গল্প - কাঁঠালগুড়ির আশ্চর্য মানুষ - রম্যাণী গোস্বামী । জানুয়ারি - ২০২৪

 






 কাঁঠালগুড়ির আশ্চর্য মানুষ




র ম্যা ণী 
গো স্বা মী






....

....

কিশোর বার্তা-র 
এই গল্পটির ছাপা সংখ্যাটি রেজিঃ ডাকে পেতে -

 

 

আমার বড়পিসো ছিলেন কাঁঠালগুড়ি টী এস্টেটের ম্যানেজার। আজ থেকে প্রায় তিরিশ চল্লিশ বছর আগেকার কথা বলছি। তখন ডুয়ার্সের চা বাগানগুলোর রমরমা অবস্থা। আর কাঁঠালগুড়ির বাগানটা ছিল বিশাল ছড়ানো ছেটানো। বাগানের ঠিক মাঝ বরাবর কাঠের তৈরি দোতলা ম্যানেজারস বাংলোটা। তখন ইলেক্ট্রিসিটির কোনও বালাই ছিল না। সন্ধ্যার পরে দোতলার পিসিদের শোবার ঘরেই শুধু একটা জোড়াতালি মার্কা আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা ছিল। রাতের বেলায় নিচের তলায় তাই কেউ যেত না। এমনিতেও বাংলোর বাবুর্চির কাছে শুনেছি যে নিচতলায় রাতের বেলায় নাকি ভূতেরা গিজগিজ করে। তবে আমি কখনও তাদের দেখিনি। তবে হ্যাঁ, জোনাকিদের দেখেছি। 

গোটা চা বাগানে সন্ধের পর থেকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে খেলা করত শুধু জোনাকিরা। মনে হত যেন মুঠো মুঠো তারাদের কেউ দু’হাত ভরে এনে ছড়িয়ে দিয়েছে জমি থেকে দেড় ফুট উঁচু জমাট অন্ধকার প্রান্তরে। মাঝে মাঝে শুধু রেইনট্রি গুলো দাঁড়িয়ে থাকত উজ্জ্বল তারাদের উপরে থমথমে একতাল অন্ধকার ছাতার মত। বাংলোর দোতলার বারান্দা থেকে সেই দৃশ্য দেখতে কী যে ভালো লাগত। আমি আর আমার চাইতে চার বছরের বড় পিসতুতো দাদা সন্ধেবেলা আগেভাগেই পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সেই বারান্দায় বসেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম। সারাক্ষণ খালি ‘পড়, পড়, পড়তে বস’ ইত্যাদি বলার মত কেউই ছিল না।  

পিসিদের বাংলোর কাছে ছিল একটা ছোট্ট নদী। নদীর নামটা এখন আর মনে নেই। তবে নদী আর তার আশেপাশের গোটা এলাকার ছবিটা পরিষ্কারভাবে মনে গেঁথে আছে এখনও। ছোট সেই নদী পেরলেই টিলা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে এক দৌড়ে উঠে যাওয়া যায় টিলার একেবারে মাথায়। সেখানে আছে এক মন্দির। বহু পুরনো মন্দির সেটা। ভিতরে কষ্টিপাথরের তৈরি বিরাট এক মসৃণ শিবলিঙ্গ। কে যে কবে মন্দিরটা বানিয়েছিল তা আমরা জানতাম না। কোনও পুরোহিত আসত না। পুজো হত না। কেমন ফাঁকা ফাঁকা জায়গাটা। কিন্তু নদী পেরিয়ে ওই টিলার উপরে তরতরিয়ে উঠে যেতে ভীষণ আনন্দ পেতাম সবাই। বাগানের বন্ধুরা মিলে আমাদের জোরদার লুকোচুরি খেলার জায়গাই ছিল টিলার উপরের ওই পুরনো ভাঙা মন্দির এবং তার আশেপাশের জঙ্গুলে অঞ্চলটা। বড় কোনও হিংস্র জানোয়ার সেখানে ছিল না। ভাম, শেয়াল, বাঁদর আর খরগোশ। আর পাখি ছিল অনেক। শীতকালে সাপেরা ঘুমোয়। তাই সে ভয় ছিল না। প্রতিবছর শীতের ছুটিতে আমি চলে যেতাম বড়পিসির বাড়ি। ওই সময় পড়াশোনার তেমন কোনও চাপ নেই। সমস্তটা দিন খেলায় মেতে থাকতেও তাই বারণ ছিল না কোনও। খেলতে খেলতেই একদিন এক ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে পড়েছিলাম। সেদিনের কথাই বলতে বসেছি আজ। আর সেদিনই আমি প্রথম দেখি ওই আশ্চর্য মানুষটিকে। 

