গল্প - চিপকো - মঞ্জিলা চক্রবর্তী । মার্চ - ২০২৪




    চিপকো








ম ঞ্জি লা
চ ক্র ব র্তী 






....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -

 

 

সত্যেন পার্কের সরকারি আবাসনে বাবা-মা আর ঠাকুমার সঙ্গে তুফান থাকে। তার বাবা-মা দু'জনেই চাকুরিজীবী। তাই স্কুল থেকে ফিরে সে ঠাকুমার কাছেই থাকে। কাছাকাছি একটা স্কুলে পড়ে সে। মর্নিং স্কুল হওয়ায় দুপুর দু'টোর মধ্যে সে বাড়ি ফিরে আসে। ফিরে চটজলদি স্নান খাওয়া সেরে নিয়ে সে স্কুলের পড়া নিয়ে বসে পড়ে। খানিক স্কুলের হোমওয়ার্ক এগিয়ে রাখে। যাতে বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারে

তাদের আবাসনের দু'পাশে পরপর ফ্ল্যাট বাড়িমাঝ বরাবর পিচ ঢালাই রাস্তা। সামনের দিকে একফালি ফাঁকা জায়গা। আর সেখানেই এক কোণার দিকে একটা বুড়ো বটগাছ রয়েছে। সেই গাছ থেকে সরু সরু ঝুরি নেমেছে। তুফান ও তার বন্ধুরা বিকেলে খেলার সময় ওই ঝুরিগুলো ধরে ঝোলা ঝোলে গ্রীষ্মের দীর্ঘ বিকেলে বট তলায় বসে তাদের গল্প আড্ডাও চলে

রোজ দিন স্কুলে যাওয়াবিকেলে একটু খেলাধূলাগল্প-আড্ডা এই সব নিয়ে তুফান ও তার আবাসনের বন্ধুদের ভালই কাটছিল। তাল কাটল আচম্বিতে। একদিন সরকারি দপ্তর থেকে জনাক'য় লোক এল তাদের আবাসনে। নীচে লোকজনের ভিড় দেখে তুফানের বাবাও গেল সেখানে। তুফানেরও ভীষণ কৌতুহল হচ্ছিলকিন্তু বাঁধ সাধে তার মা। সামনেই পরীক্ষা যে! সুতরাং একটু উঁকিঝুঁকি মেরেই সে আবার বই নিয়ে বসে পড়ে

কিছুক্ষণ পর তার বাবা ফেরত এসে জানায়, "বুড়ো বটগাছটা কেটে ফেলবে বলছে। ওই ফাঁকা জায়গাতে নতুন একটা বিল্ডিং উঠবে। সরকারি অফিসাররা তারই তদারকি করতে এসেছেন"

কথাটা শোনামাত্র তুফানের বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠে!উত্তেজিত হয়ে সে বাবাকে বলে "গাছটাকে কেটে ফেলবেনা...না... বাবা গাছটাকে কাটতে মানা করো তুমি"

শুনে তুফানের বাবা বলেন, "আমার কথা শুনবে রে বাবাসরকারি সম্পত্তিতে বিল্ডিং উঠবে আমরা বাধা দেওয়ার কে?"

তুফান তখন মাকে ধরে, "মাও মা তুমি কিছু একটা করো যাতে গাছটা ওরা না কাটে। যাও না ওদের গিয়ে বুঝিয়ে বলো। গাছেদের ব্যাপারে আমায় তো কত কী বলো"

তুফানের মা কী উত্তর দেবেন ভেবেই পান না। ছোট থেকেই প্রকৃতিকে ভালবেসে গাছেদের রক্ষা করার শিক্ষা দিয়ে আসছেন ছেলেকে। আর আজ ছেলের করুণ আকুতি শুনেও তাকে আশ্বস্ত করতে পারছেন না!

