গল্প - চেয়ার - বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী । জানুয়ারি - ২০২৪








 চেয়ার



বি ম লে ন্দ্র
চ ক্র ব র্তী






....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -


 

সকালে খবরের কাগজ পড়তে গিয়েই হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ে নবীনের । অফিসে যাবার পর একা ঘরে মা বারান্দায়, রোদে বসে কাগজ পড়ছিলেন।

এমন সময় মাঝ বয়সী একটি লোক এসে মা'কে প্রণাম করে বললেন,

- মাসিমা কেমন আছেন ?

মা হেসে বললেন 

- ভালো আছি বাবা ।

- মাসিমা আমি গদাই। এ বাড়িতে অনেক দিন কাজ করে গেছি। দাদাকে দেখলাম অফিসে যাচ্ছে রিক্সা করে। ডাকলাম। তাড়া ছিল বলে দু'চার কথা বলেই চলে গেলেন।

- তাই, আমি তো বাবা তোমাকে ঠিক চিনতে পারলাম না ।

- দাদা জানেন আমি ওপাড়ার গদাই। গদাই দত্ত রায়চৌধুরী ৷ বাবা অকালে মারা যাবার পর ভীষণ কষ্টে আছি তবু গুরুদেবের নামে শ্রদ্ধাভরে পুজো করি বছরে একবার।

- ঠাকুর, তুমি সবার মঙ্গল করো ঠাকুর। হাতজোড় করে প্রণাম করেন মা। ছেলে বাড়ি না এলে তোমাকে টাকা দিতে পারছি না অথচ কিছু টাকা দিতে পারলে খুবই ভালো লাগতো আমার। তুমি কাল সকালে এসো। তোমার দাদা থাকবেন, ও বাড়ি এলে বলবো গদাই এসেছিল, বাৎসরিক পুজোর কথা বলতে।

- মাসিমা পুজো তো আজ সন্ধ্যায়।

- তাহলে তো আমি কিছু করতে পারবো না গদাই। পুজো শেষে বরং একদিন এসো। দাদা নিশ্চয় কিছু সাহায্য করবে তোমাকে।

- তাতো প্রতিবারই করেন মাসিমা। দাদাদের সাহায্য না পেলে আমার পক্ষে কি আর উৎসব করা সম্ভব হতো।

- সবই তো শুনলাম। তুমি কাল বা পরশু একবার এসো ।

- গদাই ফের প্রণাম করে বলল মাসিমা আজ সন্ধ্যায় পুজো হবে।

-তাহলে?

- টাকার জন্য আজ কিন্তু আসিনি মাসিমা। এসেছি ঠাকুরের ছবি বসাবার জন্য দাদার হাতলওয়ালা চেয়ারটা একদিনের জন্য নিতে।

- আরে, ওতো এই চেয়ারে বসেই পড়াশুনো করে। এইতো ক'দিন আগে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এনেছে নিজের পছন্দ মতো। এ চেয়ার ওকে জিজ্ঞেস না করে কিভাবে দিই বলো।

- দাদাকে আমি চেয়ারের কথা বলেছি।

- বলেছ, তো কি বলেছে দাদা?

- দাদা বললেন মা বাড়ি আছে মা'কে বলে নিয়ে যা। মাত্র একদিনের ব্যাপার, কাল আবার দিয়ে যাবি সকালে ।

- নবীন বলেছে -

- হ্যাঁ মাসিমা। ঠাকুরের নাম বললে কেউ কি আর না বলে। এতো আমার পরম সৌভাগ্য, ঠাকুরের আশীর্বাদধন্য হবে এ চেয়ার।

- বাহ! তুমি তো খুব সুন্দর কথা বলো। পড়াশোনা করেছো নিশ্চয়।

- গদাই মাথা চুলকায়- ক্লাশ টেন। বাবা মারা যাওয়ায় আর পড়াশোনা হয়নি ।

- ঠিক আছে এতো যখন বলছো তবে চেয়ারটা নিয়ে যাও। তোয়ালেটা রেখে দাও পাশে।

-মাসিমা তোয়ালেটাও সাথে করে নিয়ে যাই, ধুয়ে বিছিয়ে দেবো আসনে। দেখতে ভালো লাগবে । খালি চেয়ারে ঠাকুরের ছবি বসালে ভালো লাগবে না। তাছাড়া তোয়ালেটা একদম নতুন ।

- ঠিকই বলেছ। গতকালই কিনে এনেছে। পেতে এখনও বসেনি সে। সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে বলে ঠাকুর, তুমিই সব। চেয়ারটা কাঁধে করে বাইরে সাইকেলের সাথে বেঁধে তোয়ালেটা একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফের বলেন মাসিমা যদি কিছু না মনে করেন তাহলে বলি।

- মনে করার কি আছে, বলো।

- ঠাকুরের ঘট বসাবার জন্য ছোট টুলটা দিলে খুবই ভালো হয়।

-আবার টুল!

