শীতের সকাল। রোদের আকাল। কুয়াশা কাটেনি। ঘষা কাচ কুয়াশা। সূযযিঠাকুর সেই কুয়াশার আড়ালে। আবছা আলোর সকাল। ফাঁকা নদীর চর।
নদীর চরে আলসে বুড়ো কুমীর।
সে জানে, তার দাদুর দাদু রবি ঠাকুরের গল্পে আছে। কুমীর জল থেকে উঠেছে
সেই। এখনও তার গায়ের জল শুকোয়নি। সেও রোদ পোহানোর চেষ্টায়। মিঠে রোদের দেখা নেই।
শীতের নদীতে জল কম। সে জল বেজায় ঠাণ্ডা। তাই সেই জলে থাকতে বুড়ো কুমীর নারাজ। এমনি
করেই সময় খানিক কাটায় কুমীর। পিটপিটে চোখে তাকায় পুবের পানে। বুঝতে পারে, সূযযিঠাকুর আছে। কুয়াশার আড়ালে। কুয়াশা চাদর ছিঁড়ে বেরিয়ে
আসতে পারছেনা। বেরোতে হয়তো দেরি হতেপারে।
রোদের ওম এখন বাড়েনি। একটু
পরে রোদ খানিকটা গায়ে লাগার মতো হয়ে উঠতে পারে। উত্তুরে হাওয়ার দাপট তেমন নেই।
তবুও শীতটা জাঁকিয়ে পড়েছে। গাঁয়ের লোকজন এখনও নদী কিনারে তেমন কেউ আসেনি। বেশ
নিঝুম ঠাণ্ডা সকাল। কয়েকটা পাখি নদীর চরের গাছে ওড়াউড়িতে ব্যস্ত। তাদের আপন খেয়ালে
ওড়াউড়ি চোখ পিটপিটিয়ে দেখতে থাকে বুড়ো কুমীর। কাল খানিক খাবার পেটে পড়েছিল। এখন
খিদে পাচ্ছে। এতো ঠাণ্ডায় খাবার ধরার ইচ্ছেটা করছেনা।
বুঁচি বেদেনি জানে, সে রবি ঠাকুরের গল্পের কাঁচি বেদেনির নাতনির নাতনি। তার
দারুন সাহস। সে তার ছাগল নিয়ে নামে। নদীর পাড় থেকে। অল্প ঢালু পাড়। মা-ছাগল তার
ছানাদের সাথে নামে। সামান্য ঘাসচটি। পাশে একটা ঝাঁকড়া ঝোপ। সেখানেই ছাগলের গোঁজটা
পোঁতে বুঁচি। বুঝে নেয় তার ছাগলের এবেলার খাবার এখানেই জুটে যাবে। ঘরে গিয়ে এখনও
তার অনেক বাকি কাজ সারার আছে। তার ছেলেটাও ঘুম থেকে ওঠেনি। উঠে পড়তে পারে। তাই
বুঁচির ঘরে যাওয়ার তাড়া। সে দেরি করেনা। ঘরের দিকে হাঁটাদেয়। মা-ছাগলের তিনটে ছানা
তিড়িংবিড়িং করে খুশিতে লাফাতে থাকে। তাদের মা একটা শব্দকরে প্যাঁ…। তাতেই তারা
বুঝতে পারে, তাদের মায়ের নির্দেশ, দূরে যেতে মানা। তারা নরম
বালির উপর লাফাতেই থাকে। কচি পায়ে তাদের এখন অনেক চঞ্চলতা। তাদের তিড়িং বিড়িং
লাফানো চলতেই থাকে। লাফাতে লাফাতে পৌঁছায় বুড়ো কুমীরে কাছে। তারা খুশির লাফালাফিতে
বুঝতেই পারেনা, কাছেই একটা বুড়ো কুমীর চুপটিকরে শুয়ে।
ছানা তিনটে ভাবে, এটা বোধহয় পুরানো নৌকা। তারা কুমীরের পিঠে চড়ে। আবার নামে।
আবার চড়ে, লাফিয়ে নামে। তাদের ওঠা নামার খেলা চলতেই থাকে। কুমীর
