গল্প - পিলকু - সুস্মিতা নাথ । জানুয়ারি - ২০২৪






 পিলকু



সু স্মি তা 
না থ





.....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -

 

 

আমার জীবনের পরতে পরতে ঘাপটি মেরে আছে রহস্য। এড়াতে চাইলেও এড়াতে পারি না। কী করে যেন যেখানেই যাই কোনও না কোনও রহস্যজনক ঘটনার সাক্ষী হয়ে যাই। কেন এমন ঘটে আমার জানা নেই। একেই হয়ত নিয়তি বলে। সেজন্যে উদ্যোগ নিয়ে ইদানীং সব লিখে রাখছি। যখন যা মনে পড়ছে, টুকে রাখছি এই ডায়েরিতে। এই নির্দিষ্ট ডায়েরিটা তাই ঠিক সে অর্থে আদর্শ ডায়েরি নয়। এতে আমার দৈনন্দিন রোজনামচা নেই, আছে কেবল বিশেষ কিছু ঘটনার কথা। কখনও ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই লিখে রেখেছিলাম, কখনও বা স্মৃতি নির্ভর লিখতে হচ্ছে। এখন যেটা লিখতে চলেছি, সেটা আমার ছেলেবেলার একটা ঘটনা। কিন্তু এখনও ভোরের ফুলের মতোই তাজা সে স্মৃতি। এখনও চোখের সামনে হুবহু দেখতে পাই সব।  

ঘটনাটা এতটাই রহস্যময় যে, কোনও যুক্তি বুদ্ধি দিয়েই আমি এর ব্যাখ্যা করতে পারিনি। একদম বালক বয়সের কথা হলেও বেশ ভয়বহ স্মৃতি।  

তখন আমার আট-দশ বছর বয়স। সময়টা গ্রীষ্মকাল। একদিন মাঝরাতে প্রকৃতির ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ছোট বাইরে পেয়েছিল। কাউকে না জাগিয়ে একাই দরজা খুলে বেরিয়ে আসি। আমাদের বাড়িটা ছিল অনেকটা জায়গা জুড়ে। তিন দিক জুড়ে ঘর। সামনে টানা বারান্দা। মাঝখানে মস্ত উঠোন, আর তুলসিতলা পেরিয়ে বাগান। টয়লেট, স্নানঘর, কলপাড় আদি ছিল ঘরের বাঁ দিকের একদম কোনায়। আমি সোজা সেখানে চলে আসি। বাথরূম সেরে যখন চলে আসছি হঠাৎ মনে হল বাগানে যেন কেউ আছে। কেউ যেন হেঁটে বাঁ দিক থেকে ডানদিকে সরে গেল। 

আগেই বলেছি, সময়টা মাঝ রাত। চারদিক অন্ধকার। বাগানের ভেতরে গাছপালার আধিক্যের জন্যে অন্ধকার বেশি গাঢ়। ও দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝা গেল না। তখনও আমাদের মফসসল শহরটায় ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ আসেনি। ফলে এখনের মতো সঙ্গে সঙ্গে যে সুইচ অন করে আলো জ্বেলে দেবো সে উপায় নেই। হাতে কোনও হ্যারিকেন বা নিদেনপক্ষে কুপি বা মোমবাতিও নেই। কিন্তু আমার কৌতূহল অসীম। বাগানে এত রাতে কে এসেছে জানতেই হবে। আমি নিশ্চিত চোর ছ্যাচরই হবে। এবং অবচেতনে হাতেনাতে চোরকে ধরার একটা আকাঙ্খায় তাড়িত হয়েই পা টিপে টিপে বাগানে চলে এলাম। 

ভয়ডড় আমার চিরকালই কম। সেই বালক বয়েস থেকেই ডানপিটে আমি। বয়স জনিত সারল্যের জন্যে সাতপাঁচ না ভেবেই ঐ মাঝরাতে চোর ধরার হিরোয়িক বাসনা নিয়ে একাকী বাগানে ঢুকে পড়লাম। এর জন্যে হয়ত বড় বিপদের সম্মুখীন হতে পারতাম। কিন্তু ভাগ্যগুণে সেটা হল না। উলটে যে অভিজ্ঞতা হল, আমৃত্যু মনে থাকবে। 

