আজ দুদিন হল তমশ্রী বাবা ও মায়ের সঙ্গে ফিলিপাইনের গুইমারাস দ্বীপে বেড়াতে এসেছে। বাবা ও মায়ের এটা সপ্তাহান্তিক ছুটির সময়। ওর মা শৈলী বলে দিয়েছে-"বেশী কোথাও ঘুরতে যাব না, এই বিচেই চিল করব।"
বাবাও হাই তুলতে তুলতে সহমত
পোষণ করেছে। কিন্তু বছর আটেকের তমশ্রীর তো অফুরন্ত প্রাণশক্তি। ও এক জায়গায় বসে
থাকার পাত্রী নয়। রিসর্টের বিচ সাইডে একটা দোলনায় ও দুলতে শুরু করল। হঠাৎ একটা পাম
পাতার ফাঁক দিয়ে নজরে এল প্রায় ওরই বয়সী একটা ছেলে ওকে দেখছে। ও খেলার সঙ্গী পেল
ভেবে ওকে হাত নাড়িয়ে ডাকল। ছেলেটা একটু ভয় পেয়ে সরে যেতে লাগল। তমশ্রী সিকিউরিটি
গার্ডকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল-"ঐ ছেলেটা এখানে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে কেন?"
গার্ডের নিস্পৃহ
উত্তর-"ওরা বাজাউ, যাযাবর জাতি। ওদের ডাঙায় থাকার অনুমতি নেই। পুলিশ দেখলে
ধরবে। রিসর্টে ঢোকাও ওদের বারণ। মাঝে মাঝে পানীয় জলের জন্য আসে, নিয়ে যায়। তখন আমরা কিছু বলি না।"
তমশ্রী অবাক বিস্ময়ে
জিজ্ঞেস করল-"তাহলে ওরা থাকে কোথায়?"
"জলে"
"জলে!"
"হ্যাঁ, জলেই উঁচু করে বানানো বাঁশ
আর কাঠ দিয়ে তৈরী ওদের বাড়ি।"
"ঐ বাড়ি সমুদ্রের জলের তোড়ে ভেঙে যায় না?"
"জলের তোড়ে? ওতে কী হবে? সুনামীর সময়েও ওদের বাড়ি একই রকমভাবে দাঁড়িয়েছিল। একটুও
হেলে যায়নি।"
"খায় কী?"
"সামুদ্রিক মাছ, অক্টোপাস।"
"ভাত খায় না?"
"পাবে কোথায়? পেলে খাবে।"
"শুধু মাছ খায়?"
"ওরা তো সমুদ্রের জলে থাকে, ওখানে তো মাছই
পাওয়া যায়।"
"ওগুলো কাঁচাই খায়?"
"চেয়ে চিন্তে কাঠকুটো জোগাড় করে।"
"ও"
"কেউ কেউ লুকিয়েচুরিয়ে রিসর্টে কোন কাজ করে অর্থ উপার্জনও
করে।"
"ঐ ছেলেটা কি লুকিয়ে এসেছিল? ওর নাম কী?"
"ও হাল্লু, বললাম না, পানীয় জলের জন্য মাঝেমাঝে আসে।"
বারান্দা থেকে তমশ্রীর মা
শৈলীর গলা পাওয়া গেল-"ঘরে আয়, কী করছিস ওখানে? রুমে লাঞ্চ দিয়ে গ্যাছে।"
অগত্যা তমশ্রীকে এক মাথা
জিজ্ঞাসা হজম করে ফিরতে হল। হাত ধুয়ে বাবা'মায়ের সঙ্গে খেতে বসল ও।
ভাতের গরাসগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ও ভাবছে হাল্লুর কথা, ও কি আজ ভাত খেতে পেয়েছে? বাবার ডাকে
হুঁশ ফিরল। বিষাণ জিজ্ঞেস করল- "শ্রী, খেতে বসে কী এত ভাবছিস?"