পিটপিটিয়ে দেখে তাদের খেলা। তাদের খেলা ভালোই লাগে। পিঠে সামান্য সুড়সুড়িটাও তার
ভালোলাগে। ওঠা নামা তাদের থামেনা। খানিক পরে তাদের খেলায় বিরতি আনে। একসময় কুয়াশা
আগল ফুরিয়ে যায়। রোদের তাপ বাতাসে চুঁইয়ে পড়ে। তারা সবাই কুমীরের পিঠে শুয়েপড়ে।
তারাও মিঠে রোদের তাপকে বুঝে নিতে চায়। তাদের দু’জন কুমীরের
পিঠে শুয়ে রোদ পোয়াতে থাকে। একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ে। অন্য ছাগল ছানার লাফালাফি চলতেই
থাকে। তার অন্য দুই সঙ্গীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় না। একসময় সেও কুমীরের পিঠে ঘুমিয়ে
পড়ে।
মিষ্টি রোদের হাসি ছড়ায়।
চারদিক আলোয় আলো। বুড়ো কুমীর টেরপায় রোদের মিঠে তাপ। সে চোখবুজে মিঠে তাপের ওম
নিতে থাকে। মনেমনে সুযযি ঠাকুরকে ধন্যবাদ জানায়। এদিকে বুড়ো কুমীরের খিদে পায়।
উল্টোপারে নদীর পাড়ের নিচে তার গর্তবাসা। সেখানে কিছু বাসি খাবার আছে। জলে নামলে ঠাণ্ডা
লাগার ভয়। তাই ওপারে যাওয়ার ইচ্ছে মোটেই নেই। অনেক কষ্টে শরীরে খানিক আরাম। সে
আরাম ফুরিয়ে ফেলতে সে অরাজি। অগত্যা খিদে সহ্য করেই পড়ে থাকে।
এদিকে খিদের তাড়না বাড়তে
থাকে। কিছু না খেলেই নয়। তার পিঠের উপরেই সামান্য খাবার আছে। খাবারগুলো আরামের
ঘুমে। কুমীর ভাবে, ঘুম থেকে এদের জাগানো চলবেনা। চুপিচুপি খুব ধীরে নদীর জলে
নামা দরকার। জলে নেমেই ছাগলছানাদের জলে ফেলতে হবে। তাহলে ওরা সাঁতার শুরু করার
সময়েই গপাগপ মুখে পোরা যাবে। মিষ্টি চিন্তায় কুমীর বুঁদ। ব্রেকফাস্টে খাবার কম
হলেও, বেশ নরম স্বাদু খাবার আজ তার বরাতে আছেই।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। খুব
ধীর পায়ে, কম নড়াচড়ায় সে হাঁটতে শুরুকরে। পাছে ছাগলছানারা জেগে ওঠে।
এমনকি চরের বালিতে তার পায়ের আওয়াজ ওঠেনা। এদিকে মা-ছাগল খাওয়ায় ব্যস্ত। সামান্য
ঘাস আগেই খাওয়া শেষ। পাশের ঝাঁকড়া ঝোপের উপর পা ওঠায়। মাথা উঁচিয়ে ঝোপের গাছের
পাতা চিবোতে থাকে। পেট ভরানোর সময় তার ছানাদের খেয়াল থাকেনা। এবার তার পেট প্রায়
ভর্তি। একটু জল খাওয়ার দরকার। কিন্তু সেতো খোঁটা বা গোঁজের সাথে দড়ির বাঁধনে আটক।
জল পানের উপায় নেই। তাকায়
নদীর পানে। দেখে তার ছানাদের পিঠে নিয়ে বুড়ো কুমীর ধীরে হেঁটে চলেছে জলের কাছে।
সর্বনাশ! বুড়োতো তার ছানাদের সাবড়ে দেবে। কীভাবে বাঁচাবে তার ছানাদের? দড়িটা তাকে গায়ের জোড়ে চটকাতেই হবে। নইলে তার ছানাদের
