক কথা বলে। ক্ষুব্ধ প্রীতিরাম প্রতিবাদ করে উপরমহলকে বিষয়টি জানান এবং অতিথিশালা জমিদার পরিবারেই থেকে যায়। এই ক্ষুদ্র ঘটনাটি অল্প বয়স থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাসমণির প্রতিবাদী চরিত্র তুলে ধরে।

নানা সামাজিক কাজের মাধ্যমে বাবু রাজচন্দ্রের খ্যাতি ছড়িয়ে পরে। কোলকাতার অভিজাত মহলেও জমিদার পরিবারের দান-ধ্যানের কথা প্রচার হয়। সব ঠিক চললেও হটাত করেই অসুখে ভুগে বাবু রাজচন্দ্র মারা যান। কাজেই সমস্ত জমিদারী দেখাশুনো নিজের হাতে তুলে নিতে হয় রাসমণিকে।

রাসমণির তিনটি কন্যাসন্তান হয়। তৃতীয় কন্যার স্বামী ছিলেন মথুরবাবু। রাসমণির কোনও পুত্র সন্তান না থাকায় মথুরবাবুর উপরই জমিদারী সামলানোর দায়িত্ব দেন রানি রাসমণি। মথুরবাবুও খুব বুদ্ধিমান যুবক ছিলেন এবং জমিদারির সব কাজ দক্ষতার সাথে সেরে ফেলতেন। ঠিক এই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি “ডকট্রিন অফ ল্যাপ্স” নামের কালা কানুন চালু করার কথা ভাবছিল। এই আইনে রাজা মহারাজা ও জমিদারদের পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকলে জমিদারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে নিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। স্বভাবতই ভারতের সমস্ত জমিদারির উপর উপনিবেশকারী ইংরেজদের নজর পড়ে। উৎপীড়নের নতুন নতুন রাস্তা বার করে তারা।

কোলকাতার উপকণ্ঠে গঙ্গা নদীতে যে সব জেলেরা মাছ ধরতে যেত তারা ইংরেজদের উৎপীড়নের শিকার হয়। গঙ্গা নদী দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য নৌকো এবং জাহাজ যাতায়াত করত। হটাত তারা জেলেদের মাছ ধরার নৌকোর উপর কর বসিয়ে দেয়। তাদের যুক্তি ছিল, মাছ ধরার নৌকো যাতায়াত করার ফলে জলপথ ব্যবহারে কোম্পানির অসুবিধার কারণে রাজস্ব কম আদায় হচ্ছে। এই কর চাপানোর ফলে হাজারে হাজারে গরিব জেলে ভয়ানক অসুবিধায় পড়ে। অতিরিক্ত করের বোঝায় তাদের পরিবার প্রায় অনাহারে ভুগতে থাকে। জেলেরা রানি রাসমণির কাছে বিহিত চেয়ে দরবার করে।

গঙ্গার যে অঞ্চলে জেলেরা মাছ ধরত সেই জায়গাটি ছিল মিটিয়াবুরুজের পাশে। এই অঞ্চলের জমিদারি ছিল বাবু রাধাকান্ত দেবের। রানি জেলেদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, রাধাকান্ত দেবের কাছে দরবার করেও জেলেরা সুবিচার পায়নি। বাধ্য হয়েই তারা রানির কাছে দরবার করেছে। তারা জানে যে, রানি রাসমণি একজন দয়াবতী রমণী এবং তাঁর কাছেই হয়ত কোনও প্রতিকারের রাস্তা থাকতে পারে।

রানি বিষয়টি খতিয়ে দেখতে মথুরবাবুকে নির্দেশ দেন। মথুরবাবুর চেষ্টায় ঘুসুড়ি থেকে মিটিয়াবুরুজ পর্যন্ত দশহাজার টাকায় গঙ্গা নদীর ইজারা নেন রানি রাসমণি । এরপর তিনি ইংরেজদের জব্দ করার জন্য একটা ফন্দি বার করেন। রানির নির্দেশে বহু অর্থ ব্যয় করে গঙ্গার এক পাড় থেকে আর এক পাড়ে ঘুসুড়িতে ও মিটিয়াবুরুজে মজবুত লোহার শিকল লাগিয়ে দেওয়া হয়। দুই পাড়ে লোহার খুঁটি পুঁতে দিয়ে এই শিকল লাগিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে গঙ্গা নদী দিয়ে ইংরেজদের পণ্য জাহাজ ও নৌকো যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়।