আবার প্রশ্নের ভূত মাথায়
চাপল তমশ্রীর। বিষাণ মানে ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করল-"জানো বাবা, এখানে এমন কিছু লোকজন থাকে যাদের ডাঙায় কোন ঘরবাড়ি নেই। ওরা
সমুদ্রের জলেই থাকে। ওখানেই কাজ করে, ছোটরা ওখানেই খেলে। ওরা জলকে একটুও ভয় পায় না।"
"হ্যাঁ, জানি তো, ওরা বাজাউ। ওরা তো এখানকার আদিবাসী নয়। ওরা যাযাবর, বাড়িঘর সমুদ্রের জলে অস্থায়ীভাবে বানায়। ওরা একজায়গায় থাকে
না তাই কোন বিশেষ দেশের নাগরিক নয়।"
"তাহলে ওদের অসুখ হলে কী হয়?"
"কিছু টোটকা ওষুধে সারলে সারে নাহলে মরে যায়।"
"এ বাবা, তাহলে হাল্লুর অসুখ হলে ও
মরে যাবে?"
"হাল্লু কে?"
"আমারই মতো একটা ছোট ছেলে। আজ জল নিতে এখানে এসেছিল।"
শৈলী তমশ্রীকে সাবধান করতে
বলল-"তুই আবার গোয়েন্দাগিরি করতে হাল্লুর পেছন পেছন ঘুরবি না।"
ঐদিন রাতে তমশ্রী স্বপ্নে
দেখল সমুদ্রের জলের তলায় একটা অদ্ভুত রাজ্য। সেখানে গাছে গাছে মণিমুক্ত ঝুলছে।
পাখিরা না উড়ে সাঁতার কাটছে হাঁসের মতো। বড় বড় মাছেদের মাঝখানে একটা ছোট্ট ছেলে।
ওর মাথায় রাজাদের মতো সোনার মুকুট। তবে পায়ের দিকটা মাছেদের মতো। ও হাতছানি দিয়ে
তমশ্রীকে ডাকছে। তমশ্রীও ওর দিকে এগিয়ে চলেছে। ওর নিজের পাও মাছেদের লেজের মতো হয়ে
যাচ্ছে। ঠাণ্ডা জল ক্রমশ ওর মাথা, বুক ডুবিয়ে দিচ্ছে।
সমুদ্রের ঘন অন্ধকারে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে ও। ওর গোঙানির আওয়াজে শৈলীর ঘুম ভেঙে
গেল। তমশ্রীকে ঝাঁকিয়ে শৈলী বলল-"কী রে, কী হয়েছে তোর? গোঙাচ্ছিস কেন?"
ঘুম ভাঙতে চোখ কচলে চারদিকে
তাকিয়ে তমশ্রী দেখল, কোথায় সমুদ্র, কোথায় সেই মুকুট পরা ছেলে, এ তো ওদের রুমের খাট। শৈলী
বলল- "ভোর হয়ে গ্যাছে, আর ঘুমোতে হবে না। চল, রিসর্টের বাগান থেকে ঘুরে
আসি।"
মায়ের প্রস্তাবে রাজী হয়ে
তমশ্রী যখন বাইরে এল তখন সূর্য সবে পুব আকাশে উঁকিঝুঁকি মারছে। নারকেল গাছের ফাঁক
দিয়ে সেই ঝিলিমিলি তমশ্রীর চোখে এসেও পড়ছে। সমুদ্রের বুকেও ঐ একই ঝিলিমিলির খেলা।
ওদের কলকাতার ফ্ল্যাটে ঐ সূর্যটা যে কোথায় ওঠে কোথায় ডুবে যায় তা ও টের পায় না।
শৈলী বলল-"ফিলিপাইনের জাতীয় ফল কী বল তো?"
"কী?"