ঘটনাটার কথা একটু বলি। ছোট্ট সেই নদীর বুকের চ্যাপ্টা আর মসৃণ পাথরে পা ফেলে ফেলে বেশ তো পেরিয়ে গিয়েছি তাকে আমরা দুই বন্ধু। বন্ধুর নামটা এখানে জানিয়ে রাখি। ওর নাম কুটুন। কুটুন ছিল আমার চা বাগানের বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি ফ্রক আর ও হাফ প্যান্ট। কত ভালো বন্ধুর মতো ওকেও হারিয়ে ফেলেছি জীবন থেকে। কোনও যোগাযোগ নেই আর। ইস, আমাদের সময় যদি তোমাদের মত ফেসবুক, হোয়াটসআপ এগুলো থাকলে বেশ হত। যাক সে কথা। নদী পেরিয়ে আমরা এক ছুটে টিলায় উঠে দুজনে মিলে গিয়ে তো লুকিয়েছি মন্দিরের গর্ভগৃহে। বাকি দলটা তখন নদীর ওপারে বাগানের মধ্যে খোলা মাঠে ডাংগুলি খেলতে ব্যস্ত। জানি যে একটু পরেই আমাদের খোঁজ পড়বে। খুঁজতে খুঁজতে ওরা সোজা চলে আসবে এখানে। কিন্তু সেটা জেনেও আমাদের উৎসাহ আর ধরে না। ঠাণ্ডা ঘরের ভিতরে শিবলিঙ্গের আড়ালে চুপটি করে বসে আছি তো আছিই। সকালে দেখেছি ঈশান কোণে একটু একটু করে মেঘ জমেছে। তাছাড়া বাইরে তখন ঝকঝকে আকাশ। তাই গরম জামা টামা গায়ে দিইনি। তোমরাই বল। গরম জামা গায়ে চাপিয়ে কি কেউ খেলতে বেরোয়? এদিকে মন্দিরের গর্ভগৃহের ভিতরে কনকনে শীতে আমাদের দুজনের হাত পা জমে যাওয়ার জোগাড়। জোরে কথা বলতেও পারছি না। যদি ইতিমধ্যে সকলে এসে গিয়ে থাকে? জঙ্গলের দিকটায় আমাদের খুঁজতে যাওয়ার আগেই গলা শুনে সব টের পেয়ে যাবে না? 

ইশারায় কুটুনকে বললাম, কী রে? এখনও কারোর পাত্তা নেই কেন? 

কুটুনটা মনে হল ব্যাপার স্যাপার দেখে একটুখানি ভয় পেয়েছে। যদিও ও সেটা কিছুতেই স্বীকার করবে না। বরং চোখ পাকিয়ে এমন একটা ভাব করল যেন আমার জন্যই আর একটু হলেই দুজনে ধরা পড়ে যেতাম। কুটুনের বেশি বাড়াবাড়ি। মনে মনে ওর মুণ্ডুপাত করতে করতে আবার চুপচাপ বসে আছি হিম ঠাণ্ডা চ্যাটালো পাথরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে। কিছুক্ষণ ওভাবে থাকতে থাকতে কখন যেন ঘুম জড়িয়ে এল আমার দুই চোখে। বাইরে একটা রিমঝিম ঝিমঝিম রুমঝুম ঝুমঝুম শব্দ হচ্ছে কোথাও। মন্দিরের ছাদে পাথরের গায়ে মনে হল পাহাড়ি ঝোরার মত আছড়ে পড়ছে জলকণা। আর আমি বসে আছি ঝোরার তলায় একটা লুকনো গুহায়। পাথুরে গুহার ভিতরটা কী ঠাণ্ডা! উফ! নাহ্‌, নির্ঘাত ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি। 

