জানা অজানা । বৈশাখ ১৪৩২



 পঞ্জিকার অন্দরে










সুদীপ্ত শেখর পাল

কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ




 

বাংলা নববর্ষের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালীর ঘরে ঘরে চলে আসে একটি নতুন বই, যার নাম পঞ্জিকা। গোলাপী রঙের মলাট, অত্যন্ত সাধারণ কাগজে ছাপা আর ভিতরে ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরের ঠাস বুনন। এই হলো তার বাহ্যিক রূপ। 

পঞ্জিকার ভালো নাম পঞ্চাঙ্গ সময় নির্ধারণের পাঁচটি বিষয় এখানে আলোচনা করা হয় বলে এর এইরকম নামকরণ মোটামুটি ভাবে বলা যায় যে, বিশদ তথ্য দিয়ে ক্যালেণ্ডারকে বই আকারে প্রকাশ করলে তাকে বলা যায় পঞ্জিকা

যতদূর জানা যায় পঞ্জিকার উদ্দেশ্য ছিল ফসল বোনার সময় নির্বাচন এবং পুজা- পার্বনের দিন নির্ধারণ ফসল বোনার সময় নির্ধারিত হয় ঋতু অনুযায়ী যাপৃথিবীর বার্ষিক গতির সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত এবং অধিকাংশ পূজা-পার্বনের দিন নির্ধারিত হয় তিথি অনুযায়ী যাচাঁদের পৃথিবী পরিক্রমণের উপর নির্ভরশীল যখন পঞ্জিকার প্রচলন হয় তখন মানুষ জানত না যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে আর চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে তারা জানত এবং প্রত্যক্ষ  করত সূর্য চাঁদ দুই জ্যোতিষ্ক (তখন এরা গ্রহ নামে পরিচিত ছিল) পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে সূর্য প্রতিদিন যেমন পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঘোরে তেমনি অত্যন্ত ধীর গতিতে পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘোরে এখনকার জ্ঞান দিয়ে আমরা জানি যে প্রথমটি হলো আহ্নিক গতির ফল আর দ্বিতীয়টি হল বার্ষিক গতির ফল ধরা যাক, বর্ষার শুরুর দিনে বীজ বপন করতে হবে দেখা গেল দীর্ঘ গরমের পর কোন একদিন শুরু হল বর্ষা তাহলে পৃথিবী আপন কক্ষপথে এক পাক ঘুরে ঠিক সেই অবস্থানে   এলে সেদিন বর্ষা শুরুর দিনের অনুরূপ অবস্থান হবে এই সময়টা হল ৩৬৫ দিন ঘন্টা ১২ মিনিট ৩৭ সেকেণ্ড একে বলা হয়এক নাক্ষত্র বৎসর আহ্নিক গতি বার্ষিক গতি ছাড়াও পৃথিবীর আর একটি গতি আছে সেটা হল পৃথিবীর অক্ষের ঘুর্ণন জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় পৃথিবীর অয়ন চলন এর ফলে পরের বছর পৃথিবীর একই রকম অবস্থানে আসতে পুরো একটি নাক্ষত্র বৎসর অপেক্ষা করতে হয় না প্রতি বছর ২৪ মিনিট কম অপেক্ষা করলেই চলে যায় দুএক বছর বা দুএকশো বছরে এই কয়েক মিনিটের হেরফের কোন প্রভাব ফেলবে না বটে কিন্তু কয়েক হাজার বছরে যে প্রভাব পড়বে তাএকটু হিসাব করলেই বোঝা যাবে বসন্তের শুরুতে যে কোকিল ডাকে একসময় সেই কোকিলের ডাক শুনতে পেলে কিংবা বসন্তের বাতাস অনুভব করলেও পঞ্জিকায় দেখা যাবে সেটা বসন্তের শুরু নয়  সেটা দেখাচ্ছে নিখাদ শীত কাল কেননা বসন্ত এগিয়ে আসতে আসতে এতটা এগিয়ে এসেছে যে, শীত কালের মধ্যে ঢুকে গেছে ইংরাজী ক্যালেণ্ডারে বছরের মাপ ধরা হয় ২৪ মিনিট কম করে, তাই প্রতি বছর বসন্ত আসে নির্দিষ্ট দিনে, কয়েক হাজার বছর পরেও আসবে নির্দিষ্ট দিনে

