গল্প - এক ভূবনের জেরে - দেবলীনা চক্রবর্তী । ফেব্রুয়ারি - ২০২৪


 এক ভূবনের জেরে







দে ব লী না
চ ক্র ব র্তী 






....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -

 

 

ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল পিকলু!

বারান্দার পাশে খোলা বাদামী রঙের থ্যাবড়ানো চামড়ার চটিজোড়া দেখেই দাঁত কিরমিড়িয়ে উঠলো পিকলু। এমনিতেই আজ তার মন মেজাজ মোটেই ভালো নেই। তার উপর ভূবন কাকুর আগমন। একেই বলে গোদের উপর বিষফোঁড়া।

অবশ্য ভূবন কাকু মানে ত্রিভূবন মিত্তির যবে থেকে পিকলুর জীবনে উদয় হয়েছেন, পিকলুর জীবনটাই যেন বিভীষিকাময় হয়ে গেছে। সেই আগের মত নিপাট শান্তি কি আর কখনো তার জীবনে ফিরে আসবে?

পিকলু মানে যার ভালো নাম রত্নদীপ ঘোষাল, সে জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ঘন সবুজ গাছের ছায়া, মনমাতানো চা বাগান আর অদূরের নীলচে পাহাড়ের ছবিঘেরা এই শহরেরই দেশবন্ধু পাড়ায় ওর বাড়ি। বাবা সমীরণবাবু রেলে চাকরি করেন। আপাতত মালদায় পোস্টেড। ওখানেই থাকেন। দু’তিন দিনের ছুটিছাটা থাকলে তবেই এখানে আসেন। মা গীতশ্রী ঘোষাল গৃহবধূ। পিকলুর বাড়িতে মা বাবা ছাড়া ছোট মামা স্বপনও থাকে। সে জলপাইগুড়ি ফার্মেসি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।

বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার দৌলতে ছোট থেকেই পিকলু আদরটা একটু বেশিই পেয়ে এসেছে। তার উপর বাবা বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকেন, তাই যেটুকু সময়ের জন্য বাড়িতে আসেন পিকলুকে মোটেই বকাবকি করতে চান না। মা মাঝেমধ্যে একটু আধটু কড়া হলেও যথেষ্ট নরম স্বভাবের মানুষ। মামাও আদরের ভাগ্নেটিকে চোখে হারায়।

তবে এসব এখন ইতিহাস। যবে থেকে ওই ভূবন মিত্তিরের পা এই বাড়িতে পড়েছে, পিকলুর জীবনের সমস্ত ভালোগুলো অতীতে পরিণত হয়ে গেছে। বর্তমানে ওর ভূবন জুড়ে কেবলই মায়ের বকুনি, মামার টিপ্পনি, বাবার উপদেশ সঙ্গে শতশত কড়াকড়ি আর বিধিনিষেধের বান ডেকেছে।

ব্যাপারটা তাহলে খোলসা করেই বলা যাক। ত্রিভূবন মিত্র পিকলুর বাবার দুঃসম্পর্কের পিসতুতো ভাই। পিসি পিসিমশাই তো কবেই পঞ্চত্ব প্রাপ্তি করেছেন। এই ভাইটিও বহু বছর আসাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরায় ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন ট্যুরিজমের চাকরির সুবাদে। এতদিন বাদ শিলিগুড়ির ঘোষপুকুরের কাছে নিজেরই একটা পর্যটন অফিস খুলে বসেছেন। আর শিলিগুড়িতে ফেরার পরপরই কিভাবে যেন সমীরণবাবুর সাথে আবার তার যোগাযোগ হয়ে যায়। ব্যাস তারপর থেকে বাড়ি আসাযাওয়া শুরু। একলা মানুষ, বিয়ে থাও করেননি। তাই অবরে সবরে, ছুটির দিনে, আনন্দ উৎসবে তার পিকলুদের বাড়ি আসা চাইই।

তা সে আসুক না। তাতে তো পিকলুর কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু যে দিন থেকে উনি পিকলুর জীবনে হস্তক্ষেপ করা শুরু করলেন গোলটা সেদিন থেকেই বাঁধা শুরু হল।