একটু বাদের স্বপ্নে চলে এল এক ঘোর বর্ষার রাত। লোডশেডিং চারিদিকে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমাদের টাকির একতলা বাড়ির ঘুপচি রান্নাঘরের মেঝেতে বসে মা গ্যাসের উনুনে খিচুড়ি চাপিয়েছে। মুসুর ডালের খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা আজ রাতের মেনু। কড়াইতে তেলের মধ্যে মাছ ভাজার প্রবল চড়বড় শব্দ। নাকে ভেসে আসছে তার স্বাদু গন্ধ। বাইরে একটানা বৃষ্টির ঝমঝমে আওয়াজটা কেমন সুরেলা গানের মত আমায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে গভীর ঘুমের দেশে। উনুনের ওম থাকা সত্ত্বেও কেমন যেন শীত শীত করছে। হঠাত চোখ মেলে দেখলাম মা সত্যিই আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলছে, এই মিঠি, দ্যাখ, বাবা বাজার থেকে আজ কত বড় ইলিশটা এনেছে। পদ্মার ইলিশ। একদম টাটকা। একটা ইলিশ মাছ ভাজা খাবি রে? কড়া করে ভেজেছি। তারপরই সুর পালটে মা কেমন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, অ্যাই, অ্যাই বোকা মেয়ে, পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস কেন! তুই এখন বাড়ি ফিরবি কীভাবে?  

আমি চমকে জেগে উঠলাম সঙ্গে সঙ্গে। বুকের ভিতরে, বুকের বাইরেও, গোটা জগতময় মায়ের মুখের ওই একটাই কথা তখন মরুভূমির তপ্ত বালিতে ধেয়ে আসা ঝড়ের মত উথাল পাথাল করছে। তুই এখন বাড়ি ফিরবি কীভাবে? বাড়ি ফিরবি কীভাবে তুই... মিঠি?

সেকী! কতটা সময় পেরিয়ে গেছে? কিচ্ছু টের পাই নি তো? কুটুন কই? আমার বাকি বন্ধুরা সব কোথায়? কেউ আসেনি আমাদের খোঁজে? আতঙ্কে হাত পা ভীষণ কাঁপছে আমার। মন্দিরের দেওয়াল ধরে ধরে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখি কখন যেন আবছা আঁধার ছেয়ে গেছে আকাশের বুকে। আর ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টিতে চারিপাশ সাদা। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। এমনকি কুটুনকেও কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। এতদিন খেলতে এসেছি এখানে। একা লুকিয়ে থেকেছি মন্দিরের ভিতরে কোণা খামচিতে কতবার। অথচ এমন অচেনা লাগেনি জায়গাটাকে। এত ভয় পাইনি। কখনও না। জীবনেও না। 