আমাদের বাগান শেষ হলেই পিলকুদের বাগান শুরু। পিলকু হল রামলাখান চাচার ছেলে। আমার সঙ্গে একই ইসকুলে একই ক্লাসে পড়ে। রামলাখান চাচা মূলত গোয়ালা। আমাদের পাড়ার সব বাড়িতে দুধ আসত ওদের বাড়ি থেকেই। ওদের এখানে বাড়ি থাকলেও মূল বাড়ি বিহারে। ভাগলপুরের আশেপাশে কোনও গ্রামে। বছরে অন্তত তিন চারবার ওরা দেশের বাড়ি যেত। এখানে ছোটখাটো একটা ঘর বানিয়ে থাকত, আর নিজেদের গ্রামে নাকি প্রাসাদোপম বাড়ি করেছিল। সেখানে তার ভাই বোনেরা ও আত্মীয়স্বজনেরা থাকত। যদিও গ্রাম থেকে কাউকে কখনও ওদের এ বাড়িতে আসতে দেখিনি। পিলকু  ছিল রামলাখান চাচার বেশি বয়সের ছেলে। পিলকুর জন্মের সময়ই নাকি ওর মা মারা গিয়েছিল। সেজন্যে থাকার মধ্যে কেবল বাপ-ব্যাটাই ছিল। 

পিলকুকে যে একবার দেখেছে, ভুলতে পারবে না। ওর চেহেরাটা এমনই অদ্ভুত ছিল। গায়ের রং এত কালো ছিল যে, মনে হবে এইমাত্র কয়লার খনি থেকে উঠে এসেছে। অথচ চোখগুলো ছিল কেমন যেন শেওলা রঙের এবং ঘোলা। এমন চোখের মানুষ আমি এযাবৎ দ্বিতীয়টি দেখিনি। তেমনই ছিল কান দুটো। ঠিক বিড়ালের কানের মতো ছোট্ট ছোট্ট। উপরে সামান্য ওঠানো, কিন্তু নীচের লতি নেই। ও মেয়ে হলে নির্ঘাত কানের দুল পরতে পারত না। গোল মুখ, পেট বড় এবং কাঠি কাঠি হাত-পা। কিন্তু এসব ছাপিয়ে সবচাইতে আকর্ষণীয় ছিল ওর হাসিটা। মুক্তোর মতো চকচকে দাঁতের সারী মেলে যখন হাসত পিলকু, বড় ভালো লাগত দেখতে। 

পিলকু  ছিল স্বভাব লাজুক। খুব কম কথা বলত। মেলামেশাও একেবারে করত না। ওকে কখনও খেলার মাঠে দেখিনি। ডাকলেও আসত না। চুপটি করে ইসকুলে আসত, আবার ছুটি হয়ে গেলে সোজা ঘরে চলে যেত। এর বাইরে আর কখনও বাড়ির বাইরে বেরোত না সে। তবে আমি ওর দেখা প্রায় সময়ই পেতাম। যেহেতু ওরা আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি, যেহেতু আমাদের বাড়ি দুটো বাগান দিয়ে জুড়ে আছে, মাঝে কেবল একটা বাঁশের বেড়ার ব্যবধান, বাগানে এলে প্রায়ই ওর দেখা পেতাম। পিলকু  আর রামলাখান চাচা মিলে বাগানে খুব চাষাবাদ করত। প্রচুর শাকসবজি ফলাত। অনেক ফলেরও গাছ ছিল ওদের। পিলকু  বাড়িতে থেকে সারাক্ষণ বাগানের পরিচর্চা করত। 

তা, সেদিন সেই মাঝরাতের অন্ধকারে আমি তো বাগানে চলে এসেছি। ততক্ষণে অন্ধকার চোখে সয়ে এসেছে অনেকটা। চুপটি করে চারদিকে তাকিয়ে যখন চোর খুঁজছি, নজরে এল পিলকু  ওদের বাগানের আম গাছ থেকে বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে কাঁচা আম পাড়ছে। খুব অবাক লাগল। এত রাতে পিলকু কিনা আম পারছে! কিন্তু কেন? নিজেদেরই তো গাছ, দিনের বেলাতেই তো স্বচ্ছন্দে পাড়তে পারে। বড় অদ্ভুত লাগল ব্যাপারটা। কেমন যেন সন্দেহ দেখা দিল। মনে প্রশ্ন নিয়ে আরও একটু এগোই। তবে সন্তর্পণে, যাতে পিলকু টের না পায়। 

