গল্প - ছোটকার তেঁতুলপাতা - চুমকি চট্টোপাধ্যায় । জানুয়ারি - ২০২৪

 






 ছোটকার তেঁতুলপাতা 





চু ম কি
চট্টোপাধ্যায়







....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -

 

 

আজ তোমাদের আমার ছোটকার গল্প বলব। আমি হলাম শিমূল। ক্লাস সিক্সে পড়ি। সিস্টার নিবেদিতা গার্লস হাইস্কুলে। আমাদের যৌথ পরিবার। যৌথ মানে জয়েন্ট, আমার মা শিখিয়ে দিয়েছে কথাটা। বলেছে, কেউ জিগ্যেস করলে যৌথ পরিবার কথাটা বলতে। তাই বললাম। সোজা কথায়, আমরা সবাই একসঙ্গে থাকি।

আমার বন্ধু তিতির কেবলই আমাদের বাড়ি আসতে  চায়। ও বলে, ' তোদের বাড়ি এলে মনে হয় মেলায় এসেছি। কি সুন্দর মজা করে থাকিস তোরা। আমাদের বাড়িটা খুব বোরিং। কেবল বাপি মা আর আমি। একটুও হইহই নেই।'

আমাদের বাড়িতে কতজন থাকি বলো তো? বলছি দাঁড়াও, ঠাদ্দা, ঠাম, জেজে, জেঠিম, টুকাইদাদা, টুবুলদাদা, কাকাই, কাকিম, দুষ্টু, ছোটকা, ছোটমা, বাবা, মা, আমি, বাসন্তীমাসি, গীতাদিদি আর ডিনো। তাহলে কতজন হলো?  এক... দুই...তিন... ষোলোজন। না, সাতেরোজন। ডিনো বাদ পড়ে গেছিল গোনা থেকে।

ডিনো হলো ফ্রেঞ্চ বুলডগ। খুব সুইট। টুকাইদাদা ওকে নিয়ে এসেছে। সবাই ডিনোকে ভালোবাসে। ডিনোও সবার কোলে চড়ে আদর খায়। আর কি করে জানো? যা পায় তাই কামড়ায়।

সোফার হাতলগুলো কামড়ে দাগ করে দিয়ছে। সেদিন তো ছোটমার নতুন ব্লাউজ মুখে নিয়ে দে ছুট! ' গেলো রে আমার ব্লাজটা ' বলে ছোটমা ছুটেছে ওর পেছনে। সবাই 'ডিনো ডিনো' করে ডাকাডাকি করাতে ও বুঝতে পেরেছে কাজটা ঠিক হয়নি। তখন চুপ করে ঠামের ঘরে আলমারির পেছনে গিয়ে বসেছে।

আরেকদিন কি করেছে শোনো। সামনের বাড়ির শান্তাকাকিমা সন্ধেবেলা এসেছিল কি একটা কাজে। সোফায় বসতেই ডিনো ছুটে এসেছে আর শান্তাকাকিমাও কোলে তুলে নিয়েছে ওকে। যেই না ' সোনামনা ' বলে কাঁধের ওপর ফেলেছে ওমনি ডিনোবাবু কাকিমার মুক্তোর কানের দুলটা খপ করে মুখে নিয়ে গিলে ফেলেছে।

সে এক হইহই রইরই কান্ড। মা জেঠিম সবাই তো লজ্জায় পড়ে গেছে। মা বলছে, ' কি বাঁদর কুকুর দেখো। দুল কেউ খায়! ছি ছি, কিছু মনে কোরো না গো শান্তা! দোকানে গেলে ওরকম একজোড়া দুল নিয়ে আসব। ' টুবুলদাদা তো মায়ের কথা শুনে হাসতে হাসতে কাশতে শুরু করেছে। বাঁদর কুকুর কথাটা টুবুলদাদার খুব পছন্দ হয়েছে।

জেঠিম বলছে, ' হ্যাংলা কুকুর একটা। এর ঠেলায় মানুষ গয়না পরতে পারবে না নাকি রে বাবা! '

