বৈজ্ঞানিকের রান্নাঘর - ১ ২ । জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২



 ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল











অরূপ

বন্দ্যোপাধ্যায়

দিল্লি, এন সি আর 



 

গুমোট গরম পড়েছে দিল্লিতে। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। দুই ভাইবোন রিয়া আর অর্ক বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাশের পার্কে হাঁটতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে একশা। গেটের সামনে আইসক্রিমের গাড়ি দেখে ওরা দুজন বাইরে এল।

এই গরমে আর ওয়াক করে শক্তি খরচ করে লাভ নেই অর্কদা। চলো, তোমাকে সেদিন আইসক্রিম খাওয়াব বলেছিলাম না?” আইসক্রিমের গাড়ির দিকে ইশারা করে বলে রিয়া

চাঁদনি চৌকে সেইরকম কথাই তো বলেছিলি! ভুলে মেরে দিয়েছিলাম। চল, যাওয়া যাক।

অর্ডার দেবার সময়ে রিয়া নেয় বাটারস্কচ কোন, আর অর্ক নিজের জন্য নেয় ক্যান্ডি। তাই দেখে রিয়া বলে, “তুমি ওই সস্তার ক্যান্ডি নিলে কেন?”

বিকজ আই লাইক ইট! সহজ! আচ্ছা বল দেখি ক্যান্ডি আর আইসক্রিমের মধ্যে তফাত কোথায়?”

ক্যান্ডি হয় শক্ত পাথরের মতো, আর আইসক্রিম হল… আইসক্রিম, মানে ক্রিম আছে।

শূন্য পেলি। একটু ভাব। মাথাটা কাজে লাগা। একটা ছোটো বাচ্চা হলে এমন করে উত্তর দিত।

সেই তো! গরমে আর মাথাটা কাজ করছে না। তুমিই বলো। আমি বরং আইসক্রিম খেতে খেতে শুনি।

ফাঁকিবাজ একটা। যাক গে, এই যে ক্যান্ডি দেখছিস, এটা শক্ত এইজন্য যে এতে বরফের ক্রিস্টাল জমাট বেঁধে আছে, যেমন ফ্রিজে বরফ জমালে হয়। তফাত হচ্ছে সেই বরফে না থাকে চিনি, না দুধ। ক্যান্ডিতে দুটোই থাকে পরিমাণমতো। আর এই সুগার বা চিনি হচ্ছে আসল চাবিকাঠি। জানিস তো যে জলের মধ্যে সল্ট বা সুগার মিশিয়ে দিলে তার হিমাঙ্ক কমে যায়?”

এই রে! হিমাঙ্ক কী?” রিয়া চেঁচিয়ে ওঠে

ফ্রিজিং পয়েন্টের বাংলা। ভয় পাস না। লবণাক্ত জলের ফ্রিজিং পয়েন্ট কমে যায় কি না?”

হ্যাঁ যায় তো! নুন মিশালে জানি, অন্য সল্ট মেশালেও হয়। কিন্তু আইসক্রিমে নুন মেশালে… অ্যাহ্‌!

হুম, চিনি মেশালেও জলের হিমাঙ্ক কমে যায়। কাজেই শূন্যের নীচে জমাট বাঁধে বরফের ক্রিস্টাল। তবে আইসক্রিম জমাতে গেলে আবার এমন করলে হবে না। জলে দুধ-চিনি মিশিয়ে, সুগন্ধি ঢেলে স্রেফ ফ্রিজে রেখে দিলে যা হবে, তার সঙ্গে এই সুস্বাদু নরম আইসক্রিমের মিল থাকবে না। কারণ তুই যেটা খাচ্ছিস, সেটাতে বরফের ক্রিস্টালগুলো সমান পরিমাণে মিশে আছে আলাদা করে। কাজেই ক্রিমের ভেলভেটের মতো একটা স্বাদ পাচ্ছিস নিশ্চয়ই

আইসক্রিম বানাতে গেলে প্রথমেই দুধ, ক্রিম, চিনি খুব ভালো করে ফেটিয়ে তাতে সুগন্ধি মেশাতে হবে। ফেটানো মানে কিন্তু মেশিনে খুব জোরে আইসক্রিমের মিশ্রণটাকে ঘোরানো। ফেটানোর সময়ে প্রচুর পরিমাণে বাতাস মিশ্রণটাতে ঢুকে পড়ে। তার ফলে যে মিশ্রণ তৈরি হয় তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় কোলয়ডাল সল্যুশন। এইবার যদি মিশ্রণটাকে হিমাঙ্কের অনেক নীচের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয়, তাহলেই আইসক্রিম জমে যাবে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে বরফের ছোটো ছোটো ক্রিস্টাল জমে যাবে। বাতাসের কারণে আইসক্রিমের মিশ্রণে অনেক ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হয়, কাজেই পুরো মিশ্রণটা জমাট বেঁধে কঠিন হয়ে যেতে পারবে না।

রিয়ার আইসক্রিমের কোন প্রায় শেষের দিকে। বাটারস্কচ আইসক্রিমের কোনের শক্ত অংশটা চিবাতে চিবাতে সে প্রশ্ন করে, “তাপমাত্রা ঠিক কতটা রাখা হয় শূন্যের নীচে?”