বাঁশের বেড়া সংলগ্ন কাঁঠাল গাছের আড়াল নিয়ে দাঁড়ালাম। কাছে আসাতে আরও কিছুটা স্পষ্ট হল সব। দেখি, একটা বড় ব্যাগ ভর্তি করে আম পেড়েছে পিলকু। এর পরেই মাটিতে উবু হয়ে বসে কতগুলো চারাগাছ তুলতে লাগল। আমি অবাক হয়ে সব দেখছি। আরও একটা ব্যাগ নিমেষেই চারাগাছে ভরে ফেলল ও। ঠিক তখনই একটা নরম সবুজ আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল চারদিক। চমকে উঠে দেখি ওদের ডালিম গাছটার পেছনে যে ফাঁকা জায়গাটা আছে, সেখানে সুবিশাল গোলাকার একটা বেলুনের মতো জিনিস দাঁড়ানো। আলোটা আসছে ওটার ভেতর থেকেই। 

আমি হতভম্ব। জিনিসটা কী, হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হল, সব আমার বোধের বাইরে। একটু পরেই সেটার পেটের ভেতর থেকে অবিকল পিলকুর মতো দেখতে কয়েকজন নেমে এল। পিলকুও তৈরি ছিল। ও তাদের হাতে আম ও গাছের চারা ভর্তি ব্যাগদুটো তুলে দিল। তারপর খুব মিহি স্বরে কী কী কথা বলল। এরপরে আগন্তুক দলটি আবার গিয়ে বেলুনের পেটে ঢুকে গেল। ওরা ভেতরে ঢুকতেই সেটার আলো কমে এল। তারপর সাঁই করে আকাশে উঠে গেল, আর একটু পরেই মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।    

সমস্ত ব্যাপারটা ঘটতে বড়জোর মিনিট পাঁচেক সময় লাগল। আমি ভয়ানক বিস্ময়ে পাথরের মত স্থানু হয়ে গেছি। কী ঘটল, কারা এসেছিল, কোত্থেকে এসেছিল, কিচ্ছু  বুঝতে পারছি না আমি। সংবিৎ ফিরলে দেখি পিলকু  ওদের ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। আমারও তখন যেন গা ছমছম করতে শুরু করেছে। আমি ছুটে নিজেদের ঘরে ঢুকে সোজা বিছানায় চলে এলাম। 

এরপর বাকি রাত কিছুতেই ঠিকভাবে ঘুমোতে পারলাম না। যতক্ষণ না পিলকুর থেকে ব্যাপারটা বিশদে জানতে পারছি, আমার স্বস্তি নেই। কেবল অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন ভোরের আলো ফুটবে, আর কখন বিছানা ছেড়ে উঠব।

আমার ঠাকুমা একদম কাকভোরে উঠতেন। আমি সেদিন ঠাকুমার সঙ্গে উঠে পড়লাম। সবে অন্ধকার কেটেছে তখন। পুব আকাশে আলতো কমলা আভা। আমি ঘর থেকে বেরিয়েই ছুটে যাই বাগানে। কিন্তু এখন দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। পিলকুদের ঘর তখনও বন্ধ। আমি হাঁটতে হাঁটতে বাগানের শেষ দিকে এসে পড়ি। এখান থেকে ওদের ডালিম গাছের দিকটা ভালো করে দেখা যায়। আমি স্পষ্ট দেখলাম, ডালিম গাছের পেছনে মোটামুটি দুই মানুষ সমান ব্যাসের একটা গোলাকার জায়গায় ঘাসগুলো পুড়ে বাদামি হয়ে আছে। ঐ অংশের মাটি ডেবে গিয়ে ইঞ্চি ছয়েক কিংবা ফুটখানেক গভীর একটা গর্তেরও সৃষ্টি হয়েছে। নরম মাটির ডেলার উপরে একটা লোহার ভারী থালা রেখে দিলে যেমন গর্তের সৃষ্টি হবে, ঠিক তেমনই। আমি হতবাক। বুঝলাম কালকের সেই বেলুনের মতো জিনিসটা এখানে দাঁড়িয়েছিল বলেই এই গোলাকার জায়গাটার সৃষ্টি হয়েছে। ঘাসগুলোও শুকিয়ে কাল্টে বাদামের রং নিয়েছে। ভেতরের কৌতূহল ও বিস্ময় স্বাভাবিক ভাবেই তীব্রতর হয়ে উঠল। 

ওখান থেকে ঘরের দিকে ফিরছি, দেখি পিলকু আর ওর বাবা উঠে গোরুর জাবনা তৈরি করছে। এরপর ওরা গোরুদের খাওয়াবে। তারপর দুধ দুইয়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেবে রামলাখান চাচা। আমি পিলকুকে ডাক দিলাম, -‘পিলকু একটা কথা শুনে যা।’

পিলকু  জাবনার বড় বালতিটা ছেড়ে ছুটে এল বেড়ার কাছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কালকে মাঝরাতে তোদের বাগানে কারা এসেছিল রে?’