সবথেকে বিপদে পড়েছিল শান্তাকাকিমা। নিজেই ডিনোকে কোলে নিয়েছেন। ওদিকে পছন্দের দুলের একটা  ডিনোর পেটে গেছে। রাগ হলেও কিছু বলতে পারছে না। খালি বলছে, ' ঠিক আছে, কোনো ব্যাপার না, তোমরা ডিনোকে বোকো না। অবোধ শিশু, ও তো আর কোনটা চকলেট আর কোনটা দুল বোঝে না! তোমরা ব্যস্ত হয়ো না, আমার ওরকম দুল আছে। '

পরের দিন ডিনোর পটির সঙ্গে বেরলো শান্তাকাকিমার সেই দুল। ইস, মাগো, ওই দুল কি কেউ ধরে! আমরা সবাই খুব হাসাহাসি করলাম। দুষ্টুমি করলেও কেউ কিন্তু ওকে বকে না। মিছিমিছি বকেই সবাই বেশি বেশি আদর করে।

আর একটা মজার কথা শোনো। আমার ভাইয়ের নাম দুষ্টু হলেও ও কিন্তু মোটেই দুষ্টু নয়। দুষ্টুমি করতে পারে ভেবে নিয়ে কাকাই ওর নাম রেখেছিল দুষ্টু। বাবা বলে, শান্ত ছেলেকে দুষ্টু বলে ডাকাটা ভারি অন্যায়। ডাকতে ডাকতেই না ছেলেটা দুষ্টু হয়ে যায়। বাবা ভাইকে তাই দুষ্টুনা বলে ডাকে।

আমাদের বাড়ির যতজন মেম্বার সবারই কিছু না কিছু মজার ঘটনা আছে। সবার কথা বলতে গেলে তো রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে যাবে। তাই সবার কথা বলছি না। তবে বাসন্তীমাসি আর গীতাদিদির কথা না বললে তো তোমরা বুঝতে পারবে না ওরা কারা।

বাসন্তীমাসি হল আমাদের বাড়ির কুক। যা দারুণ রান্না করে না, তোমরা খেলে বুঝতে পারতে। আমার বন্ধুরা,  তিতির, লাবন্য, অনীশা, মেরি, সুমনা -- সব্বাই বলে, ' কি লাকি রে তুই! আমাদের যদি বাসন্তীমাসি থাকত তাহলে খাওয়ার মজাই আলাদা হত। '

ওরা মাঝেমধ্যাই এসে বাসন্তীমাসির পেপারথিন পরোটা আর ঘুগনি খেয়ে যায়। ওরকম পাতলা পরোটা কেউ বানাতে পারে না। সারাদিন থাকে বাসন্তীমাসি। রাত্তিরের খাবার গরম করে ডাইনিং টেবিলে রেখে নিজের খাবার নিয়ে বাড়ি চলে যায়।

শীতের সময় বাসন্তীমাসির হাতের মেথি পরোটা, ফুলকফির পরোটা, কড়াইশুঁটি দিয়ে আলুর দম-- ওহ, যাকে বলে অসাম! বিরিয়ানি থেকে বেগুনি, পোলাও থেকে পটলের দোলমা -- সবেতেই ডিস্টিংশন বাসন্তীমাসির ( এই কথাটা কাকাইয়ের, আমি টুকলি করলাম)। 

এবার গীতাদিদির কথা বলি। গীতাদিদি আমাদের বাড়িতেই থাকে। জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ -- সবই সামলায় গীতাদিদি ( এটা জেঠিমের ডায়ালগ, কপি করেছি)। দেখেছ কান্ড! যে গল্পটা বলব বলে ঠিক করেছি, সেটাই শুরু করিনি এখনো। এজন্যই মা বলে, ' বড্ড বেশি কথা বলিস শিমূল! '

এবার আসল গল্প। ছোটকা গাড়ি কিনেছে। মারুতি ওমনি। সবার খুব আনন্দ! যদিও ঠাদ্দা বলেছে, ' ষোলো জন লোকের জন্য সাতজনের গাড়ি! হে হে। ' ঠাদ্দার কথায় দুঃখ না পেয়ে হাসিহাসি মুখে ছোটকা বলল, ' যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন'জন। বুঝলে বাবা। ' সেই থেকে ছোটকার গাড়ির নাম হয়ে গেল ' তেঁতুলপাতা '।

