গল্প - ভেজালের মধ্যে ভুত - সুদীপ শেখর পাল । মার্চ - ২০২৪






 ভেজালের মধ্যে ভুত







সু দী প 

শে খ র

পা ল







....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -

 

 

বারুইপুরের রবীন্দ্রভবন থেকে বেরিয়ে শিবনাথবাবু দেখলেন ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছেরাত ন'টা বেজে গেছেপদ্মপুকুর গ্রামে যাওয়ার কোন কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেইঅগত্যা ছাতা খুলে হাঁটতে শুরু করলেন

মহকুমা শহর বারুইপুরে ছোট বড় মিলিয়ে খান পনেরো পত্র - পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে ছোটদের পত্রিকা 'জানালা' বেশ নাম করা। সেবার গ্রীষ্ম সংখ্যায় ছিল ভুত নিয়ে চার - চারটি গল্প। একদম গা ছমছমে গল্প। যারা পড়ল তারা গল্প করল সহপাঠীদের কাছে। আবার যারা ছুটিতে মামা বাড়ি, পিসিবাড়ি গেল তারা মামাতো-পিসতুতো ভাই বোনের কাছে গল্প করল। কারো ভালো লাগল গেছো ভূতের কথা - যে কি না গাছের উপর থেকে পাকা ফল মাটিতে ফেলে দেয়। যদি কেউ সেই ফল কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য উপুড় হয় অমনি তার পিঠে ভুত চেপে বসে। ব্যাস, ঘন্টা খানেক ভুতকে নিয়ে ঘোরো এবার! কারো ভালো লাগল ভেজাল দেওয়া ভুতের কথা, যে কিনা সারাদিন ঘুরে ঘুরে নানান জিনিষে ভেজাল দিয়ে বেড়ায়। গোলমরিচের সঙ্গে পেঁপের বীজ, পোস্তর সঙ্গে কাঠের গুঁড়ো, তেজপাতার সঙ্গে শুকনো সবেদা পাতা- এইসব। যারা গল্প লেখেন তারাও এই ভুতের ভেজাল দেওয়ার গল্পকে খুব প্রশংসা করল ও ঠিক করল ভোতিক সাহিত্যে এহেন ভুত চরিত্র সৃষ্টি করার জন্য লেখক শিবনাথ সাধুখাঁ কে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। তা' সেই সম্বর্ধনার তারিখ ঠিক করতে করতে ভাদ্র মাস এসে গেল৷ এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান শেষ করেই তিনি ফিরছিলেন।

অপ্রশস্ত রাস্তা৷ ঠাসা বাগান দুদিকে। ছাতা থাকলেও জামা কাপড়ে জলের ছাঁট লাগছে৷ হঠাৎ দেখলেন তার সামনে একজন লোক ছাতা মাথায় যাচ্ছে৷ কী মনে করে পিছনে তাকালেন। অবাক হয়ে দেখলেন যে পিছনেও একজন আসছে ছাতা মাথায়। ভাবলেন, যাক, আমি একা নই। আমার মতো আরো লোক আছে৷ তারপর আবার যেই সামনে তাকিয়েছেন, দেখলেন সামনে একজনের বদলে দু' জন লোক। এদিক - ওদিক তাকিয়ে দেখলেন লোক সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছে। বৃষ্টির মধ্যেও তিনি ঘেমে উঠলেন। লক্ষণ তো ভালো নয়! ডাকাতের খপ্পরে পড়লেন শেষ পর্যন্ত? কিন্তু এত ডাকাত তার মতো সাধারণ লোকের কাছে ডাকাতি করতে আসবে কেন, পাবেই বা কী! কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছেন না। জোরে হাঁটতে লাগলেন। কিছু সময় পরে সামনের লোকজন গতি কমিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গেল, পিছনের লোকজন কাছে চলে এলো। তিনি দাঁড়ালেন, বলা ভালো তাকে দাঁড়াতে হলো। সামনে একটা বটগাছ সিমেন্টের বাঁধানো বসার জায়গা। তিনি বসে পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করলেন। এমন সময় সামনে এলেন এক ভদ্রলোক। খালি গা, প্রকাণ্ড ভুঁড়ি, ভুঁড়ির উপরে সাদা পৈতে দোল খাচ্ছে। যদিও বৃষ্টি কমে গেছে, তবুও ভিজে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু সেই ভদ্রলোক ওসব কোন কিছু ভ্রুক্ষেপ না করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ বললেন, কী বুঝঝ? ভেজাল না আসল?