এক মুহূর্ত মনে হল যে মাকে আর দেখতে পাব না কোনওদিন। গঙ্গার পাশে আমাদের ছোট্ট সাদাসিদে বাড়িটা, পোষা কাকাতুয়া গুডলা, সাদা বলের মত কুট্টুসটা আমাকে দেখলেই কেমন লাল টুকটুকে জিভ বের করে চেটে দেয়, ওদের দেখতে পাব না আর। বাবা সাইকেলের কেরিয়ারে চাপিয়ে গাজনের মেলা দেখতে নিয়ে যায়। মা তার আগে চুলে ফিতে দিয়ে কষে বেঁধে দেয় দুই বিনুনি। সব শেষ। ঝাপসা বৃষ্টিটা দৃশ্যগুলোকে যেন ধুয়ে মুছে নিয়ে যাচ্ছে দূরে। আর ধীরে ধীরে অদেখা এক জগত এসে গ্রাস করে নিচ্ছে আমায়। এবার বড়পিসির বাড়িতে পোঁছে দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় বাবা যেমন একবার আমার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার চোখের কোণায় বাষ্প এসে জমেছিল ঠিক সেরকম হাহাকার উথলে উঠল বেচারি আমার ছোট্ট হৃদপিণ্ডের খাঁচা থেকে। বাড়ি ফিরবি কীভাবে তুই... মিঠি?          

চরম আতঙ্কিত অবস্থায় বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমি লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকলাম টিলার পাকদণ্ডী বেয়ে। পড়ে গেলে যে হাত পা ভাঙবে তখন সে হুঁশও নেই। নদীর সামনে এসে হতবাক আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। কোথায় সেই ছোট্ট নদী যাকে পায়ে পায়ে পেরিয়ে এসেছিলাম? এ যে ভয়ঙ্করভাবে ফুঁসছে! পাথরগুলো অদৃশ্য এখন। ফুলে ফেঁপে ওঠা বিপুল জলরাশি তলায় লুকিয়ে থাকা পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে রূপকথার পাতার রাক্ষসের মত গর্জন করতে করতে ছুটে যাচ্ছে। আমি ধপ করে বসে পড়েছি নদীর ধারের ভেজা মাটিতে। বুকের ভিতরে একটু আগে স্বপ্নে মায়ের বলা কথাটা ধস নামাচ্ছে যেন। মিঠি? তুই বাড়ি ফিরবি কীভাবে?  

তখনই আমি প্রথম দেখি ওই আশ্চর্য মানুষটিকে। কোনও কোনও মানুষকে দেখলে কেন যে আশ্চর্য লাগে তা আজও জানা হয়নি। লোকটার চেহারায় তেমন কোনও বিশেষত্ব ছিল না। সাধারণ চা শ্রমিকরা যেমন হয়, তেমনই। খাটো ময়লা ধুতি পরনে। খালি গা। মেটে গায়ের রঙ। দড়ি দড়ি পাকানো দীর্ঘ শরীর। হ্যাঁ, প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা তো হবেই সে। আর বিশেষত্ব ছিল ওর চোখে। এই রকম তীক্ষ্ণ চাহনি আমি আগে দেখিনি। ওর কোমরে হাঁসুয়ার মত একটা কিছু ঝুলছিল। হয়ত ঘাস টাস কাটতে এসেছিল নদী পেরিয়ে এদিকটায়। বৃষ্টির পাঁচিল ভেদ করে ও লম্বা লম্বা বকের মত পা ফেলে দ্রুত চলে এল আমার সামনে। ঘোলাটে নদী তখনও গর্জন করে বয়ে যাচ্ছে আর সেই গর্জনকে ছাপিয়ে নদীর ধারে হাত পা ছড়িয়ে বসে আমি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছি। এইসব দেখে মানুষটা তার কোমরে দুই হাত রেখে শরীর বাঁকিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। তারপর ওদের ভাষায় আমাকে বলল, এই, তুই ওই ম্যানেজারবাবুর বাড়ির মেয়েটা না? কাঁদিস কেন? খিদা লাগছে? 