পিলকু যেন একটু চমকে গেল। বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকাল সে। সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিতে পারল না। অন্তত আধ মিনিট পর তুতলে তুতলে বলল, ‘মম্‌-মাঝ রাতে?  ক্ক-কই, কেউ আসেনি তো!’

আমি বললাম, ‘কেউ আসেনি মানে? আমি নিজের চোখে দেখলাম একটা গোল বেলুনের মতো জিনিসে চড়ে কয়েকজন এল। তুই ওদের ব্যাগ ভর্তি করে আম আর চারাগাছ দিলি। আর বলছিস কেউ আসেনি?’

  পিলকুর চোখগুলো গোল্লা পাকিয়ে আরও বড় আকার নিয়েছে তখন। অবাক হয়েছে নাকি ঘাবড়ে গিয়েছে বোঝা গেল না। কিছুক্ষণ সে ভাবেই তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর অবশ্য মুখে হাসি এনে বলল, ‘যাহ, কী যে আজেবাজে বলছিস তুই! মাঝরাতে কেউ কখনও আসে নাকি? নিশ্চয়ই ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছিস।’

শুনে আমি হতভম্ব। বলে কী পিলকু? নিজের চোখে দেখলাম সব, আর ও বলছে স্বপ্ন দেখেছি? বললাম, ‘মোটেই এসব স্বপ্নের কথা নয়। ওরা এসেছিল। তোদের ডালিম গাছের পেছনে বেলুনের মতো জিনিসটা দাঁড়িয়েছিল। এইমাত্র দেখে এলাম, ঐ জায়গাটা পুড়ে একদম কালটে হয়ে গিয়েছে। মাটিও নীচে ডেবে গেছে খানিক। চল, তুই দেখবি চল।’

কিন্তু পিলকু গেল না। বলল, ‘ধ্যুস কী দেখতে কী দেখেছিস, তার ঠিক আছে?’

বললাম, ‘ঠিক আছে, তুই চল না, নিজের চোখে দেখলেই তো বুঝতে পারবি।’

পিলকু  একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘ঠিক আছে পরে দেখব। এখন তাড়া আছে। গোরুকে খাইয়ে দেখব। ঠিক আছে?’ এরপর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছুটে চলে গেল ঘরে। 

আমিও ঘরে ফিরে এসে মুখ-টুক ধুয়ে চা-মুড়ি খেলাম। কিন্তু পিলকু ব্যাপারটা অস্বীকার করায় কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না মনে। অনেক ভেবেচিন্তে আমার ছোট কাকাকে গিয়ে সব বললাম। সবটা শুনে ছোটকাকাও বিশ্বাস করতে চাইল না। উলটে পিলকুর মতোই বলল, ‘দূর, এসব কি হতে আরে? পিল্কুর কথাই ঠিক, নির্ঘাত স্বপ্ন দেখেছিস তুই।’

কিন্তু ছোটকাকাকে যখন ডালিম গাছের পেছনের গোলাকার জায়গাটা পুড়ে যাওয়ার কথাটা জানালাম, তখন তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। বলল, ‘তুই ঠিক দেখেছিস? জায়গাটা পুড়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ, একদম ঠিক দেখেছি। জায়গাটা মানে, ঐ জায়গার ঘাসগুলো পুড়ে বাদামি হয়ে আছে। গর্তও হয়েছে কিছুটা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঐ জায়গায় কিছু দাঁড়িয়েছিল।’

‘তাই নাকি?’ এবারে যেন বিষয়টাকে খানিক গুরুত্ব দিল ছোটকাকা। বলল, ‘আশ্চর্য! তা হলে চল তো দেখি কী ব্যাপার।’

