দাদুর ফোনে অজানা নম্বর থেকে কল। এদিকে দাদু অজানা নম্বর থেকে আসা কল ধরতে নারাজ। রিং হতে হতেই মিসড কল। একটু পরেই আবার সেই নম্বর থেকে কল। দাদু আমাকেই বলেন, “ভাই আলু, কলটা রিসিভ করতো।"
আমি কলটা রিসিভ করি। আমি “হ্যালো” বলতেই ফোনের ওই দিক থেকে বলে, “প্রমথ বাবুর বাড়ি এটা? কে বলছো? ফোনটা প্রমথ বাবুকেই দাও।”
ছোট ছেলের গলা। সেই ব্যক্তি বুঝতে পারেন। আমি কোন উত্তর দিইনা। ফোনটা দাদুকে ধরাই। বলি, “দাদু, তোমাকেই চাইছেন।” দাদু এবার কথা বলতে থাকেন। কলটা কোলকাতার এক ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির চাঁপাডাঙ্গা সাব অফিসের। আমার বাবা, দাদুর ঘরের জন্য একটা এসি পাঠিয়েছেন। ওই ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির মাধ্যমে। সেটি ইঞ্জিন ভ্যানে চাঁপাডাঙ্গা থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। দাদু যেন বুঝে নেন জিনিসটা। দাদু ফোনটা রেখে বেল শরবতটা মাত্র খান। গ্লাসটা তখনো হাতে। তখনি কলিং বেলের আওয়াজ।
বাইরের বারান্দার জানালাটা একটু ফাঁক করি। পালকির দরজার মত। আমিই জিজ্ঞাসা করি, “কাকে চাই?” বাইরের ঘর্মাক্ত কলেবর লোকটি গামছায় ঘাম মুছতে মুছতেই বলে, “তোমাদের একটা এসি এসেছে। বাড়ির বড়দের কাউকে আসতে বলো। এটা প্রমথ বাবুর বাড়ি আমি জানি। দাদু বাড়িতে নেই?”
‘হ্যাঁ আছেন।’
‘দাদুকেই আসতে বলো।’ আমি হাঁক দিই, “দাদু, এসি এসে গ্যাছে। তোমায় বাইরে ডাকছে।” শুনেই দাদু বাইরে যান। লোকটি দুটো ঢাউস প্যাকিংবাক্স বারান্দায় তুলে দেয়। আমি দাদু দু’জনেই হাত লাগাই।
আমার কৌতূহল ছিঁড়ে প্রশ্ন বেরিয়ে আসে, “দাদু, তাহলে এসিটা কবে আমাদের ঘরে লাগানো হবে?” এখানে আমাদের ঘর বলতে আমার আর দাদুর একসাথে থাকার ঘর। দাদু বলেন, “অতীনতো জানিয়েছে কোম্পানির মিস্ত্রি আগামিকাল বা পরশু আসবে এসি ইনস্টল করতে। সামনেইতো ‘ফাদার্স ডে’। এটা তোমার বাবার ‘ফাদার্স ডে’র জন্য পাঠানো গিফট। বুঝলে কিছু?” আমার যে তর সইছে না, তা দাদু বেশ বুঝতে পারেন।
আমার মনের ভিতর, দেওয়ালে এসি লাগানোর ছবিটা আঁকা চলতে থাকে। আমার কল্পনার ছবি আঁকা থামিয়ে দাদু বলেন, “জানো দাদুভাই, আমরা যত বেশি যন্ত্র লাগাবো, তত বেশি যন্ত্র নির্ভর হয়ে পড়ব। আমার এসিতে সায় নেই এবং ছিল না। তোমার বাবা জোর করেই লাগাচ্ছে এসিটা। যেহেতু তুমি আমার রুম পার্টনার, তাই ‘না’ করতে পারিনি। জানো মানুষের সমবেত সদিচ্ছা থাকলে অনেক অসুবিধাকেই সরিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আমরা তা করিনা। কিছু অর্থলোভী মানুষের জন্যই বেশি অনর্থ ঘটে।”
দাদুর কথা মন দিয়েই শুনি। এবার প্রশ্ন করি, “দাদু তুমি বললে, মানুষের সমবেত সদিচ্ছা থাকলে অনেক অসুবিধাই সরিয়ে দেওয়া যায়। সেই রকম ঘটনা তোমার জানা আছে? নাকি মন থেকেই বললে কথাটা?”
‘না ভাই, কথাটা আমার সাজানো কথা নয়। তোমাকে চিপকো আন্দোলনের গল্প বলেছিলাম, মনে আছে?’
‘কেন থাকবে না? এইতো সেদিন বললে। এর মধ্যেই ভুলে যাবো?’
‘আমি জানি, আমাদের আলু ভাইয়ের চেহারাটা আলুর মতো গোলগাল। কিন্তু তার মনে রাখার বহর ভালোই। তবে পড়াশোনার চেয়ে গল্পকেই ভালো মনেরাখে।’
‘কেন, আমি কি পড়া ভুলে যাই নাকি?’