অবশ্যই মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দোকান থেকে কিনে আনলেও এই তাপমাত্রার কাছাকাছি আইসক্রিমকে রাখা উচিত ফ্রিজারে। নইলে আইসক্রিম গলে যেতে পারে।

তাহলে আইস ক্যান্ডির ব্যাপারটা একটু বলো আমাকে।টিসু পেপারে হাত মুছে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় রিয়া

ক্যান্ডিতে দুধ আর ক্রিমের জায়গায় জল রাখা হয়। এই কারণেই ফ্রিজে জমানো বরফের টুকরোর সঙ্গে খুব একটা তফাত থাকে না এর। তবে নানারকম গন্ধ ও রঙ ব্যবহার করে ক্যান্ডি বানানো হয়। এই যেমন আমার হাতে যে ক্যান্ডিটা ছিল কিছুক্ষণ আগে, যার কাঠিটা এই আমি ছুড়ে দিলাম ডাস্টবিনে, সেটা ম্যাংগো ক্যান্ডি বললেও ওতে বিন্দুমাত্র আমের চিহ্ন পাবি না। আছে ম্যাঙ্গোর স্বাদ ও গন্ধ। ভালো ক্যান্ডি হলে সামান্য দুধও মেশায় ওরা। বেশ লাগে খেতে।

তাই বুঝি আইসক্রিমের এতসব রকম দেখতে পাই বাজারে, অথচ ক্যান্ডির নানা বাহার দেখা যায় না। আচ্ছা অর্কদা, আইসক্রিম কবে আর কোথায় আবিষ্কার হয়েছিল বলতে পারো?”

১৮০০ সালের গোড়ার দিকে ইতালির নেপলস-এ শিশুদের কাছে শরবত বিক্রি করা একজন রাস্তার বিক্রেতার বার্তোলোমিও পিনেলি (১৭৮১-১৮৩৫) এর জলরঙের গ্রাফিক আর্ট (সূত্র: বরিস ভোজনিৎস্কি লভিভ জাতীয় আর্ট গ্যালারি)।                                     ছবি ঋণ - কাভেহ ফারুক

অর্ক কিছুক্ষণ চিন্তিত মুখে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিল, “আইসক্রিম কোথায় প্রথম আবিষ্কার হয়েছিল তা বলা একটু শক্ত, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে আইসক্রিম প্রথম তৈরি করা শুরু হয় খুব সম্ভব চিনে অথবা ইরানে। প্রায় তিন হাজার বছরের পুরোনো পুথিতে আইসক্রিমের হদিস পাওয়া যায়। তাই বলা যেতে পারে এর অনেক আগে থেকেই মানুষ আইসক্রিম তৈরি করার চেষ্টা করে। মরুভূমির দেশে গরম থেকে বাঁচতে আইসক্রিম তৈরি হওয়া শুরু হয়। তবে আজকে আমরা আইসক্রিম বলে যে বস্তুটি খেতে অভ্যস্ত, শুরুতে ব্যাপারটা তেমন ছিল না। সেটাকেফ্রজেন ডেজার্টবলা যেত। ইরানিরা বলত শরবত। এই শরবত আবার আজকের দিনে আমরা যা খাই, তা আদপেই নয়। ঠান্ডা বরফ জল আর দুধে মিশিয়ে তাতে ফুলের মধু ইত্যাদি দিয়ে বানানো হত আইসক্রিম। তাতে ক্রিম কতটা থাকত কে জানে!

চাঁদনি চৌকে এখনও অনেক দোকানে এমন শরবত নাকি পাওয়া যায় শুনেছি।মন্তব্য করে রিয়া

সে তো হবেই। মোগলদের তৈরি শহরে এখনও সেই সংস্কৃতি থাকতেই পারে। যা গরম পড়েছে, আমার তো এখনি সেই শরবত খেতে যেতে ইচ্ছে করছে।

বাড়িতেও বানানো যায়। যাক গে, একটা কথা বলো, তখন তো ফ্রিজ-ট্রিজ কিছু ছিল না, তাহলে লোকে বরফ পেত কোথায়?”

কেন? বরফ তুলে নিয়ে আসা হত পাহাড়ের মাথায় জমে ওঠা বরফের চাঁই ভেঙে!