তুফানের আর পড়ায় মন বসে না। সে কেবল ছটফট করতে থাকে। কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে আর সে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করবে। যাতে তাদের প্রিয় বটবৃক্ষকে বাঁচাতে পারেসে বিষয়ে কিছু পরামর্শ করতে পারে তাদের সঙ্গে

বিকেলে সব বন্ধুরা মিলে জড়ো হয় সেই বটগাছ তলায়। খবরটা কারোরই অজানা ছিল না। তাই সবাই মন মরাচুপচাপ হয়েছিল। তুফানই ছেলের দলের লিডার। সেই বলা শুরু করে, "এখন আমাদের চুপ করে থাকলে চলবে না বন্ধু। ভাবতে হবেউপায় খুজতে হবে কিভাবে গাছটাকে বাঁচানো যায়!"

         তখন বিট্টু বলে, "আচ্ছা আমরা যদি সবাই মিলে অনুরোধ করি গাছটাকে না কাটার জন্য"

অহনা বলে, "আমরা যদি গাছ না কাটার জন্য সরকারের কাছে চিঠি লিখি - শুনবে না আমাদের কথাআর গাছটা কাটা না পড়লে বিল্ডিংও উঠবে না। আমাদের খেলার জায়গাটাও বেঁচে যাবে"

তুফানের বাবার বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল। সে বলল, "শুনবে না বোধহয়এটা সরকারি জায়গা তো তবুও আমরা একবার চেষ্টা তো করতে পারি"

জিতু দৌড়ে ঘর থেকে খাতা কলম নিয়ে এল। তুফান তার সুন্দর হাতের লেখায় লিখতে শুরু করে, "আমাদের আবাসনে একটি মাত্র বড়ো গাছ আছে। তার তলায় আমরা সবাই মিলে খেলা করি। এখানে আমাদের খেলার আর কোন জায়গাও নেই। এখানে বিল্ডিং উঠলে আমরা খেলার জায়গা হারাব। তাছাড়া ঔ বটগাছটিও কাটা পড়বে। খর গ্রীষ্মে শীতল ছায়া দেয় গাছটি। ঠান্ডা বাতাসে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আমাদের বাঁচার অক্সিজেন জোগায় সে। তাছাড়া কতো পাখিকাঠবিড়ালিপোকামাকড়... গাছে আশ্রয় নেয় গাছটিকে কেটে ফেললে আমাদের আবাসনটি মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করবে। আর আমরা যখন ওখানে খেলি ওই বুড়ো বটগাছটা দাদুর মতো আমাদের উপর নজরও রাখে। তাই আমাদের সকলের একান্ত অনুরোধ - গাছটাকে দয়া করে কাটবেন না!"

নীচে একে একে সব বন্ধুরা সই করে। তারপর সে চিঠিটাকে ভাঁজ করে পকেটে পুরে নেয়। বন্ধুদের বলে, "দেখিমাকে বলে এটাকে পাঠানো যায় কিনা!"

তার মা অফিস থেকে ফেরার পর পরই সে চিঠিটা মাকে ধরায় জমা করার জন্য। চিঠিটা পড়ে বিস্মিত হন তিনি! বটগাছটাকে তো নিজেও রোজই দেখেন কিন্তু ওই গাছটির প্রতি ছোট মানুষগুলোর অনুভূতি ও ভালবাসা তাকে বিচলিত করে তোলে! তিনি ছেলেকে আশ্বস্ত করেন, "তোদের চিঠি অবশ্যই জায়গা মতো পৌঁছে দেব

তাদের চিঠি দেওয়ার পর আরও সপ্তাহখানেক কেটে যায়  কিন্তু কোন সদুত্তর তারা পায় না। বরং হীতে বিপরীত হয়। গাছটি দ্রুত কেটে ফেলার তোড়জোড় শুরু হয়