শিবনাথবাবু কী উত্তর দেবেন বুঝতে পারছেন না। কীসের ভেজাল বা আসলের কথা তাই তো বুঝতে পারছেন না। আমতা আমতা করে বললেন- যা' আছে সব দিচ্ছি, দয়া করে মারধোর করবেন না। বলেই পাঞ্জাবীর পকেট হাতড়াতে লাগলেন।

একটা হাসির রোল উঠল৷ পৈতেধারী বললেন, আমাকে চিনলে না, গুপি গাইন বাঘা বাইন দেখনি? এইবার মনে পড়ল শিবনাথবাবুর। হ্যাঁ, তাই তো। ভুতো রাজা সামনে দাঁড়িয়ে৷ আপনি আপনি মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, 'ভুতো রাজা'। কিন্তু সে তো গল্প কথা! বাস্তবে নেই। ভূতের গল্প লিখতে হয় তাই লেখেন তিনি। নিজে ভুত একদম বিশ্বাস করেন না। তবে সে কথা বললেন না। বললেন, রাজামশাই বলুন কী বর দেওয়ার জন্য এখানে হাজির হলেন।

- বর দেব কেন! জবাব নিতে এসেছি৷ ভূতেদের ভেজাল দিতে তুমি কোথায় দেখেছ?

এতক্ষণে শিবনাথবাবুর কাছে ব্যাপারটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। কপালের ঘাম মুছলেন৷ এদিকে ভূতো রাজা বলে চলেছেন- দেখ, লেখক ভূতেদের নিয়ে গল্পের ছলে যা' নয় তাই বলবে তা' আমরা মেনে নেব না। আমাদের সব কিছু বিশুদ্ধ আর আমরা নাকি ভেজাল দিই। নিজেদের কু-কর্ম ঢাকতে আর কী কী করবে বল দেখি!

শিবনাথ বাবু কোনদিন ভুত দেখেননি। কেউ যে ভূত দেখতে পারে তা'ও তিনি বিশ্বাস করেন না। তাই ভুতো রাজাকে ভুত ভাবলেন না। সেই সঙ্গে মনে মনে ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা তৈরি করতে লাগলেন৷ হতে পারে এটা এ সুখময় বাবুর চক্রান্ত। নামটা সুখময় হলে কী হবে, সব সময় যেন দুঃখে ডুবে আছে ৷ তার গল্প এবারে ছাপা হয়নি। মনে হয় সেই রাগে লোক পাঠিয়ে ভুতের ভয় দেখাচেছ। বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকা যায় না, তাই বললেন– আমাদের কু-কর্ম আসলে ভূতেদেরই কু-কর্ম, তাই লিখেছি৷

- মানে? মানুষ আর ভুত এক হলো? জানোনা, মানুষ মরে ভুঁত হয়?

- ভুত দিয়ে মানুষ তৈরি হয়। সেই ভুত গুলো হল- ক্ষিতি, অপ, তেজ.........

- থাক, থাক। বিজ্ঞানের ওই পাতাটাই পড়েছ। মানুষ মরে যাওয়ার পর তার আত্মা চলে যায় সেটা পড়োনি?

- আমাদের বিজ্ঞান এ কথা বিশ্বাস করে না।

- ওহ ! বিশ্বাস করে না। কী বিশ্বাস করে শুনি? আমি যে একসময় মানুষ ছিলাম, সেটা বিশ্বাস করে?

