গল্প ২ । কার্ত্তিক ১৪৩২



অর্জুন ও অন্যান্য ঝামেলা 











পিনাকী রঞ্জন পাল

জলপাইগুড়ি, পশ্চিম বঙ্গ


 

জলপাইগুড়ির সেদিনের দিনটা ছিল ছিমছাম আর নরম রোদে ভরা। এখনকার মতো উঁচু উঁচু দালান বা পিচের মসৃণ রাস্তা তখন ছিল না। শহরের বেশিরভাগ বাড়ি ছিল টিনের চাল আর বাঁশের বেড়ার। রাস্তা ছিল কাঁচা, লাল ধুলো উড়ত, আর মানুষজন চলাফেরা করত ঢিমেতালে।

এইরকমই একটা শান্ত পাড়ার বাসিন্দা ছিল কমল। বয়স তার আট কি নয়, আর মনটা কাঁচের মতো স্বচ্ছ। তার বাবা, অমলবাবু, পেশায় ছিলেন ছোটখাটো ব্যবসায়ী

এক সন্ধে বেলা, অমলবাবু হাট থেকে ফিরলেন। তার সাইকেলের ক্যারিয়ারে একটা বড় থলে, আর তার মধ্যে থেকে 'কক-কক' শব্দ আসছে। কমল আর তার মা বিমলা দেবী উৎসুক হয়ে তাকাতেই অমলবাবু বললেন, "আজ একটা চমৎকার জিনিস পেয়েছি। একেবারে সস্তায়। কালকে মোরগের ঝোল হবে, বুঝলি!"

কমল দৌড়ে গেল থলের কাছে। থলের মুখ খুলতেই উঁকি দিল একজোড়া ছোট্ট কালো চোখ। তার সারা শরীর কুচকুচে কালো পালকে ঢাকা, যেন অন্ধকার রাতের এক টুকরো। আর মাথার উপর টকটকে লাল ঝুঁটি, যা দেখলে মনে হয় সদ্য ওঠা সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়েছে। কমল থলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মোরগছানাটাকে বের করে আনল। অমলবাবু বললেন, "আহা, ওটাকে ছুঁস না। কালকে ও তোর পেটে গিয়ে..."

কিন্তু কমলের চোখে তখন অন্য জগৎ। সে মোরগটাকে বুকে জড়িয়ে বলল, "ওকে কিচ্ছু করা যাবে না, বাবা। ও আমার বন্ধু।"

অমলবাবু তো অবাক। "কিসের বন্ধু? মোরগ হল খাবার জিনিস, পোষা হয় না।"

বিমলা দেবীও বললেন, "হ্যাঁ রে কমল, ওটা তো কালকে আমাদের দুপুরের মেনু।"

কিন্তু কমলের জেদের কাছে বাবা-মা দু'জনেই হার মানলেন। সে কিছুতেই রাজি নয়। সে মুখের কোণে একরাশ মেঘ জমিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অমল-বিমলার একমাত্র সন্তান কমল। তার মন খারাপ থাকলে যেন গোটা বাড়িতেই বিষণ্ণতা নেমে আসে। শেষে অমলবাবু মাথা নেড়ে বললেন, "আচ্ছা বাবা, তোর কথাই থাকল। ও তোর পোষ্য।"

কমল খুশিতে লাফিয়ে উঠল। সে মোরগটিকে নাম দিল অর্জুন। "অর্জুন কেন?" জিজ্ঞাসা করল বিমলা দেবী। কমল বলল, "ওর চালচলনটা বেশ বীরের মতো। ওর চোখ দুটো দেখলে মনে হয় ও খুব সাহসী।"

এভাবেই অর্জুন হয়ে উঠল তাদের পরিবারের সদস্য। কমল স্কুল থেকে ফিরেই দেখত অর্জুন বাড়ির উঠোনে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সারাদিন সে উঠোনে ঘুরে বেড়াতো, কখনও বাগানের কাদা মাটি খুঁটে পোকা খুঁজে খেত, আবার কখনও বা কমলের পায়ের কাছে এসে ঘুরঘুর করত। অর্জুনকে দেখে পাড়ার লোকেরা হাসাহাসি করত। "অমল, মোরগ পুষেছিস নাকি?" জিজ্ঞাসা করত কেউ কেউ। অমলবাবু মুচকি হেসে বলতেন, "আমার ছেলের নতুন বন্ধু।"