বাঁচানো অসম্ভব। প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে লাফায়। তার গলায় বেজায় টান লাগে। তবুও মায়ের
প্রাণ বাচ্ছাদের জন্যেই সে বাজি রাখতে বাধ্য। বারংবার লাফায়। দড়ি চটকায় না। এবার
সে জোরে ‘ম্যাঁএঁ, প্যাঁএঁএঁএঁ’ ইত্যাদি সুরে বেসুরে কান্না মেশানো চিৎকার জোড়ে। তারসাথে
কুমীরকে ভয় দেখানোর কথাও থাকে।
কুমীর শুনতে পায়, ‘অ্যাই বুড়ো দুষ্টু কুমীর। তুইতো বেজায় পাজি। আমার ছানাদের
নিয়ে যাচ্ছিস কেন? আমার ছানাদের আগে নামিয়ে দে। নইলে আমি আমার মালকিনকে ডাকবো।’ কুমীর বিপদের আঁচ পায়। তবুও কোন উত্তর দেয়না। সে তার হাঁটায়
জোর বাড়ায়। নদীর জলের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টাকরে।
মা-ছাগল চিৎকার করে জানায়, ‘জানিস্, আমার মালকিন কাঁচি বেদেনির
নাতনির নাতনি বুঁচি বেদেনি। সে তোকে ভয় পায়না। সে ধারালো কাঠারি নিয়ে আসছে।’ কাঠারির কথাশুনে বুড়ো কুমীরের বুক ধড়ফড়িয়ে ওঠে। বুড়ো কুমীর
তার দাদুর দাদুর কাছে শোনা কাঁচি বেদেনির সাহসের কথা আজও ভোলেনি। কাঁচি বেদেনি তার
দাদুর গলায় কাঠারির কোপ মেরে জখম করেছিল। তার দাদু প্রায় একমাস ভুগেছিল। সেই গল্প
মনে পড়তেই তার গা ঝাঁকিয়ে ওঠে। তখনি ছাগলছানারা জেগে ওঠে। তারা চটপট লাফিয়ে নামে।
তাদের মায়ের দিকে তিড়বিড়িয়ে দৌড় লাগায়। বুড়ো কুমীর আর ফিরেও তাকাতে সাহস পায়না।
এদিকে মা-ছাগল দড়ি চটকায়।
বারবার গায়ের জোরে টান দড়িটা সহ্য করতে পারেনা। বেজায় জোরে দৌড়দেয় তার ছানাদের
দিকে। ছানাগুলোও মায়ের দিকে ছুটে আসতে থাকে। মাকে কাছে পেয়েই তিন ছানা মাকে ঘিরে
দাঁড়ায়। তারা মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। তাদের মা তাদের অনেক বকাবকি করে। তারা ম্যাঁপ্যাঁ
আওয়াজ দিয়ে বোঝায় তাদের ভুলের কথা। তারা জানায়, এমন ভুল তারা আর করবেনা।
তাদের দু’জন মায়ের দুধ খেতে শুরুকরে। তৃতীয় জন নাগাল না পেয়ে আশেপাশে
লাফাতেই থাকে। একসময় সেও সুযোগ পায় দুধ খাওয়ার।
তারপর চারজনেই হাঁটাদেয়
ঘরের পানে। মা-ছাগল একটু জোরেই হাঁটে। ছানাগুলো সাথে দৌড়াতে থাকে। তারা ঘরে হাজির।
বুঁচি বেদেনি অবাক। কেন তারা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে? তা হয়তো বুঝতে
পারেনি বুঁচি বেদেনি। মা-ছাগলের বেজায় তেষ্টাপায়। সে জলের বালতিতে মুখ ডোবায়।