গল্প - লেখকের বিপদ - সৌম্য নারায়ণ আচার্য । ফেব্রুয়ারি - ২০২৪





 লেখকের বিপদ







সৌ ম্য না রা য় ণ
আ চা র্য 






....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -
























































































































































































































































































































































































































































































































































































































































































































 

 

আমার নাম শ্রীসৌম্যচরণ পাকড়াসী, আমি পেশায় পুরুলিয়ার শ্রীময়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভুগোল শিক্ষক হলেও, ভূতের গল্প লেখা আমার নেশা। কিন্তু সম্প্রতি এমন কতগুলো ঘটনা ঘটেছে, যার জন্য আমি ভূতের গল্প ছেড়ে হাসির বা গোয়েন্দা গল্প লেখার কথা ভাবছি। কেন তা বলছি

        বছর কয়েক আগে, নেহাতই খেলাচ্ছলে আমি শিশুদের বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা 'সবুজ মন' এ একখানি ভূতের গল্প পাঠিয়ে ছিলাম। এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে সম্পাদক মহাশয় সেই গল্পটি ছাপেন। বৈশাখ মাসে অর্থাৎ নববর্ষ সংখ্যাতে ওই টিই ছিল একমাত্র ভূতের গল্প। গল্পটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল ও চিঠি দিয়ে পাঠক পাঠিকারা সম্পাদক মশাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছিল। তারপর সম্পাদক মশাই শ্রীশূলপাণি ভদ্র আমাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়ে আরো ওই রকম ভূতের গল্প লিখতে অনুরোধ করেন। এতে আমি নিঃসন্দেহে খুশি হয়ে আরো নতুন গল্প লিখতে শুরু করি। এ পর্যন্ত সব কিছুই ঠিক ঠাক ছিল, কিন্তু তার পর যা ঘটল, তা অত্যন্ত চিন্তাজনক।

        আমি তখন দ্বিতীয় ভূতের গল্পটা সবে শুরু করেছি, এমন সময়ে ভদ্রবাবুর গিন্নি আমাকে ফোন করলেন। তাঁর কাছ থেকে যা শুনলাম, তা হল এই, সম্পাদক মশাই ব্যালকনি থেকে পড়ে গিয়ে মারাত্বক ভাবে আহত হয়ে দক্ষিন কলকাতার এক নার্সিংহোমে ভর্তি আছেন। তাঁর পায়ের অনেকগুলো হাড় ভেঙ্গেছে, তবে এখন অনেকটা ভালো আছেন। আর, আমার সাথে কথা বলতে চান

         পরদিন অর্থাৎ মঙ্গলবারে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে কংসাবতি এক্সপ্রেসে চড়ে আমি পুরুলিয়া থেকে কলকাতা পৌঁছই। লেকমার্কেটের কাছে একটা লজে জিনিষপত্র রেখে আমি সোজা রওনা দিলাম নার্সিংহোমের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে দেখলাম ভদ্রবাবু সামলে উঠেছেন, তাঁর ডানপাটা প্লাস্টার করা। বাঁ হাতেও চোট লেগেছে। কিভাবে তিনি আহত হলেন প্রশ্ন করাতে তিনি বললেন যে, তাঁর এক ভাইপোর কাছে আমার লেখা গল্পটির প্রশংসা শুনে তাঁর আবার ওটি পড়তে ইচ্ছা হল। এর আগে তিনি শুধু পাণ্ডুলিপিটা পড়েছিলেন, ছাপার অক্ষরে পড়েন নি।

সেদিন ছিল রবিবারের দুপুর। গিন্নি শোবার ঘরে দিবানিদ্রার আয়োজন করছেন, ছেলে বাড়িতে নেই, মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে। এ বাড়িটা নতুন, এখানে তাঁরা পনেরোদিন হল এসেছেন। বাড়িটা তাঁদের পছন্দ হয়েছে। তিনি হলঘরে বসে ‘সবুজ মন' পত্রিকাটা হতে নিয়ে আমার গল্পটা পড়তে শুরু করলেন। গল্পাটা তাঁর ভালোই লাগছিল। 

‘আমার গল্পটা ছিল এই রকম। একজন লোক তার নতুন ভাড়া করা ঘরে শুয়ে শুয়ে ভূতের গল্প পড়ছে, এমন সময়ে ভূতটা জানালা দিয়ে সে ঘরে ঢুকে বলে যে, সে খুন হয়েছে। তার খুনিকে ধরে দিতে হবে, না হলে সে লোকটির ঘাড় মটকাবে। এই বলে সে নিজের হাতটা বের করল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে লোকটি দেখে যে, ভূতটার হাতের বদলে শুধুই হাড়। সে আঙ্গুলের হাড় দিয়ে দেয়ালে খুনির নামের আদ্যক্ষরটা লিখে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। এবং তারপর থেকে প্রতিদিন রাত্রে সে লোকটিকে ধমক দিতে থাকে, শেষে লোকটি পুলিশের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়। খুনি ধরা পড়ে, ওর নামের সাথে ভূতের লেখা আদ্যক্ষরটা মিলে যায়। বাড়ির পেছনের জমি খুঁড়ে তার কংকাল উদ্ধার হয়। ভদ্রবাবু যেই এই পর্যন্ত পড়েছেন, অমনি তাঁর মনে হল যে, কেউ তাঁর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁর এই ঘরটা দোতলা, নিচের তলাটি এখনো ফাঁকা আছে। তিনি চমকে উঠে দেখলেন একটা রোগামতো লোক দাঁড়িয়ে আছে। তিনি লোকটার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করতেই তাঁর গলা দিয়ে একটা আওয়াজও বেরুল না।    

লোকটা তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার নাম রত্নেশ্বর পাত্র, ছয় মাস আগে আমি খুন হয়েছি। যদি ভালো চাও তো আমার খুনিকে ধরে দাও। খুনির নামের আদ্যক্ষরটা আমি বলে দিচ্ছি।”   

