কিন্তু তাদের মধ্যে বুদ্ধির তারতম্য ছিল এটা মেনে নিতে আপত্তি থাকার কথা নয়। একই মানব জাতির মধ্যে বুদ্ধি ও ক্ষমতার তারতম্য ঘটাও এক ধরণের বিবর্তন। এর ফলে কারো কারো মধ্যে দেখা গেল কথা বলার অদ্ভুত ক্ষমতা। তারা বলতে শুরু করল একদম ভিন্ন ধারার কথা। সে সব কথার বিষয় তাদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রার উপর সরাসরি সম্পর্ক যুক্ত ছিল না, আবার একেবারে সম্পর্কহীণও ছিল না। এর থেকেও বড় কথা হলো সেই সব কথায় শ্রোতার মনের মধ্যে সৃষ্টি হলো আনন্দের অনুভূতি । তাই দৈনন্দিন জীবন যুদ্ধের অনিশ্চয়তার মধ্যেও মানুষ বার বার শুনতে চাইল সেই ধরণের নতুন নতুন ‘কথা’। সেগুলোকেই আমরা এখন চিনি লোককথা নামে। লোককথার বিষয়, উদ্দেশ্য, ধরণ পরিবর্তন ও বিবর্তন হতে হতে সৃষ্টি হয়েছে এখনকার সাহিত্য। তবুও লোককথার সেই আদিম আবেদন আজও অমলিন।
লোককথার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য - আনন্দ দান, উপদেশ দান আর প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা। প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা আমরা এখন বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখতে ও বিচার করতে অভ্যস্ত। কিন্তু যে কালের কথা বলছি সে কালে বিজ্ঞানের জ্ঞান ছিল নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। তবে কেউ কেউ প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ আর বিচার শক্তি দ্বারা প্রাকৃতিক নিয়ম গুলি ভালোভাবে জানত। তখন তারা চেষ্টা করত গল্পের মোড়কে সেই সব নিয়ম বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। এর ফলে যে সব লোককথা সৃষ্টি হল তার সঙ্গে বিজ্ঞানের যোগ না থাকতে পারে কিন্তু মানুষের আনন্দের যোগ রইল পুরোমাত্রায়। এই ধরণের গল্পকে আমরা বলি মিথ।
সমাজ যখন তৈরি হলো তখন সকলের স্বার্থে তৈরি হল সামাজিক নিয়ম। যেমন হিংসা না করা, মিথ্যা কথা না বলা, প্রতারণা না করা ইত্যাদি। এসব যারা করবে তারা শেষ পর্যন্ত কোন না কোন বিপদে পড়বে এই ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য হাজির হল নানা রকম চরিত্র। মানুষের মধ্যে থাকা সরল ও সাধু চরিত্রের প্রতিনিধি হলো তরুণ রাজপুত্র, গরীব ব্রাহ্মণ কিংবা কোন চাষী। আবার প্রতারক ও অসাধু চরিত্রের প্রতিনিধি হলো নাপিত, কোতোয়াল এরা। মানব চরিত্রের পাশাপাশি এলো আমাদের পরিচিত পশুপাখিরা। তারা মানুষের মতো কথা বলল আর সেই সঙ্গে মানব চরিত্রের গুণ - অবগুণ নিয়ে নিজেদের সাজিয়ে তুলল। গল্পে এক একটা পশু পাখি মূলত এক এক ধরণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। যেমন সাধাসিধা চরিত্রের অধিকারী হল চড়াই আর বুদ্ধিমান ও ধূর্ত চরিত্রের অধিকারী হল শিয়াল। এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন কাক কোন গল্পে বোকা আবার কোন গল্পে চালাক। এই ধরণের গল্পকে আমরা বলি পশু-কথা। এই সব গল্পের কোন কোনটিতে মানব চরিত্র থাকে তবে নায়ক অর্থাৎ প্রধান চরিত্র অবশ্যই কোন পশু অথবা পাখি। নীতিকথার প্রচার ও উপদেশদান এই সব গল্পের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। বিপদকে