জ্ঞান বিজ্ঞান । কার্ত্তিক ১৪৩২





জোনাকি জ্বলে মিটিমিটি 












ড. সৌমিত্র চৌধুরী

কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ




 

অদ্ভুত আলো। জ্বলছে, নিভছে। ‘নিরুত্তাপ কোমল আলো’ জোনাকির। তাপ নেই। ঠাণ্ডা আলো। জোনাকি, ইংরাজিতে ফায়ার ফ্লাই (Fire fly)। এদের আলো নিয়ে কবিতা লেখা হয়েছে অনেক। যেমন,  

ওই একটি দুটি পাতার পরে /একটু মৃদু আলো, / ও যে দেখতে ভারী নুতন, ওরে / কেমন লাগে ভালো

(কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)  

 

কবি বিনয় মজুমদার লিখেছেন, “কবিতা বুঝিনি আমি; অন্ধকারে একটি জোনাকি / যত্সামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক / এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ পড়ে আছে—। / এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট করে নিয়ে / যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে, / তারকা, জোনাকি—সব; / লম্বিত গভীর হয়ে গেলে / না-দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি…।

তবে শুধু জোনাকি নয়, জলের স্থলের অনেক প্রাণী তাদের শরীর থেকে বাইরে আলো ছড়ায়। সবাই যে একই প্রক্রিয়ায় এমন কাজ করে তা নয়। যেমন, সমুদ্রের গভীরে জেলিফিশ আলো ছড়ায় বিশেষ প্রোটিনের মাধ্যমে। সামগ্রিক ভাবে এমন প্রক্রিয়ার নাম ফ্লোরেসেন্স (Fluorescence)যাইহোক, জোনাকির আলো নিয়েই আজকের কথা। জোনাকি পোকা অনেক ধরণের। তবে সামান্য কিছু প্রজাতির শরীরেই থাকে আলো তৈরির কৌশল। আলোর কারসাজিতে জোনাকি শিকার ধরে, সঙ্গিনীকে ডাকে। 

কেন ওদের গা থেকে আলো জ্বলে? গোটা শরীর থেকেই কি আলো বেরোয়? না, আলো বের হয় অল্প কিছু কোষ থেকে। সেগুলোর নাম ফটোসাইট (photocyte)ফোটো (photo) মানে আলো, আর সাইট (cyte, cyto) মানে কোষ। ফটোসাইটের ভিতরে অনেক রহস্য। এর মধ্যে অভুত সব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। তৈরি হয় আশ্চর্য রাসায়নিক অণু, অক্সিলুসিফেরিন। কয়েক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ যেমন লুসিফেরিন, লুসিফারেজ উৎসেচক, এ টি পি (ATP) এবং অক্সিজেন বিক্রিয়া করে তৈরি করে অক্সিলুসিফেরিন। আর ওই অক্সিলুসিফেরিন থেকেই আলো বের হয়

আলো বের করা ফটোসাইটের মধ্যে অক্সিজেন সরবরাহ হয় নিয়ন্ত্রিত ভাবে। শ্বাসনালি থেকে শ্বাসনালিকার মাধ্যমে কোষের ভিতরে ঢোকে অক্সিজেন। খানিক ঢোকে তারপর সরবরাহ বন্ধ। আবার প্রবেশ করে অক্সিজেন, আবার বন্ধ। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে রাসায়নিক গুলির সঙ্গে বিক্রিয়া করে পরিমিত মাত্রার অক্সিজেন। এই কারণেই আলোর নির্গমন ছন্দোবদ্ধ, অর্থাৎ জ্বলছে নিভছে। এমন না হলে? শুধু স্থির আলো দেখতে পেতাম, যেমন বাড়ির বৈদ্যুতিক বাল্বের ক্ষেত্রে দেখি। 

        আলো জ্বলা-নেভা ক্রিয়াটি ঘটে অক্সিজেনের জন্য। তবে পুরো ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রন করে স্নায়ুতন্ত্র। স্নায়ুর প্রান্তে ক্ষরিত হয় নিউরোট্রান্সমিটার, অক্টোপামিন। একে নিউরো হরমোনও বলা হায়। জটিল বিক্রিয়ায় ফটোসাইটে অনেক রকম নির্দেশ পাঠায় নিউরো হরমোনটি। যেমন, কতটা অক্সিজেন সরবরাহ করবে তার নির্দেশ পাঠায় অক্টোপামিন। নির্দেশ মেনে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় আলো। স্থির আলো নয়, জ্বলছে নিভছে। অদ্ভুত রকমের আলো

জোনাকির এই আলো তৈরিতে ব্যাটারি লাগে না। পেট্রল দহনের প্রয়োজন নেই। আলো তৈরি হয় কিন্তু তাপ উৎপন্ন হয় না। অদ্ভুত বিস্ময় প্রকৃতির। এখানে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, তার ১০০ শতাংশই আলোতে পরিণত হয়ে যায়। আমাদের বৈদ্যুতিক বাল্ব কেবল ১০ শতাংশ বিদ্যুতকে আলোতে পরিণত করতে পারে। অর্থাৎ, বাকি ৯০ শতাংশ তাপশক্তি পরিবেশে হারিয়ে যায়। জোনাকির আলোক সৃষ্টির নেপথ্যে সব ঘটনা জানা যায়নি এখনও। 

হারিয়ে যাচ্ছে জোনাকি। নগরায়ন হচ্ছে; ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে গাছপালা পুকুর, গ্রামীণ পরিবেশ। অনেক দেশ চেষ্টা করছে প্রকৃতির বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া জোনাকি পোকাদের ফিরিয়ে আনতে। 



আরও পড়ুন  -

 

খুব ছোট ক্ষমতায় সূর্যেরও বেশী


গলগি


বোতল ব্রাশ


ফুলের কেন এত রঙ

ডাকটিকিটে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ...

প্রকৃতির ফাঁদ

বিজ্ঞান দিবস ও ভারতের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী

হাড়গিলা কি বিলুপ্ত পাখি

মাইক্রোবায়োলজি আর মাইক্রোস্কোপ

রহস্যে মোরা গিরগিটি

হাঁস নিয়ে অন্য কথা