জানা অজানা । শ্রাবণ ১৪৩২



সে এক অন্য সাগর, কথাসরিৎসাগর











সুদীপ্ত শেখর পাল

কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ




 

মাধ্যাকর্ষণ যেমন পৃথিবীর পক্ষে স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা তেমনি মানুষের গল্প শোনার আকাঙ্ক্ষা স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা। রাজা মহারাজার কাহিনী যেমন মানুষের প্রিয় তেমনি প্রিয় গরীব ব্রাহ্মণ কিংবা বনের প্রান্তে থাকা কাঠুরিয়ার কথাও। 

গল্প বলিয়েরা যেমন বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের মানুষ তেমন গল্পের বিষয়ও বিচিত্র বৈশিষ্ট্য যুক্ত। সব গল্প যে সত্যি ঘটনার ‘কাহিনী’ এমনটা নয়। পশু পাখি কিংবা কাল্পনিক চরিত্র অবলম্বন করে গল্প রচিত হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল কখনো মানুষের মনে যাতে ন্যায় নীতির প্রতিষ্ঠা, কখনো বা নিছক আনন্দ লাভ। যে ভাবেই গল্প তৈরি হোক না কেন একজনের তৈরি গল্প যখন মুখে মুখে ফেরে তার সংযোজন বিয়োজন হয়, কখনো পুরানো ভিতের উপর তৈরি হয় নতুন গল্প। যে যুগের কথা বলছি সে যুগে কোন কিছু লেখাটা মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না। তাই কোন কাহিনী যে ঠিক কে রচনা করেছেন তা বলা ভারি শক্ত। এভাবেই শত শত বছর ধরে গল্পের যে সম্ভার তৈরি হয়েছে তাকে একমাত্র সাগরের সঙ্গে তুলনা করা চলে। বিশাল ব্যাপ্তি ছাড়াও সাগরের সঙ্গে কাহিনী সম্ভারের মিল আছে আরেক ভাবে। বিভিন্ন স্থানের নদী ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জল সাগরে নিয়ে আসে, আসার সময় সেই জলে মেশে বিভিন্ন জনপদ ধৌত বৃষ্টির জল। গল্পের সাগরও তেমনি বহুস্থানের গল্পে সমৃদ্ধ

কোন এক সময় কেউ ভেবেছেন এগুলো লিখে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন। যিনি লিখেছেন তিনি তো আর নিজে স্রষ্টা বলে দাবী করতে পারেন না। অথচ কেউ না কেউ তো স্রষ্টা আছেন আর আছে সে সব গল্পের এক যাত্রাপথ, সাগরাভিমুখী নদীর মতো। তাই এই সব কথা নিয়ে তৈরি হয়েছে আরেক গল্প, ‘কথাসরিৎসাগর’ গ্রন্থের গল্প শুরুর গল্প। আর সেটাও রয়েছে বইয়ের মধ্যেই

আমরা যে ‘কথাসরিৎসাগর’ গ্রন্থ পাই সেটি রচনা করেছেন সোমদেব ভট্ট, সংস্কৃত ভাষায়। সে কাহিনী প্রথম যিনি লিখেছেন তার নাম গুণাঢ্য। লিখেছিলেন এক আঞ্চলিক ভাষায়  সেই আঞ্চলিক ভাষার নাম পিশাচ ভাষা। গূণাঢ্য কেন পিশাচ ভাষায় লিখলেন তারও কারন আছে, কারনের পিছনে গল্প আছে। সে গল্পে যাচ্ছি না, তবে যে কথাটা বলা ভালো সেটা হল, যে কারণে গুণাঢ্য সংস্কৃত, প্রাকৃত আর দেশীয় ভাষা ত্যাগ করে পিশাচ ভাষার আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই কাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে পানিণির ব্যকরনের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ কলাপ ব্যকরণের উদ্ভবের কথা

গুণাঢ্য এটা পিশাচ ভাষায় লিখলেও শুনেছিলেন অন্য ভাষায়, যা বলেছিলেন বিন্ধ্যারণ্যের কানভূতি। কানভূতি শুনেছিলেন আরেক পণ্ডিতের কাছে, যার নাম বররুচি। বররুচি কীভাবে পণ্ডিত হলেন, কেনই বা উত্তর ভারতের মগধ ছেড়ে দক্ষিণে বিন্ধ্যারণ্যে গেলেন আর কানভূতিকে কেন গল্প বললেন তারও মজাদার কাহিনী আছে। তবে ঘটনা পরম্পরায় বররূচির সঙ্গে কানভূতির দেখা হওয়া মাত্র ‘কথাসরিৎসাগরের গল্প’ মনে পড়ে গেল যা’ তিনি শুনেছিলেন তাঁর পূর্বজন্মে স্বয়ং মহাদেবের কাছে। না, মহাদেব অবশ্য গল্প তাঁকে বলেননি, বলেছিলেন  পার্বতীকে। সে দিন হল কি, পার্বতীর স্তবে শিব এত সন্তুষ্ট হলেন যে পার্বতীকে খুশি করতে চাইলেন। কতকটা ‘বর’ দেওয়ার মত। পার্বতী  শিবের কাছে গল্প শুনতে চাইলেন, তবে সম্পূর্ণ নতুন গল্প যা কেউ কোনদিন শোনেনি। শিব গল্প বলা শুরু করলেন, বাইরে নন্দী থাকল পাহারায়। এদিকে শিবের এক অনুচর, পুষ্পদন্ত শিবের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে নন্দী বাধা দিল। কিন্তু পুস্পদন্ত ছেড়ে দেওয়ার লোক নয়, সে সূক্ষ্ণ দেহ ধরে গল্প শুনে নিল। নিজে তো শুনলই আবার শোনাল তার স্ত্রী জয়াকে। জয়া তো আর জানে না এই গল্পের কী রহস্য! সে এসে শোনাল পার্বতীকেই। যা হবার, পার্বতী রেগে গেল শিবের উপর, এই তোমার নতুন গল্প! নতুনই যদি হবে তাহলে জয়া জানল কীভাবে? শিব তৎক্ষনাৎ ধ্যানযোগে জেনে নিলেন এর ভিতরের ব্যাপার স্যাপার। ব্যাস! পার্বতীর রাগ গিয়ে পড়ল পুষ্পদন্তের উপর অভিশাপ দিলেন মর্তে মানুষ জন্ম নিতে হবে। পুষ্পদন্তের বন্ধু মাল্যবান পার্বতীকে অনুরোধ করল যাতে শাস্তি মুকুব হয়। শাস্তি মুকুব তো হলোই না, উলটে মাল্যবান নিজেই পুষ্পদন্তের সঙ্গে অভিশপ্ত হয়ে গেল। তাকেও জন্ম নিতে হবে পৃথিবীতে। পৃথিবীতে পুষ্পদন্ত হলেন বররুচি আর মাল্যবান হলেন গুণাঢ্য

অভিশাপ যখন আছে, তা থেকে নিস্কৃতিও আছে। সে কথা বলে দিলেন পার্বর্তী। বররুচি যদি কানভূতিকে এই গল্প শোনায় তবে তার মুক্তি ঘটবে। তাই তিনি কানভূতি কে গল্প বলেছেন। কানভূতি কেন গূণাঢ্য কে বললেন? কেননা তিনি কুবের অভিশাপে মনুষ্য জন্মে বিচরণ করছিলেন যদি বররুচির কাছে শোনা গল্প গুণাঢ্য কে বলেন তাহলে তার মুক্তি ঘটবে? তবে গুণাঢ্যও যে শুধু শুধু গল্প শুনবেন আর লিখবেন এমনটা নয় সেও যে পার্বতীর অভিশাপে মর্তের মানুষ। তার মুক্তির শর্ত নির্ধারিত হয় গল্পকে কেন্দ্র করেই। তাকে গল্প জগতে প্রচার করতে হবে তাই তিনি পিশাচ ভাষায় সেই গল্প লিখলেন নিজের রক্ত দিয়ে