দিনের পর দিন পেরিয়ে গেল। অর্জুন ছোট থেকে বড় হল, আর তার রূপটাও খুলল। দশাসই চেহারা, বিশাল ঝুঁটি আর চকচকে কালো পালক নিয়ে সে যখন উঠোনে বুক ফুলিয়ে হাঁটত, তাকে দেখলে আর কেউ মোরগ বলতে সাহস করত না। সে হয়ে উঠেছিল যেন বাড়ির একজন প্রহরী। কিন্তু এই বীরত্বই যে একদিন কাল হবে, তা তখন কেউ বুঝতেই পারেনি। অর্জুনের স্বভাবে অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করল। আর সেই পরিবর্তনগুলোই একসময় তাদের শান্ত জীবনে একের পর এক ঝড় নিয়ে আসতে শুরু করল

*****

অর্জুন এখন আর সেই ছোট্ট মোরগছানাটি নেই। সে পুরোপুরি দশাসই এক যুবকে পরিণত হয়েছে। তার কালো পালকগুলোতে এখন এক অদ্ভুত শৌর্য। যখন সে উঠোনে হেঁটে বেড়ায়, তার চলনে এক ধরনের দাপট থাকে। ঝুঁটিটা লাল টকটকে হয়ে উঠেছে, আর তার ডাক শুনলে আশেপাশের মোরগগুলো ভয়ে সিঁটিয়ে যায়

অর্জুনের এই বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তার মধ্যে এক নতুন শখ দেখা গেল। সে শুধু বাগানের পোকা-মাকড় খুঁটে খেয়েই সন্তুষ্ট থাকে না, তার মধ্যে এক অনুসন্ধানী কৌতূহল জেগে উঠেছে। সে বাড়ির পেছনের ঝোপঝাড় আর নালাগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ত, যেন কোনও এক গুপ্তধনের সন্ধানে বেরিয়েছে। কমলও তার পিছন পিছন যেত, কিন্তু অর্জুনের এই নতুন খেলার ধরন দেখে সেও খানিকটা অবাক

ব্যাপারটা প্রথম চোখে পড়ল বিমলা দেবীর। তিনি একদিন দুপুরের দিকে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেন, অর্জুন তার ঠোঁটে করে কী একটা কালো লম্বা জিনিস নিয়ে উঠোনে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রথমে তিনি ভাবলেন, হয়তো বড় কোনও কেঁচো হবে। কিন্তু একটু ভালো করে তাকাতেই তার রক্ত হিম হয়ে গেল। ওটা কোনও কেঁচো নয়, ওটা একটা সরু নির্বিষ সাপ! অর্জুন সেটাকে ঠোঁটে ধরে মাটিতে ফেলছে, আবার সেটা যখন পালানোর চেষ্টা করছে, তখন ঠোঁক দিয়ে ঠুকরে তাকে থামিয়ে দিচ্ছে। যেন সাপটার সাথে মোরগটা এক অদ্ভুত খেলা খেলছে

বিমলা দেবী ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন, "ওমা গো, মোরগটা সাপ ধরে এনে খেলছে!"

অমলবাবু ছুটে এলেন। তিনিও এই দৃশ্য দেখে হতবাক। কমল হাসিমুখে বলল, "মা, অর্জুন তো খুব বাহাদুর! ও সাপ ধরে খেলে।"

কিন্তু বাহাদুরির এই খেলা একদিন এক চরম পরিস্থিতিতে পড়ল। সেদিন দুপুরে সবাই খেতে বসেছে, এমন সময় রান্নাঘরে বিমলা দেবী জল আনতে গিয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তাঁর চিৎকার শুনে কমল, অমলবাবু এবং পাড়ার লোকজন সবাই ছুটে এল। দেখা গেল, রান্নাঘরের এক কোণে, ঠিক বিমলা দেবীর পায়ের কাছে, সেই নির্বিষ সাপটা চুপচাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে

খবরটা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তেই হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। পাড়ার এক বুড়ো লোক বলল, "অমল, ওই মোরগটাকে বিক্রি করে দাও। ওটা ভূতে পাওয়া মোরগ। নয়তো কি মোরগ কখনও সাপ ধরে বাড়িতে আনে?"