- আপনি এখনো মানুষ আছেন৷ যেহেতু চিনি না, তাই বলতে পারছি না। একটু সময় দিন ঠিক বার করে ফেলব আপনি কে, কী উদ্দেশ্যে আমার পিছনে লেগেছেন।

এই সময় অন্ধকারের মধ্য থেকে একটা আওয়াজ উঠল- রাজামশাই হকুম করুণ গলাটা ছিড়ে ফেলি। কেউ বলল- ছিড়ে ফেললেই হল ! ভূতেদের অরিজানিলিটি নষ্ট হবে না? আমাদের নিয়ম হলো ঘাড় মটকে দেওয়া, ছিড়ে ফেলা নয়। - এই জন্য তোদের কোন উন্নতি হল না। অবশ্য কেউ কেউ প্রাচীন সংস্কার নিয়ে বসে আছে। আমি একটা নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি লেখক তো, তাই একে লিখিয়ে মারব।

ভূতো রাজা বিরক্ত হয়ে বললেন- তোদের শুধু মারার চিন্তা। মারলে তোদের কি আর দুটো হাত গজাবে? একে মারলে তোদের কী সর্বনাশ হবে জানিস?

- এ ব্যাটা এক্ষুণি ভূত হবে । তারপর যদি লিটল ম্যাগাজিন ছাপে আর কেনার জন্য দিন রাত কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে সহ্য করতে পারবি ? শিবনাধবাবু ভয় পেয়েছিলেন। মরার ভয় না হোক মারধরের ভয় তো আছেই ৷ এদের উদ্দেশ্যটাও বোঝা যাচ্ছে না।

এমন সময় বৃষ্টিটা জোরে এলো । ভুতো রাজা বলল- ভয় নেই। আমরা কারো ক্ষতি করতে চাই না। তবে উচিত শিক্ষা দেব যদি তিনদিনের মধ্যে গল্প লেখার দরুণ পাওয়া মানপত্র খানা ফিরত না দাও ।

- আচ্ছা ফিরত দেব। সেই সঙ্গে বলব, আপনাদের দেওয়া মানপত্র আমি ফিরত দিচ্ছি কারণ আমি মিথ্যে গল্প লিখেছি। আসলে ভুত বলে কিছু নেই।

- কিছু নেই? প্রমান এখুনি দিতাম, কিন্তু সেকেলে ধরণের প্রমাণ দেব না। এবার আমাদের প্রমান হবে একদম আনকোরা। শেষ কথা বলে যাচ্ছি– মানপত্র ফিরত দেবে আর বলবে যে, ভুতেরা কখনো ভেজালের কারবার করে না।

               - নিমেষে ভূতো রাজা উধাও হয়ে গেল। সেই সঙ্গে তার সাথীরাও৷ এই দেখে শিবনাথবাবু মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন, অজ্ঞান হতে হতে বেঁচে গেলেন৷ ভূত যে এতক্ষণ ছিল, অর্থাৎ ভূত যে আছে তার প্রমাণ এর চেয়ে আর কী হতে পারে? তবুও শিবনাথ বাবু ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজতে লাগলেন।

খটকা লাগা শুরু হল দু'দিন পর থেকে। লক্ষ্য করলেন চালে আর কাঁকর থাকছে না, গোলমরিচের মধ্যে পেঁপের বীজ আর দেখা যাচ্ছে না। এমনকি রসোগোল্লা - সন্দেশের স্বাদও কেমন যেন আগের থেকে ভালো হয়েছে। একদিন তারক মুদি ডেকে বলল- ও মশাই, শুনেছি আপনি ভূতের গল্প লিখে নাম করেছেন৷ দেখুন দেখি কী ভুতুরে কাণ্ড! পয়সা দিয়ে মাল কিনছি, ভেজাল তো আমি দিচ্ছি না, ওরাই দিচ্ছে। কিন্তু বারুইপুরে আনলেই ভেজাল আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তাই দাম না বাড়ালে আর চলছে না।

শিবনাথ বাবু ভাবতে লাগলেন। তবে কোন ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য নয়, মানপত্র খানা কীভাবে ফিরত দেবেন তাই নিয়ে॥