তো সেগুলো গলে যেত না?”

অর্ক রিয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “আবার একটু বারো ক্লাসের বিজ্ঞান বইতে চোখ বোলাতে হবে কিন্তু তোকে! মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝে ফেলেছিল, বরফের চাঁই কাঠের গুঁড়োতে কিংবা খড়ের গাদায় ঢেকে রাখলে সহজে গলে না, কারণ কাঠ এবং খড় তাপ অপরিবাহী।

রিয়া চেঁচিয়ে ওঠে, “কী বাহী? মাঝেমাঝে এমন কঠিন বাংলা বলো না, মাথার উপর দিয়ে যায়!

অপরিবাহী মানে ইনসুলেটর, মানে সিন্স উড ইজ অ্যান ইনসুলেটর, ইট ডাজ নট কন্ডাক্ট হিট। এত নিরেট মাথা নিয়ে তুই বিজ্ঞান পড়বি?”

আমি ইংরেজিতে পড়েছি। তবে ভালোই হল তোমার কাছে বাংলায় শিখছি। তাই বলে আমাকে এইভাবে…

রাগ করিস কেন? আচ্ছা শুনলে অবাক হবি, বরফে লবণ মেশালে হিমাঙ্ক কমে যায়, এই যে ব্যাপারটা, তাও কিন্তু মানুষ কয়েক হাজার বছর আগেই আবিষ্কার করে ফেলেছিল। তাই বরফে লবণ মিশিয়ে জমিয়ে রাখার বিষয়টা বহু পুরোনো। বিংশ শতাব্দীতে যখন রেফ্রিজারেটর আবিষ্কার হয়, তখন থেকেই শুরু হয় আইসক্রিম বিপ্লব। সহজে বানিয়ে জমিয়ে রাখার সুবিধার জন্য ইউরোপে, বিশেষ করে ইতালিতে আইসক্রিম নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা পুরোদমে চলতে থাকে। এর আগে কিন্তু সেখানেও বহুদূরের পাহাড় থেকে বয়ে আনতে হত বরফের চাঁই।

রেফ্রিজারেটর তো আবিষ্কার করেন আলবার্ট টি. মার্শাল, তাই না?”

অতটা সাধারণ জ্ঞান আমার নেই। কুইজ কম্পিটিশন থেকে আমি চিরকালই দূরে থাকতাম। তবে কোনও আবিষ্কার তো একজনের হাতে হয় না। অনেক মানুষের পরিশ্রমের ফলে আবিষ্কার কৃতিত্ব পাবার অবস্থায় আসে। যে সেই কৃতিত্বের ভাগীদার হয়, তার নাম থেকে যায় বিজ্ঞানের বইয়ের পাতায়।

হঠাৎ ধুলো ওড়ে প্রবল বেগে। রাস্তার দুই পাশে গাছের পাতা ঝরে পড়তে থাকে। রিয়া বলে, “আঁধি উঠল অর্কদা। পা চালাও জোরে। নইলে আমরা উড়ে যেতে পারি।

অর্ক রিয়ার হাত ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে বলে, “হ্যাঁ, উড়ে গিয়ে হয়তো তুই চার হাজার বছর আগে ইরানে পাওয়া এক বরফের ডিপোতে পৌঁছে গেলি।

ওরে ব্বাবা, তাও পাওয়া গিয়েছে নাকি খুঁজে?”

ইয়াখচাল (২য় ছবিতে ভেতর থেকে) 

য়াখচাল ।  যেখানে মানুষ বরফ জমিয়ে রাখত সারাবছর।                              ছবি ঋণ - স্টনিব্রুক 

  সারাদিন মোবাইল না ঘেঁটে এবার একটু ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখে নিতে পারিস সেই ছবি, যেখানে মানুষ বরফ জমিয়ে রাখত সারাবছর। ওই দ্যাখ বৃষ্টির ফোঁটাও পড়তে শুরু করল। আইসক্রিমের মতো আবহাওয়াটাও একটু হয়ে যাক, ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল।

 

(ক্রমশ)

 

<
সূ চি প ত্র


 

আরও পড়ুন  -


+    মামলায় ঝোলে বাটার চিকেন


+    চার চার নয়, শক্তির হোক জয়

+    পাখিদের জি পি এস

+    আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো

+    ইনডাকশন কুকারের কেরামতি

+    অন্ত্র তো নয় যন্ত্র

+    খাবারের গায়ে কেন টক টক গন্ধ

+    জল শুধু জল

+    ফ্রাই, কিন্তু ড্রাই নয়

+    যার নুন খাই, তার গুণ গাই

+    কুসুমে কুসুমে


......