অমলবাবু খুব বিব্রত হলেন। তিনি অর্জুনকে দেখতে লাগলেন। অর্জুন তখন উঠোনে বুক ফুলিয়ে পায়চারি করছে, যেন কিছুই হয়নি। তার চোখে-মুখে এক ধরনের অদ্ভুত কৌতুক আর বীরত্ব মিশে আছে। কমল তবুও অর্জুনের পক্ষ নিয়ে বলল, "বাবা, অর্জুন তো সাপটাকে মেরে ফেলেনি। ও তো শুধু খেলে।"

কিন্তু কমলের কথা তখন কেউ শুনতে রাজি নয়। পাড়ার লোকজনের ফিসফিসানি আর ভয় অমলবাবুকে চিন্তায় ফেলে দিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই সমস্যাটা কেবল একটা মোরগের দুষ্টুমি নয়, এটা ধীরে ধীরে তাদের পরিবারের একটা দুর্নামের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্জুন যে তার নিজের অজান্তেই বাড়ির জন্য কী মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছে, তা তখন সে নিজেই জানে না। আর এই সমস্যার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো যখন অর্জুন তার বীরত্ব বাড়ির বাইরে দেখাতে শুরু করল...

*****

অর্জুনের সাপ নিয়ে খেলার শখটা ধীরে ধীরে এক পুরনো খবর হয়ে গেল। কারণ তার নতুন কীর্তি সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল। অর্জুনের বীরত্ব এখন আর বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সে তার রণক্ষেত্র বাড়িয়ে নিয়েছে বাড়ির বাইরের রাস্তায়

          কমলরা তখন নতুন করে বাড়ির চারপাশে একটা কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। কিন্তু অর্জুন তার ফাঁকফোঁকর ঠিকই খুঁজে নিত। সে যখনই দেখত বাইরের রাস্তায় কোনো মানুষ তার অপছন্দের ঢংয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তখনই তার মাথা গরম হয়ে উঠত। তার ওই একচোখো বিচারপদ্ধতি ছিল, যাকে তার ভালো লাগত না, তার পায়ে ঠোকর দিয়ে আসাটা তার নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল

প্রথম দিকে ব্যাপারটা হালকাভাবে নিলেও, ধীরে ধীরে তা এক মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। পাড়ার সাইকেল আরোহীরা তো অর্জুনের ভয়ে তটস্থ থাকত। যেই অর্জুনকে দেখতে পেত, ওমনি গতি বাড়িয়ে দিত। অর্জুনও দাপটে ছুটে যেত তাদের পেছনে। একদিন তো এক সাইকেল আরোহী অর্জুনের তাড়া খেয়ে সোজা গর্তে পড়ে গেলেন

স্কুলের মাস্টারমশাই গোপালবাবু একদিন কমলদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। অর্জুন তাকে দেখে ঠোঁক মারতে ছুটে গেল। গোপালবাবু বাঁচার জন্য তার হাতের ছাতাটা দিয়ে অর্জুনকে তাড়াতে চেষ্টা করলেন। অর্জুনও ছাড়বার পাত্র নয়। সে ছাতায় ঠুকরে ঠুকরে তাকে অস্থির করে তুলল। শেষে গোপালবাবু রেগে গিয়ে অমলবাবুকে বললেন, "অমল, তোমার মোরগটা তো দেখি একটা গুণ্ডা! ওর কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই?"

অমলবাবু লজ্জায় মাথা হেঁট করে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিপদটা ঘটল যখন পুরোহিত মশাই তাদের বাড়িতে পুজো দিতে যাচ্ছিলেন। সাদা ধুতি আর খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। অর্জুন তার সেই সাদা পোশাকে কী এমন দোষ খুঁজে পেল কে জানে! সে সটান ছুটে গিয়ে পুরোহিত মশাইয়ের পায়ের বুড়ো আঙুলে ঠুকরে দিল। পুরোহিত মশাই 'উফফ' করে এক চিলতে চেঁচিয়ে উঠলেন এবং রেগে গিয়ে বললেন, "এই অসভ্য মোরগটা কি তোমার বাড়ির?"