কাকাই আবার ছোটকাকে সাপোর্ট করল। কাকাই বলল, ' বাবা তোমার মনে আছে আমরা যখন ছোট তখন যশোর থেকে তোমার খুড়তুতো ভাই বোনেরা এসেছিল। আমাদের এই বাড়িতেই উঠেছিল। আমরা তখন দশজন মতো আর ওরা তেরো চোদ্দজন। বাড়িতে পুরো পিকনিকের পরিবেশ। সবই ঠিক ছিল কেবল শোবার ব্যবস্থা করতে গিয়ে মা তো হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল।

'তখন আমাদের বাড়িতে দামুদা ছিল মনে আছে তো? দামুদা পরামর্শ দিল, ভাঁড়ার ঘরে চারদিকের দেওয়াল জুড়ে যে ঢালাই করা বেশ চওড়া তাক আছে, সেই তাক পরিষ্কার করে বিছানা করে দিতে। ছেলেরা অনায়াসে চেয়ারে উঠে তাকে চড়তে পারবে। সবাই রাজি হল কারণ এর থেকে ভালো সমাধান আর হয় না।

' দামুদাই তাকে চড়ে ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে বিছানাপাতি করে দিল। চারজন ছেলে সেখানে শুয়ে পড়ল। বাকিদের ব্যবস্থা খাট আর মেঝে মিলিয়ে হয়ে গেল। তাহলে তেঁতুল পাতায় ন'জন হল কি না? বলো বাবা?'

ঠাদ্দা মুচকি হেসে বলল,' তোর গাড়িরও তাক আছে নাকি রে? ' সবাই হোহো করে হেসে উঠল। ছোটকা একটু লজ্জা পেলেও জোর গলায় বলে উঠল,  ' আছে আছে। ' হাসির হল্লা আরও বেড়ে গেল। টুবুলদাদা বলল, ' ছোটকার তেঁতুলপাতা, ষোলোজনে খুলবে খাতা। ' আমরা ছোটরা সবাই চিল্লিয়ে উঠলাম ' ইয়ে-এ-এ-এ'।

কদিন ধরে বাড়িতে সবাই খালি বেড়াবার প্ল্যান করছে। জেজে বলে দীঘা তো বাবা বলে তাজপুর। কাকাই বলে গড়চুমুক তো কাকিম বলে ঘাটশিলা। কিছুতেই আর জায়গা ঠিক হয় না। তখন ঠাদ্দা বলে উঠল, ' চুপ, সবাই চুপ করো। যে যা পারছিস বলে যাচ্ছিস। আরে যুক্তি দিয়ে ভাবতে হবে তো!

' একে ছোট গাড়ি, তায় অ্যাতগুলো মানুষ, তার ওপর যদি দূরত্ব বেশি হয় সেটা সম্ভব কখনো? অসম্ভব! বাস্তববুদ্ধি নেই না কী তোদের? এমন কোনো জায়গা ঠিক কর যেটা কাছাকাছি। ' 


সে প্রায় এক কোটি দু কোটি কথা বলল সবাই। তারপর ঠিক হলো কোলাঘাট যাওয়া হবে।  একটা দারুণ ধাবা আছে ওখানে, সেটায় লাঞ্চ করে তারপর ফেরা হবে। আমরা সবাই ' ইয়ে-এ-এ-এ ' করে আবার চেঁচালাম। কেবল টুবুলদাদা মাথা নীচু করে সোফায় বসে থাকল। মা জিগ্যেস করল, ' কি রে টুবুল, মনমরা হয়ে বসে আছিস কেন?  '

টুবুলদাদা শুকনো মুখ তুলে বলল, ' পরশু ইকনমিক্স প্রজেক্ট জমা দিতেই হবে কাকিয়া। কিচ্ছু রেডি হয়নি। কাল বসে করতেই হবে। আমার যাওয়া হবে না। ' মা বলল, ' এ যাঃ, সময়মতো করে নিস না কেন, কাজ ফেলে রাখতে নেই। '