 এই বলে রত্নেশ্বর পাত্র অর্থাৎ রত্নেশ্বরের ভূতটা নিজের হাতের হাড়টা বের করে দেয়ালে খোদাই করে লিখল, ‘গ’। তারপর ভদ্রবাবুকে বলল, “তিনদিনের মধ্যে যদি আমার খুনি ধরা না পড়ে তো, তোমাকে আমার মতো ভূত হতে হবে।” ভদ্রবাবু তখন ঠকঠক করে কাঁপছেন, তাঁর দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি শুরু হয়ে গেছে। তিনি কোনোমতে বললেন, “বাবা, আমি তো কোনো দোষ করিনি।“

“এই বাড়িতে থাকাটাই তো তোমার দোষ।“ রত্নেশ্বরের ভূত বলল।

“আমি গয়ায় তোমার পিণ্ডি দেব বাবা, কালকেই আমি গয়া যাব।“ মরিয়া হয়ে ভদ্রবাবু বললেন। 

“খবরদার, যদি খুনি ধরার আগে পিণ্ডি দিয়েছ তো, আমি ট্রেন থেকে তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেব।“ রত্নেশ্বর ওয়ার্নিং দিল।‘

তারপর দুই হাড়ের হাত বাড়িয়ে ওঁর দিকে এগিয়ে এল, ভদ্রবাবু তখন পালাতে পারলে বাঁচেন। দরজার দিকে যাচ্ছেন এই ভেবে তিনি ব্যালকনিতে গিয়ে নিচে ঝাঁপ দিলেন এবং সোজা একতলায়। তারপর হাড়গোড় ভাঙ্গা দ হয়ে নার্সিংহোমের বিছানায়। ভাগ্যিস মাথায় চোট লাগেনি।

সবশুনে আমি তো অবাক, কারণ, এই গল্পের প্লট আমার সম্পূর্ন নিজস্ব। ভদ্রবাবু আমাকে বলেন, “এটা যে সত্যি ঘটনা আগে বলেন নি তো?”

আমি ওঁকে যত বোঝাই যে, এই গল্পটা আমার মস্তিষ্ক প্রসূত, এর সাথে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই,  তিনি কিছুতেই শুনবেন না। শেষে ওঁর গিন্নি এসে আমাকে উদ্ধার করেন। আমাকে বলেন, “নিজের দোষেই ওঁর এই অবস্থা হয়েছে। না হলে ব্যালকনি থেকে না লাফিয়ে আমাকে ডাকলে পারতেন। আমি তো পাশের রুমেই ছিলাম, দেখতুম কোথাকার নচ্ছার রত্নেশ্বর না কে যেন ভয় দেখায় বাড়িতে এসে। এসে মুখে ঝাটা ঘষে দিতাম। ব্যাটাচ্ছেলের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে দিতাম।“

যা হোক সম্পাদক মশাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। আমি ঠিক করলাম, এবার থেকে ওঁর পত্রিকায় হাসির গল্প বা ভ্রমণ কাহিনি লিখব। ভদ্রবাবু সুস্থ হয়ে নতুন বাড়িতে ফিরলেন, তিনি ঠিক করেছিলেন যে, ঐ বাড়িতে আর নয়। তাঁর শালা একটা নতুন বাড়ি ঠিক করে ছিল। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই পুলিশ ঐ ভূতের বাড়িটার পেছনের জমিটা থেকে রত্নেশ্বর পাত্রর কংকালটা উদ্ধার করে। রত্নেশ্বর বিজনেস করত, গজেন্দ্র নামের ওর এক ব্যবসার পার্টনার ওকে খুন করে পুঁতে রেখেছিল। পুলিশ গজেন্দ্রকে গ্রেফতার করল। একথা বলাই বাহুল্য যে, রত্নেশ্বর দেয়ালে ‘গ’ অক্ষরটা খোদাই করেছিল।

ভুতের গল্প অবশ্য আমার পিছন ছাড়ে না। এর কিছু দিন পরেই ‘সূর্য কিরণ' পত্রিকার সম্পাদক আনদ বর্ধন বাবুর ফোন পেলাম, তিনি বললেন, “কি মশাই, ভূতের গল্প লেখা ছেড়ে দিলেন না কি?”

আমি বললাম, “না, ছাড়িনি।“

“তাহলে, পাঠান দেখি একখান জব্বর ভূতের গল্প, শারদীয় সংখ্যায় ছেপে দেব।“ আনন্দ বাবুর অনুরোধ। একখানি ভূতের গল্প রেডি ছিল, দিলাম পাঠিয়ে। মাস চারেক পরে শারদীয় সংখ্যা প্রকাশিত হল। আনন্দ বর্ধন বাবুর ফোনটা পেলাম দশদিন পরে, “মশাই, গল্পটা দারুন হয়েছে। পাঠক পাঠিকাদের কাছ থেকে খুব ভালো ফিডব্যাক পাচ্ছি। অনেক অনেক ধন্যবাদ।“ উনি বললেন।

আমি শুনে খুশি হলাম। ওই গল্পটা আমি আমার এক দূর সম্পর্কের দাদুর কাছথেকে শুনে ছিলাম। তিনি যা বলেছিলেন তা হল এই, তাঁর তখন বয়স কম। একবার রাত্রে তিনি ধান ক্ষেত থেকে ফিরছিলেন। তখন ধান কাটাই চলছে। তাই সেগুলো গরুর গাড়িতে চাপিয়ে খামারে আনবার ব্যবস্থা করতেই তাঁর যাওয়া। বিকেল চারটেয় বাড়ি ফেরার কথা ছিল, কিন্তু পাশের গ্রামে বাল্যবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে একটু দেরী হয়ে গেল। তিনি যখন আমাদের গ্রামের নির্জন বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছলেন, তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা। এই রুটে বাস চলাচল সন্ধ্যে ছটার পরই বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের গ্রাম থেকে বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। ধারে কাছে কোনো গ্রাম নেই, চারিদিক এক্কেবারে নিঃস্তব্ধ।