          কমল বারবার অর্জুনকে বোঝাতে চেষ্টা করত, "অর্জুন, এটা করো না, ওটা করো না।" কিন্তু অর্জুন কমলের কথা শুনত না। তার নিজের রাজত্বে সে-ই রাজা, আর সে-ই আইন। পাড়া থেকে রোজ অমলবাবুর কাছে অভিযোগ আসতে লাগল। "অমলদা, আপনার মোরগটা আমার ছেলেকে তাড়া করেছে।" "অমল, তোমার মোরগের জন্য আজ আমি বাজার যেতে পারিনি।"

এইসব অভিযোগের চাপ অমলবাবুর কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। তিনি অর্জুনের দিকে তাকিয়ে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অর্জুন তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে, মাথা উঁচু করে। তার চোখে-মুখে কোনো অনুশোচনা নেই, আছে শুধু এক বিজয়ীর গর্ব। অমলবাবু বুঝলেন, এই সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। অর্জুনের এই অদ্ভুত স্বভাবের জন্য পুরো পাড়ার মানুষ তাদের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকাচ্ছে। একটা মোরগ যে তাদের সামাজিক জীবনে এমন একটা বিপর্যয় ঘটিয়ে দেবে, তা তিনি ভাবতেই পারেননি। অমলবাবু একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। খুব কঠিন। 

 *****

একদিন সন্ধ্যায় তিনি কমলকে ডেকে বললেন, “বাবা, অর্জুনকে আর রাখা যাবে না।কমল যেন বোবা হয়ে গেল। তার চোখের সামনে অর্জুনের সব দুষ্টুমি আর ভালোভাসার স্মৃতি ভেসে উঠল। সে জোর করে বলল, “কেন বাবা? অর্জুন কী করেছে?”

কী করেছে?” অমলবাবু যেন অসহায় হয়ে পড়লেন।ও যে গোটা পাড়ার মানুষের রাতের ঘুম কেড়েছে। ও আমাদের বাড়ির দিকে সবার আঙুল উঁচিয়ে রেখেছে। আর এভাবে চলতে পারে না।

কমল সেদিন রাতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন সকালে সে অর্জুনকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করল। বাড়ির খাটের নিচে, আলমারির পেছনে, এমনকি উঠোনের ঝোপের মধ্যে। কিন্তু অর্জুন তার নিজের জগতে মত্ত, সে এসবের কিছুই বোঝে না। কমল বারবার অর্জুনকে দেখতে লাগল, মনে মনে ভাবল, “আর তো কটা দিন, তারপর আমি অর্জুনকে ঠিক রেখে দেব।

কিন্তু কমলের পরিকল্পনা ব্যর্থ হল। এক মেঘলা সকালে, যখন কমলের মনটা ভার, অমলবাবু চুপচাপ অর্জুনকে একটা বড় ব্যাগের মধ্যে ভরে ফেললেন। কমল ছুটে এলো, “বাবা, না, অর্জুনকে নিয়ে যেও না!

অমলবাবুও কমলের কষ্ট দেখে চোখে জল লুকিয়ে ফেললেন। তিনি জানতেন, এই কষ্টটা তার নিজেরও। অর্জুনের সাথে যে তাদেরও একটা অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তবুও কঠিন মুখে তিনি বললেন, “ওর ভালো হবে, কমল। ওর নিজের মতো একটা জায়গা দরকার।

সাইকেলে করে অর্জুনকে নিয়ে অমলবাবু চললেন সেই গৌরিহাটের দিকে, যেখান থেকে তিনি একদিন ওকে কিনে এনেছিলেন। হাটের পথে যেতে যেতে তিনি ভাবছিলেন, তিনি অর্জুনকে কোথায় বিক্রি করবেন? কসাইয়ের হাতে তুলে দেবেন? নাহ! যে মোরগ তার ছেলের বন্ধু, তাকে তিনি কোনোদিনও মাংস হিসেবে বিক্রি করতে পারবেন না

হাটে পৌঁছে তিনি একজন এমন ক্রেতা খুঁজতে লাগলেন, যিনি অর্জুনকে পোষার জন্য কিনবেন, খাওয়ার জন্য নয়। অবশেষে এক দাড়িওয়ালা, লম্বা-চওড়া লোকের সাথে তার দেখা হল। তিনি অর্জুনের বীরত্ব দেখে মুগ্ধ হলেন। তিনি বললেন, “এই মোরগকে আমি পুষব। আর আমার মোরগ লড়াইয়ে খেলানোর একটা শখ আছে। তাতে মোরগটা আরও বড় বীর হয়ে উঠবে।