বররুচি গুণাঢ্যের জীবন কাহিনীর মধ্যে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সম্বন্ধ। যেমন কৌটিল্য চাণক্যের সাহায্যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সিংহাসন লাভ, রাজা সাতবাহনের কথা ইত্যাদি। গুণাঢ্য এক সময় এই রাজা সাতবাহনের মন্ত্রী ছিলেন তাই ‘কথা সরিৎ সাগর’ গল্প লেখার পর শিষ্যদের হাতে দিয়ে রাজার কাছে   পাঠিয়ে দিলেন প্রচারের জন্য। একে তো পিশাচ ভাষা, তা’ও আবার রক্ত দিয়ে লেখা। রাজা সঙ্গে সঙ্গেই সে প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন আর অপমানিত গুণাঢ্য জঙ্গলের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে সেই পুঁথির পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে পোড়াতে লাগলেন কত কষ্টের জিনিস, সাত লক্ষ শ্লোকের সাতটি কাহিনী। লিখেছেন সাত বছর ধরে। পোড়ানোর আগে এক একটি পাতা জোরে জোরে পাঠ করেন তারপর আগুনে ফেলেন। সেই গল্প পাঠ শুনতে গুণাঢ্যের চারদিকে পশু পাখি সব ভিড় করল। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে শুধু গল্পই শুনতে লাগল। এই সব অনাহারী পশু পাখির মাংস খেয়ে রাজার পুষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটল আর তিনি অসূস্থ হয়ে পড়লেন। কারণ অনুসন্ধান করে যখন জানতে পারলেন যে, এর মূলে রয়েছে তাঁরই প্রত্যাখ্যান করা গুণাঢ্যের বই তখন নিজে হাজির হলেন জঙ্গলের মধ্যে। নিষেধ করলেন পুঁথি পোড়াতে। অঙ্গীকার করলেন জগতে সেই গল্প প্রচার করবেন। কিন্তু ততদিনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ছয় লক্ষ শ্লোকের মোট ছয়টি কাহিনী। বেঁচে আছে শুধু এক লক্ষ শ্লোকের নরবাহন দত্তের কাহিনী। রাজা সাতবাহন সেইটুকু নিয়ে গুণাঢ্যের দুইজন শিষ্যের সহায়তায় সংস্কৃত ভাষায় এক গ্রন্থ রচনা করালেন। নাম হল কথাপিঠ। এভাবেই শিবের মুখনিঃসৃত গল্প জগতে প্রচার পেল

নামে একটি কাহিনী হলে কি হবে, এই কাহিনীতে নানা দিক থেকে বহু উপকাহিনীর মিশ্রণ ঘটেছে। রয়েছে রামায়ন, মহাভারত, পুরাণের গল্পও। এছাড়া আরো কয়েকটি স্বতন্ত্র গ্রন্থেরও দেখা মেলে এই কাহিনীর মধ্যে। যেমন বেতাল পঞ্চবিংশতি, বত্রিশ সিংহাসন, পঞ্চতন্ত্র প্রভৃতি। লোককথা, নীতিকথা, পুরাণ, ইতিহাসের সুচারু মিলনে সৃষ্ট এই কাহিনীকে সাগরের সঙ্গে তুলনা করাই যায়

‘কথাসরিৎসাগরের’ সূচনা করতে যে গল্পের অবতারণা করা হল তার শেষ হল ‘কথাপিঠ’ নামক বই রচনাতে। তবে আমরা ঐতিহাসিক কালে দেখতে পাই গুণাঢ্যের সংকলন করা গ্রন্থের থেকে বৌদ্ধ কবি ক্ষেমেন্দ্র রচনা করলেন ‘বৃহৎকথা মঞ্জুরী’ আর ব্রাহ্মণপন্থী কবি সোমদেব ভট্ট রচনা করলেন ‘কথা সরিৎ সাগর’

 


 

আরও পড়ুন  -


+ ছবি আঁকার মাধ্যম