বাসস্ট্যান্ডের ফাঁকা দোকানঘরগুলোর পাশদিয়ে যাবার সময় তাঁর গা ছমছম করছিল। দিনের বেলা বাসযাত্রিরা এখানে ভীড় করে, চা, তেলেভাজা, প্যাঁড়া বা জিলিপি খায়। সন্ধ্যে হলেই ময়রারা হাঁড়িকুড়ি জিনিষপত্র নিয়ে চলে যায়। দাদুর যৌবনকালে এইরুটে গাড়ি আরো কম চলত। পাকা সড়ক থেকে দাদু যখন বাঁদিকে গ্রামের রাস্তা ধরলেন তখন তাঁর মনে হল যে, সিমেন্ট বাঁধানো প্রকান্ড বটগাছটার নিচে সাদা শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা নিয়ে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। তিনি ভাবলেন যে, হয়তো বা গ্রামের কোনো বৌ রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, “এখানে কি করছ বৌঠান?”

সেই মহিলাটি কোনো উত্তর দিল না। তিনি আর কথা না বলে হাঁটা শুরু করলেন, পেছন ফিরে দেখলেন বটগাছের তলা তখন ফাঁকা। এইভাবে কয়েককদম হাটবার পর তাঁর মনে হল যে, পেছনে কেউ আসছে। পেছন ফিরে দেখেন যে, সাদা শাড়ি তাঁর পেছন পেছন আসছে। তিনি ব্যপারটাকে গুরুত্ব দিলেন না। এইভাবে কয়েক মিনিট চলার পর তিনি দেখেন সাদা শাড়ি তাঁর কয়েক ফুট আগে আগে চলছে। তিনি একটু চোখের পলক ফেলতেই সে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল আর এই বার তিনি পেছন ফিরে দেখলেন ছায়ামূর্তি তাঁর পেছনে আসছে। এইভাবে একবার সামনে আর একবার পেছনে করতে লাগল সাদা শাড়ি। দাদু বুঝতে পারলেন, ব্যপার সুবিধের নয়। তিনি শরীর বন্ধনের মন্ত্র জানতেন। তাই তাড়াতাড়ি মন্ত্র বলে শরীর বেঁধে নিলেন। এই ভাবে এক কিলোমিটার চলবার পর যখন বাঁদিকে গ্রামের বড় দিঘিটা এল তখন সাদা শাড়ি ঝপাং করে জলে ঝাঁপ দিল। তিনি দেখলেন সাদা শাড়ি সাঁতার কেটে শ্মশানের দিকে যাচ্ছে। তিনি যখন ভাবছেন যাক এইবার বিপদ কাটল, অমনি তখন সাদাশাড়ি তাঁর বা দিক থেকে উঠে আলের উপর দাঁড়াল।

তারপরে নাকি সুরে বলল,”এই তুই কোন দিকে যাচ্ছিস? আমার সাথে আয়।“

সেই দাদু বিললেন,”মোটেই না, আমি কেন তোর সাথে যাব?”

তাঁর উত্তর শুনে সেই ভূতটা কোনো কথা না বলে আবার আগে আগে চলতে লাগল। এঁকে ঠান্ডা আবহাওয়া, তারপরে বাতাস যেন আবার জোরে বইতে লাগল। দাদু জোরে জোরে এগিয়ে চলতে লাগলেন। আরো একটু এগোলেই গ্রামের শুরু, তারপর আর কোনো ভয় নেই।

এইভাবে আরো একটু দূর এগিয়ে বামুনপুকুরের কাছে তাঁরা এসে পৌঁছলেন। একটু এগিয়ে দান দিকে উচ্চ বিদ্যালয় আর শিবের মন্দির। সোজা গেলে কৃষ্ণের মন্দির। উনি জানতেন, ভূতেরা মন্দিরের কাছে যেতে পারবে না।  ভূতটা পুকুরের দিকে এগিয়ে গেল। তার পর নাকী সুরে বলতে লাগল, “যাঁ, যাঁ, তোঁর বাবা মার ভাগ্যি ভালো তাই তোঁকে ছেড়ে দিলাম।“

দাদু তখন দৌড়ে পেত্নীটার দিকে এগিয়ে দুই হাত তুলে বললেন, “যা, যা, তোরও খুব ভাগ্যি ভালো। তাই তোকে ছেড়ে দিলাম, না হলে বোতলে পুরে দিঘির জলে ফেলে দিতাম।“ 