এই কথার ভেতরেই ঠাম বলে উঠল, ' আমি বাপু যাচ্ছি না। তোদের ওই হরিবোল হট্টগোলে পড়ে আমার হাঁটু দুটো খুলেই যাবে। এমনিতেই খুব ব্যথা। ' ছোটকা জোরে বলে উঠল, ' আরে কোনো অসুবিধে হবে না গো মা। চলো না, মজা হবে।'

বকা দিয়ে উঠল ঠাদ্দা। ' তোর আক্কেল কবে হবে বল তো ছোটন! অ্যাতগুলো মানুষকে ওই ছোট গাড়িতে আঁটাবি কী করে? তোদের মা তো যাবেই না, আমিও যাব না। কাল মালি আসবে, দুটো নতুন প্রজাতির রঙ্গন গাছ নিয়ে। আমাকে থাকতে হবে। তাছাড়া,আমি ওই মুড়ির টিনে মুড়ি হয়ে যেতে পারব না। '

ছোটকার মুখটা করুণ হয়ে গেল। বাসন্তীমাসি আর গীতাদিদিও যাবে না। ডিনো কে নিয়ে যেতে বারণ করেছে টুকাইদাদা। তাহলে যাবে কে?

' আমরা যাব, আমরা যাব ' -- চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, দুষ্টু, টুকাইদাদা। ছোটকা গোনা শুরু করল। ' তাহলে কজন হল -- বদ্দা, বৌদি, টুকাই, মেজদা, মেজবউ, শিমূল, সেজ, সেজবউ, দুষ্টু, তুতুন, আমি। মোট এগারোজন। এহহে, কম হয়ে গেল যে!

এবার যাবার পালা! আমাদের খুব আনন্দ হচ্ছে। অন্যদিন ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না আর আজ ঘুমই আসছিল না। অনেক সকালে উঠে আমি রেডি হয়ে নিলাম। দুষ্টুও দেখি রেডি হয়ে ' চলো না, চলো না ' করে লাফাচ্ছে। 

দশটার সময়ে তেঁতুলপাতায় চড়ে  রওনা দিলাম আমরা। ছোটকা ড্রাইভিং সিটে। পাশে জেজে। জেজের কোলে দুষ্টু। পেছনে জেঠিম, মা আর কাকিম। তার পেছনের সিটগুলো না খুলে ভাঁজ করে রেখে নীচে মোটা শতরঞ্চি পেতে দিয়েছিল।  সেখানে কাকাই, ছোটমা,  টুকাইদাদা, আমি আর বাবা বসলাম। তেঁতুলপাতা স্টার্ট দিল। সবাই বলল ' হুররে! '

বাবা বলল, ' ছোটো, দম আটকে আসছে তো রে। পেছনে তো জানলাটা ফিক্সড। ' ছোটকা বলল, ' দাঁড়াও বদ্দা, হাইওয়েতে উঠে ব্যবস্থা করছি। '

হাইওয়েতে ওঠার আগেই তেঁতুলপাতা জব্বর একখানা লাফ মারল। জে'র মাথাটা ছাদে ঠুকে গেল। মাঝখানের সিটে জেঠিমরাও ' ও বাবা গো ' বলে উঠল। আর পেছনে আমরা তো এর ঘাড়ে ও গিয়ে পড়লাম। আসলে ছোটকা একটা বাম্পার দেখতে পায়নি। দোষটা তো ছোটকার, তেঁতুলপাতার তো নয়, বলো তোমরা?

হুমড়ি খেতে খেতে এসে গেল হাইওয়ে। ছোটকা বলে উঠল, ' ব্যস, হাইওয়েতে উঠে পড়েছি আর চিন্তা নেই। একেবারে মাখনের মতো রাস্তা। '

কাকাই পেছন থেকে বলল, ' সে নাহয় কেউ কারু ঘাড়ে পড়লাম না কিন্তু দম নিতে পারছি না যে আমরা কেউ, তার কী ব্যবস্থা করবে বলো দেখি? শেষে কিনা আউসউইৎসের মতো ঘাঁটা কেসে পড়ে যাবে না তো তোমার তেঁতুলপাতা?'