- কাল সকাল আটটার মধ্যেই পেয়ে যাবেন মাসিমা।

- ঠিক আছে নিয়ে যাও। তবে আগামীকাল কিন্তু সকাল সকাল ফেরত দিয়ে যেও।

-দাঁদা থাকলে একটা গ্যাস সিলিন্ডারও নিতে পারতাম খিচুড়ি রান্নার জন্য।

গতকাল এলেই সব পেয়ে যেতাম দাদার কাছে। দাদা কিন্তু আমাকে ছোটো ভাইয়ের মতোই দেখেন। একটা প্রণাম করে চলে গেল গদাই। নবীনের মা দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েন। দুপুর শেষে বিকেল তারপর সন্ধ্যা।

- সেদিন নবীন অফিস থেকে বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যা সাতটায়। ব্যাঙ্কের কাজ শেষ না করে তো আর বাড়ি আসা যায় না। কম্পিউটার যে ভীষণ কড়া হিসাব না মিলিয়ে যে আসা যায় না।

নবীন বাথরুমে হাত পা ধুয়ে পায়জামা পরে ও পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে একটু ফ্রেস হয়ে নিজেই চা- টা করে মাকে দিয়ে কাপ প্লেট নিয়ে তার বসার ঘরে যায়। টেবিলে চায়ের কাপটা রাখতেই তার চোখে পড়ে চেয়ারটা নেই, পাশে রাখা নতুন টুলটাও।

মাকে ডাকে নবীন- মা, আমার চেয়ারটা আবার কোথায় গেল, কাঠের টুলটাও তো দেখছি না। তোমাকে কতদিন বলেছি তোমার বয়স হয়েছে এভাবে ভারি কিছু টানাটানি করো না।

- আরে না, আমি টানাটানি করবো কেন, গদাই এর বাড়িতে আজ ঠাকুরের উৎসব। ও চেয়ার টুল দুটোই নিয়ে গেছে একটায় ঠাকুর আর অন্যটায় ঘট বসাতে।

- নতুন তোয়ালেটাও?

- হ্যাঁ, তোয়ালে না হলে ঠাকুর বসাবে কিভাবে।

গদাই! কোন গদাই! মা তুমি গদাইকে চেনো?

- না, ওতো বলল তোর চেনা। অফিসে যাবার পথে গদাই এর সাথে তোর কথা হয়েছে।

- আমার সাথে গদাই এর কথা হয়েছে, ও বলল!

- হ্যাঁ, তাইতো এসে বলল। সিলিন্ডারটাও....

- দাওনি তো।

- না না, দিই নি।

- খুব ভালো করেছো। মা, ঘরে চোর ঢুকেছিল তুমি বুঝতে পারোনি।

- চো-র-র.. নানা ওকে দেখে তো মনে হয় না, কপালে চন্দনের টিপ কথায় কথায় মাসিমা, কতবার প্রণাম করেছে। ঠাকুরের প্রতি কী ভক্তি।

- কি বলেছে তোমার গদাই?

- বলেছে আগামীকাল সকালে সব দিয়ে যাবে।

- আগামীকাল রবিবার৷ আমি বাড়িতেই থাকব দেখো দিয়ে যায় কিনা। এবার মা কেমন যেন চুপ হয়ে যায়। ভয়ে মায়ের হাত পা কাঁপছে। গদাই কী তাহলে চোর! দিন দুপুরে ঠাকুরের নাম বলে নিতে পারে সব। ওর পাপ হবে না বিড় বিড় করতে করতে কাঁপতে থাকে মা। আমার শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে নবীন। আমায় বিছানায় একটু শুইয়ে দে বাবা।

- এতো চিন্তা করো না মা, এখন থেকে অপরিচিত লোক এলে দরজা খুলে দিও না। প্রয়োজনে পাশের বাড়ির কাউকে ডেকো অথবা ফোন করো আমাকে। সারারাত ঘুমাতে পারেননি মা। পরদিন সকালে চা খেয়ে গদাই এর প্রতীক্ষায় জানালার পাশে বসে থাকে মা, গদাই আসে না। তার পরদিনও না, তারপর দিনও না।

এদিকে মা খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছোটোবেলার সিঁদকাটা চোরের সাথে আজকের গদাইকে তিনি কোন ভাবেহ মেলাতে পারছেন না।