অনেক বছর আগের কথা সে সময় দঃ আফ্রিকার এক বর্ধিষ্ণু অঞ্চলে বাস করতেন এক জমিদার। তিনি সেখানকার প্রধানও ছিলেন বটে। তাঁর সংসারে অভাব বলে কিছু ছিল না। প্রচুর জমিজামার সাথে কয়েকখানা বিরাট বিরাট প্রাসাদসম বাড়ি।
খামারে প্রচুর পশু পাখি, জীবজন্তু। বাড়িতে চাকর
বাকর সহ কয়েকজন স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে ছিল তাঁর। হুকুম করলেই তাঁর সামনে হাজির হতো
সমস্ত জিনিস। তবুও মনের তৃপ্তি ছিল না জমিদারের তাঁর সব সময় মনে হতো তিনি এই
দুনিয়ার সবচেয়ে দুঃখী মানুষ। ফলে তার মুখে হাসি খুশি ভাবটা উবে গিয়েছিল।
সেই দুঃখী ভাবটা কাটাতে একদিন তিনি তাঁর এক বৃদ্ধ চাকরকে
শুধালেন-তুমি বলতো আমার এত ঐশ্বর্য এত ধন-সম্পদ আছে, তবুও আমি সুখী
হতে পারছি না কেন?
বৃদ্ধ চাকর গুম হয়ে খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর একসময়
বলল--প্রভু! আপনি শান্ত মনে একবার জগত
সংসারের দিকে তাকিয়ে দেখুন। উঠোনে বসে থাকলে শূন্য আসমানের দিকে দৃষ্টি মেলে দিন।
দেখতে পাবেন দিনের আলোকোজ্জ্বল সূর্যের নানা রূপ। রাতের স্নিগ্ধ চাঁদ তারার অপরূপ
সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। বুঝতে পারবেন, জগৎ সংসার কত সুন্দর। এসব দেখলে আপনার মনে সুখ শান্তি ফিরে আসবে।
সে কথা শুনে একটা অবজ্ঞার হাসি ঝরে পড়লো জমিদারের ঠোঁট
থেকে। রাগতস্বরে তিনি বৃদ্ধ চাকরকে বললেন--তুমি একটা মহামূর্খ! সুখশান্তি সম্বন্ধে
তোমার কোন ধ্যান-ধারণা নেই। আমি প্রতিদিন সূর্য চন্দ্র তারার দিকে তাকিয়ে দেখি।
দেখে আমার খুব রাগ হয়। হিংসা হয়। কেননা আমি জানি, আমি তা পেতে
চাইলেও হাতে বা কাছে কোনোদিন পাবো না।
দ্বিতীয় দিনে এক পৌড় নফরের কাছে জমিদার বাবু জানতে চাইলেন
সুখের হদিস। তার কথায় আপ্লুত হয়ে এবং সুখের সন্ধান দিতে গান পাগল নফর বলল--
মালিক! আপনি কি কখনো মধুর সঙ্গীতের সাথে কোন দিন সখ্যতা করেছেন! যদি না করে থাকেন, তাহলে আপনি দিনরাত প্রাণখুলে বা গুনগুন স্বরে গান গাওয়া
শুরু করুন। গান মানুষের জীবনে সুখ শান্তির পথিকৃৎ। গান নিশ্চয়ই আপনার মনের সুখ
ডেকে আনবে।
পৌড় নফরের মুখে সে কথা শুনে গা জ্বলে উঠল জমিদারের। একরকম
ধিক্কার দিয়ে পৌড়কে শুনিয়ে দিলেন কয়েকটা কথা। রাখো তোমার গান! কি নির্বোধ
তোমার ধারণা সময়ের নিরিখে দুই একটা গান ভালো লাগলেও দিনরাত গান করলে বা গান
শুনলে কার ভালো লাগে? গায়ক ও শ্রোতার বিরক্তি জন্মায় তাতে।
জমিদার বাবুর গোঁসা দেখে পৌড় নফর পালিয়ে বাঁচলো। বাড়িতে
ঢুকে বিষণ্য বদনে জমিদার খাওয়া দাওয়া করল। এমন সময় এক যুবক আজ্ঞাবাহক এসে ঢুকল
তাঁর ঘরে। জমিদার তাকে বললেন-ওহে
ছোকরা! তুমি আমাকে সুখের সন্ধান দিতে পারবে?
সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে আজ্ঞাবহ যুবক বলল-জনাব! এ জগতে অনেকের
সহায় সঙ্গতি কিছু না থাকলেও মনে-প্রাণে তারা খুব খুশি, সুখি। তাদের খুশির রাজ হল তাদের জামা। সেই জামা যদি আপনি পরতে পারেন তাহলে তার মনের
সুখ শান্তি সব আপনার মনের মধ্যে ঢুকে যাবে। সুখ শান্তি তখন এসে বাসা বাঁধবে আপনার
শরীরে, আপনার দেহ-মনে।
কথাটা ফালতু হলেও জমিদারের মনে হল একদম খাঁটি কথা বলেছে
ছোকরাটা। তখন তিনি তার সহচর রক্ষীদের আদেশ দিলেন--তোমরা সব এখনই বেরিয়ে পড়ো
সমস্ণ এলাকায়। তন্ন তন্ন করে খুঁজে একজন সুখী মানুষকে নিয়ে এসো আমার কাছে।
আদেশ মত সুখী মানুষের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল রক্ষীরা। এ জগতে
সুখী মানুষ খুঁজে পাওয়া কি সহজ কাজ? রক্ষীরা তন্ন তন্ন করে
খুঁজে বেড়ালো প্রতিটি ঘরের কোনে কোনে।
কথায় বলে--একাগ্রতা আর লক্ষ্য থাকলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছান
সম্ভবপর। এই জাজ্জ্বল্যমান সত্য কথাটা একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। বিফল মনোরথে
অন্যান্য রক্ষীরা খালি হাতে ফিরে এলেও একজন রক্ষী একটা গ্রামে একজন সুখী মানুষের
সন্ধান পেল। সেই মানুষটা নিজের বুক বাজিয়ে রক্ষীকে বলল--এই বিশ্বে আমি সবচেয়ে
সুখী মানুষ। আমার ধন দৌলত কিছু নেই। আমি একটা আস্ত গরীব। উদয় অস্ত খেটে খাই।
প্রাণ খুলে গান গাই। বুক ভরে শ্বাস-প্রশ্বাস নেই। সুখের রাজ্যে ঘুরে বেড়াই।
মানুষটাকে দেখে খুব পছন্দ হলো রক্ষীর। তাকে জমিদারের সামনে
হাজির করতে পারলে তার কাজ শেষ। এ কথা ভেবে তাকে সঙ্গে নিয়ে এলো। তারপর সোজা হাজির
হলো জমিদার বাড়িতে। জমিদার তখন
অন্দরমহলে ছিলেন। সুখী মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে শুনে খুব আনন্দিত হলেন তিনি।
দরবারে গিয়ে নিজের পরনের জামাটা খুলে ফেললেন। তারপর সেই রক্ষীকে বললেন--নিয়ে আয়
ওকে!
রক্ষী তড়িঘড়ি করে তাকে নিয়ে ঢুকল জমিদারের দরবারে। একটু
বেঁটে খাটো মানুষ। গায়ের রং তামাটে। হাল্কা কালো। রূপোর মতো ঝকঝকে ফর্সা সাদা
দাঁত। সেই বাহারি দাঁতে ছড়িয়ে আছে সুখের হাঁসি। সে হাঁসি দেখার সৌভাগ্য তখন
হয়নি জমিদারের। তিনি তখন ব্যস্ত ছিলেন নিজের জামা খোলতে। একসময় তিনি আগত
মানুষটার উদ্দেশ্য করে বললেন --বন্ধু! তোমার গায়ের ওই জামাটা...বলতে বলতে তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন জমিদার। পরমুহূর্তে হা হা হো হো অট্ট হাঁসিতে ভরে উঠল তার
মুখোমন্ডল। সেই অদ্ভুত হাঁসি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল দূর-দূরান্তরে।
কিন্তু হঠাৎ জমিদার হো হো করে হেসে উঠলেন কেন? তার কারণটা আর কিছু নয়, রক্ষী যে সুখী মানুষটাকে
নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তার সামনে তার শরীরে কোন জামা ছিল না।