জানা অজানা । আষাঢ় ১৪৩২




  ছবি আঁকার মাধ্যম











সুদীপ্ত শেখর পাল

কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ




 

ছবি আঁকার কথা মনে পড়লে আমাদের মনে প্রথমেই যে জিনিসটার কথা মনে হয় সেটা হল পেন্সিল অর্থাৎ উড পেন্সিল। কাঠের মধ্যে থাকে একটা কালো রঙের পদার্থ যা দিয়ে দাগ টানা হয়। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একে বলা হয় গ্রাফাইট। 

সাধারণত এটা দিয়েই ছবির খসড়া করে তারপর দেওয়া হয় রঙের আঁচড়। ছবি আঁকার  কাল  যতদিন ধরে চলছে তার তুলনায় পেন্সিল নিতান্ত সেদিনের আবিস্কার, মাত্র শ’পাঁচেক বছর। কিন্তু ছবি আঁকা শুরু হয়েছে বেশ কয়েক হাজার বছর আগে। কত আগে নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও গুহার দেওয়ালে মানুষের আঁকা ছবি পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেগুলো কোনটা আঁকা চোদ্দ হাজার বছর আগের, কোনটা বা উনিশ হাজার বছর আগে। ছবির রঙ বলতে তখন ছিল প্রকৃতি থেকে আহরণ করা খনিজ সমৃদ্ধ রঙীন মাটি। সেই মাটি মেশানো হত পশুর চর্বিতে তখন মানুষের জীবনযাত্রা ছিল শিকার কেন্দ্রিক, তাই পশুর চর্বি পেয়ে যেত সহজে। সেখানে  রঙীন মাটি হল রঞ্জক কণা (dye / pigment)  আর চর্বি হল তার দ্রাবক, যার উপর ভর দিয়ে রঙ থাকতে পারে দীর্ঘ্য দিন। আরেকটি প্রাচীন রঞ্জক কণা হল চারকোল বা কাঠ কয়লা। মানুষের সভ্যতা যত অগ্রসর হয়েছে তত জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে আর খুঁজে নিয়েছে নানা রকম প্রাকৃতিক  রঞ্জক পদার্থ, কৃত্রিম ভাবে তৈরিও করেছে অনেক

ঐতিহাসিক কালেও মানুষ পাথরের উপর বহু ছবি এঁকেছে, যেমন আমাদের দেশে অজন্তার দেওয়ালে আঁকা জাতক কাহিনীর ছবি। এক সময় এক নতুন ধরণের ছবির প্রচলন হল, মোটামুটি ভাবে বলা যায় খৃষ্টিয় ত্রয়োদশ শতকে। তখন ঘরের দেওয়ালে প্লাস্টার করার চল হয়েছে। প্লাস্টার ভিজে থাকতে থাকতে শিল্পীরা রঞ্জক পদার্থ জলে গুলে দেওয়ালে আঁকতে লাগলেন। এর ফলে সেই রঙ শুকিয়ে দেওয়ালের সঙ্গে মিশে গেল পুরোপুরি ভাবে, ফলে স্থায়িত্ব হল দেওয়ালের প্লাস্টারের মতই। একে বলা হল ফ্রেস্কো পেন্টিং, আরেকটু নির্দিষ্ট করে বলা হয় ফ্রেস্কো বুয়ানো পদ্ধতি। তবে সাধারণ ভাবে ফ্রেস্কো  পেন্টিং বলতে এই পদ্ধতিকেই বুঝে থাকি।  ইতালি সহ ইউরোপের নানা দেশে বহু প্রতিভাবান শিল্পী গীর্জার দেওয়ালে অসংখ্য ফ্রেস্কো পেন্টিং এর মাধ্যমে তাঁদের শিল্পকলাকে অমর করে গেছেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ফ্রেস্কো পেন্টিং এর কাছাকাছি এক নতুন ধারায় এক বিখ্যাত ছবিদ্য লাস্ট সাপার আঁকলেন। তিনি ভিজে প্লাস্টারের বদলে শুকিয়ে যাওয়া প্লাস্টারে রঙ দিয়ে ছবি এঁকেছিলেন কিছুদিনের মধ্যে সেই ছবি থেকে রঙ খসে পড়তে থাকে। পরবর্তীকালে অন্যান্য শিল্পীদের সহযোগিতায় এবং নতুন পদ্ধতিতে রঙ লাগিয়ে ছবিটি পুনরুজ্জিবীত করা হয়েছে। এই পদ্ধতিকে বলা হল ফ্রেস্কো মেস্কো পদ্ধতি। তবে প্রসঙ্গত বলি, খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে অজন্তার গুহাতে যে ছবি আঁকা হয়েছিল তা’ এই ফ্রেস্কো মেস্কো পদ্ধতির মতোই। এখানে গোবর, ধানের তুঁষ, চুন ইত্যাদি পদার্থ  এমন ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে সে সব ছবি সহস্রাধিক বছর টিঁকে আছে। দুঃখের বিষয় সে সব মহান শিল্পীদের  পরিচয় কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে

বোঝাই যাচ্ছে এ সব ছবি একস্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শিল্পী  নিজের বাড়িতে বসে ছবি এঁকে বিক্রি করতে পারবে না। তখন তাঁরা অন্য এক পদ্ধতিতেও ছবি আঁকতে লাগলেনরঙ মেশালেন ডিমের কুসুমের সঙ্গে। ডিমের কুসুম কাজ করল রঙের বন্ধক হিসাবে। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ ফলের কষ ও আঠা রঙের সঙ্গে মিশিয়ে কাঠ, কাপড় ইত্যাদির উপর আঁকার চলন হল। এই পদ্ধতির নাম আমরা জানি টেম্পারা পেন্টিং। কারণ টেম্পারা কথাটির অর্থ হল মিশ্রণ। এরপর আদিম মানুষের চর্বির ব্যবহার ফিরে এল নতুন আঙ্গিকে। চর্বির বদলে ব্যবহৃত হল নানা রকম তেল তেল ব্যবহার এতটাই জনপ্রিয় হল যে এই পদ্ধতিতে আঁকা ছবির  নামই হয়ে গেল তৈলচিত্র। ইংরাজীতে বলা হল অয়েল পেন্টিং। এই পদ্ধতির পথিকৃত হিসাবে যার নাম করতে হয় তিনি হলেন জ্যান ভ্যান আইক (Jan Van Eyck )  তাঁর জন্ম নেদারল্যান্ডে, ১৩৯০ খৃষ্টাব্দে। ঐতিহাসিক কালের মধ্যে তিনিই প্রথম সার্থক ভাবে তেল রঙ ব্যবহার করে ছবিতে নতুন ধরণের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসেন। যদিও খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে অজানা বৌদ্ধ শিল্পীর আঁকা তৈলচিত্রের সন্ধান মিলেছে আফগানিস্থানের গুহার দেওয়ালে। এর পরে আঁকা বেশ কিছু তৈলচিত্রের সন্ধান পাওয়া গেলেও সারা বিশ্বের শিল্পীদের মধ্যে এই পদ্ধতি জনপ্রিয় ছিল না। জ্যান ভ্যান আইকের পরই তৈলচিত্র সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়। রঙের যেমন বিবর্তন হল তেমনি বিবর্তন হল ছবির ধারক বস্তুটিরও। আদ্র জলবায়ুতে কাঠের নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই চিত্রশিল্পীরা একটা বিকল্প বস্তুর সন্ধানে ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে ভেনিসের শিল্পীরা শুরু করলেন ক্যানভাসে আঁকা। ক্যানভাস হল সুতো দিয়ে তৈরি এক বিশেষ ধরণের মোটা কাপড়।  তখনকার সময়ে জাহাজের পাল তৈরিতে এই কাপড় ব্যবহার হত। প্রথমদিকে এই কাপড়ে ছবি আঁকা শুরু হলেও পরে শুধু মাত্র ছবি আঁকার জন্য ক্যানভাস তৈরি হতে লাগল। কাঠের প্যানেলের সঙ্গে তুলনায় এটা এগিয়ে থাকল আরও খানিকটা। কারণ এই ক্যানভাস ফ্রেম থেকে খুলে নিয়ে গুটিয়ে রাখা যায়, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়, আবার সুবিধামত ফ্রেম করে দেওয়ালে ঝোলান যায়। এত কিছু করলেও ছবির ক্ষতি হয় না একটুও। বহু বিখ্যাত ছবি ক্যানভাসে আঁকা হয়েছে, আজও হয়ে চলেছে। তবে বিংশ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি এক নতুন ধরণের রঙের প্রচলন হল। সে রঙের নাম এক্রাইলিক রঙ। এর বিশেষ সুবিধা হল এই যে, এই রঙ জলে গুলে লাগানো যায় আর তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। তেল রঙ একবার ব্যবহার করে পরের বার তার উপর রঙ দিতে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় ২৪ ঘন্টা কিন্তু এক্রাইলিক রঙের ক্ষেত্রে এক ঘন্টা অপেক্ষা করলেই যথেষ্ট। ক্রমে ক্রমে শিল্পীদের মধ্যে এই রঙ জনপ্রিয় হয়ে উঠল

ছাড়াও শিল্পীরা বহু রকমের মাধ্যম প্রতিনিয়ত উদ্ভাবন করতে সচেষ্ট থাকেন। ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ নতুন ধরণের মাধ্যম কিছু আসবে না, একথা বলা যায় না

 


 

আরও পড়ুন  -


+    বন্ধু বিবেকানন্দ

+    দর্শন
+    শূন্যের আবিস্কার ও গুরুত্ব
+    ধীরে ধীরে জ্ঞানের গভীরে
+    ছবি আঁকার পথে মানুষের বিচরণ
+    বেচারা তিমি
+    সঙ্গীতের সঙ্গী হতে

+    নানা রকম দেখা

+    মাধ্যাকর্ষণের পথ ধরে
+    ইংরাজি ভাষা ও তার অক্ষর পরিচয়