‘তুমি পড়া ভুলে যাও, আমি বললাম কখন? আমি বললাম তুমি পড়ার চেয়ে গল্প ভালো মনেরাখতে পারো।’
‘সেটাইতো সবাই করে। আর আমার বেলাতেই দোষ?’
‘ঠিক আছে ভাই। ওটা তোমার দোষ নয়, গুণ। আমি চিপকো আন্দোলনের মতো বড় আন্দোলনের কথা আজ বলছিনা। আমার গল্পটা একটা ছোট গ্রামের মানুষদের সদিচ্ছা নিয়ে।
‘তাহলে বলো, শুনি।’
দাদুর গল্পের শুরু আমাকে একটা প্রশ্ন দিয়ে। তারপর সেই উত্তরের লেজ ধরেই দাদুর গল্পটা টাঙ্গার মতোই গড়গড়িয়ে চলে। দাদু প্রশ্ন করেন, “বলতো আলু ভাই, ভারতের বৃহত্তম প্রদেশের নাম কি?” আমার উত্তর, “রাজস্থান।”
আমার গল্পটা রাজস্থানের একটা গ্রামের মানুষদের সদিচ্ছার গল্প। গ্রামটার নাম আমার এই সময় মনে পড়ছে না। তবে গ্রামটা রাজস্থান আর মধ্যপ্রদেশের সীমায় অবস্থিত। অবস্থান তার রাজস্থানের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে।
আমাদের এখানে যেমন অনেক বৃষ্টি। সেখানে তেমন হয়না। তাই চাষের কাজেও জলের অভাব। মানুষের অন্য প্রয়োজনেও জলের অভাব। কূয়ো থেকে জল তুলতে কূয়োর দড়ি নেমেই চলে। বালতি আর জলে ডোবেনা। বৃষ্টি যে একেবারেই হয়না, তা নয়। জুলাই আগস্ট মাসেই অল্প বৃষ্টি। অন্য সময় খরাই খরা। আকাশে মেঘ জমে। কিন্তু বৃষ্টি হয়না। কিছু জমিতে কূয়োর জল ব্যবহার করে কিছু ভুট্টা মকাই ইত্যাদির চাষ। সেগুলো একান্তই নিম্ন মানের দানাশস্য।
গাঁয়ে তেইশটি পরিবারের বাস। সেই গাঁয়ের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি গাঁয়ের মুখিয়া। একদিন বিকালে হাঁটতে হাঁটতে হাজির পাঁচ পরিবারের এক পাড়ায়। তিনি পাড়ার বয়স্কদের কাছে ডাকেন। বলেন, “ভাইসব, আগামিকাল গাঁয়ের সব পরিবারের প্রধানদের এক জায়গায় আসতে বলো। আমি তাদের কিছু কথা বলতে চাই।” সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামের অন্য পরিবারের প্রধানদের কাছে সেই খবর পৌঁছায়। পরদিন বিকালে সব পরিবারের প্রধানরা হাজির। গাঁয়ের মুখিয়ার বাড়ির পাশের গাছতলায়।
মুখিয়া বলেন, ‘আমাদের গ্রামের মাঝখানটা উঁচু। এটা নিশ্চয় সবাই বিশ্বাস করেন?” সবাই সমস্বরে তাঁকে সমর্থন করেন। এবার তিনি বলেন, “আসুন, আমরা গাঁয়ের সবাই মিলে গ্রামের সীমানা বরাবর একটা বাঁধ তৈরিকরি। গ্রামটা বাঁধ বানিয়ে ঘিরে ফেলি। তাহলে আমাদের গ্রামের বৃষ্টির জল অন্য গ্রামে বেরিয়ে যেতে পারবে কি?” সবাই সমস্বরে জানায়, “না। পারবে না।”
“তাহলে আসুন আমরা সমবেত চেষ্টায় আমাদের গ্রামের সীমানা বরাবর একটা বাঁধ তৈরিতে লেগে পড়ি। বৃষ্টি বাদলের মাস এসেই যাবে। তার আগেই আমাদের বাঁধ তৈরি শেষ করতে হবে। আপনারা সকলে রাজি?” মুখিয়া প্রশ্ন রাখেন। সবাই তাঁকে সমর্থন জানায়, ‘আমরা সবাই রাজি।’
যেমন কথা, তেমনি কাজ। এক মাসের মধ্যেই গাঁয়ের সীমানা বরাবর তৈরি বাঁধ। বর্ষার সামান্য বৃষ্টির জল গ্রামের বাইরে যায়না। মাটিতে ভিজে ভাব। তারপর মুখিয়া আবার সবাইকে ডাকেন। দেখান মাটির অবস্থা। বলেন, ‘এই অনাবাদি মাটিতে দেখো ঘাসের চারা মাথা তুলেছে। তোমরা যে যেমন পার গাছের বীজ যোগাড় করো। বা চারা যোগাড় করো। এই ঘাসের মধ্যেই বীজ ছড়িয়ে দাও অথবা চারা লাগিয়ে দাও।’