বাংলা ক্যালেণ্ডার বা পঞ্জিকা নাই বা হলো ঋতু নিষ্ট, কিন্তু নাক্ষত্র বৎসরের মানটা তো ঠিক রাখবে তা ঠিক থাকে না নিয়ে প্রাচীন কালের পঞ্জিকা প্রণেতাদের দোষ দেওয়া যায় না কারণ যে সব গ্রন্থে (যেমন সূর্যসিদ্ধান্ত বা অর্ধরাত্রিকা) দেওয়া বর্ষমান ধরে পঞ্জিকা প্রণয়ন করা হয়েছে সেগুলি লেখা বহু পূর্বে আর মোটামুটি ভাবে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত নানা সময়ে এই  সব গ্রন্থের সংস্কার সাধন করা হলেও বর্ষমানের কোন পরিবর্তন চোখে পড়ে না কিন্তু সূক্ষ্ণ যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হওয়ার পর দেখা গেছে নাক্ষত্র বৎসরের মান আরো মিনিট ২৭ সেকেণ্ড কম যে পঞ্জিকায় বৎসরের এই মান ধরা হয় তাকে বলেদৃকসিদ্ধপঞ্জিকা আমদের পরিচিতবিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাহল একটিদৃকসিদ্ধপঞ্জিকা আগে আলোচিত পঞ্জিকা হলঅদৃকসিদ্ধপঞ্জিকা দুই পঞ্জিকার মধ্যে তিথির হিসাবে / ঘণ্টার পার্থক্য দেখা যায়, ফলে অনেক সময় কোন পূজা বা পার্বন পালনের ক্ষেত্রে এক দিনের তফাত হয়ে যায় ভারত বর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বেক্যালেণ্ডার রিফর্ম কমিটিগঠিত হয়, যার সভাপতি ছিলেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এই কমিটীর সুপারিশ মেনে ১৯৫৭ খৃষ্টাব্দ থেকেরাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গপ্রকাশিত হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গেও নির্ভুল পঞ্জিকা চালু করার জন্য ১৯৬৩ খৃষ্টাব্দে একটি কমিটি গঠিত হয় এই কমিটির সুপারিশ ছিল যে সূর্য সিদ্ধান্তের হিসাবে ভুল থাকলে তাসংশোধন করে পঞ্জিকা প্রণয়ন করতে হবে পরের বছর এই জাতীয় একটি আদেশ সরকার কতৃক জারী করা হয় পঞ্জিকাকার দের উপর কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে সেই অনুযায়ী কাজ হয়নি পশ্চিমবঙ্গ সরকার অদৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা অনুযায়ী ছুটির দিন ঘোষনা করে তবুও ১৮৯০ সাল থেকেবিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকারপ্রচলন দেখা যায় সাধারণ ভাবে এর ব্যবহার জনপ্রিয়তা অর্জন না করলেও অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্টান এই পঞ্জিকা মেনে চলে

 

ঞ্জি কা   বি   গু লি

বা

সপ্ত-অহ, সপ্তাহ, অর্থাৎ সাত দিনে এক সপ্তাহ এক-এক দিনের এক-এক নাম, তাকে বলে বাসর বা বার তাই বারও সাতটি মাস কিংবা দিনের মতো সপ্তাহ একটি সময়ের একক, যা দিনের মতো ছোট নয় আবার মাসের  মতো অত বড় নয় যদি এই বিশেষ একক সাত দিনের বদলে ছয় কিংবা আট- দশ হতো তাহলে বারের সংখ্যাও অনুরূপ হত কোন কোন সভ্যতায় সাত দিনের একক ছাড়া অন্য একক প্রচলিত ছিল, তবে বিশ্বের অধিকংশ স্থানে সাত দিনের সপ্তাহ সেই সঙ্গে সাত বারের নাম প্রচলিত আছে আমাদের পঞ্জিকায় যে বারের নাম আছে তা গ্রহদের নামে নামাঙ্কৃত গ্রহ বলতে এখনকার সজ্ঞা অনুযায়ী সূর্যের চারদিকে ঘোরা জ্যোতিষ্ক নয় গ্রহন সংঘটন কারীদের বলা হত গ্রহ আধুনিক বিজ্ঞানের নিরীখে সত্য মিথ্যা যাই হোক অতি প্রাচীন কালের মানুষ যা’  বিশ্বাস করত তার পরিপ্রেক্ষিতে সাত বারের নাম এসেছে তবে মনে করা হয় ভারতে বারের নাম চালু হয়েছে আলেকজান্ডারের আগমনের পর তার আগে রচিত কোন গ্রন্থে বারের নাম পাওয়া যায় না তখন বিশেষ কোন দিন নির্দেশ করা হত মাস, তিথি নক্ষত্র দিয়ে