আমি ছোটকাকাকে নিয়ে সোজা বাগানের শেষ প্রান্তে আসি। কিন্তু এসেই থমকে যাই। দেখি পিলকু  আর রামলাখান চাচা দুইজনে মিলে সেই গোল জায়গাটা কোদাল দিয়ে কুবিয়ে ফেলেছে। এখন সেই গোলাকার অংশটার চিহ্ন মাত্র নেই। ছোটকাকাকে বাগানের এখানে দেখে রামলাখান চাচা কোদাল থামিয়ে মাথা তুলে বলল, ‘রাম রাম বাবু।’

‘রাম রাম।’ প্রত্যুত্তরে বলল ছোটকাকা। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘রামলাখান, তোমার এই জায়গায় নাকি ঘাস পুড়ে গিয়েছিল?’

‘না তো বাবু, ঘাস কীকরে পুড়বে? আগুন লাগলে তবেই না পোড়ার প্রশ্ন আসবে। তেমন কিছুই তো হয়নি বাবু।’

‘সেই তো, সেই তো।’ সহমত জানিয়ে মাথা নাড়ল ছোটোকাকা। তারপর আমার দিকে তাকাল। সেই চোখে অবিশ্বাস স্পষ্ট। 

আমি বলে উঠলাম, ‘তা হলে রামলাখান চাচা এখানের মাটি কোবাচ্ছেন কেন?’

চাচা হেসে বলল, ‘এখানে খেতি করব ছোটেবাবু। ভাবলাম, জায়গাটা মিছেমিছি ফেলে রেখেছি কেন। এখানেও কিছু শাক সবজি লাগিয়ে দিই।’

আমার আর কিছুই করার ছিল না। ঐ বয়েসেও বুঝতে পারলাম, কিছু একটা চেপে যাচ্ছে পিলকু আর রামলাখান চাচা। কিন্তু ওদের পাল্লা ভারী। আমার কথা কাউকে বিশ্বাস করানো কঠিন। তাই তখনকার মতো চুপ করে গেলাম। 

পরদিন যখন পিলকুকে ইসকুলে একলা পেলাম, ওকে চেপে ধরলাম, ‘পিলকু, এখন তোকে বলতেই হবে, ওরা কে এসেছিল?’

কিন্তু পিলকু এবারও পুরোপুরি অস্বীকার করে গেল। এর ঠিক পরদিন থেকেই পিলকুকে আর নজরে আসছিল না। ইসকুলে নয়, ওদের বাড়িতেও দেখছিলাম না। এরপর একদিন রামলাখান চাচাকে একাই বাগান পরিচর্চা করতে দেখে আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘পিলকু কোথায় চাচা?’

 ‘পিলকু  দেশে চলে গেছে বেটা। এখন ও ঐখানেই থাকবে। গ্রামের ইসকুলে ওকে ভর্তি করে দিয়েছি।’ গাছের গোড়ায় সার দিতে দিতে বলল রামলাখান চাচা।

অমি হতবাক। হঠাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই দেশের বাড়ি চলে গেল পিলকু? কিন্তু কেন? না জিজ্ঞেস করে পারলাম না। 

রামলাখান চাচা কথাটায় তেমন আমল দিল না। গাছপালার যত্ন নিতে নিতে নিজের মনে বলে চলল, ‘বুঝলে ছোটেবাবু, গাছপালার খুব যত্ন নেবে। গাছপালা থাকলেই জীবজগত থাকবে। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত উন্নত প্রাণীরা গাছের গুরুত্ব বুঝতে পারছে। বহুত দূর দূর থেকে তারা এইখানে আসে শুধুমাত্র গাছ সংগ্রহ করতে। খালি জায়গা দেখলেই গাছ বুনে দেবে। বুঝলে?’

এসব আমার জিজ্ঞাসার উত্তর নয়। সুতরাং আমি সরে এলাম। কিন্তু আকস্মিক এত তাড়াহুড়ো করে পিলকুকে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার কারণ বোধগম্য হয়নি আজও। আর কখনও পিলকুর দেখা পাইনি। আর কখনও পিলকু ওদের এই বাড়িতে আসেনি। বছর খানেক পরে রামলাখান চাচাও বাড়ি বিক্রি করে দেশে চলে যায়। কিন্তু আজও আমার পিলকুকে মনে আছে। মনে আছে সেই রাতের কথাও। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পিলকুর মতো রামলাখান চাচাও এই রহস্যের অংশীদার।