চিন্তা করো? একে আমার বাড়ি যাওয়ার চিন্তায় মাথা পাগল অবস্থা আর লোকটা কিনা এসব বলছে! আমি লোভী? আমি পেটুক? আমার সবসময় খাই খাই ভাব? চোখ পাকিয়ে উত্তরে কিছু বলতে যেতেই মনে পড়ে গেল যে আমি এই একটু আগেও মন্দিরের ভিতরে বসে ইলিশ মাছ ভাজার স্বপ্ন দেখেছি! এই রে! লোকটা আমার স্বপ্নের কথা কীভাবে জানল? আমি অবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যেতেই টের পেলাম যে সে চোখে চোখে কী যেন একটা ম্যাজিক করল। ওমনি আমার পেটের ভিতরে জেগে উঠল দাউদাউ খিদে। হুড়মুড় করে মনে পড়ে গেল যে পিসোদের বাংলো থেকে বেরিয়েছি তাও নেই নেই করে চার ঘণ্টা হয়ে গেছে। খেলতে আসার উল্লাসে দুধের কাপ ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখিনি। কুটুন এসে ডাকল। কোনওমতে একটা জ্যাম মাখা ব্রেড মুখে পুরেই সঙ্গে সঙ্গে দে ছুট।  

আর এখন ইচ্ছে করছে গোটা পৃথিবীটাকে গিলে খাই। এমন খিদে লাগতে লাগল যে একটু আগের ভয়টয় মুহূর্তে উধাও। রকমসকম দেখে লোকটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্যরকমের হেসে উঠল। লক্ষ করে দেখলাম যে ওর চোখের মত দাঁতগুলোও খুব ঝকঝকে। তারপর আবার বকের মত পা ফেলে ফেলে সে ঢুকে গেল জঙ্গলের ভিতরে। 

কোথায় যে গেল! যাকগে। গেলে যাক যেখানে খুশি। কিন্তু আমার যে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। এতক্ষণে পিসিদের বাবুর্চিটা নিশ্চয়ই লাল লাল মুরগির কারী আর ধোঁয়াওঠা বাসমতী চালের সাদা ভাত নিয়ে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমার দেরি দেখে বাড়িতে কেউ খায়নি। কথাটা ভাবতেই এতদিন যা যা সুখাদ্য খেয়েছি, বিরিয়ানি, চিকেন চাপ, ভেটকি ফ্রাই, দইবড়া, মাখা সন্দেশ, রসমালাই, একের পর এক উড়ে এসে সব মনের মগডালে সাঁ সাঁ করে ডানা মেলে বসতে লাগল। বৃষ্টিটা ধরেছে সামান্য। আমি হাঁ করে মাথা তুলে চকচক করে কিছুটা বৃষ্টির জল খেয়ে নিলাম। ওতে খিদেটা উল্টে আরও বেড়ে গেল। 

দূরে এবার দেখলাম লোকটা ফিরে আসছে। বুকের কাছে হাত দুটো জড় করে কী যেন বহন করে আনছে ও। কাছে আসতেই পাকা কুলের মনকাড়া গন্ধে ম ম করে উঠল জায়গাটা। ডালটা আমার দিকে এগিয়ে দিতেই আমি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওটার উপর। ছিঁড়ে ছিঁড়ে টপাটপ মুখে পুরতে লাগলাম ফলগুলো। কী চমৎকার স্বাদ! আহা! কোথায় পেল ও এমন টোপা টোপা মিষ্টি রসালো ফলগুলো? কোন গাছে ফলেছে এমন? আমরা বন্ধুরা মিলে তো এই কদিনে চষে ফেলেছি জায়গাটাকে, আমাদের চোখে পড়েনি কোনও ফলন্ত কুলগাছ! 