শীগ্রই কাজ শুরু হবে। তুফানের বাবা-মা কী হতে চলেছে তা ছেলেকে বুঝিয়ে বলে। সব শোনার পর সে মনস্থির করে ফেলে, "আমাদেরকেই কিছু একটা করতে হবে"

সেদিন বিকেলে বটতলায় ছেলের দল গোল হয়ে বসলমাঝে তুফান। মৃদুমন্দ বাতাসে বটগাছের শুকনো পাতাগুলো আশীর্বাদের মতো তাদের মাথার উপর ঝরে পড়ল। তুফান আশীর্বাদস্বরূপ একটা শুকনো পাতা তুলে নিল হাতে। সেটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলতে শুরু করল, "বন্ধুরাআজ আমি একটা গল্প বলব তোদের। গল্পটা অনেক দিন আগে আমার মায়ের কাছে শোনা"

গল্পের নাম শুনে সবাই চেঁচিয়ে উঠে, "না...আমরা এখন কোন গল্প শুনতে চায় না। গাছটাকে বাঁচানোর কোন বুদ্ধি থাকলে বল"

- "আগে তোরা গল্পটা শোনতারপর না হয় বলিস"

তার অনুরোধে সবাই চুপ মেরে যায়। পুনরায় সে বলতে শুরু করে, "অনেক কাল আগের কথা। আমাদের দেশেরই ঘটনা। উত্তরপ্রদেশের উত্তরাঞ্চলহিমালয়ের পাদদেশযে জায়গাটাকে আমরা গাড়োয়াল অঞ্চল বলি। সেখানে রয়েছে পাইনের ঘন জঙ্গল। আর এই জঙ্গলের উপর স্থানীয় ঠিকাদারদের খুব লোভ ছিল। কারণ ওই অঞ্চলে ক্রীড়া সামগ্রী নির্মাণের  কারখানাগুলো ছিল। হালকা অথচ সরু লম্বা পাইন কাঠ দিয়ে খেলার ভাল সরঞ্জাম বানানো যায় বুঝলি। আর ওই কাঠের ক্রীড়া সামগ্রী বিক্রি করে তারা বিশাল মুনাফা লাভ করছিল। সরকার এই সব ঠিকাদার বা ব্যবসায়ীদের চাপে কাঠ সংগ্রহের কাজ নিজেদের হাতে না নিয়ে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। ফলে ঠিকাদাররা কোন নিয়ম না মেনে যথেচ্ছভাবে গাছ কেটে কাঠ সংগ্রহ করছিল। যার ফলে ভূমিক্ষয় বেড়ে গিয়ে এই অঞ্চলে ভয়ংকর বন্যা হয়। বিশেষত উত্তর কাশী অঞ্চল বন্যায় ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। তারপর ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা মিলে গাছ কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেতাদের আন্দোলনটা ছিল অন্য রকম। তারা হিংসাহানাহানির পথ বেছে নেয়নি। তারা তাদের প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে গানকে বেছে নিয়েছিল। গান গেয়ে তাদের প্রিয় গাছেদের বাঁচানোর আর্জি জানিয়ে ছিল। সকলের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়াতে আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে উঠছিল। আর এই আন্দোলনে গাড়োয়ালি মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। যাইহোকএত কিছুর পরও যখন অর্থলোভী ঠিকাদাররা ওই গাছেদের উপর কুঠারাঘাত করতে এসেছিল তখন আন্দোলনকারীরা হাতে হাত মিলিয়ে গাছগুলোকে জড়িয়ে ধরেছিল তাদের রক্ষা করার জন্য প্রত্যেকে জড়িয়ে ধরেছিল এক একটি গাছকেযাতে কুঠারের আঘাত গাছেদের উপর না পড়ে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য! এই প্রতিবাদ আন্দোলনের নামই হল 'চিপকো' 'চিপকোকথাটার মানে জড়িয়ে ধরা। গাছকে জড়িয়ে ধরে তারা গাছেদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল।ক্রমে 'চিপকোআন্দোলনের খবর ভারত ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। আর এই আন্দোলনের ফলে সরকার বাহাদুরেরও তখন টনক নড়েছিল। সুতরাং বন্ধুরা আমার গল্প বলার..."