পেত্নী ততক্ষনে অদৃশ্য হয়ে গেছে। দাদুর কাছে এই গল্পটা আমরা অনেকবার শুনেছি। এই গল্পটাকেই একটু অতিরঞ্জিত করে আমি ‘সুর্য কিরন' পত্রিকায় পাঠিয়ে ছিলাম ও সেটা ছাপা হয়েছিল। কিছুদিন পরেই পত্রিকার সম্পাদক আনন্দ বাবুর ফোন পেলাম, তাতে তিনি যা বললেন তা হল এই, অরুণ কর্মকার নামের ‘সূর্য কিরন' পত্রিকার একজন গ্রাহক আসানসোল লাইনের মধুকুন্ডা রেল স্টেশনে নেমে তার গ্রামের রাস্তায় যাচ্ছিল। রাত তখন দশটা, নভেম্বর মাস। কালীপুজোর ঠিক আগের দিন, নির্জন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে অরুণবাবু ঠিক আমার ওই দাদুর মতো এক ছায়ামূর্তির পাল্লায় পড়েন। ছায়ামূর্তি তাঁর একবার আগে ও পেছনে লুকোচুরি খেলতে থাকে। তারপর আমি যেমন দাদুর গল্পে রং চড়িয়ে ছিলাম, ঠিক তেমনিই ঘটতে থাকে। ডানদিকের দিঘিটা হঠাৎ স্থান বদলে তাঁর সামনেই এসে যায়। একটু হলেই তিনি জলেই পা দিয়েছিলেন আর কি। পরক্ষনেই দিঘি তাঁর বাঁদিকে সরে যায়। হঠাৎ বাঁদিকের বট গাছের সারি তাঁর সামনে পথরোধ করে দাঁড়ায়। অরুনবাবু তখন ডানদিকে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়তে থাকেন। ছায়ামূর্তিও তাঁর একবার ডানদিকে আর একবার বাঁদিকে দৌড়তে থাকে। এরপরে যা ঘটল তা রীতিমতো ভয়ংকর। ছায়ামুর্তি তাঁর সামনেই মাটির ভেতরে সেঁধিয়ে গেল, আর রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। মাঝখানের ফাটল থেকে দুটো হাত বেরিয়ে এল। অরুনবাবু স্কুলে হাইজাম্পে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন, তাই ফাটলের উপর দিয়ে খুব সহজেই লাফিয়ে অন্যপারে পৌঁছে যান। দৌড়তে দৌঁড়তে শিব মন্দির ও স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছে স্বস্তির নিঃশাস ফেলেন। গ্রামের লোকেরা তাঁর চিৎকার শুনতে পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে ছিল ও তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ছিল। আশ্চর্যের ব্যপার হল আমি আমার গল্পে ঠিক এই রকমই লিখেছিলাম। এবং আমি যা লিখেছিলাম ঠিক তাই ঘটেছে ও লেখক হিসেবে এটা আমার পক্ষে খুবই খারাপ।

তাই দমে গিয়ে ডিটেকটিভ গল্প লিখতে শুরু করলাম ও স্ফটিক খাস্তগীর নামে এক নতুন গোয়েন্দা চরিত্রর সৃষ্টি করলাম। বেশ কিছু গল্প ছাপাও হল। অনেকে প্রশংসাও করল। তারপর আবার ভূতের গল্পের জন্য অনুরোধ এল, এবার অনুরোধ করলেন 'হ য ব র ল' পত্রিকার সম্পাদক দীপাদি অর্থাৎ দীপা মজুমদার। পেশায় একজন স্কুল শিক্ষিকা দীপাদি গতদু’বছর ধরে এই পত্রিকাটি চালাচ্ছেন। তাই ছোট্ট অথচ জমাটি এক খানি ভূতের গল্প ওঁকে পাঠিয়ে দিলাম। বৈশাখ সংখ্যায় সেটা প্রকাশিত হল। ঠিক তার পনেরো দিন পরে দীপাদির চিঠি পেলাম। তাতে তিনি লিখেছেন যে, আমি গল্পে যা লিখেছি তা প্রায় সত্যি ঘটেছে।

দীপাদি লিখেছেন যে, তাঁর ভগ্নিপতি অজিত রায় যখন বলরামপুর থেকে টাটানগর যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর বাসটা হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। তখন সন্ধ্যে সাতটা, কিছুক্ষন বাসের জন্য অপেক্ষা করে তিনি রিক্সা নিয়ে কাছাকাছি এক ডাকবাংলোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। দু’কিলোমিটার দূরের নির্জন জায়গায় অবস্থিত ওই ডাকবাংলোতে পৌঁছে চৌকিদারকে দুশো টাকা দিলে সে রুম খুলে দেয়। তখন রাত আটটা, সাথে খাবার থাকায় তিনি বাথরুমে  গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তা খেয়ে নেন। চৌকিদার একটু পরে মোমবাতি ও দেশলাই রেখে দিয়ে যায়। বলে যে, রাত্রে বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে। অজিতবাবু তাকে শুধোন, “তুমি রাত্রে এখানেই থাকো তো?”

চৌকিদার বলে, “জী সাব, আমি রাত্রে এখানেই থাকি।“

চৌকিদার চলে গেলে তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে শোবার তোড়জোড় করেন। তাঁর সাথে একটা ছোট টর্চ ছিল, সেটা বিছানার কাছে রেখে তিনি শুতে যাবেন এমন সময় বিদ্যুৎ চলে গেল।

টর্চ জ্বেলে তিনি জানালার কাছে গেলেন। নিচের দুটো পাল্লা বন্ধ করে পর্দাটা ঈষৎ সরিয়ে তাকালেন, চৌকিদারের ঘরটা এখান থেকে দেখা যায়না। ভয়ের কিছু নেই, আসার সময় দেখেছেন রাস্তায় পুলিশ আউটপোস্ট রয়েছে, সেখানে দু’জন সশস্ত্র সেপাই থাকে। সুতরাং সেদিক থেকে ভয়ের কিছু নেই। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

একটু পরেই হঠাৎ অজিত বাবুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিদ্যুৎ চলে এসেছে, তিনি স্যুইচ অফ করতে ভুলে গেছিলেন। তাই মশারী থেকে বেরিয়ে উল্টোদিকের দেয়ালে স্যুইচ বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলেন। বোর্ডের পাশেই একটা আয়না আছে। সেখানে গিয়ে যেই স্যুইচ অফ করতে যাবেন অমনি আয়নায় তাঁর বিছানার প্রতিবিম্বর দিকে নজর গেল। তাতে তিনি যা দেখলেন তা বিশ্বাস করতে পারলেন না। তাঁর মনে হল যে, বিছানায় কে যেন শুয়ে আছে। তিনি চোখ বন্ধ করে ”রাম রাম” বলে আবার চোখ খুলে দেখেন বিছানায় কেউ নেই। ভাবলেন আগেরটা তাঁর মনের ভুল। মন শক্ত করে বিছানায় ঢুকলেন তিনি। শোয়ার পর মনে হল যে, বিছানার ভেতরটা সুগন্ধি দোক্তার গন্ধে ভরে গেছে। টর্চটা জ্বেলে ঘরের ভেতরটা ভালো করে দেখে নিয়ে চোখ বুজে ঘুমুবার চেস্টা করলেন। ঘড়িতে তখন শোয়া দশটা।

হঠাৎ আবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে মনে হল যে, তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে। টর্চ জ্বেলে দেখলেন জানালার পাল্লা দুটো বন্ধ যদিও ওপরে ভেন্টিলেটরটা খোলা আছে। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় বারোটা পঁচিশ। অজিত বাবু কি করবেন বুঝতে পারলেন না। এখন গরম একদম নেই তবুও পাখাটা চলছে, কিন্তু মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে কোনো হাওয়া নেই। এই অবস্থায় মশারীর বাইরে বেরুলে যদি সেই ছায়ামূর্তি আবার ঢুকে পড়ে, তাহলে কি হবে।

যা থাকে কপালে, “জয় মা কালী”  বলে অজিতবাবু টর্চটা হাতে নিয়ে মশারীর বাইরে পা রাখলেন। তারপর জানালার কাছে গিয়ে বিস্মিত হয়ে দেখলেন ওপরের পাল্লাদুটো ভেতর থেকে বন্ধ। অথচ শোবার আগেই তিনি ও দুটো খুলে রেখে ছিলেন। পাল্লা দুটো আবার খুলে টর্চটা জ্বেলে তিনি বাইরে ফোকাস করলেন। কাউকে দেখতে পেলেন না। এদিকে পেছন ফিরে বিছানার দিকে তাকাবারও সাহস নেই। তিনি ডাকলেন, “চৌকিদার।“

তাঁর মনে হল বিছানায় নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি ভয়ে ওদিকে তাকাতেই পারলেন না। আবার ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চৌকিদার কে ডাকতে থাকেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে জানালা থেকে একটু দূরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখটাও ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা। সেই লোকটা দূর থেকেই বলল,” কুছ চাহিয়ে সাহাব?”

“মেরে খিড়কী কা দরোয়াজা কিউ বন্ধ কিয়া?” অজিত বাবু শুধোন।

“ম্যাঁয় তো কুছ নেহি কিয়া হুজুর, ম্যাঁয় তো আপনে কমরে মে থা।“ সেই লোকটি অর্থাৎ চৌকিদার বলল। অজিত বাবুর সন্দেহ হল যে, এই লোকটি চৌকিদার নয়, এ অন্য লোক। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই লোকটি অদৃশ্য হয়। টর্চ জ্বালিয়ে তিনি দেখেন বাইরে কেউ নেই। ভয়ে ভয়ে বাতির স্যুইচ অন করে দেখেন বিছানায় কেউ নেই। বাতি নিভিয়ে তিনি মশারীর ভেতরে শুয়ে পড়েন।

এইভাবে পুরো রাতটা কেটে যায়, রাতে ভালো ঘুম না হবার ফলে সকালে দেরীতে ঘুম ভাঙ্গে। বাইরে চৌকিদার জানালার দরজায় টোকা মারছিল। তিনি ঘুম থেকে উঠে দেখেন সকাল আটটা বেজে গেছে, দরজা খুলে তিনি চৌকিদার কে চা আনতে বলেন। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখেন চৌকিদার চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে অর্জিত বাবু বলেন, “কাল রাতে ভালো করে ঘুমুতে পারিনি।“

“কাহে হুজুর?”

তিনি সব খুলে বলেন। শুনে চৌকিদার মনোহরলাল বলে যে, এই বাংলোর এই রুমটাতে এরকম ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। পাশের রুমের সাইচ বোর্ডটা খারাপ হয়ে গেছে, না হলে সাহাব কে ওখানেই থাকতে দিত। এরপর সে যা বলল, শুনে তিনি অবাক হয়ে গেলেন।

কাল রাতে আমিতো এখানে ছিলাম না সাহাব।“

“তাহলে কে এসেছিল?” অজিত বাবু প্রশ্ন করেন।

“ও নিশ্চয় বৃন্দাবন প্রসাদ ছিল।“ মনোহর লাল বলে।

“বৃন্দাবন প্রসাদ কে?”

“বললে আপনি ভয় পাবেন হুজুর।“

“না বলো, আমি ভয় পাব না।“

“আমার আগে ও চৌকিদার ছিল, একরাত্রে জঙ্গলের পথ ধরে আসছিল। সেদিন বৃষ্টি পড়ছিল, আকাশে বাজ চমকাচ্ছিল। সে তখন একটা নীচে দাঁড়িয়ে আশ্রয় নিয়ে ছিল। আর বাজ ওই গাছেই পড়ল। ও সাথে সাথেই মারা যায়। মৃত্যুর পরও ও আসে, কিন্তু আমি থাকলে আসতে সাহস পায়না, কারণ আমি ভূত তাড়াবার মন্ত্র জানি।“ মনোহরলাল বলে।

অজিতবাবু শুধোন, “আমাকে না বলে তুমি এখান থেকে চলে গিয়েছিলে কেন?”

“হঠাৎ আমি খবর পেলাম, আমার শশুর মশাইয়ের শরীর খুব খারাপ। আমার শালা সাইকেলে করে আমাকে খবর দিতে এসেছিল। আমি তাই শ্বশুরবাড়িতে চলে গেছিলাম, গ্রামটা এখান থেকে খুব কাছে। আমি ভাবলাম একঘন্টার মধ্যে চলে আসব, তাই আপনাকে খবর দিইনি। যাওয়ার আগে মোড়ের পুলিশদের বলে গেছিলাম, ডাকবাংলোতে সাহেব একা আছেন, একটু দেখবেন। কাজেই আপনার অন্য কোনো ভয়ের কিছু ছিল না। শ্বশুরমশাইকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হল, তাই রাত্রে আর আসতে পারলাম না” মনোহরলাল বলল।

অজিতবাবু চা খেয়ে ডাকবাংলো ছেড়ে পাকারাস্তায় এলেন, সেখান থেকে বাস ধরে চান্ডিল। তারপর চান্ডিল থেকে অন্য বাসে চড়ে টাটানগর পৌঁছন।

দীপাদি পুরো গল্পটা বলে আমায় প্রশ্ন করেন, “আপনি কি ওই ডাকবাংলোতে কখনো থেকেছেন?”