সবাই জোরে হেসে উঠল, আমরাও হাসলাম। আমি কিন্তু কথাটা ভালো করে বুঝতে পারিনি তাও হেসেছি। ছোটকা হেসে বলল, ' তারও বন্দোবস্ত করছি, পাঁচটা মিনিট দাও। '

আমি আর দুষ্টু ধাবায় কী খাব সেই নিয়ে কথা বলছিলাম। হঠাৎ করে তেঁতুলপাতা দাঁড়িয়ে পড়ল। এই যাহ, কোলাঘাট চলে এলো নাকি! দেখি ছোটকা নেমে পড়েছে ড্রাইভিং সিট থেকে। তারপরে পেছনে এসে ডিকির ডালাটা তুলে দিল। ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে এল ভেতরে। সবাই বলে উঠল, ' আহ! '।

' নেমে এসো সবাই, চা-টা খাও, বাচ্চারা কী খাবি দেখে নে। চিপ্স না খেয়ে কেকটেক খা। ' ছোটকা বলল।

হইহই করে আমরা নেমে পড়লাম। মা'রাও নামল। বড়রা চা বিস্কুট খেল, আমরা টিফিন কেক, ক্রিম রোল খেলাম। টুকাইদাদা বলল, ' অ্যাই, তোরা একগাদা খেয়ে পেট ঢাক করিস না কিন্তু। ধাবার খাবার খেতে পারবি না তাহলে। '

খেয়েদেয়ে আমরা আবার তেঁতুলপাতায় উঠে পড়লাম। ছোটকা এবার ডিকির দরজাটা আর নামাল না। তোলাই থাকল। বাবা ভয় পেয়ে বলে উঠল, ' কী রে ছোট, ডালা নামাবি না? '

' না মেদ্দা। তোলাই থাক। হাওয়া খেলবে, তোমাদের আরাম লাগবে। '

' বলিস কি? ছিটকে বেরিয়ে যাবে কেউ না কেউ। সব্বোনাশ! ডালা নামা বাবা আমার, হাওয়ার দরকার নেই। '

বাবার কথা শুনে ছোটকা বলল, ' সবাই সবাইকে ধরে বোসো না, কেউ ছিটকোবে না।  আমি স্লো চালাব। '

আমাদেরও খুব মজা লাগছিল, ঠিক কেমন মজা সেটা বোঝাতে পারব না কিন্তু বেশ ভালো লাগছিল। ছোটকা আসতে আসতে গাড়ি চালাতে লাগল।

' চলো চলো অন্তাক্ষরী শুরু হোক।' কাকিম বলে উঠল। আমরাও ' হ্যাঁ হ্যাঁ ' করে উঠলাম। মা বলল, ' আমি নেই কিন্তু, আমার একদম সুরজ্ঞান নেই। তোরা খেল, আমি শুনি।'

' আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে' ... কাকাই গেয়ে উঠল।  স দিয়ে গাও।  টুকাইদাদা শুরু করল ' সব ভালো যার শেষ ভালো '। জেজে বলল, ' এরকম গান তো জীবনে শুনিনি রে টুকাই? প্রবচনটা জানি কিন্তু গান... ।

' হবে না হবে না ', প্রতিবাদ করল কাকিম। ' নিজের বানানো গান চলবে না। নো চিটিং। '

হঠাৎ ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল তেঁতুলপাতা। কী হল,কী হল? ' ওরেব্বাবা! দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে সামনে।

' এভাবে গাড়ির ডিকি খুলে যাচ্ছেন কেন? অ্যাক্সিডেন্ট হলে দায় কে নেবে অ্যাঁ? দেখি, লাইসেন্স দেখি। '

' আসলে অনেকজনে মিলে যাচ্ছি তো, ভেতরে হাওয়া ঢুকছিল না। তাই ডিকির ডালাটা তুলে রেখেছি।' থেমে থেমে বলল ছোটকা।