তি থি

চাঁদ ২৭. দিনে পৃথিবীকে একপাক ঘুরে কক্ষপথের আগের অবস্থানে আসে৷ এই সময়টা হল নাক্ষত্র মাস কিন্তু সে সময় পৃথিবী বসে থাকে না৷ ততদিনে নিজের কক্ষপথে সেও এগিয়েও যায় খানিকটা৷ এই   দুরত্বটুকু অতিক্রম না করলে পৃথিবীর দর্শকের কাছে চাঁদের একই রকম অবস্থান বোধগম্য হয় না৷ তাই পৃথিবী থেকে দেখলে মনে হয় চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে একপাক ঘোরে ২৯ দিন ১২ ঘন্টা ৪৪ মিনিট এই সময়টাকে বলা হয় চান্দ্রমাস, আর একে মোট ৩০ ভাগে ভাগ করে এক একটি ভাগকে বলা হয় তিথি  তাহলে তিথি হল ৩০ টি শুক্লপক্ষের ১৪ টি, কৃষ্ণপক্ষের ১৪ টি, এছাড়া পূর্ণিমা অমাবস্যা৷ তিথিকে বলা যায় চান্দ্র দিন৷ এই চান্দ্র দিন সূর্যোদয় সূর্যাস্তের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত নয়৷ তাই এই মাপ বাস্তব জীবনে তেমন কোন কাজে আসে না৷ তবে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে এবং জোয়ার ভাটার হিসাব রাখার জন্য তিথির জ্ঞান আবশ্যক৷ কোন দিন কোন তিথি হবে এবং কতটা সময় ধরে সেই তিথি থাকবে তাহিসাব করতে  অনেক জটিল হিসাব নিকাশ প্রয়োজন৷

ক্ষ ত্র

পৃথিবী থেকে যখন দেখি তখন পৃথিবীকে স্থির ভাবতে বাধ্য হই তখন দেখা যায় যে চাঁদ সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে চাঁদ এবং সূর্যের পরিভ্রমণ পথ মোটামুটি ভাবে একই দেখা গেছে চাঁদ প্রতিদিন এক-একটি তারার কাছে থাকে এইভাবে ২৭টি নক্ষত্রের সঙ্গে থেকে আবার পূর্বের নক্ষত্রের কাছে ফিরে আসে এই নক্ষত্র গুলোর নাম অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা ইত্যাদি গোটা পথকে অর্থাৎ ক্রান্তিবৃত্তকে  (elliptic) ২৭ ভাগে ভাগ করে সেই নক্ষত্রের নামে জায়গাটিকে চিহ্নিত করা হয় একএকটি নক্ষত্রের এলাকা প্রায় ১৩ ডিগ্রি ২০ মিনিট চাঁদের মতো সূর্যও এই সব নক্ষত্রের মধ্য দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘোরে কোন দিন কোন নক্ষত্রে চাঁদ সূর্য অন্যান্য গ্রহ থাকে তা পঞ্জিকায় লেখা থাকে

একটি তিথিকে দুভাগে ভাগ করে এক একটি ভাগকে বলা হয় করণ এক মাসে হওয়া উচিত ৬০ টি করণ, কিন্তু মোট করণ সংখ্যা ১১ টি এর মধ্যে চারটি করণ মাসে একবার করে আসে আর বাকী টি আসে পর্যায়ক্রমে

যো

একটি নক্ষত্রের এলাকা অতিক্রম করতে চাঁদের যে সময় লাগে তাকে বলা হয়যোগ প্রথম যোগের নাম বিষকুম্ভ আর শেষ যোগের নাম বৈধৃতি এই পাঁচটি বিষয় নিয়ে পঞ্জিকা শুরু হয়েছিল বলে এর অপর  নাম পঞ্চাঙ্গ  

এসব ছাড়াও আধুনিক কালের পঞ্জিকার মধ্যে থাকে আরো বহু বিষয় যেমন বিশেষ ভাবে থাকে রাশি ক্রান্তিবৃত্তকে ১২ ভাগে ভাগ করে এক-এক ভাগকে বলা হয় রাশি একটি রাশির বিস্তার ৩০ ডিগ্রি বিভিন্ন ভাগে অবস্থিত নক্ষত্র মণ্ডলীর নামে রাশিগুলির নাম করণ করা হয় কোন রাশিতে চন্দ্র, সূর্য অন্যান্য গ্রহ অবস্থান করে তালেখা থাকে দৈনন্দিন সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের সময়, পুজা-পার্বনের সময়, জোয়ার-ভাঁটার সময় যেমন থাকে তেমনি থাকে বিখ্যাত ব্যক্তিদের জন্মদিন-মৃত্যুদিনের কথা, থাকে চন্দ্র গ্রহণ, সূর্যগ্রহণের কথাও পঞ্জিকার শুরুতে এত বিষয় না থাকলেও মানুষের প্রয়োজনকে সামনে রেখে নানা সময়ে নানা কিছু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ভবিষ্যতে হয়তো আরো নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়ে মানুষের আরো প্রয়োজন মেটাবে

 

 


 

আরও পড়ুন  -

+    বন্ধু বিবেকানন্দ

+    দর্শন

+    শূন্যের আবিস্কার ও গুরুত্ব

+    ধীরে ধীরে জ্ঞানের গভীরে

+    ছবি আঁকার পথে মানুষের বিচরণ

+    বেচারা তিমি

+    সঙ্গীতের সঙ্গী হতে


+    নানা রকম দেখা

+    মাধ্যাকর্ষণের পথ ধরে

+    ইংরাজি ভাষা ও তার অক্ষর পরিচয়




সূ চি প ত্র