"আম,
তবে বড় বড় খামারে চাষ হয়। বেশীরভাগ কারাবাও বা ফিলিপাইন ভ্যারাইটি, ওটাকে ম্যানিলা ভ্যারাইটিও বলে।"
"বাহ্"
"আমগুলো কাঁচাতেও বেশ মিষ্টি, জানিস।"
"চল না মা, সমুদ্রের ধারে যাই।"
"চল"
সমুদ্রের হাওয়ায় তমশ্রীকে
একটা উড়ন্ত প্রজাপতির মতো লাগছে। এগোতে এগোতে একটা অদ্ভুত নৌকা দেখল। ওটাই যেন
কারুর ঘরবাড়ি। ও বাবা,ঐ তো হাল্লু,একজন বয়স্ক মানুষকে কোন
কাজে সাহায্য করছে। বেশ মজার তো,হাল্লু নৌকা বাড়িতে থাকে।
তমশ্রী ওকে দেখে হাসাতে হাল্লুও আর গম্ভীর থাকতে পারল না। হাসিটা ওর নীলচে কটা
চোখকেও ছুঁয়ে গেল। ঘটনাটা শৈলীর দৃষ্টি এড়ায়নি তাই তমশ্রীকে জিজ্ঞেস করল-"ও
কে রে?"
তমশ্রীর অন্যমনস্ক
উত্তর-"সমুদ্রের রাজা।"
"মানে?"
"না না, ও হাল্লু। ও ইংরেজী বোঝে না, বলতেও পারে না তাই কথা বলতে লজ্জা পায়।"
বিকেলে আবার বিষাণের সঙ্গে
ঐ জায়গায় ফিরে এলো তমশ্রী। হাল্লুর নৌকার সামনে ওর নাম ধরে ডাকতে থাকল। অনেক
ডাকাডাকির পর হাল্লু বেরিয়ে এসে বলল-"আকু হাল্লু।"
তমশ্রীর হাঁ করা মুখ দেখে
বিষাণ বলল-"মনে হচ্ছে ও নিজের পরিচয় দিচ্ছে।"
হাল্লু হাতপা নেড়ে বলল-"ইকাও?"
তমশ্রী কিছু না বুঝেই বলল-"তমশ্রী।"
বিষাণ পাশ থেকে
বলল-"তোর নাম উচ্চারণ করতে গেলে ওর দাঁত ভেঙে যাবে।"
হাল্লু বলল-"বাগো?"
পাশ থেকে একজন কোস্ট গার্ড
বলল-"তুমি এখানে নতুন কিনা তা জিজ্ঞেস করছে।"
তমশ্রী মজা পেয়ে আকারে
ইঙ্গিতে বুঝিয়ে বলল-"আজ মাছ পেয়েছ?"
হাল্লু বলল-"তিননান
নাতিন।"
পাশ থেকে ঐ কোস্ট গার্ড
কথাটার মানে বুঝিয়ে দিল। ঘুরতে ঘুরতে বিষাণ বলল-"শ্রী, তোর সঙ্গে তো হাল্লুর ভালোই ভাব হয়ে গ্যাছে।"
হাল্লুর সঙ্গে ভাবের
প্রসঙ্গে তমশ্রী গর্ব অনুভব করল। ও এখন সমুদ্রের রাজার বন্ধু।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে
শৈলী মেয়েকে বিছানায় দেখতে পেল না। ও ভাবল আজও বিষাণ বোধহয় মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে
বেরিয়েছে। কিন্তু ওয়াশরুম থেকে বিষাণ বেরোতেই জিজ্ঞেস করল-"শ্রী কোথায়?"
"জানি না তো।"
"মানে? ওকে ঘরে না দেখে আমায় ডাকলে
না কেন?"