আমি “না” বলাতে উনি বলেন, “তা হলে আপনি যা লিখেছেন তা হুবহু ঘটল কি করে?” আমি ওঁকে বোঝালাম যে, আমার গল্পটা সম্পূর্ন কাল্পনিক, এর সাথে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমার লেখার সাথে প্রায় প্রতিটি ঘটনা (বা দুর্ঘটনা) মিলে যাচ্ছে। কিন্তু আমার অবাক হওয়ার আরো বাকী ছিল। শারদীয় সংখ্যার জন্য 'মুকুল' পত্রিকার সম্পাদক আমার কাছে গল্প চেয়ে বসলেন। আমি বলি যে, ভূতের গল্প ছাপা হলে তার পরিনাম খুব খারাপ হতে পারে। এবং আমি ওঁকে এ পর্যন্ত যত গুলো ঘটনা ঘটে ছিল, সেগুলো সব সংক্ষেপে জানাই, শুনে তিনি অট্টহেসে বলেন যে, ভূত ফুতে তাঁর বিশ্বাস নেই। কাজেই আমি নির্দ্বিধায় ভূতের গল্প পাঠিয়ে দিতে পারি। ওঁর অনুরোধ মতো আমি গল্প পাঠিয়ে দিলাম, ও সেই গল্প ছাপাও হল। সাথে এক নামী শিল্পীর আঁকা ছবি। সম্পাদক আমাকে এক কপি পত্রিকাও পাঠালেন, ধন্যবাদ দিয়ে আমি চিঠি লিখলাম। ভাবলাম যে, অতীতের ঘটনা গুলো নেহাতই কাকতালীয়। আশা করলাম যে, এবারে আর কোনো অপ্রীতিকর (বা অলৌকিক) ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু তখন কে জানত যে, আমার জন্য এক বিদঘুটে বা ভয়ংকর আশ্চর্য ঘটনা অপেক্ষা করছে।

আমি পুরুলিয়ায় চাকরী করলেও আমার পৈত্রিক নিবাস হল তিরিশ কিলোমিটার দূরের রঘুনাথপুরে। বছরখানেক আগে আমার ছেলেবেলার বন্ধু প্রাণেশ আমার কাছে কুড়িহাজার টাকা ধার নিয়েছিল। ও থাকে রঘুনাথপুর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে নতুনডি নামক গ্রামে। ও ওখানের সবচেয়ে বড় মুদির দোকানের মালিক। বছর খানেক আগে এক অগ্নিকান্ডে ওর দোকান পুড়ে প্রায় ছাই হয়ে যায়, ওর অনেক টাকার লোকসান হয়। নতুন করে দোকানটা গড়ে তোলার জন্য আমার কাছে টাকা ধার নিয়েছিল, ছেলেবেলার বন্ধু তাই না করতে পরিনি। হঠাৎ প্রাণেশের চিঠি পেলাম, ও লিখেছে যে, খারাপ সময়ে ওকে সাহায্য করে আমি প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিয়েছি। ও দোকান পুনরায় নির্মান করেছে ও ব্যবসা আগের মতোই চলছে। তাই আমার পয়সা সুদ সমেত ফেরৎ দিয়ে ঋণ মুক্ত হতে চায়। শুনে আমি বললাল যে, সুদ টুদ দিতে হবেনা, সম্ভব হলে প্রাণেশ শুধু টাকাটা দিতে পারে। শুনে প্রাণেশ বলল, “তুই সপ্তাহান্তে আমার গ্রামে চলে আয়। রবিবার আমি দোকান বন্ধ রাখি। সেদিন জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে আর তোর টাকাটাও ফেরৎ দেওয়া যাবে।“

