লাল ডাই দিয়ে রং করলে জামার রঙ হবে লাল। ফুলের ক্ষেত্রেও
তাই। ফুলের পাপড়ির মধ্যেও থাকে ডাই (Dye), মানে রঞ্জক
পদার্থ। কোষের মধ্যে থাকে ডাই, রঙের রাসায়নিক উপাদান।
রঞ্জক। অনেকে বলেন, পিগমেন্ট। একেক ফুলে একেক রকম। গাছের পাতা, ফুল,
ফলকে রঙিন করে দেয় বিভিন্ন রঞ্জক। আমাদের চোখে ধরা পড়ে হরেক
রঙ।
তবে রাতের অন্ধকারে চোখে ধরা পড়ে না। সূর্য উঠলে দেখতে পাই।
মানে, আলোর সাহায্য নিয়েই দেখতে হয়। কেমন সে আলো? দৃশ্যমান আলো। সূর্যের আলোক ছটার সামান্য অংশ। সেখানে আছে
সাত রঙ। বেগুনী (violet),
নীল (indigo), আকাশি (blue), সবুজ (green), হলদে (yellow), কমলা (orange) ও লাল (red)।
‘বেনীআসহকলা’ আর ইংরাজিতে রঙের প্রথম
অক্ষর বসিয়ে, ‘ভিবজর’ (vibgyor)। রঙের এই প্যাটার্ন বা নক্সা, বিজ্ঞানের
পরিভাষায় সূর্যের সাদা আলোর ‘বর্ণালী’ (line spectrum)।
বর্ণালীর প্রতিটি রশ্মির থাকবে নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা
কম্পাঙ্ক। আলো এক ধরণের ঢেউ, তরঙ্গ। তড়িৎ চুম্বকীয়
তরঙ্গ। ঢেউ-এর থাকবে শীর্ষবিন্দু, নিম্নবিন্দু। দুই নিম্ন
বিন্দুর মধ্যে পার্থক্যই তরঙ্গদৈর্ঘ। লালের তরঙ্গদৈর্ঘ, বেগুনী রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ আলাদা। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সব
চেয়ে বেশী আর কম্পাঙ্ক সব চেয়ে কম। কম্পাঙ্ক বেশী হলে তরঙ্গদৈর্ঘ কম হয়। বেগুনী
আলোর কম্পাঙ্ক সব চেয়ে বেশী।
সূর্য থেকে আসা সব তরঙ্গ চোখে দেখি না আমরা। দেখতে পাই
মাত্র চারশো থেকে আটশো ন্যানোমিটার দৈর্ঘের তরঙ্গ। চোখের রেটিনার পেছনে থাকা অপটিক
নার্ভ সেই তরঙ্গের অনুভূতি পৌঁছে দেয় মস্তিষ্কে।
সূর্যের সাদা আলো আদতে বহু-রঙা আলো (chromatic light)। সাত খানা
বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (বা কম্পাঙ্কের) আলোর সমাহার। এর মধ্যে থাকা বেগুনী বা লাল
রঙ, একরঙা আলো (monochromatic light)। এদের থাকবে নিদিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ।
প্রকৃতির বুকে রঙিন ফুল ফল দেখি আমরা। নেপথ্যে কী কারণ? সূর্যের আলো গায়ে এসে পড়লে বস্তুটি আলোক বর্ণালীর (light spectrum) অনেক গুলো রঙ শোষণ করে নেয় আর কিছু রঙ প্রকৃতিতে ছড়িয়ে দেয়৷ আমাদের চোখ এই
প্রতিফলিত রশ্মি, মানে রঙিন আলো দেখতে পেয়ে মস্তিষ্কে খবর পাঠায়। মস্তিস্ক
ফুটে ওঠে বস্তুটির রঙিন চেহারা।
আগের কথায় ফিরি। ফুলের মধ্যে থাকা রঞ্জক পদার্থগুলো সূর্যের
আলোর নির্দিষ্ট কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করতে পারে৷ সেগুলোর খানিক যখন বাইরে ছড়িয়ে
দেয়, আমাদের চোখ দেখতে পায়। এই প্রতিফলিত রশ্মিই ফুলের রং। মানে
ফুলের রঞ্জক পদার্থই ফুলের রং তৈরি করে।
রঞ্জকগুলোর অনেক নাম, অনেক ধরণ। তবে রসায়নিক