"আমি ভাবলাম ও ব্যালকনিতে আছে।"
"ভেবে নিলে হবে, চল ওর খোঁজ করি।"
এরপর তন্নতন্ন করে খুঁজেও
তমশ্রীকে কোথাও পাওয়া গেল না। রিসর্টের ম্যানেজার সিসিটিভির ফুটেজ থেকে ওর চলে
যাওয়াটুকুই দেখতে পেল। সিকিউরিটি গার্ডরা সন্দেহবশত হাল্লুর দাদুকে চেপে ধরল।
এমনিতেই ওরা ঝুটঝামেলার ভয়তে থাকে তার ওপর এই গণ্ডগোলে হাল্লুর দাদু বিধ্বস্ত হল।
উত্তরও তো কিছু দিতে পারছে না। কারণ হাল্লুকেও তো পাওয়া যাচ্ছে না। ওদের মহল্লার
সব লোকজন সমুদ্র তোলপাড় করে খুঁজেও হাল্লু আর তমশ্রীকে কোথাও পেল না। পরদিন তমশ্রী
ফিরল, সঙ্গে হাল্লু। সকলে হাল্লুকে এই মারে তো সেই মারে। বাধা
দিয়ে তমশ্রী বলল-"হাল্লুর কোন দোষ নেই। আমিই ওর কাছে সমুদ্র দেখতে চেয়েছিলাম।
ও আমার হাত পায়ে রবারের ফ্লিপার পরিয়ে দিয়েছিল। তারপর মনের আনন্দে আমরা ভাসছিলাম।
কত রকমের মাছ দেখলাম। তারপর একসময়ে ভাসতে ভাসতে আমরা পথ হারিয়ে অনেক দূরের একটা
দ্বীপে পৌঁছে গেছিলাম। ঐ দ্বীপটাতে বড় বড় ঘাসের জঙ্গল ছিল। ওখানে ঘোরাঘুরি করতে করতে খিদে পেতে একটা বড় গাছের ঝুলে
থাকা ফল দেখে আমরা ঐ ফল খেয়েছিলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই। আজ সকালে আমাদের ঘুম
ভাঙার পর বিপদটা বুঝতে পেরেছিলাম। আমার লাল স্কার্ফটা বীচে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত নাড়িয়ে
যাচ্ছিলাম। ওখানে একটা জেলে নৌকো আমাদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে। আমাদের মুখে সবকিছু
শুনে ওদের নৌকায় আমাদের তুলে নেয়। ওরাই এখানে পৌঁছে দিয়েছে।
তমশ্রীর মাথা জুড়ে লতাপাতার
মুকুট, হাল্লুরও তাই। মেয়ের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, তারপর আজ এই অদ্ভুত সাজে মেয়েকে দেখতে পেয়ে হতচকিত শৈলী
কাঁদতে কাঁদতে তমশ্রীকে জড়িয়ে ধরে বলল-
মা'কে এমন চিন্তায় ফেলতে আছে? তোর অজানাকে
জানার কৌতূহলই যত নষ্টের কারণ। ওদের জীবনযাত্রার সঙ্গে তোর কোন মিল নেই সেটা
একবারও ভাবলি না। ওরকম শারীরিক শক্তি তোর আছে? আজ যদি তোকে না ফিরে পেতাম
আমাদের কী অবস্থা হোত তা বুঝতে পারছিস?"
বিষাণ মেয়ের মাথায় হাত
বুলিয়ে বলল-"যাক বিপদ কেটে গ্যাছে। ওকে আর বকাবকি কোরো না।"
তমশ্রী বলল-"তোমরা
শুধু আমার কথা ভাবছ। হাল্লুর দাদুরও তো কষ্ট হয়েছে। ওর যদি কোন বিপদ হোত? ওর দাদুরও তো ও ছাড়া আর কেউ নেই। আমার জন্যই খামোকা ওর
ক্ষতি হয়ে যেত।"
বিষাণ মেয়ের মনের কথা বুঝতে
পেরে বলল-"তা আমাকে এই ক্ষতিপূরণের জন্য কী করতে হবে?"
তমশ্রী বলল-"তুমি
হাল্লুদের কিছু পোশাক আর অনেকটা খাবার কিনে দাও।"
হাল্লুর স্প্রিংয়ের মতো কোঁচকানো চুলে স্নেহের পরশ বুলিয়ে
বিষাণ বলল- "তথাস্তু ম্যাডাম।"