আমি বললাম, “ঠিক আছে, আগামী শনিবার যাচ্ছি।“

শনিবার দুপুরে স্কুল শেষ করে আমি রঘুনাথপুরে পৌঁছে বাড়িতে একটু বিশ্রাম করে আত্মীয়দের সাথে দেখা করে যেই সাইকেল নিয়ে নতুনডি অভিমুখে যাত্রা করব ভাবছি এমন সময়ে বৃষ্টি শুরু হল। তখন বেলা পাঁচটা। প্রায় এক ঘন্টা পর বৃষ্টি থামল, বাড়ির সবাই আমাকে সন্ধ্যের সময় নির্জন রাস্তায় যেতে বারণ করলেন। কিন্তু আমি জেদ করে বেরিয়ে পড়লাম। এই রাস্তার নাম পুরুলিয়া বরাকর রোড, দিনের বেলায় অনেক ট্রাক ও বাস চলাচল করে। কিন্তু বিকেল শুরু হলেই রাস্তা প্রায় খালি হয়ে যায়। আমি ভাবলাম দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব, কিন্তু বিধি বাম। কিছুদূর যাবার পরই টায়ারটা সজোরে চিৎকার করে পাংচার হয়ে গেল। তখনো আমি রঘুনাথপুরের সীমা ছাড়াই নি। তাই রাস্তার ধারে এক সাইকেল সারাইএর দোকানে সাইকেলটা রেখে হাটতে শুরু করলাম। আমি গ্রামের ছেলে তাই হাঁটা অভ্যেস আছে। সাথে ছাতা ছিল, তাই বৃষ্টি পড়লেও কোনো চিন্তা নেই। আমি জোর কদমে হাঁটছিলাম, আকাশে মেঘের পাশাপাশি চাঁদও রয়েছে, আগামীকাল পূর্ণিমা তাই চারদিক ঝলমল করছে। একটু আগে বৃষ্টি হওয়ার জন্য গাছের পাতায় জমে থাকা জলে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ে এক অসাধারন সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। যারা এই দৃশ্য যারা না দেখেছে তারা একটা দারুন দৃশ্য মিস্ করবে। আমি প্রায় নতুনডির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, রাস্তা দিয়ে একটা লরী শব্দ করতে করতে চলে গেল। এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ছাতাটা হাতে নিয়ে বুঝতে পারলাম যে, বৃষ্টির জোর খুব বেশী, ছাতায় আটকাবে না। আমার সামনেই এখন বুন্দলার জোড় যার ওপরে রয়েছে পুল। আমাকে ওই পুলের নীচে আশ্রয় নিতে হবে। পুরুলিয়ার ভাষায় ছোট্ট ঝরনা কে ‘জোড়’ বলা হয়, আমাদের এই জোড়টা সারা বছর বইতে থাকে। বর্ষা কালে জলের স্রোত একটু বেশী থাকে। ব্রীজ কে বলা হয় পুল যার ওপর দিয়ে বরাকর রোডটা গেছে। এই রাস্তা সোজা বরাকর হয়ে আসানসোল পর্যন্ত গেছে। আমি দৌঁড়তে দৌড়তে ব্রীজের তলায় এসে পৌঁছলাম। এখন জোড়ে জল থাকলেও ব্রীজের তলায় দু’দিকে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য প্রচুর জায়গা রয়েছে। একটা পরিস্কার জায়গা দেখে বসার পরে আমি বুঝতে পারলাম যে বৃষ্টির গতি একটু কমেছে। আমি ঠিক করলাম যে জলটা একদম না থামা পর্যন্ত আমি আবার যাত্রা শুরু করব না। এদিকে মাঝে মাঝে চুরি বা ডাকাতির ঘটনা ঘটে যায় এই সব কথা ভেবে আমি যে ভয় পাইনি তা বলব না। আমার কাছে হাতঘড়ি আর পকেটে কিছু টাকা ছিল, তাই ছাতাটা শক্ত করে ধরলাম। যেই আসুক ছেড়ে কথা বলব না। জল একই গতিতে পড়ে চলেছে। কেউ কোথায় নেই, হঠাৎ একটা কুকুর জাতীয় প্রাণী ডানদিক থেকে এসে ব্রীজের তলায় ঢুকল। কাছে আসতেই বুঝলাম ওটা একটা শেয়াল। আজকাল চোরাশিকারীদের ঠেলায় এদের সংখ্যা ক্রমশঃ কমছে। তাই একটা শেয়াল দেখে ভালোই লাগল। ভাবলাম, ঈস একটা ক্যামেরা থাকলে একটা ফটো তুলে রাখতে পারতাম। আমার কাছে মোবাইলটা ছিল, তাতেই একটা ছবি তুললাম ওই শেয়ালটার। যদিও সন্ধ্যের জন্য ছবিটা ভালো উঠল না। শেয়ালটা মাঝে মাঝে আমার দিকে মুখ তুলে তাকাতে লাগল। এই ভাবে মিনিটকয়েক থাকার পর শেয়ালটা একটা অদ্ভুত আওয়াজ করল আর ওপরের দিকে তাকাল। শেয়ালটা দৃষ্টি অনুসরণ করে ওপরের দিকে তাকিয়ে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। আমার ঠিক ওপরে যেখানে একটা বটগাছ  জন্মেছে সেখানে একটা কালো লম্বা সাপ ঝুলছে। সাপটাকে দেখে আমার কেউটে মনে হল আর ওটা আমার দিকে আসার চেস্টা করছে। বৃষ্টির জন্যই ওই প্রাণীটা এখানে আশ্রয় নিয়েছে। ব্রীজটা ছেড়ে বাইরে গেলে আমাকে ভিজতে হবে আর নাহলে সাপটা আমার ঘাড়ে এসে পড়তে পারে। একটু অপেক্ষা করে বুঝতে পারলাম যে, সাপটা বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে।

আমি তখন সময় নষ্ট না করে পাথরের উপর দিয়ে জল টপকে উল্টো দিকে চলে এলাম। শেয়ালকে ভয় পাবার কিছু নেই, তাছাড়া আমার হাতে ছাতাটা রয়েছে। দিক পরিবর্তন করে শেয়ালটা কোন দিকে গেল দেখার চেষ্টা করতেই দেখলাম ওটা সেখানেই আছে অর্থাৎ আমার উল্টোদিকে আর ওপরে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখি যে সাপটাও দিক পরিবর্তন করে এদিকে চলে এসেছে। আর আবার আমার ওপরে ঝুলছে। গাছটাও এদিকে এসে গেছে।

কিন্তু এটা কি করে সম্ভব, আমি তো ওদিক থেকে এদিকে চলে এলাম, কিন্তু শুধু সাপটাই নয় বট গাছটাও দিক পরিবর্তন করে যেন চলে এসেছে। একটু ভালো করে দেখে যা বুঝলাম তাতে ভয় আরো বেড়ে গেল। কারন শুধু সাপটাই নয় পুরো ব্রীজটাই যেন আমার সাথে ঘুরে গেছে, অর্থাৎ দিক বদলেছে। এটা আমার মনের ভুল কিনা এটা জানার জন্য আমি ঠিক করলাম আবার উল্টোদিকে যাব। যেমন ভাবা তেমনি কাজ, আবার উল্টোদিকে চলে এলাম। আমি আবার ওদিকে যেতেই মনে হল শেয়ালটা অদৃশ্য হয়ে গেল। একই সাথে শেয়াল ও সাপের দিকে লক্ষ্য রাখা সম্ভব নয়। কারণ, মাঝখানে জল আছে। এবারেও দিক পরিবর্তন করে কোনো লাভ হল না। অর্থাৎ আমার উল্টো দিকে আবার শেয়াল আর ওপরে বটগাছের কাছে ঝুলন্ত সাপ। শেয়ালটা কখনই বা দিক বদলাচ্ছে আর ব্রীজ কি করে আমার সাথে ঘুরছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম ওটার ছবিটা নেই। এই সব দেখে আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম।