গ্রামবাসীরা তাই করে। নতুন সবুজ ঘাসে এবং গাছে তাদের গ্রাম সেজে উঠতে থাকে। তার মাঝেই ঘটলো বিপত্তি। সেই বাড়ন্ত চারাগাছ ছাগল ভেড়া জাতীয় পালিত পশুরা খেয়ে ভেঙে নষ্ট করতে থাকে।
সেই পরিস্থিতি দেখে মুখিয়ার বেজায় মন খারাপ। ভাবেন, পরিকল্পনায় কিছু ভুল থাকাতেই এই বিপত্তি। আবার গ্রামের তেইশটি পরিবারের প্রধানদের এক সন্ধ্যায় আলোচনার জন্য ডাকেন। তাদের বলেন, “এই গাছ-গাছালি বাঁচাতে আমাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।” গ্রামবাসীদের প্রশ্ন, ‘কি ভাবে সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে?’ তিনি বলেন, “ব্যাপারটা একান্তই সহজ।” কথাটা শেষ করেই তাঁর হাতের লাঠিটা এক পরিবার প্রধানের হাতে তুলে দেন। বলেন, “এই লাঠিটা নিয়ে পরিবারের কোন যুবক সদস্যকে দেবেন। তাকেই আগামিকাল গাঁয়ের সীমা বরাবর ঘুরে গাছগাছালি পাহারা দিতে হবে। তাকে খেয়াল রাখতে হবে অন্য গ্রামের ছাগল, ভেড়া আমাদের গ্রামের সীমা পেরিয়ে যেন ঢুকতে না পারে। সারাদিন পাহারা দেওয়ার পর প্রতিবেশি পরিবারের কাছে সন্ধ্যায় সেই লাঠি পৌঁছাতে হবে। প্রতিবেশি পরিবারের যুবক সদস্যকে পরের দিন দায়িত্ব পালন করতে হবে। এইভাবে প্রতি তেইশ দিন পরে আবার প্রথম পরিবারের দায়িত্ব পড়বে।”
সবাই বৃদ্ধের কথায় সায় দেন। তেইশটি পরিবার পরপর দায়িত্ব পালন করবে, সেই অনুসারে নামের তালিকাও আলোচনায় স্থির করেন পরিবারের প্রধানগণ।
একজন গ্রামবাসি জানতে চায়, “তাহলে কি আমাদের গাঁয়ের গরু, ছাগল, ভেড়াদের গাঁয়ে চরানো যাবেনা?” মুখিয়া জানান, “তা কেন হবে? তাহলে পালতুগুলো বাঁচবে কি করে? গ্রামের প্রত্যেক পরিবারকে খেয়াল রাখতে হবে বিষয়টা। আগামি তিনমাস গরুছাগলকে ঘাস খাওয়ানোর সময় নিজেদের একজনকে থাকতে হবে। যাতে গরু, ছাগল ইত্যাদি চারাগাছ খেয়ে নষ্ট না করতে পারে। সেটা না মানলে গাছগুলো বাঁচানোই যাবেনা।”
পালা অনুসারে চলতে থাকে পাহারা। গ্রামবাসিরাও নিজেদের ছাগল, ভেড়া ইত্যাদিদের নিজেরা থেকে ঘাস খাওয়ান। গ্রামটা ক্রমশ সবুজ হয়ে ওঠে। নিজেদের পরিশ্রমে সততার সাথে কাজ করেন তাঁরা। পরের বছর গাছের সংখ্যা আরও বাড়ে। গ্রামের মানুষ তাদের সমবেত কাজে নিজেরাই খুশি। তাদের গ্রামে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আগের চেয়ে বাড়ে। সেই গ্রামের ঘটনাকে অনুসরণ করে আশপাশের আরও গ্রাম। তারাও এই কাজে এগিয়ে আসে। কাছাকাছি বেশ কয়েকটি গ্রাম দশ বছরেই অনেক বেশি সবুজের ছোঁয়া পায়।
আলুভাই, খেয়াল করো, সদিচ্ছা নিয়ে সমবেত ভাবে ভালো কাজে আগানো দরকার। তাহলে কাজটা সফল হবেই। আমাদেরও ভাবা দরকার, গাছপালা কোন উপায়ে বাড়ানো যায়। শক্তি খরচের বহর কমানোও একান্তই জরুরি। তবেই পরিবেশ দূষণ কমবে।
আমি বলি, “দাদু, তোমার কথাই ঠিক। তাহলে, এসিটার কি হবে?” দাদুর হাসি লেপটানো উত্তর, “বেজায় গরম না হলে চালাবো না। তাহলেই মিটে গেলো।”