দুজন পুলিশের একজন তখন পেছনদিকে চলে এসেছে। ' কোথায় যাচ্ছেন? কেউ যায় এভাবে? সাতজনের গাড়িতে কতজন উঠেছেন?বন্ধ করুন ডালা। ' ধমকাল সেই পুলিশকাকুটা। দুষ্টু খুব ভয় পেয়েছে। বাবাকে খামচে ধরে আছে। আমারও পেটটা গুড়্গুড় করতে শুরু করেছে।

মাঝখানের বাঁ দিকের দরজা খুলে জেঠিম নেমে এল। ' শুনুন অফিসার, আমরা কোলাঘাট যাচ্ছি। আমাদের যৌথ পরিবার। আমরা যেখানে যাই, একসঙ্গেই যাই। আমরা স্বজন তাই সাতজনের গাড়িতে এগারোজন যাচ্ছি। এই গাড়ির নাম তেঁতুলপাতা। বুঝেছেন? '

একটু ঘাবড়ে গিয়ে পুলিশকাকু বলল, ' ম্যাডাম, আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন। এভাবে যাওয়া বে-আইনি। '

' কত বছর বাদে আমাদের বাড়িতে একটা গাড়ি এসেছে, সবাই মিলে বেরব না? যৌথ পরিবার বোঝেন?  আমাদের হল সতেরোজন মেম্বার। তাও তো সকলে আসেনি। আপনারা বাধা দিলে তো আমাদের আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে, মন খারাপ হবে। মন খারাপ থাকলে শরীরে রোগ বাসা বাঁধে, জানেন তো? অসুখ বিসুখ হলে তো আর আপনারা সাহায্য করতে আসবেন না!  তাই বলছি, ছেড়ে দিন। ' জেঠিম বেশ একটা লম্বা লেকচার দিল ( লেকচার কথাটা কাকাইয়ের)।

' আরে ম্যাডাম আপনাদের ঘুরতে যেতে বাধা দিচ্ছি না। বলছি, এভাবে ডালা তুলে যাওয়া যাবে না। এক কাজ করুন, আপনাদের মধ্যে থেকে তিনজন মাঝখানে চলে যান, তাহলেই প্রবলেম সলভ হয়ে যাবে। ' একজন অফিসার বলল।

বাবা আমাকে, ছোটমাকে আর টুকাইদাদাকে মাঝখানে পাঠিয়ে দিল। আমি বসলাম জেঠিমের কোলে, ছোটমা বসল মায়ের কোলে আর টুকাইদাদা কাকিমের কোলে। পেছনের ডালা বন্ধ করে দেওয়া হল।

পুলিশকাকুদের সঙ্গে জেজে হ্যন্ডশেক করে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ অফিসার। '

একজন অফিসার বলল, 'তেঁতুলপাতায় ন'জন কথাটা শুনেছিলাম, আজ চোখে দেখলাম। আপনাদের যাত্রা শুভ হোক। '

তেঁতুলপাতায় স্টার্ট দিল ছোটকা। আমরা ' ইয়ে-এ-এ-এ ' করে চেঁচালাম। তারপর ধাবায় পৌঁছে দারুণ দারুণ আইটেম খাওয়া হল। আমরা অনেক্ষণ ধরে আসতে আসতে খেলাম। খাওয়া শেষ হলেই তো বাড়ি ফেরার পাল। যতটা আনন্দ করা যায় করে নিতে হবে।

' এবার ফিরতে হবে, সবাই উঠে পড়ো গাড়িতে। ' জেজে হাঁক দিল। জেঠিম বলল, ' গাড়ি বোলো না, বলো তেঁতুলপাতা। আমাদের অ্যাতগুলো লোককে পেটে করে বয়ে এনেছে তো! ' সবাই হোহো করে হেসে উঠল।

টুকাইদাদা বলল, ' আনন্দটা আরো বেড়ে গেল কেন বলো তো?  কতদিন পর কোলে বসলাম। মনে হল, আবার ছোট হয়ে গেছি। টুবুলদাদা খুব মিস করল। '

তেঁটুলপাতায় স্টার্ট দিল ছোটকা। আমরা ভিক্টরি সাইন দেখিয়ে বললাম, ' তেঁতুলপাতা জিন্দাবাদ, হিপ হিপ হুররে! '