রিয়া আজ কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছিল। অর্ক দিল্লি
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে বেরিয়ে গিয়েছিল সকাল সকাল। বাড়ি ফিরে রিয়া ভেবেছিল আজ
কিছু একটা স্ন্যাক্স বানিয়ে খাওয়াবে তার দাদাকে। রিয়ার বাবা-মা গিয়েছিলেন একটা
গানের অনুষ্ঠানে। যদিও রান্নার দিদি ঘরেই ছিল, তবুও আজ নিজেই চাউমিন বা
বার্গার অর্ডার না করে ঘরের জিনিস দিয়ে খাবার বানাবার ইচ্ছে ছিল তার। দিল্লিতে
বৃষ্টি হয়ে ক’দিন তাপমাত্রা একটু কমে গিয়েছে। তাই রান্নাঘরে ঢোকার
বিরক্তি উদ্রেক হচ্ছে না তেমন।
একটু হতাশ হয়ে রিয়া বলে, “আবার কোথায় যাবে? এই তো ফিরে এলে! ভর সন্ধেয় কোথাও তোমার পছন্দের জায়গা, মিউজিয়াম বা কেল্লার দরজা খোলা নেই। তাহলে…”
“তোদের নিয়ে এই হচ্ছে মুশকিল। কিছু না শুনেই এক ঝুড়ি প্রশ্ন
করে ফেলিস! তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। একজন ইন্টারেস্টিং মানুষের সঙ্গে আলাপ করিয়ে
দেব। তোর ভালো লাগবে। অজিতাভদা, আমাদের ইউনিভার্সিটির
সিনিয়ার। আমার বন্ধু। ব্যাঙ্গালোর থেকে দিল্লি এসেছিল অফিসের কাজে। আগামীকাল ফিরে
যাবে। পেশায় একজন সত্যিকারের বিজ্ঞানী। পণ্ডিত মানুষ।”
“তা ওঁকে বাড়িতে ডাকলেই তো হত! আবার কোথায় যাবে দেখা করতে?”
“যে-জায়গাটার লোকেশন আমার মোবাইলে পাঠিয়েছে, সেটা তোদের বাড়ি থেকে কাছেই। ওখানে নাকি দারুণ তেলেভাজা
পাওয়া যায়। অজিতাভদা ফিরে যাবার আগে খেয়ে যেতে চায়। কে নাকি ওকে জানিয়েছে এমন
তেলেভাজা না খেলে নাকি জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।”
“ওহ্, নৌরজি নগরের পকোড়া হবে। কই
দেখি মোবাইলটা! হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছি। কোনোদিন খাইনি, কিন্তু গাড়িতে
যাবার সময় দেখেছি ভিড়ের চোটে রাস্তা বন্ধ হবার উপক্রম হয়। কিন্তু ওই পকোড়া খাওয়ার
জন্য এদ্দুর ছুটে এলেন কেন ভদ্রলোক, সেটাই বুঝতে পারছি না।”
“খুব একটা দূরে নয় তাঁর হোটেল। বিজ্ঞানীদের মাথায় ছিট থাকে
জানিস তো! একদিন তোরও হবে। যাক গে, চল তাড়াতাড়ি। অজিতাভদা
কিন্তু আগেভাগে পৌঁছে গেলে কুরুক্ষেত্র করবে। সাতটার মধ্যে না যেতে পারলে হয়তো
রেগেমেগে ফিরেও যেতে পারে। একটু খ্যাপাটে গোছের বিজ্ঞানী আর কী!”
সাতটার মধ্যে দুই ভাইবোন নৌরজি নগরের পকোড়ার দোকানের কাছে
যেতেই দূর থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, “অর্ক, এদিকে আমি। চলে আয় শিগগির!”
রিয়া বুঝল ইনিই হচ্ছেন অজিতাভদা, ব্যাঙ্গালোরের বিজ্ঞানী। ভদ্রলোকের চোখ দুটো খুব উজ্জ্বল।
বোঝা যায়, খুবই বুদ্ধিমান ব্যক্তি।
রিয়াকে দেখে খুব উৎসাহ নিয়ে অজিতাভ বলেন, “আরে,
এই খুকিটা কে রে? তোর…”
অর্ক অজিতাভকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, “আরে না, এ হচ্ছে আমার খুড়তুতো বোন
রিয়া। ওদের বাড়িতেই আপাতত বডি ফেলেছি দিল্লিতে।”
“তা বেশ! এবার চল তোর বডিকে একটু কষ্ট দিয়ে তেলেভাজা খেতে
খেতে কথা বলি। আমি অর্ডার করে দিয়েছি। ফুলকপি আর পালংশাকের পকোড়া।”
চট করে রিয়ার সঙ্গেও অজিতাভ খুব সহজে আলাপ জমিয়ে ফেললেন।
কেবলমাত্র তেলেভাজা খেতে চলে এসেছেন কেন সেই কথা জিজ্ঞেস করতে অজিতাভ বলেন, “আর বলো কেন? কিছু একটা উপলক্ষে অর্কর
সঙ্গে দেখা করার ছুতো খুঁজছিলাম। দিল্লি এসেছে শুনেই ফোন করেছি। কোথায় উঠেছে জানতে
পেরে কাছেপিঠেই এই পীঠস্থান খুঁজে পেলাম। ওই যে, আমাদের
পকোড়াগুলো নেমে গিয়েছে কড়াই থেকে। চলো আমার সঙ্গে গাড়ি আছে, সেখানে বসেই খেতে খেতে কথা বলি।”
রিয়া বোঝে, অজিতাভ বেশ ব্যস্ত মানুষ।
স্রেফ আড্ডা দিতে চলে এসেছেন এই দোকানে। বোঝা যায়, বড়ো নামি
রেস্তোরাঁতে এঁর মন রোচে না। অর্কদা ঠিকই বলে, বিজ্ঞানীরা একটু ছিটগ্রস্ত
হয়ে থাকে।
পকোড়াতে কামড় দিয়ে চোখ বন্ধ করে চিবোতে চিবোতে অজিতাভ বলেন, “ইস,
যদি একটু মুড়ি পাওয়া যেত এখন, জমে যেত রে!”
“মুড়ি এখন তোমায় দিচ্ছে কে দাদা? এ কি আর তোমার মধ্যমগ্রাম পেয়েছ? ব্যাটারা দেখলাম বেগুনিও ভাজে না। কলকাতার তেলেভাজা
দিল্লিকে অনায়াসে দশ গোলে হারিয়ে দেবে।”
“আসল কথাটা হল রসায়ন, বুঝলি?” অজিতাভ গাড়ির জানালার বাইরে তাকিয়ে বলেন।
“এর মধ্যে কোন রসায়ন তুমি পেলে? আর কলকাতার রসায়ন দিল্লির চাইতে উত্তম হল কী করে? তেলেভাজার সঙ্গে তার কী-ই বা সম্পর্ক?”
“তোর তো ইকনমিক্স! তেলেভাজার ব্যাবসায় ইকনমিক্স তুই খুঁজতেই
পারিস, কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখবি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়
কিন্তু কলকাতার মানুষ ছিলেন।
“তেলেভাজা আর প্রফুল্লচন্দ্র রায়? এবার তুমি বোধ হয় বলবে, বেঙ্গল কেমিক্যাল তেলেভাজা
ম্যানুফ্যাকচার করত।”
“বলিস কী? স্যার পি. সি. রায় তেলেভাজা
আর মুড়ি খেতে খুবই ভালোবাসতেন। আর সেই খেয়েই ওঁর রসায়নে রসবোধের উদয় হয়। কিন্তু ওই
ভিড়ে ঠাসা দোকানটার তেলেভাজা কেমন শক্ত না? একটু তিতকুটেও লাগছে।”
তেলেভাজায় কামড় দিয়ে রিয়ারও ঠিক তাই মনে হয়েছিল। সে বলে, “অজিতাভদা একেবারে আমার মনের কথাটা বলেছেন। আমার সেইজন্য
একটুও ভালো লাগছে না। বাড়িতে মা যে তেলেভাজা করে সেটা বেশ তুলতুলে হয়, এগুলো কেমন যেন…”
“তুমি তো বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছ। এই তেলেভাজায় ওরা বেকিং সোডা
দিয়েছে, বেকিং পাউডারের জায়গায়। তাও বেশি ঢেলেছে বলে মনে হচ্ছে। তাই
তেতো হয়ে গিয়েছে।”
“বেকিং সোডা পকোড়ায় দিলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়, আর তাইতেই পকোড়া বা কেকে একটা ফ্লাফি, মানে তুলতুলে ভাব আসে। পকোড়ার ব্যাটার বানাবার সময় সামান্য
বেকিং সোডা দিলে রান্নার সময় তাপের প্রভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেরিয়ে আসে পকোড়া
থেকে। আমরা স্কুলের নীচু ক্লাসেই পড়েছি।” রিয়া উত্তর দেয়।
“বেশ,
তা না-হয় হল। এবার বলো, বেকিং সোডা তো একটা বেস, মানে ক্ষার। অবশ্যই মৃদু ক্ষার, কিন্তু অ্যাসিড আর বেস এই দুইয়ের মিলনে তবেই না
কার্বন-ডাই-অক্সাইড ঠিকমতো নির্গত হবে তাপের প্রভাবে। তাই বেকিং সোডার জায়গায় যদি
বেকিং পাউডার দেওয়া যায়, তবে ব্যাপারটা ঠিক হয়। আর এই কাজটাই আমাদের পকোড়াওয়ালা
করেনি।” অজিতাভদা গাড়ির ড্যাশ বোর্ড থেকে টিস্যু পেপার বার করে
রিয়ার হাতে দিয়ে নিজেও আর একটাতে হাত মোছেন।
“আরে আমাকেও একটা টিস্যু দাও অজিতাভদা! ইকনমিক্সের ছাত্র বলে
এতটা উপেক্ষা কোরো না। তবে আমি বেকিং সোডা আর বেকিং পাউডারের মধ্যে পার্থক্যটা
জানতে চাইব।”
“বেকিং সোডা যে সোডিয়াম-বাই-কার্বোনেট তা তো তোরা জানিস।
কিন্তু বেকিং পাউডারে সঙ্গে আরও একটা রাসায়নিক যৌগ মিশিয়ে দেওয়া হয়, তা হল টারটারিক এ্যাসিড। তাই বেকিং পাউডারে রইল বেস এবং
অ্যাসিড দুই-ই। যেই সেই পাউডার মেশানো হল পকোড়ার মিশ্রণ ফেটানোর সময়। অ্যাসিড আর
বেসের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয়ে গেল, পকোড়া কড়াইতে ফেলা মাত্র
তাপে সেই বিক্রিয়া আরও দ্রুত ঘটতে লাগল। ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়ে পকোড়ার
মধ্যে দিয়ে বাইরে আসতে লাগল। যে ফাঁকা জায়গাগুলো সৃষ্টি হল, তাতে ঢুকে গেল তেল আর হাওয়া। কাজেই বেশ একটা তুলতুলে
ব্যাপার হল। বেকিং সোডা দিলে কিন্তু এত কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেরোত না।”
“তাহলে যদি কোনও খাবারে আগে থেকে অ্যাসিড থাকে, তবে বেকিং সোডাতেই কাজ হয়ে যাবে, তাই না অজিতাভদা?” অর্ক বলে।
“এই জন্যই অর্থনীতির ছাত্র হলেও তোকে আমি বেশি ভালোবাসি।
কারণ, সব বিষয়েই বিজ্ঞানসম্মত ধারণা থাকার বিশেষ প্রয়োজন। এটাকে
বলে অ্যানালিটিক্যাল পাওয়ার। ধারেকাছে কোথাও একটু কফি পেলে এর পুরস্কার তোকে দিয়ে
দিতাম এক কাপ কফি খাইয়ে।”
অজিতাভ গাড়ির বাইরে এসে চা বা কফির দোকান খুঁজতে থাকেন।
রিয়া বাইরে এসে বলে, “অজিতাভদা, একটু এগোলে একটা ছোট্ট দোকান আছে দেখেছি। গিয়ে দেখি?”
অজিতাভ গাড়ির ড্রাইভারকে বলেন, “চলিয়ে, আগে চলকে দেখ লেতে হ্যায়
কফি কহাঁ মিলেগা।”
“বুঝলি রিয়া, এবার রান্নাঘরে ঢুকেই বেকিং
পাউডার খুঁজে গরম গরম বেগুনি বানিয়ে ফেলিস। তবে দেখিস, বেশি পাউডার মেশালে তেতো হয়ে যাবে খেতে।” বলেই অজিতাভর উদ্দেশে অর্ক বলে, “অজিতাভদা, চাঁদনি চৌকের কাবাব কিন্তু
এই পকোড়াগুলোর চাইতে ঢের বেশি ভালো ছিল।”
“আর আমার কাবাবের কথা বলে মনখারাপ করে দিস না। এবার ফিরে
যেতে হবে ইডলি-সম্বরের দেশে। পরের বার এসেই না-হয় খাব। ওই তো কফির মেশিন দেখা
যাচ্ছে ছোট্ট দোকানটায়। রোখ লিজিয়ে গাড়ি ড্রাইভার সাহাব।”
তিনজনে কফি শপের দিকে এগিয়ে যায়।