অমলবাবু একটু ইতস্তত করলেন, কিন্তু অন্য কোনো উপায় ছিল না। তিনি সেই লোকটার হাতে অর্জুনকে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। তার মনটা ভার। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তিনি শুধু একটি মোরগকে বিক্রি করে দেননি, তিনি যেন কমলের আনন্দের একটা অংশকেও বিক্রি করে এসেছেন। 

 *****

অর্জুনের নতুন মালিকের নাম ছিল বিশুচরণ। তিনি পেশায় একজন মোরগ লড়িয়ে এবং তার কাছে অনেক মোরগ আছে, যারা শুধু লড়ার জন্যই জন্ম নিয়েছে। অর্জুনকে যখন প্রথম বিশুচরণের ঝাঁ-চকচকে মোরগ লড়ার আখড়ায় আনা হলো, তখন তার মনটা ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল। চারদিকে এত মোরগ, এত কোলাহল! অর্জুনের চেনা শান্ত জলপাইগুড়ির পরিবেশ থেকে এ যেন সম্পূর্ণ আলাদা এক পৃথিবী

প্রথম কয়েকটা দিন অর্জুন খাঁচার এক কোণে চুপচাপ বসে থাকত। অন্য মোরগগুলো তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাত, যেন এই নতুন সদস্যের রণকৌশল সম্পর্কে জানতে চাইছে। বিশুচরণ অর্জুনের দিকে মনোযোগ দিলেন। তিনি অর্জুনের বীরত্ব আর বলিষ্ঠ শরীর দেখে বুঝতে পারলেন, এই মোরগের মধ্যে কিছু একটা আছে

একদিন বিশুচরণ অর্জুনকে একটি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করলেন। সামনে তার চেয়েও বড়, আরও শক্তিশালী একটি মোরগ। তার নাম ছিল 'কালা পাহাড়'কালা পাহাড়ের চোখে ছিল আগুন, আর তার ঠোঁটে ছিল বিজয়ের অহংকার। অর্জুন প্রথমে ভয় পেয়ে গেল। সে পেছিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু বিশুচরণ তাকে লড়াইয়ে নামিয়ে দিলেন

লড়াই শুরু হলো। কালা পাহাড় এক ঝটকায় অর্জুনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অর্জুন তখন কেবলই আত্মরক্ষা করছিল, ঠোকর মারার কথা তার মাথায় আসেনি। হঠাৎ যেন তার কানে কমলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, "অর্জুন, তুমি তো খুব বাহাদুর!" এই কথাতেই অর্জুনের ভেতর থেকে তার আসল সত্তাটা জেগে উঠল

সে আর ভয় পেল না। সে তার মাথা উঁচু করে দাঁড়াল, আর কালা পাহাড়ের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অর্জুনের ঠোঁট ছিল অন্য মোরগদের থেকে আলাদা, অনেকটা নিখুঁত নিশানার মতো। সে ঠোকর মেরে কালা পাহাড়কে হতভম্ব করে দিল। এরপর সে তার পা ও ডানা ব্যবহার করে এমনভাবে কালা পাহাড়কে ছ্যাঁকা দিতে লাগল যে, কালা পাহাড় দিশেহারা হয়ে গেল। দর্শকরা অর্জুনের এই নতুন ধরণ দেখে হাততালি দিয়ে উঠল

অর্জুনের জয় হলো। বিশুচরণ আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন, "এ তো মোরগ নয়, এ তো সাক্ষাৎ অর্জুন!"