গঙ্গা নদী শিকলে বাধা পড়ায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাদের মাথায় হাত পড়ে। তাদের সাধের বাণিজ্য একেবারে ডুবতে বসে কোলকাতায়। প্রথমে রানিকে অনুনয় বিনয় করে লোহার শিকল তুলে নেওয়ার জন্য দূত পাঠাতে থাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। রানি তাদের ফিরিয়ে দিয়ে জানান যে, জলপথের এই এলাকার ইজারা যেহেতু তাঁর নেওয়া, কাজেই শিকল তুলে দেওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না। আসলে বহুবছর আগে রাসমণি তাঁর শ্বশুরমশাইকে যে ইংরেজরা অপমান করেছিল, সেই ঘটনার কথা ভুলতে পারেননি।

আদালতে আবার রাসমণির বিরুদ্ধে মামলা ঠোকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আদালতে রানির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, ঘুসুড়ি থেকে মিটিয়াবুরুজ পর্যন্ত গঙ্গার ইজারা জানবাজারের জমিদারের আছে। গঙ্গা নদীতে যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে, তারা রানির সন্তানসম। দারিদ্র্যে কালাতিপাত করা জেলেরা এই অতিরিক্ত করের কারণে আরও অনাহারে মরতে বসেছে। কাজেই এই অন্যায্য কর অবিলম্বে তুলে নেওয়া উচিত।

বাধ্য হয়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রানির কাছ থেকে নেওয়া ইজারার দশ হাজার টাকা ফেরত দেয় এবং গঙ্গা নদীতে মাছ ধরার জন্য জেলেদের উপর বসানো কর প্রত্যাহার করে নেয়। শুধু কোলকাতাতেই নয়, বাংলার ঘরে ঘরে রানির এই ইংরেজ বিরোধিতার কথা ছড়িয়ে পড়ে। প্রকৃত রানির মত প্রজাবৎসল জমিদার হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে ইংরেজরাও তাঁকে সমীহের চোখে দেখতে শুরু করে।

দাস পরিবারের নীলচাষের জমি ছিল অনেক। জোড়াসাঁকোর জমিদার প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর সহ কোলকাতার অনেক জমিদার তখন নীল চাষ করে প্রচুর রোজগার করছিলেন। দাস পরিবারের অর্থাগমও এই চাষ থেকে কিছু কম ছিল না। সেই সময়ে নীলকর বসিয়ে দিয়ে নীল চাষিদের উপর অকথ্য নির্যাতন করতে শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। চাষিদের অবস্থা যখন চরম হয়ে ওঠে, তখন রানি রাসমণি জমিতে নীল চাষ করা বন্ধ করে দেন। ইংরেজরা একটা বড় রাজস্ব এই নীল চাষ থেকে আদায় করত। রানি রাসমণি নীল চাষ বন্ধ করে দিয়ে তাদের রোষানলে পড়েন। দৃঢ়চেতা রাসমণি তাদের কাছে কোনও কিছুর বিনিময়ে মাথা নত করেননি।

কবি, লেখক ও সমাজসংস্কারক হরিনাথ মজুমদার, যিনি কাঙাল হরিনাথ নামে বেশি খ্যাত, তিনি কোলকাতার জমিদারদের একজন প্রবল সমালোচক ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’তে নিয়মিত তিনি কোলকাতার জমিদারদের প্রজাবিরোধী কার্যকলাপ মানুষের সামনে তুলে আনতেন। রানি রাসমণি মারা যাবার পর এই পত্রিকাতে তিনি রাসমণির জমিদারি সম্পূর্ণ ভিন্নপথের বলে দাবী করেন, এমনকি ঠাকুর পারিবারের চাইতেও রানির জমিদারি অনেকবেশি প্রজাহিতকারি বলে মন্তব্য করেন।

যে সময়ে ভারতবর্ষে নারীরা কেবলমাত্র অন্তঃপুরবাসিনী হয়েই কাল কাটাত, সেই সময়ে রানি রাসমণি সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর নানা ধার্মিক ও সামাজিক কাজের অন্যতম হল দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা, নিমতলা মহাশ্মশানের নির্মাণ। রামকৃষ্ণ পরমহংসের পৃষ্ঠপোষক বলে বেশি খ্যাত হলেও রানি রাসমণির ইংরেজ বিরোধিতা ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে স্মরণীয় থেকে যাবে। 


        তথ্যসূত্র -
        ১) রাজেশ্বরী রাসমণি, গৌরাঙ্গ প্রসাদ ঘোষ
        ২)
Rebel with a cause, The Statesman, Amiya K Samanta, November 14, 2018