আসলে হয়েছেটা কি, পিকলু পড়াশোনায় তেমন আহামরি কিছু নয়। বলা ভালো মধ্যম মানের ছাত্র। অবশ্য প্রতি বছর ভালোভাবেই পাশ করে যায়। পিকলুর অভিভাবকরা যে এতে খুব একটা অখুশি ছিলেন তেমন কিন্তু না। তারা কোনোদিনই তাকে প্রথম দ্বিতীয় হওয়ার জন্য বা নব্বই শতাংশ নম্বর পাওয়ার জন্য চাপ দেননি। তাই পিকলুও দিব্বি হাল্কা চালে জীবন কাটাছিল। স্কুল টিউশনের সাথে সাথে খেলাধুলো, তিস্তা স্পারে সাইকেল চালানো, বন্ধুদের সাথে আড্ডা… সবই চলছিল জমিয়ে। কিন্তু ওই ভদ্রলোক আসা ইস্তক সবটা কেমন যেন পাল্টে গেল। কিসব ভুজুংভাজুং দিলেন পিকলুর মা বাবার মাথায় যে ওনারা রাতারাতি কেমন বদলে গেলেন! পড়াশোনা নিয়ে জোর কড়াকড়ি জারি হল। রবিবার ছাড়া ক্রিকেট, ফুটবলে পা ছোঁয়ান যাবে না, আড্ডাবাজি গল্পগুজব সব বন্ধ। মন দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে। অনেকগুন ভালো রেজাল্ট করতে হবে, এমন হাজারো নিয়মনীতি লাগু হল। 

ব্যাস পিকলুর পালকের মতো হাল্কা সুখময় জীবনটা ধীরে ধীরে লোহার মত ভারী আর দুখময় হয়ে উঠলো। আর এসবের কারন হিসেবে ভূবন কাকু তার চরম শত্রুতে পরিণত হল।

চটিদুটোকে ল্যাং মেরে রাস্তায় ফেলে দিল পিকলু। ভালো হবে যদি পাড়ার কুকুর কালু ওগুলোকে টেনে নিয়ে যায়। যাক এবার খালি পায়ে বাড়ি! 

পরক্ষনেই নিজের ভুল বুঝে চটিজোড়াকে কুড়িয়ে এনে আবার স্বস্থানে রেখে দিল। বলা যায় না, এই চটির অজুহাত দেখিয়ে যদি ওদের ঘরে দুদিন থেকে যান! 

            পা টিপে টিপে ঘরের ভেতর ঢুকলো পিকলু। আজ তার অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষার অংক খাতা বেরিয়েছে। মোটে বাষট্টি পেয়েছে সে। আগে হলে ততটা বকা হয়তো খেত না। তবে এখনকার পরিস্থিতি একদম ভিন্ন। এখন আবহাওয়া প্রতিকূল। যে কোন মুহূর্তে যা কিছু ঘটতে পারে।

ওই তো বসার ঘরে বসে আছে লোকটা। পা নাচিয়ে নাচিয়ে মামার সাথে গল্প করছে। গল্প তো নয়, উপদেশের ঝুড়ি। এত জায়গা ঘুরে ঘুরে যা কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে তা সব উগড়ে দেওয়া।

লুকিয়ে একবার ভেংচি কেটে দিল পিকলু। মাঝে মাঝে তার মনে হয় ভদ্রলোকের বোধহয় কোন গোপন জাদুশক্তি আছে। তা না হলে বেছে বেছে ঠিক তার খাতা বেরোনোর বা রেসাল্ট দেওয়ার দিনগুলোতেই কেন এ বাড়িতে আসেন! 

“কি হে পিকলু কুমার যে! স্কুল ছুটি হয়ে গেল?”

শুট শুট করে বসার ঘরের দরজা পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল পিকলু। ঠিক ধরা পড়ে গেল। দেঁতো হাসি হেসে উত্তর দিল সে,

“ হ্যাঁ এই যে… আমি ব্যাগ রেখে আসি পরে কথা বলছি”

“দাঁড়াও দাঁড়াও। তোমার মা বলছিলেন যে ভূগোলে নাকি তোমার মোটেই ভালো নম্বর হয়নি? ছোট প্রশ্নের উত্তরগুলো নাকি সবই ভুল দিয়েছ?”

অন্তরাত্মা অবধি জ্বলে উঠলো পিকলুর। মায়ের কি দরকার ছিল এনাকে সবকিছু বলার। মাস ছয়েক আগে ক্লাস ফাইভের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর সময় কত না খারাপ কথা শুনিয়েছে ওই লোকটা। তখন সবে সবে তার এবাড়িতে আসা যাওয়া শুরু হয়েছিল। বাহাত্তর শতাংশ নম্বর পেয়ে নতুন ক্লাসে উঠেছিল সে। নিজের নম্বরে মোটেই অখুশি ছিল না। কিন্তু ভূবন কাকু এমনভাবে কথা বলতে শুরু করে দিলেন, মনে হল সে বোধহয় ফেলই করে গেছে। 

        “শোন শোন এখানে এসে বস। এসব তো ভালো কথা নয়। সবে ক্লাস সিক্স। এখনই যদি ভিত্তিটা মজবুত না করে নিতে পারো, তাহলে কি করে হবে…”

পিকলুর আর নিজের ঘরে যাওয়া হল না। নিমের পাচন খাওয়ার মত মুখ করে বসে পড়ল ভূবন কাকুর পাশে। অবিরাম জ্ঞানবানীর বর্ষণে যথেষ্ট অসহায়বোধ করছিল সে আর তাকে আরও অসহায় করে দিয়ে মামা মোক্ষম প্রশ্নটা করেই ফেলল,

“কি রে পিকলু, আজ তোর কোনো খাতা বেরোয়নি?”

ব্যাস হয়ে গেল! পিকলুকে এবার অংক খাতার কথাটা বলতেই হবে। এই এক সমস্যা পিকলুর। মিথ্যে কথা সে মোটেই বলতে পারে না। কাওকে না। অনেক ঘনিষ্ট বন্ধুর সাথেও  অনেক সময় অশান্তি হয়ে গেছে কেবল এই একটা কারণে। 

এবারও তার অন্যথা হল না। চাপা স্বরে স্বীকার করে নিল অংক খাতা বেরোনোর কথা। সে যে মাত্র চুয়ান্ন পেয়েছে সে কথাও লুকিয়ে রাখতে পারল না। 

ব্যাস শুরু হয়ে গেল এলোপাথাড়ি বকুনি বর্ষণ। তার সাথে জ্ঞানগঙ্গাও প্রবাহিত হতে থাকলো। সকলের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হল বোধহয় সুনামি টুনামি গোছের কোন একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে গেছে। মা হায় হায় করে ছুটে এলেন রান্নাঘর থেকে, মামা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, আর ভূবন কাকু গভীর শোকে নিমজ্জিত হয়ে গেলেন। আর শুরু করলেন ওনার কীর্তিগাথা

“তোমার পরীক্ষার এই নম্বর শুনে আমার নিজের পরীক্ষার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। না আমি কোনদিনই কোন বিষয়ে চুয়ান্ন পাইনি। আর অংকে তো প্রতিবার ফুলমার্কস পাওয়া আমার রেকর্ড ছিল। আসল গল্পটা ওই চুয়ান্ন সংখ্যাটাকে নিয়ে। একবার ক্লাসের সবার একটা অংকের উত্তর তিপ্পান্ন এসেছিল। ওই যে তৈলাক্ত বাঁশ আর বাঁদরের ওঠানামা… ওই সংক্রান্তই একখানা অংক ছিল। স্যারও বলেদিলেন ওটাই সঠিক উত্তর। কেবল আমার উত্তর এল চুয়ান্ন। স্যারকে প্রায় চ্যালেঞ্জ করে বসলাম। উত্তরটা চুয়ান্নই হবে।  

স্যার অঙ্কটা দুবার করলেন দুবারই উত্তর তিপ্পান্ন এলো। কিন্তু আমি ওনাকে আরো একবার অংকটা করতে অনুরোধ করলাম। এবার উত্তরটা চুয়ান্নই এলো। আসলে ব্যাপারটা কি সবাই মাঝের ধাপগুলোতে দশমিকের পর একখানা সংখ্যা নিয়ে ক্যালকুলেশন করছিল, স্যারও। আমি দুটো সংখ্যা নিয়েছিলাম। একদম আ্যকিউরেট। তাই আল্টিমেট আনসারে এক বেশি আসছিল। ওটাই ছিল সঠিক উত্তর। স্যার খুশি হয়ে আমাকে সেদিন পাঁচ পাঁচখানা ইয়া বড়ো রাজভোগ খাইয়েছিলেন”

মা আর মামা আপ্লুত হয়ে গেল ভূবন কাকুর কেরামতি শুনে। এটা ওনার একশোখানা দোষের মধ্যে অন্যতম। নিজের বড়াই করতে বড্ড ভালোবাসেন তিনি। প্রতিটা বিষয়েই নাকি তার অগাধ জ্ঞান। আর সেই জ্ঞানের পরিচয় দিতে এমনই নানা রকম উদাহরণ দিয়ে থাকেন। কখনও বা ক্লাস নাইনে ইংরেজি বলে ইংরেজকে হারিয়ে দেওয়ার গল্প। কখনো নব্বইখানা যুদ্ধের সাল তারিখ একটানা বলে যাওয়ার গল্প। আরও কত কি…!

প্রায় আধ ঘন্টা ধরে চলল অনর্গল বকাঝকা, উপদেশ আদেশের পালা। এসব আজকাল অবশ্য পিকলুর অভ্যেস হয়ে গেছে। সেই গত বছর থেকে প্রতিটা পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর এমনটাই হয়ে আসছে। আর সত্যি বলতে কি, এসবের জন্যই পিকলুর আজকাল পড়াশোনার প্রতি কেমন যেন একটা ভীতি জন্মে গেছে। পড়তে বসলেই ভূবন কাকুর মুখটা মনে পড়ে, সকলের গালমন্দের কথা মনে পড়ে আর কেমন যেন কুঁকড়ে যায় ও। পড়াশোনায় ততটা ভালো না হলেও সেটা ওর কখনও অপছন্দের ছিল না। এখন যেন আর কিছুই ভালো লাগে না। জীবনটাই কেমন একটা বিভীষিকাময় হয়ে গেছে।

তবে এবার শুধু বকুনি দিয়েই ব্যাপারটা থেমে গেল না। তাকে রীতিমতো শাসানী দেওয়া হল। বাকি বিষয়গুলিতে প্রাপ্ৰনম্বর যদি আশানুরূপ না হয়, তবে আসছে পুজোর ছুটিতে পুরী যাওয়ার যে কথা হয়ে রয়েছে, তা বাতিল করে দেওয়া হবে। 

আর সত্যি সত্যি সেটাই হল। ইংরেজি, ইতিহাস, জীবনবিজ্ঞান কোনটাতেই ভালো নম্বর পেল না সে। আর তার পুরী যাওয়ার ইচ্ছেও পূরণ হল না। পিকলুর ধৈর্য্যর সীমা একটু একটু করে পেরিয়ে যাচ্ছে। রাগ আর হতাশা ওকে ঘিরে ধরছে। এই জীবনটা কি আর কখনো আগের মত হবে না? 

……..

থরথর করে কাঁপছে পিকলু। চোখ থেকে অবিরাম অশ্রু বয়ে চলেছে। অপরাধবোধে মাথা তুলে তাকাতেও পারছে না।

বাবা দরজাটা ভেঁজিয়ে দিলেন। বসার ঘরে এখন শুধু পিকলু আর তার বাবা। বাকিরা ভূবন কাকুকে নিয়ে পাড়ার ডাক্তারখানায় গেছে। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলেন উনি।

বাবা পিকলুর পাশ ঘেঁষে বসলেন। ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

“আমি জানি এটা তুই করেছিস। কিন্তু কেন পিকলু? তুই তো আমার তেমন ছেলে নোস?”

পিকলু কাঁদতে কাঁদতে বাবার কোলে মুখ গুঁজে দিল। প্রবল জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে অস্ফুটে বলে উঠলো..

“আমি আর পারছিলাম না বাপি। তোমরা সবাই কেমন পাল্টে গেলে…! সবটা ওনার জন্য। আমার পড়তে বসতেও ভয় লাগে…”

পিকলু অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছিল কোন একটা উপায় ভাবার। কোনভাবে যদি ঐ ভূবন কাকুর এ বাড়িতে আসা বন্ধ করা যায়…! সবকিছু নিশ্চয়ই আবার আগের মতো হয়ে যাবে। এটাই একমাত্র পথ তার মুক্তির। আর সেইজন্যই অনেক ভেবেচিন্তে এই উপায়টা বের করেছিল ও।

আজ ভাইফোঁটার দিন। পিকলুর মা ঠিক করেছিলেন স্বপনমামার সাথে সাথে ভবন কাকুকেও ফোঁটা দেবেন। আর তাই ঘটা করে খাবারদাবারের আয়োজন করে ওনাকে নেমন্তন্ন করেছিলেন। বাবাও কালীপূজায় ছুটি নিয়ে  বাড়িতে এসেছেন। জলপাইগুড়িতে অনেক বড় বড় কালীপূজা হয়। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সেসব মন্ডপের ঠাকুর দেখার মজাই আলাদা।

সকালে ফোঁটা দেওয়ার পর দুপুরে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হল। পাঁঠার মাংস, বেলাকোবার চমচম, বগুড়ার মিষ্টি দই…. এককথায় এলাহী আয়োজন। আর সব শেষে ভূবন কাকুর জন্য স্পেশাল মিষ্টি পান তো রয়েছেই। তবে শুধুই ওনার জন্য। এ বাড়ির আর কেউ যে পান মুখে দেয়না।

আর সেখানেই কান্ডটা ঘটিয়ে রেখেছিল পিকলু। পানের ভেতরের মশলা বের করে সেখানে ইঁট গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো আর কাঁকরের মিশ্রণ ভরে দিয়েছিল। 

ব্যাস, যেই না উনি পানটা মুখে পুড়েছেন ইঁটগুড়ি আর লঙ্কা গুঁড়ো গলায় আটকে কাশির দমকে দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কাঁকর দাঁতে পড়ে দাঁত নড়ে গেছে। মারাত্মক ব্যাথা… সে এক ভয়ংকর অবস্থা। 

মামা সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে তাকে পাড়ার ভবেশ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। বাবা, মাকেও তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছেন। হয়তো বা পিকলুর সাথে একলা কথা বলার জন্যই। 

সমীরণবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পিকলুর মুখটা তুলে ধরে বলে উঠলেন।

“ভীষন অন্যায় করেছিস তুই। কত বড় বিপদ হতে পারে বলতো! এটা একদম ঠিক হয়নি”

পিকলু ফোঁপাতে ফোঁপাতেই কান ধরল, “আর কখনও করব না বাপি, আর হবে না”

সমীরণেবাবু ওর হাত দুটো কান থেকে ছাড়িয়ে নরম করে ধরলেন। তারপর বললেন,

“তুই জানিস ভূবন কেন এরকম করে? কেন সবসময় তোর পড়াশোনার পেছনে পড়ে থাকে?”

পিকলু মাথা নাড়ল।

“ভূবনরা দুই ভাই ছিল। ও ত্রিভূবন ছোট আর ওর দাদা ভূষণ, ওর চেয়ে চার বছরের বড়। ওদের বাবা অনেক ছোটতেই মারা যান বাস আ্যক্সিডেন্টে। ওদের মা মানে আমার বিনু পিসি বহু কষ্টে সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন”

একটু থেমে আবার শুরু করলেন সমীরণবাবু,

“ভূষণ পড়াশোনায় দুর্দান্ত ছিল। সব বিষয়ে তুখোড়। তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল পিসির। উল্টোদিকে ভূবন একেবারেই বখে যাওয়া। সারাদিন মাঠে ঘাটে পড়ে থাকতো। এক দু বছর ফেলও করেছিল। পড়াশোনায় একদমই মন বসত না ওর”

পিকলু অবাক হয়ে গেল, “তাহলে ঐ গল্পগুলো?”

“ওগুলো সবই ভূষনের গল্প। ওর কীর্তি শুধু পিসি বা ভূবনের নয়, সারা পাড়ার মুখে মুখে ফিরত। আমিই ছাড়া আর কেউ এসব জানে না”

পিকলুর বাবা উঠে দাঁড়ালেন, “সবকিছু ঠিকই চলছিল। কিন্তু ওই যে বলে না কারোর কারোর ভাগ্যে সুখ লেখা থাকে না..! পিসিও সেই দলেই পড়ে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার মাস দেড়েক আগে মাত্র তিন দিনের জ্বরে ভূষণ মারা গেল। পিসি সেই শোক নিতে পারেননি। ওই ছেলেই যে ছিল তার সমস্ত আশা ভরসা। ওকে ঘিরেই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতেন উনি। অমন ছেলের হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। বাঁচার ইচ্ছেটাই হারিয়ে গেছিল। আর তাই ছ মাসের মধ্যে তিনিও…” 

গলাটা ধরে এলো সমীরণ বাবুর। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলে উঠলেন,

“দাদা, মা সবাই একে একে চলে যাওয়ার পর ভূবন একদম একা হয়ে গেল। পেট চালানোর দায়ে পড়াশোনাও বন্ধ করে দিতে হল। আমার বাবা বা অন্যান্য আত্মীয়দেরও তখন তেমন অবস্থা ছিল না যে কেউ ওর ভরন পোষনের দায়িত্ব নিতে পারবে। আর ওর তো তেমন মেধাও ছিল না। আমার বাবাই এক পরিচিত ট্যুর কোম্পানিতে ওকে কাজে ঢুকিয়ে দেন”

টেবিলের ওপর রাখা জলের বোতল থেকে গলা ভিজিয়ে নিলেন সমীরণ বাবু। 

“সেই থেকেই শুরু। তবে ওদের মৃত্যুটা ভূবনকে একেবারে পাল্টে দিল। বখাটে ছেলেটা ধীরে ধীরে দায়িত্ববান হয়ে উঠলো। আসলে কোথাও গিয়ে ওর নিজের উপরও একটা রাগ জন্মেছিল যে, কেন ও নিজের দাদার মতো হয়ে উঠতে চায়নি! তাহলে হয়তো পিসি ওর মুখের দিকে চেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করত। এভাবে শেষ হয়ে যেত না। আর তাই কাওকে পড়াশুনায় অমনোযোগী হতে দেখলেই ও অস্থির হয়ে ওঠে। তাকে ভালো করানোর জন্য প্রাণপণ চাপ দিতে থাকে”

পিকলুর খুব কষ্ট হচ্ছিল সব কথা শোনার পর। অজান্তে মানুষটার সঙ্গে বড় অন্যায় করে ফেলেছে সে। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল সে, হে মা কালি তুমি দেখো, কোন ক্ষতি যেন না হয়।

সমীরণবাবু পিকলুর সামনে এসে দাঁড়লেন। ওর চোখ দুটো মুছিয়ে বলে উঠলেন, “তবে ভুল আমাদেরও হয়েছে। এতটা চাপ তোর উপর দেওয়া ঠিক হয়নি। একটা চারাগাছকে সঠিকমাত্রায় রোদ্দুর না দিলে, খোলা বাতাসে না রাখলে শুধু জল আর সার দিলেই কি বড় হয়ে যাবে? খেলাধুলা, বন্ধুবান্ধব, গল্প আনন্দ…. এসবের কি কোন প্রয়োজন নেই! শোন, আমি তোকে কথা দিচ্ছি। তুই মন দিয়ে পরাশোনা কর। তোর ক্রিকেট ফুটবল, কিচ্ছুটি বন্ধ হবে না। সবকিছু একসাথেই চলবে”

পিকলু বাবার কথাগুলো পুরোটা হয়তো বুঝতে পারলো না। তবে শক্ত করে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। না, আজ থেকে সে মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। ভূবন কাকুর উপর আর কোন রাগ নেই ওর। ওনাকে আর বকাবকি করার কোন সুযোগই দেবে না সে। মনের মতো রেসাল্ট করে চমকে দেবে একেবারে।

এখন শুধু একটাই চিন্তা, বেচারার দাঁতগুলো আদৌ টিকবে তো! কাঁকরের আঘাতে ওগুলো না পড়ে যায়।

দন্তবিহীন ভূবন কাকুর মুখখানা কেমন দেখতে লাগবে সেটা ভেবে এত মনখারাপের মধ্যেও ফিক করে হেসে ফেলল পিকলু।