এরপর অর্জুনকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সে একটার পর একটা লড়াই জিততে লাগল। তার লড়ার ধরণ ছিল অনন্য। সে শুধু ঠোঁক মারত না, সে তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রতিপক্ষকে কাবু করত। একসময় অর্জুন মোরগ লড়াইয়ের মাঠে একজন কিংবদন্তি হয়ে উঠল। তার নাম শুনলেই প্রতিপক্ষ মোরগরা কেঁপে উঠত। 

 

*****

 

অর্জুন এখন শুধু একজন লড়াকু মোরগ নয়, এক কিংবদন্তি। বিশুচরণের কাছে তার গুরুত্ব অনেক। তিনি অর্জুনকে নিয়ে খুব গর্বিত। কিন্তু অর্জুনের মনে তখনও যেন সেই পুরোনো বাড়ির মায়া লেগে ছিল। সেই শান্ত উঠোন, কমলের গলা, বিমলা দেবীর হাতের পোলাও - এসবের স্মৃতি তাকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়

একদিন এক বিশাল লড়াইয়ের আয়োজন করা হলো। প্রতিপক্ষ ছিল এক বিরাট আকারের মোরগ, যার নাম ছিল 'বাজ বাহাদুর'তার ওজন এবং শক্তি অর্জুনের চেয়ে অনেক বেশি। লড়াই শুরু হলো। অর্জুন তার চিরাচরিত রণকৌশল ব্যবহার করে ঠোক্কর মারতে শুরু করল, কিন্তু বাজ বাহাদুর তাকে তার বিরাট ঠ্যাং দিয়ে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিল। অর্জুনের একটি ঠ্যাং সামান্য আহত হলো। সেই মুহূর্তেই, অর্জুন যেন হঠাৎ করে এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিল। সে আর লড়াই করল না, সে লাফ দিয়ে সোজা বাউন্ডারির বাইরে চলে গেল

          সবাই অবাক হয়ে গেল। বিশুচরণ রেগে চিৎকার করে বললেন, "অর্জুন পালিয়েছে! আমার সেরা মোরগ হার মেনেছে!" দর্শক এবং বিশুচরণ সবাই অর্জুনকে কাপুরুষ ভাবল। কিন্তু অর্জুন তখন এক অন্যরকম মিশনে বেরিয়ে পড়েছে। তার আহত ঠ্যাং নিয়ে সে ছুটতে লাগল, তার একমাত্র গন্তব্য সেই পুরোনো বাড়ি, যেখানে তার প্রাণ জুড়িয়েছিল

তিন দিন পর, জলপাইগুড়ির শান্তপাড়ায় এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। কমল তার উঠোনে খেলছিল, এমন সময় সে দেখল, একটা কালো মোরগ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ির দিকে আসছে। তার শরীর ক্লান্ত, পালকগুলো ধুলোয় মাখা, আর একটি ঠ্যাং সামান্য হেলানো। কমল প্রথমে চিনতে পারল না। কিন্তু মোরগটা যেই তার দিকে তাকাল, কমল বুঝতে পারল, এটা তারই অর্জুন

কমল বিস্ময়ে থ হয়ে গেল। তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। সে দৌড়ে গিয়ে অর্জুনকে কোলে তুলে নিল। তখন পাশেই তার পাশের বাড়ির বোন রেণু খেলতে এসেছিল। রেণু অর্জুনকে দেখে অবাক হয়ে বলল, "দাদা, এ যে তোমাদের বাড়ির অর্জুনবাবু! ও কি ফিরে এসেছে?"

কমল হাসল। সেই হাসিটা ছিল এক বিজয়ের হাসি, এক ভালোবাসার হাসি। অর্জুন তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মাথা উঁচু করে, যেমন করে সে আগে দাঁড়াত। তার ঠ্যাংয়ে আঘাত ছিল, শরীরে ক্লান্তি ছিল, কিন্তু তার চোখে ছিল এক বিজয়ীর ঔজ্জ্বল্য। সে যেন নিজের জীবনে আবার ফিরে এসেছে। সে প্রমাণ করল, সত্যিকারের বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা দিয়ে গড়া বাড়িই তার আসল রণক্ষেত্র। সেখানে কোনো লড়াইয়ের প্রয়োজন নেই, শুধু ভালোবাসার প্রয়োজন

অর্জুন যে শুধু মোরগ ছিল না, সে ছিল কমলের বন্ধু, পরিবারের সদস্য এবং সবার উপরে একজন বীর, যে জীবনের শ্রেষ্ঠ লড়াইটা জিতে ফিরে এসেছিল তার নিজের ঘরে। এইভাবেই অর্জুন আর তার ঝামেলাগুলো শেষ হল, কিন্তু থেকে গেল এক মানবিক বন্ধনের গল্প, যা সবার মনে এক আলাদা জায়গা করে নিল