ধর্মের ভিত্তিতে তিন রকমের। পরফাইরিন (porphyrin), ক্যরোটিনয়েড (carotenoids), ফ্ল্যাভোনয়েড (flavonoids)।
অন্যতম প্রধান রঞ্জকটি পরফাইরিন গ্রুপের। কী নাম তার? ক্লোরোফিল (chlorophyll)। আমাদের খুব পরিচিত। ক্লোরোফিল থাকে বলেই গাছের পাতা সবুজ।
আর ফুল ফলকে রঙিন বানিয়ে দেয় অন্য দুই ধরণের রঞ্জক, ফ্ল্যাভোনয়েড
আর ক্যারোটিনয়েড। গাছের কোষের মধ্যে থাকে ক্লোরোপ্লাস্ট। সেখানেই জটিল রাসায়নিক
ক্রিয়ায় তৈরি হয় ক্লোরোফিল অণু। অনেক রকম এর। ক্লোরোফিল a, ক্লোরোফিল b…। উদ্ভিদের পাতায় সবুজ রঙ এনে দেয় ক্লোরোফিল। অনেক রকম কাজ
করে। সূর্যের আলো শোষণ ক’রে,
বাতাস থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড আর মাটি থেকে জল টেনে নিয়ে
গাছের খাবার, গ্লুকোজ বানায়। উদ্ভিদের যাবতীয় রঞ্জক পদার্থের চার ভাগের
তিন ভাগই ক্লোরোফিল a। ক্লোরোফিল b থাকে অনেক গাছে যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় কম।
ফুল ফল, শাকসবজিকে রঙিন বানাবার
প্রধান রাসায়নিক ক্যারোটিনয়েড। হলুদ, কমলা এবং লাল রঙ তৈরি করে।
উজ্জ্বল হলুদ কমলা রঙের ফুল তৈরি করে ক্যারোটিনয়েড গ্রুপের রাসায়নিক। আবার গাজর, মিষ্টি কুমড়োতে কমলা রং এনে দেয় এই গ্রুপের বিটা-ক্যারোটিন।
পাতাবাহার গাছের লাল বা হলুদ পাতা তৈরি করে ক্যারোটিনয়েড।
কেমন করে তৈরি হয়? সূর্যের আলো খুব কম পরিমাণ পেলে ক্লোরোফিল অণু ভেঙে যায়।
তৈরি হয় ক্যারোটিনয়েড। দৃশ্যমান আলোক বর্ণালীর ৪০০ থেকে ৬০০ ন্যানোমিটার
তরঙ্গদৈর্ঘ্যে শোষণ করে ক্যারোটিনয়েড। বর্ণালীর হলুদ, কমলা এবং লাল অংশে আলো প্রতিফলিত করে। তাই আমরা তাদের হলুদ, কমলা কিংবা লাল দেখি।
ক্যারোটিনয়েডের কথা অল্পে শেষ হবার নয়। দুই ধরনের
ক্যারোটিনয়েডের কথা বলতেই হয়। ক্যারোটিন (carotene) আর জ্যান্থোফিল
(xanthophyll)। ক্যারোটিনে
থাকে বিটা- ক্যারোটিন এবং লাইকোপিনের (lycopene) মতো রঞ্জক। লাইকোপিন, ফুল ফলে লাল রঙ তৈরি করে। সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়াকে সাহায্য করে
ক্যারোটিনয়েড। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (antioxidants) হিসেবেও কাজ
করে। মানে কোষের ক্ষতি করতে পারে এমন ধরণের জারন ক্রিয়া (অক্সিডেশন) বন্ধ করে দেয়।
ফ্ল্যাভোনয়েড গ্রুপের প্রধান যৌগ,
অ্যান্থোসায়ানিডিন (anthocyanidin)৷ এর কথা অল্প বলতেই হয়। মূলত পলিফেনল (polyphenol) যৌগ। অধিকাংশ ফুলের রঙ তৈরি করে অ্যান্থোসায়ানিডিন। কমলা, লাল থেকে শুরু করে বেগুনি নীল।
ফুল ফল বা পাতার রঙের জন্য দায়ী আরও কিছু উপাদান। রঞ্জকের
পরিমাণ, পরিবেশের তাপমাত্রা, মাটির পিইচ, জিনের প্রভাব।
নির্দিষ্ট কিছু জিন নিয়ন্ত্রণ করে ফুলে কোন্ ধরনের রঞ্জক
থাকবে। জিনগুলোর বৈশিষ্ট্য প্রজাতিভেদে আলাদা রকম। তাই একই প্রজাতির গাছে ভিন্ন
রঙের ফুল ফুটতে দেখি।