তুফানের গল্প বলা শেষ হওয়ার আগেই সবাই আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠে। অবশেষে তারা তাদের প্রিয় গাছকে বাচাঁনোর একটা উপায় খুঁজে পেয়েছে। তারপর তারা তুফানের কথা মতো কী করবে না করবেকিভাবে করবে তার একটা পরিকল্পনা ছকে ফেলে। তারপর তারা চুপচাপ অপেক্ষায় থাকে

সেদিনটা ছিল রবিবার। ছেলেপুলেদের ছুটির দিন। বেলার দিকে বড়ো একটা গাড়ি আসেসঙ্গে যন্ত্রপাতি ও লোকলশকর। তাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না কী হতে চলেছে। তুফান দৌড়ে নীচে নেমে জোরসে হাততালি দিতে শুরু করে। এ যেন বিপদ ঘন্টা! শব্দ শোনামাত্র সব বন্ধুরা করতালি দিতে দিতে বাইরে বেরিয়ে আসে। তারা এগিয়ে যায় বটগাছের দিকে। তারপর ছোট ছোট হাত মিলে গোল হয়ে গাছটিকে জড়িয়ে ধরে

এমন ঘটনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না! আবাসনের বড়রা তাদের ঘরের দুরন্ত ছেলেপুলেদের কর্মকাণ্ড দেখে বিস্মিত! সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে কী হয় কী হয়... ভেবে!

ওদিকে গাছ কাটার লোকেরাও প্রস্তুত তাদের কুঠার হাতে। কিন্তু কুঠার চালাবে কোথায়শিশু কিশোরের দল ভালবাসার আলিঙ্গনে জড়িয়ে রেখেছে তাদের প্রিয় গাছকে। তারা ছোটদেরকে তখন শাসায়, "সরে যাও তোমরাআমাদের কাজ করতে দাও"

তারা সমস্বরে জানায়, "নাআমরা সরবো না। প্রাণ থাকতে এই গাছকে আমরা কাটতে দেব না। তোমরা ফিরে যাও..."

        তারা তখন আবাসনের বড়োদের কাছে অনুরোধ করে ছোটদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তাঁরাও তাদের আবেদনে সাড়া দেয় না

এইভাবে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে ছোটদের এক পাও সরাতে না পেরে তারা বিফল হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় বলে, "গাছটা কাটতে আবার আসব কিন্তু!"

"একদিকে গাছকে বাঁচানোর জন্য তাকে জড়িয়ে রয়েছে আবাসনের ছোটরাঅন্যদিকে তাদের উপর কুঠার উদ্যত হাত...", এই ছবিটি তুলে সোশাল মিডিয়ায় আপলোড করে দেন তুফানের মা। প্রতীকী ক্যাপশন দেন - 'চিপকো'

ছোটদের এই ছবিটি সভ্য সমাজের নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অতি দ্রুত ছবিটি ছড়িয়ে পড়ে। 'চিপকোছবিটি নজরে পড়ে রাজ্যের পরিবেশ মন্ত্রীর। তিনি তৎক্ষনাৎ বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন

পরদিনই তুফানদের আবাসনে সরকারি প্রতিনিধি দল হাজির হয়। সমস্ত বৃত্তান্ত জানার পর তাঁরা গাছ না কাটার প্রতিশ্রুতি দেয় ছোটদের

ছোটদের এই 'চিপকোপ্রতিবাদ সফল হয়। ছোটদের আন্দোলনের ফলে বুড়ো বট বেঁচে যায়। বিকেলে তুফান ও তার বন্ধুরা জড়ো হয় বট তলায়। আনন্দে সবাই আরও একবার হাতে হাত মিলিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে!