কিন্তু কোন কোন সময় অঞ্চল
ভেদে কথ্য ভাষার এত পার্থ্যক্য দেখা যায় যে তাদের সবগুলিকে বাংলা বলতে সংশয় তৈরি
হয়। কিন্তু সবাই ব্যবহার করে বাংলা ভাষার এক সর্বজন স্বীকৃত বর্ণমালা, যার প্রবক্তা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দে
(১২৬২ বঙ্গাব্দ) প্রকাশ করেন ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থ। বাংলা লিপির ইতিহাসে এ এক সন্ধিক্ষণ বিশেষ। আমারা অনায়াসে ১৮৫৫
খৃষ্টাব্দের আগের বছর গুলিকে ‘প্রাক বিদ্যাসাগরীয়’ সময় বলে উল্লেখ করতে পারি।
বর্ণপরিচয় বইটির প্রকৃত অর্থ হল, বর্ণের লিপির সঙ্গে পরিচয়।
অ – আ – ক- খ যে বাংলা ভাষার বর্ণ এসব শুনেও শেখা যায়, কিন্তু কোন লিপিকে ‘ক’ বলব সেটা জানতে হলে ‘ক’ এর লিখিত রূপ চিনতে হবে। বর্ণ পরিচয়ের আসল উদ্দেশ্য এটা
হলেও বিদ্যাসাগর কিন্ত এ কাজটি করেননি। কেনন তাঁর আগে বহু বিখ্যাত বাংলা গ্রন্থ রচিত কিংবা বাংলা ভাষায় অনুদিত হয়েছে। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতকে রচিত হয়েছে শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনীমূলক কাব্য চৈতন্য ভাগবত, চৈতন্য চরিতামৃত । ঐ সময়ে মহাভারতের মতো মহাকাব্যও বাংলায় লেখা
হয়েছে নতুনভাবে। সে সব গ্রন্থে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও এখনকার প্রচলিত
বাংলা থেকে সেই সব গ্রন্থের বাংলায় বেশ কিছু
পার্থক্য দেখা যায়।
সব থেকে প্রাচীন যে লেখা বাংলা ভাষার
লেখা বলে পণ্ডিতেরা মেনে নিয়েছেন সেটি হল চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়। এর কবিতাগুলি খৃষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত
বলে মনে করা হয়।
আমরা সিদ্ধান্তে এলাম যে, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রণয়নের আগে প্রায় নশো বছর ধরে
বাংলা ভাষা চলে আসছে ও নিজস্ব বর্ণমালায় লেখা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর নতুন
করে বর্ণ ‘পরিচয়’ করাতে চাইলেন বিশেষ
কিছু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে।
উনবিংশ শতকের সেই সময়টা ছিল
আধূনিক শিক্ষা বিস্তারের তাগিদে ভরপুর। দেশীয় পণ্ডিতদের
সঙ্গে বিদেশী শিক্ষাবিদরাও চাইছিলেন বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শিক্ষা দেওয়া হোক।
কিন্তু শিক্ষা দিতে গেলে দরকার পাঠ্যপুস্তক। শিক্ষকদের উপরেই ভার পড়ল বাঙলা গদ্য রচনার। বিদ্যাসাগর
লিখলেন বেতাল পঞ্চবিংশতি। এই সময়েই বিদ্যাসাগর অনুভব করলেন বাংলা ভাষার গদ্যের এক
সুসংহত রূপ থাকা দরকার। তারও আগে দরকার কোন কোন বর্ণ ব্যবহার করব আর করব না। এক
কথায় লেখ্য ভাষা ও ভাষায় ব্যবহৃত বর্ণের সংস্কার সাধন। সংস্কার করার দায়িত্ব
বিদ্যাসাগর নিজের কাঁধে তুলে নিলেও সংস্কার কার্য্য লেখকদের মনোজগতে শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। বর্ণ পরিচয়ের প্রথম ভাগের ভূমিকায় বিদ্যাসাগর লিখেছেন “বহুকাল
অবধি বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল ।” বহুকাল বলতে ঠিক কতকাল তা’ বলা মুশকিল । তখনকার সময়ে যে সব শিশুপাঠ্যের বই ছিল, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের
লেখা শিশুশিক্ষা । সেখানে ষোলটি স্বরবর্ণ ও চৌত্রিশটি ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল।
বিদ্যাসাগর ষোলটি স্বরবর্ণ থেকে একেবারে বাদ দিলেন দীর্ঘ ঋ, দীর্ঘ ৯ (লি)। এছাড়া
অনুস্বর ও বিসর্গকে স্বরবর্ণ থেকে সরিয়ে ব্যঞ্জন বর্ণে স্থান দিলেন। স্বরবর্ণের সংখ্যা দাঁড়াল বারোতে। ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে
যুক্ত করলেন চন্দ্রবিন্দু (ঁ), ড়, ঢ়,
য় এবং ৎ। মোট সংখ্যা দাঁড়াল ৪১ টি। এবার সেখান থেকে বাদ দিলেন ‘ক্ষ’ কে। এবার ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা দাঁড়াল ৪০
টি।
এর থেকে সিদ্ধান্তে আসতে
পারি যে বহুকাল আগে থেকেই বাংলা ভাষায় সংস্কৃত
বর্ণগুলির গ্রহণ বর্জনের কাজ চলেছে। বর্ণপরিচয় শুধু বর্ণের পরিচয় নয়, ভাষার পরিচয়ও। সেটা বোঝা যাবে বর্ণপরিচয়ের পাতা ওল্টালে। শব্দ তৈরির সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট বাক্য তৈরি করে গদ্য রচনার একটা সুস্পষ্ট ধারার প্রচলন করলেন। যদিও শব্দের গঠন ও বাক্যের গঠনের
ক্ষেত্রে সংস্কার কার্য বহু আগেই শুরু হয়েছিল। এটা বোঝা যাবে যখন চর্যাপদে ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে পরবর্তী লেখকদের ভাষা তুলনা করি। উদাহরণ স্বরূপ বলি, চর্যাপদে দেখা
যায় ‘অ,
আ,
এ’ স্বরবর্ণ গুলি শব্দের প্রথমে ছাড়াও মধ্যে কিংবা শেষে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন – যাঅ, গবিআ, অবিদারঅ, নাশিঅ ইত্যাদি। চৈতন্যচরিতামৃতে
শব্দের শেষে ‘আ’ এর বদলে দেখতে পাই ‘ঞা’। যেমন, ধরিঞা, পাইঞা ইত্যাদি। আবার উনবিংশ শতকে রামমোহন রায়ের লেখায় (১৮১৮ তে প্রকাশিত
সহমরণ বিষয় প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ) পরিবর্তিত
বানানে পেলাম করিয়া, লইয়া, থাকিয়া ইত্যাদি শব্দ। এই সব লেখায় দীর্ঘ ৯ ও দীর্ঘ
ঋ এর দেখা পাওয়া যায় না। এগুলি লুপ্ত হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু খাতায় –কলমে ছিল, নয়তো বিদ্যাসাগর স্বজ্ঞানে বাদ দেওয়ার কথা বলতেন না । ৯ (লি) রেখে দিলেন বটে তবে ব্যবহার করলেন না। ৯ এর উচ্চারণ যেহেতু লি এর মতো তাই লিচুর উদাহরণ দিয়ে
বুঝিয়ে দিলেন ৯ এর কাজ লি দিয়েই করা হোক।
সংস্কৃত থেকে বাংলা হওয়ার
পথে বহমান সংস্কারের স্রোতকে সুনির্দিষ্ট পথে পরিচালিত
করে দিলেন বিদ্যাসাগর তাঁর বর্ণপরিচয় গ্রন্থের মাধ্যমে। তাঁর কৃতিত্ব এখানেই।
তবে সজীব ভাষাকে কোন নিয়মেই
চিরকাল আবদ্ধ করে রাখা যায় না। ভাষা নিয়ে ভাবনা চিন্তা চলতেই থাকে। কেউ কেউ
প্রকাশও করেন। যেমন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহজ পাঠ প্রকাশিত হয় ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে। অর্থাৎ বর্ণপরিচয় প্রকাশের ৭৫ বছর পর। সেখনে তিনি স্বরবর্ণের মধ্যে ৯ কে রাখলেনই না। আবার যে ব্যঞ্জনবর্ণকে বিদ্যাসাগর যুক্তাক্ষর বলে
সরিয়ে রেখেছিলেন সেই ক্ষ কে রবীন্দ্রনাথ প্রকারান্তরে ব্যঞ্জনবর্ণের মর্যাদা দিলেন, অন্য ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে আলোচনা করে।
পরবর্তীকালে বর্ণপরিচয়ের বানানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের হাতেই হয়েছে ‘ঊষা’ পরিবর্তিত হয়ে ‘উষা’ হয়েছে। ভবিষ্যতে যুগের
প্রয়োজনে হয়তো আরও সংস্কার হবে। তবুও বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় বাঙালীর মননে থাকবে চিরকালের মতো।