কিন্তু না দমে দিক পরিবর্তন করতে লাগলাম, যদিও কোনো লাভ হল না। তখন বর্ষা একটু ধরে এসেছে, তাই ছাতাটা খুলে ব্রীজের বাইরে এসে বাঁদিকে দৌড় লাগালাম। যেই কয়েক কদম জোরে দৌড়েছি অমনি কারা যেন “হা-হা” করে হেসে উঠল। পেছন ফিরে যা দেখলাম তাতে রীতি মতো আতঙ্ক গ্রস্ত হলাম। আমি ছুটছি আর ব্রীজটা আস্তে আস্তে আমার দিকে শেয়াল সমেত এগিয়ে আসছে আর ব্রীজের নীচে কতগুলো লোক হাত বাড়িয়ে আমার দিকে তেড়ে আসছে।

দৌড়তে দৌড়তে আমার নিজের লেখা ‘মুকুল' পত্রিকায় সদ্য প্রকাশিত ভুতের গল্পটির কথা মনে পড়ে গেল। বর্তমানে আমার সাথে যে ঘটনাটি ঘটছিল, তার সাথে ওই গল্পটির অনেক মিল আছে। আমার গল্পটি ছিল এইরকম, একজন লোক সন্ধ্যেবেলায় নির্জন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। সে শর্টকার্টে যাবার জন্য একটা পুরোনো ব্রীজের নীচে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ ভুতের পাল্লায় পড়ে ও কোনো মতে প্রাণ বাঁচিয়ে পালায়।

আমি দৌড়তে দৌড়তে হাঁপাচ্ছিলাম আর চিৎকার করছিলাম। ভেজা ঘাস, উঁচু নীচু জমি আর পাথরের ওপর দিয়ে দৌড়নো খুব মুশকিল। আমি তাই মাঝে মাঝে লাফাচ্ছিলাম, বুঝতে পারছিলাম যে লোকগুলো আমার পেছনে আসছে। ওদের মুখদিয়ে একরকম আওয়াজ বেরুচ্ছে, পেছন ফিরে চাঁদের আবছা আলোতে আমি সব দেখতে পাচ্ছিলাম। বেশীক্ষন এভাবে দৌড়নো গেলনা, আর আমি হোঁছট খেয়ে পড়ে গেলাম। মাথায় আমার চোট লাগা মাত্র আমি জ্ঞান হারালাম।

জ্ঞান ফিরে দেখলাম আমি এক বাড়ির উঠোনে শুয়ে আছি, আমাকে ঘিরে ছোটখাটো একটা ভীড়। কে একজন আমার পাশে বসে আমার নাড়ীটা পরীক্ষা করছিল। আমি চিনতে পারলাম, উনি রঘুনাথপুরের ডাক্তার ডঃ গজেন্দ্র হাজরা। কিন্তু উনি এখানে কি করে এলেন? আমায় ডাক্তারবাবু প্রশ্ন করেন, “এইযে, তুমি ওই ব্রীজের কাছে কি করছিলে?”

আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক প্রৌঢ়, তিনি প্রশ্ন করেন, “এখন কেমন বোধ করছেন?”

আমি বলি, “ভালো।“  তারপর ওঁদের সবিস্তারে খুলে বলি। শুনে সেই ভদ্রলোক বলেন যে, আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে প্রায় কুড়ি জন লোক এক বৃষ্টির দিনে ওই ব্রীজের নীচে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন হঠাৎই ওই ব্রীজটা ভেঙ্গে পড়ে। ইংরেজ আমলের ব্রীজ, অনেক পুরোনো হয়েছিল, ওই ভাবে ভেঙ্গে পড়াতে কুড়ি জন লোক মারা যায়। ওদের সাথে একটা শেয়াল ও সাপও মারা পড়ে। সেই দিন থেকে সন্ধ্যের পর সবাই ওই ব্রীজের কাছে যেতে ভয় পায়, বর্তমান ব্রীজটা যদি তারপরে বানানো হয়েছে। অনেকেই ওখানে আপনার মতন ভয়ংকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে বেঁচে গেছে। সেই ভদ্রলোক যাঁরনাম অমর নাথ ভট্টাচার্য, এক স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক সবচেয়ে আগে আমার চিৎকার শুনতে পান। তিনি তারপর অন্যলোকদের ডেকে আমাকে নিয়ে আসেন। ডাক্তারবাবু এক নেমন্তন্ন খেতে এই গ্রামে ভাগ্যক্রমে এসেছিলেন, তাই তাঁকে পাওয়া গেল। এই গ্রামের নাম বুন্দলা, অর্থাৎ ব্রীজের একটু আগেই এই গ্রামটা। তাই ব্রীজেরও ওই একই নাম।

ডাক্তারবাবু সব শুনে বলেন, “গল্পটা শুনতে ভালোই, তবে বিশ্বাস করা মুশকিল।“ উনি আমাকে বলেন, “আপনার চোটটা গুরুতর নয়, অর্থাৎ ক্ষতটা গভীর নয়। তবে আমি ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়েছি, ইঞ্জেকশনও দিয়ে দিয়েছি। চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

সেই রাতেই একটু বিশ্রাম করে আমি পঞ্চায়েত প্রধানের গাড়িতে চড়ে ওই গ্রামের সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে নতুনডি, অর্থাৎ আমার বন্ধু প্রাণেশের বাড়ি রওনা হলাম। আমি অন্য রাস্তা দিয়েই গেলাম। তারপর অনেক আড্ডা দিয়ে ভালোভালো খাবার খেয়ে পরদিনটাও ওই গ্রামে কাটালাম। পুরুলিয়া ফিরে আমি নাক কান মললাম, আর কখনও ভুতের গল্প লিখব না। ডিটেকটিভ, হাসির বা দুঃখের গল্প লিখব কিন্তু ভুতের গল্প? কখখনো নয়। তোমরাই বলো আমি ঠিক কি না?