পরাস্ত করে সফলতা লাভ করার আকাঙ্ক্ষা মানুষের মজ্জাগত। তাই গল্পের মধ্যে রাজপুত্র কিংবা সওদাগরপুত্রের দুঃসাহসিক অভিযান মানুষ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে শুনেছে। পথের মধ্যে হিংস্র পশুদের থেকে বাধা পেয়েছে, রাক্ষস- দৈত্যদের বাধা পেয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব বাধা অতিক্রম করে গল্পের নায়ক জয়ী হয়েছে। মানব মনের মধ্যে থাকা জয়ী হওয়ার একান্ত কামনা প্রতিফলিত হয়েছে এই সব গল্পে। আমরা এই ধরণের গল্প গুলিকে চিনি রূপকথার গল্প হিসাবে। যদিও সামগ্রিক বিচারে রূপকথার পরিসর আরো বিস্তৃত।
রাজপুত্রের মতো যার পক্ষীরাজ ঘোড়া নেই, তলোয়ার নেই, বিপদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সাহস নেই সেও চায় জীবনে সফলতা লাভ করতে। তখন গল্পের মধ্যে চলে আসে কিছু অতিপ্রাকৃত উপাদান। যেমন যাদুশক্তি, ভৌতিক সাহায্য কিংবা পরীদের বরদান। এই অলৌকিক বিষয়ের উপর ভর করে বোকা জোলা ধনী হয়ে যায়, গরীব রাখাল রাজকন্যার অসুখ সারিয়ে রাজত্ব লাভ করে। এমনকি কোন কোন সময় রাজপুত্রের তলোয়ারের থেকে যাদুশক্তি অনেক বেশি কার্যকারী রূপে দেখা দেয়। গল্পের মধ্যে অলোকিক শক্তির প্রভাব দেখতে দেখতে বাস্তব জীবনেও মানুষ সেই রকম শক্তির সন্ধান করবে সে আর আশ্চর্য্য কী! মানুষের কামনা বাসনা পরিপূরণে অলৌকিক শক্তির আগমনের জন্য মানুষ নিজেদের কখনো কখনো নানা নিয়মে বেঁধে ফেলেছে । কিছু কিছু লোককথায় দৃষ্টান্ত সহ প্রচারিত হয়েছে সেই সব নিয়ম পরিপালনের মাহাত্ম্য। এভাবেই জন্ম নিয়েছে লোককথার এক বিশেষ ধারা – ব্রতকথা। অনেক দেশেই তাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী ব্রত পালনের নিয়ম আছে কিন্তু সেই ব্রতের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাহিনী পাওয়া যায় শুধু মাত্র ভারতবর্ষে। মূলত সংসারের ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ ও খেয়ে পরে বাঁচার আকূতি এই সমস্ত ব্রতকথার প্রধান উদ্দেশ্য।
ঐতিহাসিক কাল কিংবা তারও আগের মানুষের জীবনযাত্রা আমরা অনুমান করি তাদের ব্যবহার্য্য জিনিস দেখে। কিন্তু তাদের মনের মধ্যে ভাবনা চিন্তার কীরকম স্রোত প্রবাহিত হতো তা জানার একমাত্র উপায় এই সব লোককথা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুস্পষ্ট প্রভাব লোককথায় লক্ষ্য করা যায়। তাই প্রায় সমজাতীয় গল্প যখন একাধিক যায়গায় দেখা যায় তখন আমরা বুঝতে পারি ঐ দুই জায়গার চিন্তা ভাবনার বিবর্তন ঘটেছে প্রায় একই রকম ভাবে। এছাড়া পর্যটক কিংবা বণিকদের মাধ্যমে এক স্থানের গল্প অন্য স্থানে যাওয়া অসম্ভব নয়। বিভিন্ন সমাজে নানা সময়ে এক শ্রেণির মানুষ গল্প বলার মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। যারা গল্প শুনত তাদের উদ্দেশ্যও এক রকম ছিল না। যেমন, মহাভারতের যুগে কোন যজ্ঞের আসরে কথক গল্প শোনাতেন। কেননা সারাদিন যজ্ঞের নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়ার পরে সন্ধ্যার সময় অখন্ড অবসর পাওয়া যেত। আধূনিক যুগের মতো কোন বিনোদন তখন ছিল না, তাই কথক ঠাকুরের আগমন হলেই