আশ্চর্য মানুষটা যেন সম্মোহন জানে। প্রবল শীত, ভয় এসব কেটে গিয়ে এখন আমার মনে দারুণ আনন্দ। খালি ওই যা একটু খিদেভাব ছিল, কুল খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার পেট সম্পূর্ণ ভরে গেল। বৃষ্টিও বন্ধ হয়েছে। আকাশে অল্প অল্প আলো ফুটে উঠেছে আবারও। সেই আলোয় দূরের কাঁঠালগুড়ি চা বাগানটাকে কত সবুজ দেখাচ্ছে। ঘন সবুজ। টিয়েপাখির গায়ের মত উজ্জ্বল। তারপর আনন্দে ডগমগ করতে করতে সেই আশ্চর্য মানুষের ঘাড়ে সওয়ারি হয়ে আমি নদী পেরলাম। কী অদ্ভুত! তখন আমি লোকটার গায়ে ঠিক বাবার গায়ের গন্ধটা পাচ্ছিলাম। পরম নির্ভয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওর গলা। বকের মত লম্বা লম্বা পা ফেলে সে আমাকে নিয়ে অনায়াসে স্রোত ঠেলে চলে এল এপারে। বৃষ্টি থামার পরে টান অনেক কমলেও এখনও যা স্রোত আছে নদীতে সেটাও কিছু কম নয়।

বাংলোর কাছাকাছি এসে দেখি হুলুস্থুলু অবস্থা। ভীষণ কান্নাকাটি পড়ে গেছে সেখানে। পিসি কাঁদছে। দাদার চোখ ছলছল। কুটুন একপাশে দাঁড়িয়ে আছে থমথমে মুখে। অতবড় বাগানে লোক নেমেছে আমার খোঁজে। পিসো গেছে থানায়। আমাকে একা একা আসতে দেখে ওরা দৌড়ে এল। কুটুনকে দেখে আমি তো হাঁ! আর ও আমাকে দেখে। সকালে খেলতে ডাকতে এসে দেখে আমি ঘরে নেই। ভেবেছে বাগানের অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আছি। তারপর নেমে এল বৃষ্টি। ও এদিকে ওদিকে একটু খুঁজে বাড়ি ফিরে যায়। ওকে দেখা ইস্তক আমি কেবল ভাবছিলাম তবে আমাকে সকালে কে খেলতে ডাকল? ভাঙা মন্দিরেই বা কে ছিল আমার সঙ্গে অতটা সময়? 

নদী পেরিয়ে টিলার দিকে গিয়েছিলাম শুনে বড়রা তো নিয়মমাফিক সাঙ্ঘাতিক বকাবকি করল। সবাই জানে সকাল সকাল পাহাড়ে বৃষ্টির জন্য আচমকা হড়পা বান নেমেছে নদীতে। এদিকে যেটা খুবই নিয়মিত ঘটনা। ভয়ে তাই কাকপক্ষীও যায়নি ওদিকে। আর আমি কিনা... 

হ্যাঁ রে মিঠি, জল নেমে গেছে এখন? তুই ফিরলি যখন, নেমেছে নিশ্চয়ই। পিসো বাংলোয় ঢুকেই আমাকে পাকড়েছে। 

জবাবে আমতা আমতা করে কিছু বলতে যেতেই বড়পিসি ধমকে উঠল পিসোকে। আহ, তোমার কোনও আক্কেল নেই? মেয়েটা সবে ফিরল, এবার স্নান টান সেরে খেতে বসুক। তোমরাও এসো। বেলা আড়াইটে বাজে। কিছু খেয়ে নিয়ে আমাকে উদ্ধার করো তো। অ্যাই কুটুন, তুইও এখানে খেয়ে যাবি। তোর মাকে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। ইস, আজ একটা কিছু দুর্ঘটনা ঘটে গেলে মিঠির মা বাবাকে আমি মুখ দেখাতাম কীভাবে! এই বলে পিসি আরও একপ্রস্থ কেঁদে নিল। আর আমিও সেখান থেকে চম্পট দিলাম।  

দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসে দেখলাম টেবিলে বোন চায়নার ধবধবে সাদা প্লেটে লাল লাল মুরগির কারী আর ধোঁয়াওঠা বাসমতী চালের সরু ভাত আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সঙ্গে সঙ্গে আবারও মনে পড়ে গেল পাকা কুলের মিষ্টি স্বাদ আর ওই আশ্চর্য মানুষটার কথা। 

ইসস, লোকটার নামটাই যে জানা হয়নি!