সবাই উৎফুল্ল হয়ে গল্প শুনতে চাইতেন। আরব দেশের বণিকরা যখন দীর্ঘ্য পথ পাড়ি দিত তখন রাত্রে একদল ঘুমাত আর এক দল জেগে থাকত। তাই তারা সঙ্গে গল্প কথক রাখত। আমরা জানি যে রাত্রি জাগরণের উপায় হিসাবে গল্পের কোন বিকল্প নেই । আমাদের দেশে বাগান পাহারায় নিযুক্ত লোকজনও গল্প বলিয়ে লোক রেখে গল্প শুনত। এছাড়া নিখাদ বিনোদেনের জন্যও গল্পের আসর বসানো হতো। এই সব গল্পের সবটাই যে লোককথা ছিল তা নয়, কিন্তু প্রচুর লোককথা তাদের মাধ্যমে জনমানসে ছড়িয়ে পড়েছিল। আবার শ্রোতারা প্রসঙ্গ ক্রমে নিজেদের পরিমণ্ডলে সেই সব গল্পের অবতারণা করে আনন্দ লাভ করত। মুখে মুখে প্রচারিত হতে হতে গল্পের ভাষা বদলে যেত, সংযোজন – বিয়োজন হতো। আবার দেশকাল অনুযায়ী গল্পের চরিত্রেরও পরিবর্তন কোন বিরল ঘটনা ছিল না।
বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সময়ে কেউ কেউ এই লোককথাগুলির গুরুত্ব বুঝে সেগুলি সংরক্ষণ করার প্রয়োজন অনুভব করেছেন। এই ব্যাপারে যাদের নাম সর্বপ্রথম মনে পড়ে তারা হলেন জার্মানীর দুই ভাই। সারা বিশ্ব তাদের গ্রিমভাই হিসাবে মনে রেখেছে। জার্মান ভাষায় লেখা তাদের রূপকথার গল্প সংকলন দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৮১২ ও ১৮১৫ খৃষ্টাব্দে। এই গ্রন্থ গুলি সারা বিশ্বে লোকসাহিত্য চর্চার প্রেরণা জোগায়। প্রায় সমসাময়িক কালে আমাদের বঙ্গভাষার লোক কথা সংগ্রহ করে সকলের নজর কেড়েছেন ইংল্যাণ্ড থেকে আসা একজন ধর্ম প্রচারক, উইলিয়াম কেরী। আবার বাঙলী রেভারেণ্ড লালবিহারী দে লোককথা সংগ্রহের ব্যাপারে উৎসাহিত হন। তিনি অবশ্য গল্পগুলি ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ করে ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে লণ্ডন থেকে ‘ফোকটেলস অফ বেঙ্গল’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থের ফলে বাংলার লোককথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী কালে অনেকেই এই কাজে তাঁদের পরিশ্রম ও মেধার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, আশুতোষ ভট্টাচার্য্য প্রমুখ। এঁরা লোককথাগুলি সংগ্রহ করে নিজের মতো করে লিখেছেন। তবে তার মধ্যে তাঁদের নিজস্ব রচনা একেবারে নেই একথা বলা যায় না। আবার এমন অনেকে আছেন যাঁরা নিজেরাই লোক কথার আদলে গল্প তৈরি করেছেন। সেই সব গল্পেও অন্য প্রচলিত গল্পের কাঠামোর উপস্থিতি বিরল নয়। যেমন প্রাচীন গ্রীসের ঈশপের গল্প, ভারতের বিষ্ণুশর্মার লেখা পঞ্চতন্ত্রের গল্প এবং রাশিয়ার লেখক তলস্তয়ের গল্প। এদের মধ্যে একমাত্র তলস্তয় গল্পের শেষে কোন নীতিবাক্য জুড়ে দিতেন না। তিনি মনে করতেন গল্প পাঠের মাধ্যমে পাঠকের মনে আপনা আপনি নীতি কথা ধরা পড়বে ও তারা জীবনে সেটা পালন করবে।
সারা বিশ্ব ব্যাপী অনেক গবেষক লোককথার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সভ্যতার সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নৈতিকতার বিবর্তন বুঝতে চেষ্টা করছেন। তাই আমরাও লোক কথাকে শুধুমাত্র আনন্দ দায়ক গল্প হিসাবে না ধরে তার মর্মে প্রবেশ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।